Friday, January 20, 2017

একটি গানের ইতিহাস

ধর্মতলা থেকে যখন বাসে উঠলাম তখন বাজে বেলা তিনটে। বাস বেশ ফাঁকা। বসার জায়গাও পেলাম। জানালার ধারেও। খানিকক্ষণ বাদে কন্ডাক্টার এসে টিকিট কেটে গেলেন। সবই ভালো, শুধু ঐ একটাই খিঁচ খিঁচ রয়ে গেল মনের ভিতর। ফোন বুথের সামনে বিশাল লাইন। তাই ফোন করা গেল না। তাও যদি এস টি ডি করতাম, হয়ত বুথের মালিক ব্যবস্থা করে দিতেন। লোকাল কলের খদ্দেরদের এরা পাত্তাই দেয়না। যাকগে, রাসবিহারীতে নেমে করব।
     পার্ক স্ট্রিট পার হয়ে বাস যখন এক্সাইডে দাঁড়াল, বাসে এক ভিখারি উঠল। আজ সব কিছুই ভালো যাচ্ছে আমার, মনটাও খুশী। পুরো এক টাকা ভিক্ষা দিলাম ব্যাটাকে। যা, ভালো করে খা আজ। ভিখা্রিটা বেশ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে -- "ঈশ্বর আপনার ভালো করুন।" বলে চলে গেল। তা বটে, আজ বহুদিন বাদে ঈশ্বর আমার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন বটে।
    নাহ, এবার চেতলার ঐ মেসবাড়ি ছাড়তে হবে এবার। অনেক হল। আর ভালো লাগে না ঐ পোড়া রুটি খেতে রোজ রাত্রে। এবার ভাবছি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করব। এক কামরার হলেও নিজের বাড়ি তো। কোথায় ভাড়া নেওয়া যায় ভাবছি। বংশী বলছিল গত মাসে বোসপুকুরে নাকি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। বেশ সস্তা আর ওখান থেকে নাকি ধর্মতলা যাওয়ার বাসও অনেক। গিয়ে খোঁজ করতে হবে।
    এসব ভাবতে ভাবতে যে কখন রাসবিহারী এসে পড়েছি নিজেরই খেয়াল নেই। কন্ডাক্টারের ডাক শুনে তড়িঘড়ি করে বাস থেকে নেমে পড়লাম। একটু হেঁটেই একটা এস টি ডি বুথ।

"একটা লোকাল কল করব।"
"যান, ঐ ঘরে।"

ঘর বলতে তিন দিকে কাঠের পাল্লা আর এক দিকে দেওয়াল দেওয়া এক মানুষ এক ফালি জায়গা। কাঠের পাল্লাগুলোর গায়ে বড় বড় কাঁচ লাগানো, যাতে বাইরে থেকে দেখা যায় খদ্দেরকে। ঘরের মধ্যে একটি অর্ধচন্দ্রাকার টেবিলের উপর একটা টেলিফোন। উপরে ডিজিটাল মিটার। কতক্ষণ কথা বলা হয়েছে আর কত টাকা বিল উঠছে দুই দেখা যায়।

ঘরে ঢুকে ডায়াল করলাম সেই নম্বর -- ২৪৪১১৩৯।

Friday, January 13, 2017

বিচ্ছেদ



মফঃস্বলের জন্য কেউ গান বা কবিতা লেখে না। নগরের কবিয়াল আছে; গ্রামে গেলে সবাই মুগ্ধ হয়ে কবিন্দ্রনাথ হয়ে যায়। কিন্তু মফঃস্বল যেন বড়ই একা, বড়ই অনাদরের। মফঃস্বলের কি কান্না পায়? পায় হয়ত, কিন্তু আপাতত ফটিকের পাচ্ছে না। 

   ফটিকের বয়স তেরো। মফঃস্বলের আর চার পাঁচটা তেরো বছরের ছেলের মতই। বিশেষত্ব কিছু নেই তেমন। দেখতেও সাদামাটা। কয়েক বছর বাদেই মাধ্যমিক। সবাই জানে ফটিক পাশ করে যাবে, সবাই জানে ফটিক স্ট্যান্ড করবে না। ফটিক যে খেলাধূলাতেও তেমন ভালো তা নয়। এই হয়ত দশ ওভারের খেলায় এক ওভার বল পায়। পাঁচ বা ছয় নম্বরে ব্যাট করতে নামে। একেবারেই মধ্যমেধা বলতে যা বোঝায় আর কি। ক্লাশে স্যারেরাও জানেন ফটিক বলে একজন আছে। ব্যাস এইটুকুই। 

