Saturday, August 5, 2017

প্রথম উপার্জন

আজ সকাল থেকেই দিনটা খারাপ যাচ্ছে। সকালে ঘুম ভাঙল রঙ্গোলীর আওয়াজে। রবিবার সকালে দূরদর্শনে এই গানের অনুষ্ঠানটি হয়। বাড়িতে প্রতি রবিবার-ই এটি চলে টি ভিতে। বাবা সকাল সকাল টি ভি খুলে দেন। এই অনুষ্ঠানটির একটি বিশেষত্ব আছে। শুরুতে রাজ কাপুর, দেব আনন্দদের গান দেখায়, তারপর আস্তে আস্তে রাজেশ খান্না, অমিতাভ হয়ে হালের শাহ্রুখ খান, অক্ষয় কুমার। বাবা নিজে ঐ রাজেশ খান্না অবধি শোনেন। তারপর যা চলে তা সবিতাদির জন্য। সবিতাদি সকালে সবজি কাটে -- তাই তাকে খুশী রাখতে ওসব চালাতে হয়। নইলে বাবার ভাষায় ঐ গানগুলি "অপসংস্কৃতি"।

আজ যেই পরদেশ-এর গান শুরু হল, অর্ক ছুটে গিয়ে বাবাকে ধরল

-- এই ক্যাসেটটা কিনে দেবে?
-- কোন ক্যাসেট?
খবরের কাগজটা নামিয়ে রেখে জানতে চাইলেন কমলবাবু।
--এই যে পরদেশের। কুমার শানুর গানটা খুব ভালো।
-- না ভালো না। না দেবো না।
আবার কাগজে মুখ গুঁজলেন কমলবাবু।
-- কেন দেবে না?
-- আমার পয়সায় এই অপসংস্কৃতি কেনা যাবে না। নিজে উপার্জন করে কেন।
-- ঠিক আছে গত মাসে ছোটপিসি যে টাকাটা দিয়েছিল জন্মদিন বলে, সেটা দাও, সেটা থেকে কিনব।
এবার কাগজটা নামালেন কমলবাবু
-- ওটা উপহার, আমি বলেছি উপার্জন, তোদের স্কুলে কি বাংলা শেখানো হয়না? আর এই নিয়ে আমি কোন কথা বলতে চাই না।

সেই থেকেই মেজাজটা খিঁচড়ে আছে অর্কর। তার ওপর আজ দুপুরে বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিকে যাওয়ার কথা ছিল। ওমা, রাকেশ নিজের মা, বাবা, দাদার সঙ্গে কলকাতায় চিড়িয়াখানা দেখতে চলে গেছে। কাজেই পিকনিক-ও ক্যান্সেল। এখন ছাদে বসে বসে এক মনে দুটো এমব্যাসি ক্রিম বিস্কুট খাচ্ছিল অর্ক। নিচে মা বাসনওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করছে

-- এই গেঞ্জিটা কেন নেবে না?
-- না বউদি, এটা একদম ছিঁড়ে গেছে।
-- তা হলে ঐ পাঁচটা জামাতেই এই বালতিটা দাও।
-- না, আর একটা জামা দিন। ছ'টা না হলে হবে না।

এই সময় বাবানদার গলা শুনতে পেল

-- এই অর্ক, কি করছিস? নিচে আয়।
-- কি হয়েছে?
নিচে এসে দেখে বাবানদা আর রানা।
-- আর বলিস না, রাজেশ আর আমরা মিলে আজ বইমেলাতে কুইজে যাব বলেছিলাম, তো রাজেশ বেপাত্তা।
-- হ্যাঁ জানি, ওরা সবাই মিলে কলকাতায় বইমেলা গেছে।
-- রাজেশদা সবসময় এরকম করে। গেলবার মিঠাপুকুর বাপ্পা স্মৃতি কাপের সেমি ফাইনালের দিন পালিয়েছিল।
এবার রানার রাগের পালা।
-- তো আমি কি করব?
-- আরে তিনজনের টিম দরকার কুইজে, তুই চল।
-- আমি? ধুর, তুমি আর রানা কত ভালো কুইজ কর। আমি তো কিছুই জানি না। কোনদিন নামও দিইনি।
-- উফ, তোকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমি আর রানাই করব। তুই শুধু টিমে থাক। বাড়ি বসে কি ভ্যারেন্ডা ভাজছিস?
-- চলো।

