Wednesday, July 28, 2021

ঈশ্বর দর্শন

 আয সকাল থেকেই দিনটা খারাপ যাচ্ছে সন্তুর। সকালে মা রোজ তাকে এক গ্লাস দুধ খাওয়ান। দুধটা যে খেতে খুব একটা ভালো লাগে তা না, কিন্তু ইদানীং মা তাতে চকোলেট ফ্লেভারের একটি মিক্স দেন বলে, সেটি খেতে অতি উত্তম হয়। আজকেও সকালে মনের আনন্দে সেই চকোলেট রঙের দুধ পান করতে যাচ্ছিল সন্তু, এই সময় তার দুধে এসে পড়ে একটা মাছি। অতএব দুধ খাওয়া মাঠে মারা গেল। 

স্কুলে যাওয়ার সময় দত্তপাড়া কালীমন্দিরের সামনে তার সাইকেলের চেনটা পড়ল। যা হয়, হাতে কালি মেখে স্কুলে ঢুকতে হল। জামাতেও একটু কালির দাগ পড়েছিল। সুযোগ বুঝে ভূগোল স্যার নৃপতিবাবু দুটো কথাও শুনিয়ে দিলেন। পরের পিরিয়ডে বাংলা ক্লাসে বই আনেনি বলে কান ধরে বসে থাকতে হল সন্তুকে। রোজ মনে করে বইটা নিয়ে আসে সন্তু। আজকে যে কীভাবে ভুলল সেই জানে!! বলছি না, দিনটাই খারাপ!! 

টিফিনের সময় দিন আরো খারাপ গেল। কালি মাখা হাতে টিফিন খাওয়া যায়না, তাই বাথরুমে হাত ধুতে গিয়েছিল সন্তু। ফিরে এসে দেখে তার টিফিন বক্স হাওয়া। আজকে টিফিন আনতে ভুলে গেছে নাকি? খেয়াল হতেই ব্যাগের ভিতরটা খুঁজতে লাগল সে। একটু বাদেই অবশ্য চোখ গেল সামনে স্যারের টেবিলে রাখা তার খালি টিফিন বক্সটা। মানে বক্সটা বন্ধই ছিল। সন্তু গিয়ে সেটা খুলেই বুঝতে পেল ভিতরে কিচ্ছু নেই। সে যখন হাত ধুতে গেছে, তখনি এই কাণ্ড। নির্ঘাত রবির কাজ এটা। অনেকদিন ধরেই সন্তুর টিফিনের জন্য ওঁত পেতে থাকে রবি। এবার মাথা গরম হয়ে গেল সন্তুর। ছুটে গিয়ে রবিকে ধাক্কা দিল। রবিও ছাড়বার পাত্র নয়। শুরু হয়ে গেল শুম্ভ নিশুম্ভের লড়াই। মাঝে অঙ্ক স্যার অমিয়বাবু সেটি দেখে ফেলে দুজনকে আলাদা করেন। তারপর হেডস্যারের কাছে নিয়ে যান। কোন প্রমাণ ছাড়া সন্তু রবিকে আক্রমণ করেছে। তাই সন্তুকে সেদিনের মত স্কুল থেকে বার করে দিলেন হেডস্যার। পরেরদিন বাবাকে নিয়ে আসতে হবে। 

এখন বাড়ি গেলে মায়ের রোষের মুখে পড়বে সন্তু। বাবা বাড়ি ফিরতে দেরী আছে। বাবা অতটা মারেন না তাকে। তাই বাবা ফেরার পর বাড়ি ঢোকাই মঙ্গল। কিন্তু এই সময়টা কি করবে সন্তু? তাদের পাড়ার কাছেই হাইওয়ে। সাইকেলটা নিয়ে হাইওয়ের ধারে এলো সে। এখানে একটা বড় বটগাছ আছে। তার ছায়ায় বসে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগল সন্তু। এই হাইওয়েটা খুব ভয়ঙ্কর। ভীষণ জোরে গাড়ি যায়। তাই বাবা তাকে বার বার বারণ করেছেন এই হাইওয়ের কাছে যেতে। সবচেয়ে বেশী ভয় করে লরিগুলিকে। তবু বাড়ির কাউকে না জানিয়ে মাঝে মাঝেই এই হাইওয়ের ধারে এসে বসে সন্তু। কত লোক দেখা যায়। উল্টোদিকে একটি চায়ের গুমটি। সেখানে কত লোক খেতে আসে। কারুর হাতে বড় ব্যাগ। কারুর সঙ্গে বাঁধা ছাগল। সন্তুর বেশ লাগে। আচ্ছা এই যে রাস্তাটা, এটা কতদূর গেছে? কলকাতা? দিল্লী? বম্বে? মাদ্রাজ? নাকি আরো দূর!! লন্ডন? প্যারিস? বাবাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। বড় হলে সন্তুও এরকম রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাবে। অনেক দূর দূর যাবে। 

এই সময় আচমকা একটি গাড়ি এসে থামল সন্তুর সামনে। দুধ সাদা একটা আম্ব্যাসাডর। গাড়ির সামনের জানালা দিয়ে ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল 

-- এই যে খোকা, এটা কি দয়ালপুর? 

