Monday, August 29, 2016

তারাবাগ ডায়রিজঃ বাপিদা ও বুম্বাদা

আমার জন্ম বজবজে। এক বছর বয়সে তারাবাগে যে কোয়ার্টারে এসে উঠি সেটি ছিল বি- ওয়ান। বাবা বিয়ের পর থেকেই এখানে থাকতেন। ১৯৯১ সালে, মানে আমার যখন ৬ বছর বয়স তখন আমরা বি-ওয়ান ছেড়ে অন্য কোয়ার্টারে যাই। আমাদের ঠিক উপরের ফ্ল্যাটটাতে মানে বি-থ্রিতে থাকতেন শীল জেঠুরা। প্রফেসর বিজয় শীল আর বাবা দুজনেই রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন।
শীল জেঠুর দুই ছেলে, বাপি আর বুম্বা। বাপিদা আমার থেকে অনেকটাই বড়। বুম্বাদা বছর দশেকের। দুজনেই আমাকে ভীষণ ভালবাসত। বাপিদা রোজ বিকেলে পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলতে যেত। শুনেছি আমাকে নিয়ে মা ঘুরতে বেরোলে বাপিদা মাঠ থেকে ছুটে আসত আমাকে আদর করতে। জেঠিমা নাকি বারান্দা থেকে বাপিদাকে ধমক দিতেন যেন নোংরা হাতে আমাকে না ছোঁয়।
বুম্বাদা আবার সুযোগ পেলেই আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসত। মনে আছে আমার পাঁচ বছরের জন্মদিনে বুম্বাদা একটা বই উপহার দিয়েছিল -- "মা দূর্গার কলকাতা ভ্রমণ।"
শীল জেঠুর কড়া শাসনে মানুষ হত দুই ভাই। একবার মনে আছে আমাদের বাড়ির সামনে নেট টাঙিয়ে দুই ভাই ব্যাডমিন্টন খেলছিল। প্রথম সেটটা বাপিদা একদম খাটেনি। বুম্বাদা কিন্তু প্রচণ্ড খেটে জিতল। পরের সেট খেলতে গিয়েই বুম্বাদা হাঁফিয়ে পড়ল। ব্যাস, বাপিদার সহজ জয়।
একদিন বাপিদা শুনলাম খড়গপুরে পড়তে গেল। জানতামও না সেটা কি। কয়েক বছর বাদে বাপিদা গেল আমেরিকা। এক বছর বাদে যখন বাড়ি ফিরল, আমার জন্য নিয়ে এল নীল-হলুদ এক ফেরারি গাড়ি। এখনও আছে সেটা। তারাবাগের বাকি সবাই আমাকে পিকো বলে ডাকলেও বাপিদা আর বুম্বাদা কিন্তু আমাকে "বাবাই" বলে ডাকত। এখনও ডাকে।
২০০৭-এ যখন আমি ফ্লোরিডা যাচ্ছি, জানতে পারলাম বাপিদাও ফ্লোরিডাতেই থাকে, তবে অন্য শহরে। তার মধ্যেও বাপিদা আমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করতে লাগল। বাপিদা থাকে অরল্যান্ডোতে। ওখানকার Material Science -এর নামকরা প্রফেসর। গেন্সভিল থেকে বার দু-তিন বাপিদার বাড়ি গেছি। বলা বাহুল্য, যা আতিথিয়তা পেয়েছি তা অতুলনীয়। বাপিদার স্ত্রী শান্তাদি লন্ডনের মেয়ে। আমাকে উইম্বিল্ডন দেখার গল্প বলে মুগ্ধ করে রাখতেন। বাপিদার মেয়ে লিলির মত মিষ্টি মেয়ে খুব কমই দেখেছি। সন্ধ্যে হলে বাপিদা আমার কাছে তারাবাগের গল্প শুনতে চাইত। সমস্যাটা হল বাপিদা আমার চেয়ে অনেকটাই বড়। তাই বাপিদা যাদের নাম বলত, আমি তাদের চিনতাম না। তাও কিছু কিছু চেনা জানা থাকত। বুঝতে পারতাম বাপিদা যেন অরল্যান্ডোতে বসেই তারাবাগকে ফেরত পেতে চাইছে।
বুম্বাদা থাকত ম্যাসেচুসেটসে। কথা ছিল দেখা হবে। ২০১২ তে আমি দেশে ফেরার আগে হয়ে উঠল না। এর মাঝে আমি একবার ছুটি কাটাতে বাড়ি এসেছি। যতদূর মনে পড়ছে সালটা ২০১০। দুপুরবেলা বেল বাজতে দরজা খুলে দেখি বাপিদা, শান্তাদি, লিলি আর শীল জেঠু। মা বাবাকে দেখে ভীষণ খুশি বাপিদা। তারাবাগের পুরানো গল্প শুরু হল।
"তারাবাগ কত পাল্টে গেছে কাকিমা, আর কাউকেই চিনি না আপনাদের ছাড়া।"
-- বাপিদার হতাশ উক্তি মনে পড়ে।
আবার ছোটবেলার কথা বলতেই বাপিদা বলে
"মনে পড়ে কাকিমা, বাবা আমাকে কি মারত?"