   তবে এসবের মধ্যেও ফটিককে ক্লাশের অনেকেই অন্য চোখে দেখে। তার কারণ একটাই -- ফটিকের একজন প্রেমিকা আছে। মানে আজ অবধি ছিল আর কি। ছিল কেন, এখনো আছে তো! ফটিকের এই প্রেমিকার নাম প্রিয়া। গার্লস স্কুলে পড়ত। আলাপ গত বছর অঙ্কর কোচিং-এ। ফটিকের কেন প্রিয়াকে ভালো লেগেছিল সে কথা কারো জানা নেই। প্রিয়ার মনেই যে কেন ফটিক দাগ কেটেছিল, তাও কেউ জানে না। সে না জানলেও এই একটি কারণে বন্ধুমহলে ফটিকের এক আলাদা সম্মান ছিল। ফটিকও যে মাঝে মাঝে বন্ধুদের এ ব্যাপারটা বোঝাত না তা নয়। 

"এই আজ কোচিং-এ যেতে দেরি হবে, প্রিয়ার সঙ্গে দেখা করা আছে।"

বন্ধুরা অবাক হয়ে তাকাত ফটিকের দিকে। মফঃস্বলের প্রেমিকা বলে কথা। কেউ কেউ তো জিজ্ঞেসও করত 

-- "হ্যাঁ রে, তোরা দেখা হলে কি করিস?" 
"তুই ওর হাত ধরেছিস?"
"চুমু খেলি?"

এসব প্রশ্ন করার একটাই কারণ, ফটিকরা কোথায় দেখা করত বন্ধুরা শত চেষ্টা করেও জানতে পারেনি।

আজ সেই রেললাইনের ধারে মাঠটায় বসে আছে ফটিক। একটু বাদেই প্রিয়াদের ট্রেন এখান দিয়ে যাবে। প্রিয়া কি খেয়াল করবে? নিশ্চয় করবে। বলে তো দিয়েছে ফটিক।

"সেখানেই থাকব।"
"তোমার মন খারাপ করবে না তো?"
"আমার ফোন নম্বর তো আছে তোমার কাছে, ওখানে পৌঁছে ফোন করো।"
"জানি না ফোন থাকবে কিনা। কলকাতা হলে তো চিন্তা করতাম না, যাচ্ছি সেই মালদা।"
"থাকবে নিশ্চয়। মাসিমা ফোন ছাড়া থাকবেন কি করে?"
"যাহ।"
"শোনো, করলে কিন্তু ঐ আটটার সময় করো। তার আগে করলে মা ধরবে।"
"বুঝেছি রে বাবা।"
"এই তুমি মালদা গিয়ে আমাকে ভুলে যাবে না তো?"
"তুমি আমাকে ভুলবে?"

শুরু হল দু'জনের মান অভিমানের পালা। প্রিয়ার ট্রেন একটু বাদেই এখান দিয়ে যাবে। প্রিয়া বলেছে জানালায় হাত নাড়বে। যদিও সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, গোলপোস্টের ক্রসবার পূর্ণিমার চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করেছে, তাও ফটিকের ধারণা সে প্রিয়াকে দেখতে পাবে। 

ফটিকের মূল সমস্যা হল ওর কান্না পাচ্ছে না। এই সময় সবারই কাঁদা উচিত। প্রিয়াও কাঁদছিল সকালে। কিন্তু ফটিক সারাদিন কাঁদেনি। অথচ এটা উচিত না। হয়ত ট্রেনে প্রিয়াকে দেখলে কাঁদবে।

ট্রেনটা যখন আর দেখা গেল না, প্যান্ট ঝেড়ে উঠে পড়ল ফটিক। সাইকেলটায় উঠতে গিয়ে বুঝল সামনের চাকাটা কখন যেন পাংচার হয়ে গেছে। কাছাকাছি কোন দোকান-ও নেই। সেই চন্ডীবাজারের কাছে একটা আছে। চাঁদের আলোয় সাইকেল হাঁটাতে থাকল ফটিক। নাহ, এখনো কান্না পাচ্ছে না। কিন্তু সহসা যেন ভীষণ ক্লান্ত লাগছে ফটিকের। 

রোলের দোকানের গন্ধ, ট্রেনের আওয়াজ, রিক্সার হর্ন, এস টি ডি বুথের আলো, "জন্মভূমি"-র গান, ভাতের দোকানের চীৎকার যেন মফঃস্বলের কান্না ঢেকে দিল ক্লান্তিতে।