-- না এটা তো খনা। সামনেই স্টেশন পাবেন। 

-- ওহ খনা, তাহলে কাছেই আছি। 

এই বলে ড্রাইভার ভদ্রলোক গাড়ি চালু করছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে পিছনে বসে থাকা ব্যাক্তিকে দেখে ফেলেছে সন্তু। শুধু দেখেছে না, চিনেও ফেলেছে। আরে ইনি যে শচীন। আনন্দে কিছু না ভেবেই চিৎকার করে উঠল সন্তু 

-- শচীন, শচীন। 

ড্রাইভার গাড়ি থামালেন। পিছনের জানালা খুলে গেল। এবার জানালা দিয়ে বেরিয়ে এলো একটি হাত। 

-- হাই।

ছুটে গিয়ে সে হাত ধরল সন্তু। তার ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল 

-- আই এম বিগ ফ্যান। 

-- থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ ফর হেল্পিং আস উইথ দ্য ডিরেকশন। গড ব্লেস ইউ। 

এবার হাত ছাড়িয়ে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালেন বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার। জানালার কাঁচ আসতে আসতে বন্ধ হয়ে গেল। গাড়িটিও গা ঝাড়া দিয়ে চলতে লাগল। যতক্ষণ গাড়িটি দেখা গেল, সন্তু হাত নেড়ে গেল। 

সন্তু সেদিন বাড়িতে প্রচণ্ড বকা খেল। আজকে বাবাও ছাড়লেন না। ভুলের মধ্যে সন্তু বলে ফেলেছিল শচীনের সঙ্গে দেখা করার কথাটি। বাবা বিশ্বাস তো করলেনই না, উল্টে সন্তু কেন হাইওয়ের ধারে গিয়েছিল তাই নিয়ে বকা খেল। পরেরদিন স্কুলের বন্ধুদের সবাইকে বলল সন্তু। প্রথম প্রথম দু- একজন বিশ্বাস করলেও বাংলার স্যার নির্মলবাবু -- "বাহ সন্তু, তুমি তো খুব গুছিয়ে গল্প বলতে পারো। বড় হয়ে শরৎচন্দ্র হবে?"

বলায় সমস্ত ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়েছিল। চোখ ফেটে কান্না এল সন্তুর। নাহ, আর কাউকে বলবে না সন্তু এই কথাটি। 



আজ বহুবছর বাদে ছেলের জন্য রচনা লিখতে বসলেন তন্ময়বাবু ওরফে সন্তু। রচনার বিষয় -- "জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন"। লিখতে বসেই সেই বহুবছর আগের দিনটির কথা মনে পড়ে গেল। আচ্ছা, সত্যি কি সেদিন শচীনকে দেখেছিলেন তিনি? 

Saturday, May 8, 2021

প্রবাসীর ডায়রি ৫ঃ ক্যালিফোর্নিকেশান

 ইন্টার্নশিপের অফারটা পেলাম ২০০৮-এর ফেব্রুয়ারির শেষে। এতদিন সেলফোন ছিলোনা। এবার নিলাম। একটা ক্রেডিট কার্ড-ও এপ্লাই করেছিলাম। সেটা পেলাম। বলা হয়নি এর মধ্যে আমার একটি পেপার এক্সেপ্টেড হয়েছে। সেটি পড়তে যেতে হবে অরল্যান্ডো। আমরা যেখানে থাকতাম, অর্থাৎ গেন্সভিল থেকে অরল্যান্ডো মাত্র ২ ঘণ্টা দূর। মে মাসে আমি আর আমার গাইড গেলাম পেপার পড়তে। সেই প্রথম এরকম স্তরের কনফারেন্স আমার। কত লোক। দূর দূরান্ত থেকে এসেছে। আলাপ হল। পেপার পড়লাম। প্রশ্ন করল লোকজন। উত্তরও দিলাম। সেখানে আলাপ হল দক্ষিণ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ডঃ সংযুক্তা ভঞ্জর সাথে। উনি আমার নাম শুনে বললেন -- "আরে আমার ছেলের নাম-ও তো কণাদ!!" 