জেঠু মাথা নিচু করে বলেন --
"সেই, তোদের তো শুধু মেরেইছি!"
২০১২-এ আমি আমেরিকা ছাড়ার আগে আমার মা বাবা এসেছিলেন ফ্লোরিডায় আমার কনভকেশনে। একদিন বাপিদার বাড়িতে নিয়ে গেলাম ওদের। শান্তাদি সে সময় লন্ডনে। বাবা মাকে দেখে বাপিদা যে কি খুশি বলে বোঝানো যাবে না। অত বড় একজন অধ্যাপক, যার বিশ্বজোড়া নাম, তার মধ্যে এরকম ছেলেমানুষি আনন্দ দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। সারা সন্ধ্যে ধরে চলল ১৯৮০ র দশকের তারাবাগের গল্প যার আশি শতাংশ আমার অজানা। ফোনে বুম্বাদাদের সঙ্গেও কথা হল।
দু সপ্তাহ আগে জানতে পারলাম বুম্বাদা মাত্র ৪১ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আজ বাপিদার কাছে শুনলাম জেঠুও খুব অসুস্থ। সকাল থেকেই তাই মনটা বেশ খারাপ। এই লেখাটা সেই মন খারাপেরই বহিঃপ্রকাশ। হয়ত খুব বোর করলাম সবাইকে এতটা লিখে, কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই লেখাটা না লিখলে রাত্রে হয়ত ভালো ঘুম হত না।
লোকে বলে জীবন এগিয়ে যায়। আমাদের সকলেরই জীবন এগিয়ে যাবে। হয়ত কাল আমি আবার পাগলু নিয়ে ঠাট্টা করব, বা আমার স্কুল জীবনের কোন মজার গল্পের কথা লিখব। কিন্তু দিনের শেষে হয়ত আবার ফিরে যাব তারাবাগে; সেই তারাবাগ যাকে বাপিদা বার বার খুঁজে বেড়ায়, যা আমরা জানি আর কোনদিন পাওয়া যাবে না -- না, এখনকার তারাবাগে গিয়েও না, যার থেকে হয়ত একদিন আমি সম্পুর্নভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব; কিন্তু যে তারাবাগে আমি, বাপিদা, আমরা সবাই বার বার ফিরে যেতে চাইব।

Wednesday, August 3, 2016

স্কুল জীবনের গল্প

Tapabrata-র ব্লগে লেখা পড়ে স্কুল জীবনের কিছু স্মৃতি ভেসে উঠল। সেন্ট জেভিয়ার্সের এগারো বছরের গল্প লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। বরং রামকৃষ্ণ স্কুলের কিছু গল্প বলি।
আমি ১১ ক্লাসে ভর্তি হই রামকৃষ্ণ স্কুলে। যারা পড়েননি, তাঁরা জানেন না মফঃস্বলের বাঙলা মিডিয়াম স্কুল মানে কি। এক এক করে সব গল্প বলব। তবে এটা স্বীকার করতে কোন বাধা নেই, ঐ দু'বছর চুটিয়ে ফুর্তি করেছি স্কুলে।
একবার বাঙলা স্যার বাড়ির কাজ দিয়েছেন এইরকম -- খবরের কাগজের সম্পাদককে চিঠি লেখ দূরদর্শনের অনুষ্ঠান নিয়ে তোমার ক্ষোভ জানিয়ে। আমরা সবাই লিখলাম আরও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দরকারি। শুভেন্দু বোধহয় লিখেছিল উচ্চমাধ্যমিকের অঙ্কের সাজেশান দেওয়া দরকার দূরদর্শনে (এর ফলে কানমলা জুটেছিল)। কেউ কেউ লিখল শচিন বা সৌরভের ইন্টারভিউ দেওয়া উচিত (আবারও কনমলা)। সবচেয়ে অবাক করল সুদীপ। ওর চিঠি পড়ে স্যার দেখলাম বেত নিয়ে ছুটে গেলেন মারতে। এর আগে স্যারকে দু-একবার কানমলা বা চড় মারতে দেখেছি বটে, তবে বেত দিয়ে মার আগে দেখিনি। বেশ খানিকক্ষণ পেটানোর পর উনি থামলেন। তারপর গর্জে উঠলেন "এটা কি লিখেছিস? 'দূরদর্শনের আধিকারিকদের বলবেন রাত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের সিনেমাগুলি আজকাল তেমন জুতসই হচ্ছে না।' কাল তোর বাবাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবি।"
আমরা সবাই অবাক সুদীপের কাণ্ড দেখে। ক্লাস শেষ হলে সুদীপ আরও একবার অবাক করল। আমাদের দিকে চোখ টিপে বলল "কেমন দিলাম?"