বইমেলা হয় টাউন হলের মাঠে। দুপুর ৩ টে থেকে কুইজ শুরু হল। প্রথমে রিটেন রাউন্ড আর সেমি ফাইনাল পেড়িয়ে অর্করা সহজে উঠে গেল ফাইনালে। আজ দারুণ ফর্মে বাবানদা। রানাও টপাটপ বলে দিচ্ছে। অর্ক যে কিছুই জানে না তা নয়, কিন্তু ও যেগুলো জানে, বাবানদারাও সেগুলো জানে, তাই অর্ককে কিছু করতে হচ্ছে না।

এবার ফাইনাল। পাঁচটা টিম ফাইনালে। তাদের মধ্যে আছে মিশন স্কুলের টিম। মিশন স্কুলের এই টিমটি খুবই স্ট্রং। গতবছর বইমেলাতেও ওরাই জিতেছিল। অর্ক ভাবছে আজ কি বাবানদা আর রানা পারবে এদের সাথে!

প্রথম দুটি রাউন্ড হাড্ডাহাড্ডি গেল। এখন মিশন স্কুল আর অর্করা -- দুটি টিম-ই ২৫ পয়েন্টে। এবার শুরু হল অডিও রাউন্ড। একটি গান বা কিছু আওয়াজ চালিয়ে প্রশ্ন করা হবে। অর্কদের প্রশ্নের উত্তর সহজেই দিল রানা। মিশন স্কুলের প্রশ্ন এল এবার। টেপে চালানো হল লতা মঙ্গেশকরের গান
"এ মেরে ওয়াতন কে লোগো"।
এবার প্রশ্ন করলেন কুইজমাস্টার
--বলো তো এটা কার লেখা?
মিশন স্কুলের মুখ দেখে বোঝা গেল তারা জানে না। অনেক ভেবে চিনতে তারা ভুল উত্তর দিল। বাবানদা এবার মুখ কাছে এনে বলল
--ইয়েস, ওরা পারেনি। আমি এটার উত্তর জানি না, তুই জানিস রানা।
--না, আমিও জানি না।
--এটা পারলে বোনাস আরো ৫ পয়েন্ট পেতাম। যাকগে।
এবার ভাবতে লাগল অর্ক। আচ্ছা এই ক্যাসেটটা বাবা এবার কিনেছিল না? স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে লতার গলায় এই ক্যাসেটটা বার করেছিল এইচ এম ভি। সেখানে একটা ছোট বই ছিল যাতে প্রতিটি গানের সম্বন্ধে লেখা ছিল। কার কথা, কার সুর, কবে রেকর্ড করা।
-- আমি জানি।
বলে উঠল অর্ক।
-- তুই? পারবি?
-- না পারলে ক্ষতি কি? বলুক।
এবার পাস হতে হতে মাইক চলে এসেছে অর্কদের কাছে। অর্ক আত্মবিশ্বাসের সাথে মাইক ধরে বলল
-- কবি প্রদীপ।
-- একদম সঠিক উত্তর টিম ২।
কুইজমাস্টারের গলা শুনে বাবানদা অর্কর কাঁধে হাত রাখল।
-- সাবাশ অর্ক।

এরপর আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি মিশন স্কুল। অর্করা বাকি রাউন্ডগুলো সহজেই পেড়িয়ে গেল। যদিও অর্ককে আর কোন উত্তর দিতে হয়নি। বাবানদা আর রানাই সব সামলাল।

ফার্স্ট প্রাইজ ৬০০ টাকা হাতে পেয়ে দারুণ লাগল অর্কর। টাকাটা তিনজনে ভাগ করে নিল। বাড়ি ফেরার আগে টাউন হলের সামনের দোকান থেকে তিনজনে এগরোল খেল। বাড়ির রাস্তায় একটা ক্যাসেটের দোকান দেখে সাইকেল দাঁড় করাল অর্ক।

-- কি হল রে?
-- দাঁড়াও বাবানদা, আজ প্রথম উপার্জনের টাকা থেকে নিজেকে কিছু উপহার দিই।