বিকেল বেলা কনফারেন্স করে ফিরে এলাম। পড়ন্ত বিকেলের আলোতে গাড়িতে বসে বসে সবুজ ফ্লোরিডা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, আর তো কয়েকদিন, তারপর আমার যাত্রা সোনালি রাজ্যে -- ক্যালিফোর্নিয়ায়। সেখানে কী এই সবুজ বনানী, এই বিস্তীর্ন জলভূমি দেখতে পারব? এর মধ্যে একটা মজার কথা বলি। ইন্টেলের নিয়ম ছিল ইন্টার্নদের জয়েন করার আগে ড্রাগ টেস্ট করতে হবে। তো সেই মত আমি গেলাম হাসপাতালে। জানতাম না ড্রাগ টেস্ট কাকে বলে। গিয়ে শুনলাম মূত্র বিসর্জন করতে হবে। এবার আমার সেই সময় মূত্র ত্যাগের মত অবস্থা না। রিসেপ্সনিস্ট বলল -- "জল খাও, পাশেই ফিল্টার আছে।" এবার আমেরিকানদের একটা খুব বিরক্তিকর স্বভাবের কথা বলি। এরা জল বলতে ঠাণ্ডা জল খায়। আমি আবার বেশী ঠাণ্ডা জল খেতে পারিনা। অতএব প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করে শৌচালয় যাত্রা করলাম। 

আমার ক্যালিফোর্নিয়ার ফ্লাইট ছিল অরল্যান্ডো -- ডেনভার -- স্যাক্রাম্যান্টো। আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম ওখানে এক তামিল ছেলের সঙ্গে থাকব। নাম দশরথারামান চন্দ্রমৌলী, সংক্ষেপে দশা। দশা আমার এক সপ্তাহ আগেই জয়েন করবে। সে উত্তর ক্যারোলিনা রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নির্দিষ্ট দিনে আমার রুমমেট অনিদা আমাকে অরল্যান্ডো বিমানবন্দরে পৌঁছে দিলো। সেখান থেকে লম্বা ফ্লাইট করে ডেনভার। কলোরাডো রাজ্যটা কি সুন্দর সেটি প্লেন থেকেই দেখতে পেলাম। কলোরাডোতে আমার প্রায় ৩ ঘণ্টা মত সময় ছিল। এয়ারপোর্টে ঘুরতে লাগলাম। এক জায়গায় দেখলাম জুতো পালিশ চলছে। ব্যাপারটা খুব মজা লাগল দেখে। বেশ কিছু উঁচু উঁচু চেয়ারে লোকে বসবে, জুতো খুলবেও না। আর কিছু লোক সেটা পরিষ্কার করে দেবে। মনে পড়ল ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে বিরজু আসত প্রতি রবিবার জুতো পরিষ্কার করতে। কতদিন বিরজুর খবর পাইনা। বেঁচে আছে কিনা কে জানে। আমার জীবনের অনেক কিছুর মতই বিরজু একদিন না বলে হারিয়ে গিয়েছিল। বলেও যায়নি আর দেখা হবে না। 

একটা আইসক্রিমের দোকান দেখে এগোতেই এই ভারতীয় ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। নাম হিতেশ লাথ। গুজারাটের লোক। স্যান হোশেতে চাকরি করেন। অনেকক্ষণ গল্প হল। একসাথে আইসক্রিম খেলাম। দেশের কথা, ক্যালিফোর্নিয়ার কথা, কলেজের কথা, চাকরির কথা, শাহরুখ খান, কুমার শানু, কিছুই বাকি রইল না। মনে হচ্ছিল সেই সময়, শুধু সেই কয়েক ঘণ্টার জন্য উনি একমাত্র আমার পরিচিত, আর কেউ না। অবশেষে বিদায়ের সময় এল। উনি আমাকে নিজের একটা কার্ড দিলেন। পরে ওনাকে একদিন মেল করেছিলাম, উত্তরও দিয়েছিলেন। কিন্তু যা হয়, বিরজুর মত হিতেশবাবুও আমার জীবন থেকে একদিন হারিয়ে গেলেন। অথচ সেদিন উত্তর আমেরিকার এক পাহাড়ি শহরের বিমানবন্দরে উনি ছিলেন আমার সবচেয়ে কাছের। 