বেতের ব্যথা কখন উবে গেছে।

*****************************************************************************************************************
স্কুল জীবনের দ্বিতীয় গল্প। এবারও বেত আছে, তবে শেষে।
এই গল্পটি কুন্তলকে নিয়ে। কুন্তলের স্বপ্ন ছিল নামকরা ফুটবলার হবে। মারাদোনার মত। হতে পেরেছিল কিনা জানি না, কারণ বহুবছর কোন যোগাযোগ নেই। তবে মনে হয় হতে পারেনি, কারণ পারলে নাম শুনতাম। যাই হোক, এই গল্প যখন আমি আর কুন্তল একই স্কুলে ক্লাস ইলেভেনে পড়তাম।
কুন্তল সবসময় ফুটবল খেলতে চাইত। মাঝে মাঝে তো মনে হত ও স্কুলে আসতই ফুটবল খেলবে বলে। বলা বাহুল্য, রোজ নিজের একটা ফুটবল সঙ্গে করে আনত। সিটে পায়ের তলায় রেখে দিত। ক্লাসে স্যার আসতে দেরি করলে দেওয়ালে মেরে মেরে প্র্যাকটিস করত।
তো এরকমই একদিনের কথা। কুন্তল ক্লাসে বসে আছে, পায়ের কাছে ফুটবল। পাশে কুন্তলের প্রিয় বন্ধু অয়ন। ইংরেজির স্যার সবাইকে বই বার করতে বললেন। অয়ন বেচারি বই আনতে ভুলে গেছে সেদিন। সে কথা জানাতেই স্যার গম্ভীর গলায় বললেন
"Get out of the class"
অয়নকে বেরোতে দেখে কুন্তলের মাথার পোকা নড়ে উঠল। কুন্তলের সঙ্গে বই ছিল। স্যাট করে সেটা ব্যাগের ভেতর রেখে দিয়ে হাত তুলল --
"স্যার, আমিও বই আনিনি।"
"তাহলে তুমিও get out of the class."
কুন্তল আসতে আসতে হাঁটতে লাগল। দরজার একদম কাছে পৌঁছে এবার ঘুরে তাকাল স্যারের দিকে। হালকা গলায় বলল --
"বলটা নিয়ে যাব স্যার?"
তারপর ---
সেটাও বলে দিতে হবে? প্রথম লাইনটা আবার পড়ে নাও।
*****************************************************************************************************************
স্কুল জীবনের তৃতীয় গল্প। এবার আর বেত নেই।
আজকাল দেখি মানুষজন খুব বিচলিত হয়ে পড়েন বিভিন্ন কারণে। এই ভোটে কে জিতল, জন স্নো মারা গেলেন কিনা, বিরাট কোহলি আবার সেঞ্চুরি করলেন কিনা, ফেডেরার আর খেলবেন কিনা, টাইগার শ্রফ কেন সিনেমা করছেন, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে অনেকেই বিচলিত থাকেন। অথচ আমাদের স্কুলের রসায়নের স্যার একেবারেই বিচলিত হতেন না। আজ তাঁরই গল্প।
আমাদের স্কুলে ক্লাস টুয়েল্ভের ঘরটি ছিল তিন তলায়। পাশেই একটি মেয়েদের স্কুল। নাম ভারতী বালিকা বিদ্যালয়। মাঝে একটি ছোট পাঁচিল। কদাচিৎ পাঁচিলের এদিক থেকে ওদিকে মন দেওয়া নেওয়া যে হত না, তা নয়, তবে সেটা আমাদের গল্পের বিষয়বস্তু নয়।
আমাদের গল্প একদিন দুপুরের। টিফিনের পর ক্লাস শুরু হয়েছে। রসায়নের স্যার এসে বই খুলে মারত চুল্লী হইতে লৌহ নিষ্কাশন পড়াচ্ছেন। যারা ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র/ছাত্রী, তাদের জন্য -- এর মানে Iron Extraction from Blast Furnace. অত্যন্ত ঘুমপাড়ানি বিষয়, স্যার পড়াচ্ছিলেন সেই রকম ঘুমপাড়ানি ভঙ্গীতেই, তাই স্বাভাবিক ভাবেই কেউ খুব একটা মনোযোগ দিচ্ছিল না। আমি আর আমার বন্ধু পাপাই মিলে কাটাকুটি খেলছিলাম। কেউ কেউ পিছনে বসে নিষিদ্ধ বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছিল। কেউ কেউ প্রেমপত্র লেখার অভ্যাস করছিল। আর এক দল ছেলে দুপুরে খেয়ে দেয়ে স্রেফ ভাতঘুম দিচ্ছিল। মইদুল নাকও ডাকছিল।