Tuesday, August 1, 2017

মফঃস্বলের গল্প

-- এতক্ষণে বাড়ি আসার সময় হল?
জানি আমার দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজ মা বুঝতে পারে। নইলে বাড়িতে সবিতাদি থাকলেও মা নিজেই দরজা খুলতে আসে। সবিতাদি দেখলাম টি ভির সামনে বসে লাউ কাটছে। টি ভিতে এখন কোলগেটের বিজ্ঞাপণ।
-- এই খেলা শেষ করেই এলাম।
-- বাজে বকিস না, কখন সন্ধ্যা নেমে গেছে!! অন্ধকারে কিভাবে ফুটবল খেলিস? নিশ্চয় আড্ডা দিচ্ছিলি?
-- না মা, আড্ডা না। এই একটু আর কি ...
-- আজ পায়ে লাগেনি তো?
-- না আজ ঠিক আছে
টি ভিতে গান শুরু হল -- "জন্মভূমি"...
-- যা বাথ্রুমে জল রাখা আছে, স্নান করে নে। প্যান্টটা তো কাদা ভর্তি, নামিয়ে দে। কাল সকালে ধুয়ে নিস।
-- না না, আমি এটা পরে কালকেও খেলতে যেতে পারব।
-- যা বলছি শোন। তোর ঐ কালো প্যান্টটা পরে যাস কাল। আমি এখন টি ভি দেখতে গেলাম।
-- জানো মা...
-- কী?
-- না কিছু না।
-- বল জলদি।
-- আজ যা একটা গোল দিয়েছি না, সবাই বলছে চিমা।
-- হয়েছে!! যাকগে শোন, সরকারদের বাড়ির মিতা এসেছিল। তোর টেস্ট পেপারটা চাইছিল। আমি তো জানি না কোথায় থাকে। কাল সকালে আসবে। দিয়ে দিস।
-- আচ্ছা।
--এবার স্নান করে পড়তে বস। কে বলবে কয়দিন বাদেই মাধ্যমিক?


স্নান করতে করতেই বাথ্রুমে অন্ধকার নেমে এল। বাইরে থেকে মায়ের গলা শোনা গেল --

"এই এক শুরু হয়েছে, রোজ জন্মভূমিটা শুধু দেখতে দেয়। তারপরেই এই এক ঘন্টার লোডশেডিং। সবিতা, সবজিগুলো রান্নাঘরে রেখে আয়। দাঁড়া, আগে একটা হ্যারিকেন জ্বালাই। বাবুর ঘরেও একটা হ্যারিকেন দিয়ে আসি। ছেলেটা পড়বে কি করে কে জানে এই গরমে?"




সন্ধ্যা সাতটায় হাওড়া বর্ধমান কর্ড লাইন সুপার এসে থামল বর্ধমান স্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমে সামনের দিকে হাঁটা দিলেন কমলবাবু। আগে তিনি স্টেশনেই সাইকেল রাখতেন। একদিন হাওয়া খুলে যাওয়ার পর আর রাখেন না। জি টি রোডের ওপারে মদনের দোকানে রাখেন। মাসের হিসেবে টাকা পায় মদন। একদিকে সাইকেল সারানোর দোকান, আর একদিকে সাইকেল স্ট্যান্ড।

সাইকেল নিয়ে বি বি ঘোষ রোডের দিকে মোড় ঘুরতেই তাঁর চোখ গেল দুলালের চপের দোকানে। রাধা খুব ভালোবাসে এই গরম গরম চপ। বিয়ের পর অফিস থেকে ফেরার সময় প্রায়ই নিয়ে যেতেন কমলবাবু। অনেকদিন খাওয়া হয়না। অবাক কান্ড, দুলালের চেহারার তেমন পরিবর্তন হয়নি। সেই ঘামে ভেজা স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে এক মনে ভেজে যাচ্ছে। মনে মনে ভেবে সাইকেলটা থামালেন কমলবাবু। রাধাকে চমকে দেবেন। যদিও মুখে বলবেন বাবুর জন্য এনেছেন। কিন্তু রাধা তো বুঝবেই। আপন মনেই হেসে ফেললেন কমলবাবু।


ঠিক সেই মুহুর্তে কমলবাবুর বাড়ির কোণার ঘরে হ্যারিকেনের আলোয় সাদা কাগজে লেখা একটা চিঠি পড়ছিল তাঁর ছেলে -- "... টেস্ট পেপারের মধ্যে রেখে দিও তোমার চিঠিটা।"

মফঃস্বল নিজের মত করেই ভালোবাসে।