ক্যালিফোর্নিয়ার রাজধানী স্যাক্রাম্যান্টো। যখন পৌঁছালাম তখন রাত প্রায় ৭:৩০। এয়ারপোর্টেই খেয়ে নিয়েছিলাম। একটা শাটল বলা ছিল। তাতেই উঠলাম। কিন্তু শাটল একে এলো দেরী করে। তার উপর আমি শেষ স্টপ। অতএব সবাইকে নামাতে নামাতে যখন আমার বাড়ি পৌঁছাল তখন রাত ৯:৩০। দশাকে ফোন করতেই দোতলা থেকে নেমে এলো। আমার ব্যাগ নিয়ে ওপরে উঠতে সাহায্য করল। বাড়িতে পিতজা আছে, খাবো কিনা জিজ্ঞেস করলো। আমি না বললাম, এয়ারপোর্টে খেয়ে এসেছি জানালাম। আমরা যে জায়গাটায় থাকছি সেটি স্যাক্রাম্যান্টোর শহরতলি। নাম র‍্যাঞ্চো কর্দোভা। পশ্চিমবঙ্গ ও ফ্লোরিডা কাটিয়ে মরুভূমির দেশে এসে বুঝতে পারলাম গরম কাকে বলে। রাত ১০টা তেও প্রায় ৩৮ ডিগ্রী। অতএব স্নান করে শুতে গেলাম। মনে মনে ভাবছিলাম -- আর তো ক'দিন বাদেই আমার জন্মদিন। গতবছর ঐ দিনে আমার যাদবপুরের পরীক্ষা শেষ হয়েছিল। সকালে অয়ন, সপ্তর্ষি, সোমসুভ্রদের সঙ্গে কাটিয়ে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। আর এবার, একা একা এই প্রবাসে সোনালি রাজ্যে কাটাব।  

Friday, April 2, 2021

বাড়ির খোঁজে

 আচ্ছা, আপনাদের কারুর বাড়ি হারিয়ে গেছে?  মার্কিন দেশের নেভাডা রাজ্যের এম্পায়ার শহরের ফার্নের হারিয়ে গিয়েছিল। এম্পায়ারে একটি কন্সট্রাকশন কোম্পানি ছিল। প্রায় ৭৫০ লোক থাকত। কোম্পানির বাড়িতে ছিল। একদিন কোম্পানি উঠে যায়। চাকরির খোঁজে সবাই এম্পায়ার ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। এম্পায়ার খালি হয়ে যায়। ফার্ন বেছে নেয় এক যাযাবর জীবন। নিজের ক্যারাভানে চেপে দেশের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে এমাজনে কাজ করে। একদিন সে ফিরে আসে এম্পায়ারে। নিজের পুরনো বাড়িতে যায়। কেউ নেই। দরজা খোলা। বেডরুম খালি। আলমারি খোলা। এক শূন্যতা তাকে পেয়ে বসে। খানিকক্ষণ সময় কাটিয়ে সে ফিরে যায়। এতক্ষণে হয়ত অনেকেই বুঝে ফেলেছেন আমি কার কথা বলছি। হ্যাঁ, এটি এবছরে ছয়টি অস্কারের জন্য মনোনীত সিনেমা "নোমাডল্যান্ড"। 

কিন্তু এ কী শুধুই মার্কিন দেশের গল্প? আমাদের দেশে কি নেই? আমার শ্বশুরমশাই চাকরি করতেন আসামে হিন্দুস্তান পেপার মিলসে। উনি অবসর নিয়েছেন বহয় আগে। বহুদিন হল সেটি বন্ধ। ইতিমধ্যেই প্রায় ৮০ জন আত্মহত্যা করেছে। আমার স্ত্রী এবং অন্যরা যারা ঐ মিলের হাউজিং-এ বড় হয়েছে, তাদের সেই বাড়ি কি আর থাকবে? ঐ মিল যদি না খোলে কোনদিন, তাহলে ও বাড়িও হারিয়ে যাবে। 

অনেক বাড়ি অচেনা হয়ে যায়। আমার তারাবাগের যে কোয়ার্টারে থাকতাম, যেটা জীবনের প্রায় ১১ বছর আমার বাড়ি ছিল, আজ সেখানে আমি চাইলেই ঢুকতে পারবনা। কে থাকেন চিনি না, দুম করে "এটা আমার বাড়ি ছিল, দেখব" বলে যাওয়া যায়না। অথচ সত্যি ওখানে আমি থাকতাম। আই সি এস ই, উচ্চমাধ্যমিক, জয়েন্ট সব ঐ বাড়িতে থাকতেই দেওয়া। ২০০১ এ অসুস্থ হয়ে নার্সিং হোম থেকে ফিরে ঐ বাড়িতেই উঠেছিলাম। সাইকেল চালাতে শিখে পড়ে গিয়ে পা কেটে ঐ বাড়িতেই গেছিলাম। আজ সেই বাড়ি আমার অচেনা। তবে হারিয়ে যায়নি। আমি তারাবাগ গেলেই বাড়িটি দেখতে পাই। হয়ত ঢুকতে পারিনা। 