স্যার কিন্তু বিচলিত হননি, এক মনে পড়িয়ে যাচ্ছিলেন।
এরই মধ্যে কে একটা বলে উঠল -- "এই ভারতী স্কুলের মেয়েরা পি টি করতে নেমেছে রে।"
বলা মাত্রই ম্যাজিক, পুরো ক্লাসের ভরকেন্দ্র ডানদিকের জানালায় চলে গেল। আমি আর পাপাই কাটাকুটির খেলাটা শেষ করতে গিয়ে দেরি করে ফেললাম। তাও খুব বেশি হলে মিনিট দু-এক। উঠে জানালার দিকে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম স্যার কিন্ত এসবের উর্ধে, এক মনে তখনও মারত চুল্লী পড়ে যাচ্ছেন। সেদিন থেকে স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। এ'রম পরিবেশে যদি কেউ বিচলিত না হয়ে থাকতে পারে, তাঁর অসীম ক্ষমতা।
*****************************************************************************************************************
স্কুল জীবনের একটা অনুগল্প।
বাংলা পরীক্ষা। সবাই খস খস করে পাতা ভরাচ্ছে। অনেকেরই ধারণা বেশি লিখলে নম্বর বেশি আসবে। সবচেয়ে চিন্তায় আছে আমাদের শীর্ষেন্দু। গত বার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে লাউসেনের বউ ফুল্লরা লেখায় স্যার কানমলা দিয়েছিলেন। এবার তাই আর কোন রকম সুযোগ নেয়নি। অনির্বাণের খাতা দেখে টুকছে। পরীক্ষা শেষ হতে আর আধ ঘন্টা বাকি। জোর কদমে টোকা চলছে শীর্ষেন্দুর। এর মধ্যে অনির্বাণ মাঝে মাঝেই খাতার উপর হাত দিয়ে ফেলছে। তাই বলতে হচ্ছে -- "হাত সরা"।
দু-একবার বলার পর স্যারের কানে গেল। স্যার কাছে এসে বললেন
-- "কি হচ্ছে নন্দী?"
শীর্ষেন্দু একটুও ঘাবড়াল না। ঠান্ডা মাথায় স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল --
"স্যার, এখন স্লগ ওভার চলছে, এগুলো দেখবেন না।"
*****************************************************************************************************************
স্কুল জীবনের আর এক গল্প। এটা ঠিক স্কুলের গল্প না, প্রাইভেট টিউশানের।
তার আগে বলা দরকার বর্ধমানের স্টার সিনেমা হলের কথা। জি টি রোডের উপর এই সিনেমা হলে মূলত বাংলা সিনেমা চলত। যারা ৮০-৯০ এর দশকের বাংলা সিনেমা নিয়ে খোঁজ-খবর রাখে, তারা জানে এই স্টার সিনেমা হলের সামনে "বেদের মেয়ে জ্যোতস্না" দেখার জন্য গরুর গাড়ির লাইন পড়েছিল।
আমাদের গল্প শুরু হচ্ছে বাংলার স্যার সুধীরবাবুর বাড়িতে। সুধীরবাবু সি এম এস স্কুলে বাংলা পড়াতেন। বাড়িতে ওনার টিউশানের ব্যাচ বসত। অত্যন্ত যত্ন সহকারে পড়াতেন সুধীরবাবু। ভাটনাগর পুরস্কার প্রাপ্ত বিখ্যাত রসায়নের শিক্ষক অধীর রঞ্জন চক্রবর্তী ওনার ভাই।
সুধীরবাবুর কাছে একদিন বাংলা পড়া চলছে। আমার পাশে বসে লাদেন। দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি লাদেনের আসল নাম আমার মনে নেই। সবাই লাদেন বলেই ডাকত (বোধহয় সুধীরবাবুও)। লাদেনকে খানিকটা বিখ্যাত বা কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী ওসামা বিন লাদেনের মত দেখতে ছিল, তাই এই নাম। যাই হোক, লাদেনের মাথায় সারাক্ষণ পোকা ঘুরত কি করে সুধীরবাবুকে রাগানো যায়। মাঝে মাঝে সেই পরিকল্পনা গুলোর বাস্তব রূপও দিয়ে থাকত, এবং অবশ্যই তিরস্কার জুটত।