আমার জীবনে একটি বাড়ি হারিয়ে গেছে। খুবই গুরুত্বপূর্ন বাড়ি। আমি ২০০৭ সালে প্রথম বাড়ি ছাড়ি। এই দেখুন, এতবার বাড়ি বলছি, আপনি হয়ত বুঝতে পারছেন না আমি কিসের কথা বলছি। আমি ২০০৭ এ প্রথম মা বাবাকে ছেড়ে আলাদা থাকি। ততদিন আমার বাড়ি ছিল কখনো বর্ধমানের কোয়ার্টার, কখনো শকুন্তলা পার্কের ফ্ল্যাট। ২০০৭ এ আমার বাড়ি হয় ফ্লোরিডার গেন্সভিলের এক টাউনহাউস। বিশ্বাস করুন, আমিও জানতাম না টাউনহাউস মানে কি। আমাদের কমপ্লেক্সের নাম ছিল সান হার্বার। বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার দুটি বাস ছিল -- ১৬ আর ১৭। দোতলা বাড়ি। একতলায় রান্নাঘর, একটি ছোট শৌচালয়, এবং বাইরের ঘর বা লিভিং রুম। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলে দুটি বেডরুম এবং একটি স্নানঘর। আমি থাকতাম পশ্চিমমুখী ঘরে। আমার রুমমেট সায়ক থাকত পূর্বমুখী ঘরটিতে। আমরা যখন প্রথম যাই, আমাদের সঙ্গে অনিরুদ্ধদাও থাকত। ২০০৭ এ বাড়িটির রং ছিল সাদা, আর লাল দরজা।

আমার যেন রোজকার রুটিন হয়ে গিয়েছিল সকালে বাড়ির তালা লাগিয়ে হেঁটে রাস্তা পেড়িয়ে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে বাস ধরা। ফেরার সময় আবার বাস স্ট্যান্ড থেকে হেঁটে বাড়ি ফেরা। আপনাদের হয়ত মনে হতে পারে এই ক্লিশে রোজকার যাতায়াত নিয়ে কেন লিখছি। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় ঐ ক্লিশে জিনিসটাই যদি আবার ফেরত পেতাম। 

মনে আছে, আমাদের দরজার একটু দূরে একটি ময়লা ফেলার জায়গা ছিল। রাত্রিবেলা সেখানে র‍্যাকুনের দল আসত। কয়েকবার ছবি তুলতে গিয়ে পারিনি। আমরা গাড়ি কেনার পড় বাড়ির সামনে রাখতাম। গবেষণার শেষদিকে কাজের প্রচণ্ড চাপ চলছিল। বাধ্য হয়ে রাত করে ফিরতাম ল্যাব থেকে। বাড়ির সামনে গাড়িটি যখন পার্ক করতাম, মনে হত যাক বাড়ি ফিরেছি, সারাদিনের ঝক্কি শেষ। পাঁচ বছরে আমি বাড়ি পাল্টায়নি। ঐ বাড়িতেই আমার বহু বন্ধু এসেছে, থেকেছে। জন্মদিনে কেক কাটা, একসাথে সিনেমা দেখা, ওয়ার্ল্ড কাপ, ইউরো কাপ দেখা কত স্মৃতি। 

২০১২-তে আমি যখন ব্যাঙ্গালোর ফিরি, ঐ বাড়িটা বার বার মিস করতে থাকি। কতবার যে গুগল ম্যাপ্সে গিয়ে স্ট্রিট ভিউ করে বাড়ির সামনে ঘুরে আসি। ২০১৬ নাগাদ বাড়িটি ভাঙা হয়। ওর জায়গায় নতুন লাক্সারি কমপ্লেক্স তৈরি হয়। আমি ভাবিনি আবার কোনদিন গেন্সভিল যেতে পারব। ২০১৮-তে যাই। প্রথমেই নিজের পুরনো বাড়ির কাছে যাই। বাড়ি আর নেই। আমার সেই বাড়ি হারিয়ে গেছে। আর কোনদিন চাইলেও আমি ফিরতে পারবনা। এখন শুধুই স্মৃতি আর গুগল ম্যাপ্সের টাইমলাইন স্ট্রিট ভিউ। তবু মনে হয় টাইম মেশিন পেলে একবার ফিরে যেতাম সেই ২০১০ এর গেন্সভিল। সেই ১৬ নম্বর বাসে চেপে বাস স্ট্যান্ডে নেমে বাড়ির দিকে হাঁটতাম। 

Sunday, March 14, 2021

নারী দিবস

 "মা বলছিল পুজোর ছুটিতে বেনারাস নিয়ে যেতে, ভালোই হবে বলো?" গাড়িতে উঠেই তপনের প্রশ্ন। 

"হুঁ, গেলেই হয়।" -- একটু অন্যমনস্ক গলায় বলল সঞ্চিতা। তার এই ব্যাপারটা একেবারেই নাপসন্দ। এর আগে যতবার শাশুড়ির সঙ্গে বেড়াতে গেছে ততবারই পুরো প্ল্যানটা উনিই ঠিক করেছেন। সঞ্চিতার যেন কোন মতামতই নেই। আর তপনও মায়ের কথা শুনে চলা ছেলে। আর সত্যি কথা বলতে সেভাবে বেনারাস যাওয়ারও তেমন শখ নেই সঞ্চিতার। বরং কতদিন সমুদ্র দেখেনি। পুরী গেলে হত। 

"তুমিই তো সেদিন বলছিলে কতদিন বেড়াতে যাওয়া হয়না।" 

"হুম, যাওয়া যায় পুজোয়।" এই বলে মিষ্টির প্যাকেটটা শক্ত করে ধরল সঞ্চিতা। ট্যাক্সি ততক্ষণে অনেক দূর চলে এসেছে। তারা যাচ্ছে নিউটাউন। তপনের বন্ধুর বাড়ি। স্কুলের বন্ধু। আজ সেখানে তিন বন্ধুর পরিবার নিয়ে নিমন্ত্রণ। এরা বলে পার্টি। আজকাল কথাগুলো কত পাল্টে যাচ্ছে না? আগে যাকে বলা হত নিমন্ত্রণ, আজ তার নাম পার্টি। আগে যাকে বলত ক্যাপ্সিকাম, আজ তাকে বলে বেল পেপারস। 

জানালার দু ধারে বসে আছে তপন আর সঞ্চিতা। মাঝখানে তাদের মেয়ে রুমা। ভীষণ মিষ্টি দেখতে এই সপ্তম বর্ষীয় বালিকা। নিজের মেয়ে বলে মনে করে না সঞ্চিতা, আসে পাশে পাড়া প্রতিবেশীরাও বলে। তবে সঞ্চিতার একটাই চিন্তা। তার মেয়ে যেন ঠিক ভাবে মানুষ হয়। প্রতি সপ্তাহে যখন তপন মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে তার গায়ে হাত তোলে, তখন হাঁ করে তাকিয়ে দেখে রুমা। কার জন্য কাঁদবে বুঝতে পারেনা। বিয়ের আগে সঞ্চিতা ভাবেনি এরকম হবে। তার ধারণা ছিল সমাজের নিম্নস্তরে এগুলি হয়। কবে যে এর অবসান হবে তার দিন গোনে সঞ্চিতা। দায়িত্ব । বড্ড বড় একটা শব্দ। আচ্ছা, দায়িত্ব কি তার একার? আর কেউ সঙ্গ দেবে না তাকে? কতদিন, আর কতদিন এই প্রতীক্ষা চলবে? 

সঞ্চিতার মিষ্টির প্যাকেট যেভাবে তপনের বন্ধুর বউ তাচ্ছিল্য করে টেবিলে রেখে দিল তাতে সঞ্চিতার বুঝতে বাকি রইল না ওটি আনা ঠিক হয়নি। আসলে এরা সমাজের উঁচু স্তরের। সঞ্চিতারা যাকে বলে নেহাতই মধ্যবিত্ত। সঞ্চিতা নিজে হুগলীর একটা স্কুলে ইতিহাস পড়ায়। তপন একটা প্রেসে চাকরি করে। যে বন্ধুর বাড়ি নেমতন্ন, তার নিজস্ব গ্যারেজের ব্যবসা আছে। 