তো সেদিন সুধীরবাবু আমাদের আরাকান রাজসভার কবিদের কথা বলছেন। "দুই কবির নাম দৌলত কাজী ও সৈয়দ আলাওল। এনাদের লেখা বইয়ের নাম লোর চন্দ্রাণী বা সতী ময়না।"
এই অবধি বলার পর লাদেন বলে উঠল -- "স্যার এই সিনেমাটা পুজোর সময় স্টারে এসেছিল মনে হয়। শতাব্দী ছিল না? পিঙ্কিকে নিয়ে দুপুরের শোতে দেখতে গিয়েছিলাম।"
বলা বাহুল্য, এ কথা শোনার পর সুধীরবাবু আর চুপ থাকেননি। তবে শুধুই তিরস্কার করেছিলেন, না হাতের কাজও ছিল, সেটা আজ আর মনে নেই।
*****************************************************************************************************************
 এই স্নাকুল জীবনের গল্পটার নাম দেওয়া যায় "একটি ফুটবল ম্যাচ"।
রামকৃষ্ণ স্কুলে জানতে পেরেছিলাম স্যারদের কাছে মার খাওয়া সব সময় অগৌরবের ব্যাপার না। মাঝে মাঝে মার খেয়ে সুদীপের ভাষায় "কেমন দিলাম?" বলা যায়। এটা সেরকমই এক গল্প।
সেটা ক্লাস টুয়েল্ভ। সেদিন ইংরেজীর স্যার আসেননি। প্রত্যেক স্কুলেই এই ক্লাস ৭-৮ নাগাদ একজন শিক্ষক থাকেন যিনি সব কিছু পড়াতে পারেন। মানে বাংলা, ইংরেজি, ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান, কখনও বা অঙ্ক। এরকম আমাদের স্কুলে ছিলেন শ্যামলবাবু।
তো আমরা ফাঁকা ক্লাসে বসে আড্ডা দিচ্ছি এই সময় শ্যামলবাবু এসে হাজির। আমি যেহেতু ১১ ক্লাসে স্কুলে ঢুকেছি, তাই ওনার ক্লাস করিনি আগে। শ্যামলবাবু বেশ গম্ভীর গলায় কথা বলতেন। আমাদের বসতে বলে জানতে চাইলেন কিসের ক্লাস। ইংরেজী বলায় স্যার খুব গম্বীর ভাবে একটা বই বার করলেন। সেটা নাকি "এসে" বই। সেখান থেকে স্যার এসে পড়ে শোনাবেন। আমরা চুপচাপ শুনতে লাগলাম। স্যার শুরু করলেন "A football match".
আগেই বলেছি ওনার গলা ছিল বেশ গম্ভীর। তার মধ্যে উনি অত্যন্ত নাটকীয় ভাবে এসেটা পড়ছিলেন। মানে অনেকটা এরকম -- "And with the referee's whistle, the game started. The center forward moved ahead with the ball.."। পুরো মনে হচ্ছিল আকাশবাণীতে ধারাবিবরণী শুনছি। এক্ষুনি যেন বলা হবে -- "টুলুঙ্গার থেকে বল পেলেন বাইচুং, গোলে শট, কিন্তু না, হেমন্ত ডোরা আটকে দিলেন।"
স্যার সেভাবেই পড়তে লাগলেন। ".. then Jatin passed the ball to Anil, who went past two defenders to take a shot." তখনও বুঝিনি ক্লাস শুদ্ধু ছেলে কি মতলব করছে। স্যার বললেন -- "and the ball went past the keeper and it was a G-O-A-L." গোলটা বেশ নাটকীয় ভাবে বললেন। হয়ত ভেবেছিলেন ছেলেরা আনন্দ পাবে। কিন্তু যেই গোল বলা, এক দল ছেলে পেছন থেকে লাফিয়ে উঠল -- "হে হে গোল।" তারপর পুরো ক্লাস একসাথে লাফাল গোল বলে। যেন মনে হচ্ছে বাইচুং-এর গোলের পর যুবভারতীর ইস্টবেঙ্গল গ্যালারী।
সবার দেখা দেখি আমিও সেদিন গোল বলে লাফিয়েছিলাম। রামকৃষ্ণ স্কুলে সেই আমার প্রথম বেত খাওয়া।