খানিকক্ষণ বাদেই শুরু হল মদের ফোয়ারা। দুই বন্ধু এবং তাদের স্ত্রীরাও মদ্যপানে ব্যস্ত। তপন একটু বাদেই মাতাল হয়ে গান গাইতে শুরু করল। এর মধ্যে চটুল হিন্দি গান চালিয়ে নাচছে সবাই। সোফার এক কোণে চুপ করে বসে ছিল সঞ্চিতা। তাকে তপনের বন্ধুর স্ত্রীরা মাদক রসে বঞ্চিত করতে চায়না। কিন্তু আজ কঠোর সঞ্চিতা। নিজেকে সংযত রেখেছে। নাচতে নাচতে মাঝে মাঝেই তপনের বন্ধুরা তার হাত ধরে টানছিল। একজন তো বার বার গায়ে পরে যাচ্ছে। রুমা বাচ্চা। সে এসব বোঝে না। সবাই নাচছে দেখে সেও মাঝখানে নাচতে লাগল। মাতালের দল নিজেরা নাচা বন্ধ করে রুমাকে হাততালি দিতে শুরু করে। নিজের মেয়েকে রেয়াত দেয়না তপনও। লজ্জায় কান কট কট করছিল সঞ্চিতার। ইচ্ছে করছিল গিয়ে রুমার গালে কষে একটা থাপ্পড় মারে। কিন্তু নিজেকে সংযত করে রুমার হাত ধরে টেনে আনল  সে। 


রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ৩ টে বাজল। তপনের বন্ধুরাই ট্যাক্সি ডেকে দিল। তপন মাতাল অবস্থায় অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। বাড়িতেও কষ্ট করে উঠল। এখন বাবা-মেয়ে শুয়ে আছে। সঞ্চিতা আর ঠিক করল শোবে না। সাতটার ট্রেন ধরতে হয় তাকে। এখন আর শুয়ে লাভ নেই। একা একা বারান্দায় এসে দাঁড়াল সঞ্চিতা। গত তিনদিন বৃষ্টি হয়নি। আকাশটা কেমন থমথমে। সঞ্চিতার মনে পড়ে যাচ্ছিল বহুদিন আগে সে একবার মরুভূমি দেখেছিল। সেই মরুভূমির সামনে দাঁড়িয়ে তার যেন মনে হয়েছিল সকল মানব সভ্যতাই মিথ্যা। এক দীগন্ত বিস্তীর্ন জমি যা কাউকে পরোয়া করেনা। কত শত শতাব্দী জুড়ে এই মরুভূমি এখানে অবস্থিত। যেন বলছে দেখ, আমিই সত্য, আমি ধ্রুব, আমি ঈশ্বর। কলকাতার বাড়ির ভিড়ে সেই মরুভূমির অসীম স্পর্ধা যেন হারিয়ে গেছে। 

এসব ভাবতেই ভাবতেই সঞ্চিতার ফোন বেজে উঠল। নম্বরটা দেখা যাচ্ছেনা। 

"হ্যালো" 

"শোন,  তৈরি হয়ে নাও। আধ ঘণ্টার মধ্যে আমরা আসব। জিনস আর একটা টপ পরে চলে এস। জিনিসটা আছে তো?" 

"হ্যাঁ, কিন্তু মাত্র আধ ঘণ্টা।" 

"হ্যাঁ, আর শোন, মেয়েকে আদর করতে যেও না। ওর ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমরা সমস্যায় পড়ব। আমাদের হাতে সময় নেই।" 

"একবারও না?" 

"না, একবারও না। চিন্তা করো না। তোমার মেয়ে ভালো থাকবে, আমরা দায়িত্ব নেব।" 

"আচ্ছা, আমি তপনকে একটা শাস্তি দিয়ে যেতে চাই।" 

"না, আমরা চাই না এসবের মধ্যে পুলিশ কেস হোক। কথা দিচ্ছি, যদি তুমি আমি দুজনেই বেঁচে থাকি, প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ তোমায় দেব। এবার রাখছি, আমাদের হাতে সময় নেই। তোমার বাড়ির সামনে একটা হিরো হোন্ডা বাইক থাকবে। উঠে পড়।"

চটজলদি নিজের পোশাক পরিবর্তন করল সঞ্চিতা। উফ, অবশেষে মুক্তি। এবার নিজের আলমারির গয়নার বাক্সটা খুলল সে। এই জায়গায় শাশুড়ির অধিকার নেই। জড়োয়ার সেটের বাক্সটা খুলল। তার বিয়েতে এটি উপহার দেওয়া হয়েছিল। সবাই অবাক হয়েছিল এত দামী গয়না কে দিল, কেউ বুঝতে পারেনি, নাম লেখা ছিলোনা। শুধু সঞ্চিতা জানত। উপরের  ডালাটা সরাতেই নিচের খালি জায়গাটাই দৃশ্যমান হল একটি মসকিউটো। মশা না, বন্দুক। 

বেরিয়ে আসার সময় রুমার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখে জল এল সঞ্চিতার। স্যার যখন বলেছেন, রুমা ঠিক থাকবেই। 

বাইকটা তাকে নামিয়ে দিল একটা বড় বাসের সামনে। বাস না বলে ভ্যানও বলা যায়। বাইরে অপেক্ষা করছিলেন সেই মানুষটি যাকে এতবছর বাদে দেখে আবার চোখে জল এল সঞ্চিতার। 

"স্যার কেমন আছেন?" প্রণাম করল সঞ্চিতা। 

"ভালো, এতদিন আন্ডার কভার ভালো লাগল?"

"আপনি তো সবই জানেন।" 

"জানি, বেশ, আলাপ করো। এরা হল সুমেধা, আলম, তমাল আর অঙ্কিতা।" 

"হাই।" 

"বেশ সঞ্চিতা, এবার তো তোমাকে ঘুমোতে হবে।"

"স্যার, আমার ঘুম পাচ্ছে না। " 

"তোমার ঘুম না পেলেও ঘুমোতে হবে সঞ্চিতা। 'অগ্নীশ্বর"-এ উত্তমবাবু যেমন বলেছিলেন, 'দেশের আগে কিচ্ছু না'। ঘুমও না। কাল তোমার অনেক কাজ। দাঁড়াও একজনের সাথে তোমার দেখা করাই। দেখো তো চিনতে পারছ কিনা?"

"আরে ডাক্তার সেন?" 

"হ্যাঁ, সেই রেশমি সেন। রেশমি, সঞ্চিতাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। সবাই গাড়িতে ওঠো। অনেকটা পথ যেতে হবে।" 

গাড়ির মধ্যেই একটা বিছানা ছিল। ইনজেকশন পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর নিদ্রায় নিমজ্জিত হল সঞ্চিতা। গাড়ী তখন দিল্লী রোড ধরে ছুটেছে। 


সঞ্চিতার ঘুম ভাঙ্গল এক বিছানায়। কোন একটা ঘরে সে শুয়ে আছে। এখানে কী করে এল সে নিজেও জানে না। নিশ্চয় স্যার এনেছেন। ঘরের বাইরেই একটা বারান্দা। বারান্দায় এসে দেখল সূর্য মধ্যগগন থেকে অস্তগামী। হাতঘড়ি দেখে বুঝল এক দিন হয়ে গেছে। গতকাল এই সময় সে স্কুলে মেয়েদের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজীর ভূমিকা পড়াচ্ছিল। আর আজ এ কোথায় সে। 

পাশেই সিঁড়ি। নিচে নামল সঞ্চিতা। একটা বড় দালান মত জায়গায় সকলে বসে চা খাচ্ছে। 

"গুড আফটারনুন, তুমি কখন উঠেব সেটাই ভাবছিলাম।"

"এটা আমরা কোথায় স্যার?"

"এটা, মাই ডিয়ার সঞ্চিতা হচ্ছে বেনারাস।" 

Friday, February 5, 2021

শিমুলতলা

 আজ ঠাণ্ডাটা একটু কম। তাই বারান্দায় এসে বসলাম। নইলে রোজ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। ডাক্তার বারণ করেছে। কবিতা বিকেলে এসে আমাকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখলে বকা দেয় --  

"দাদাবাবু, আপনাকে কতদিন বারণ করেছি এভাবে একা বসে থাকতে?"

হাসি পায়। মনে হয় যেন কবিতা আমার গুরুজন। হাসি। বলি -- 

"কি আর হবে, খুব বেশী হলে কয়েকদিন কম বাঁচব তাই তো?" 

"তুমি এসব কথা বলবে না দাদাবাবু, দুপুরে ওষুধ খেয়েছিলে?" 

সম্মতি জানাই। কবিতাও জানে আমি আর বেশিদিন নেই। শুধু কবিতা কেন, পাড়ার সকলেই জানে। ডাক্তারবাবু বলতে চাননি, কিন্তু একদিন বলে ফেলেছিলেন। আর খুব বেশী হলে মাস দুয়েক। আমার বাড়ির সামনে একটা শিমুলগাছ আছে। আর কয়েকদিন বাদেই ফুল হবে। খুব সুন্দর লাগে যখন শিমুলফুল ফোটে। আমাদের বাড়ির চারিদিকটা যেন  রাঙিয়ে যায়। কেন যে আমাদের বললাম কে জানে? তনিমাও নেই, আমিও আর কিছুদিন বাদে থাকব না। এই  বাড়িটার কি হবে কে জানে!! হয়ত সরকার নিয়ে নেবে। আমার কোন উইল করা নেই। ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে শোনার পর ইচ্ছে হয়েছিল করি। কিন্তু তারপর মনে হল কেন করব? কে দেখবে? ধুর। এবার যখন শিমুলফুল ফুটবে, আমি থাকব না। 

পাড়ার লোকে আমাকে আমার অসুখের জন্য দয়া করেনা। অসুখের কথা খুব বেশীদিন জানেনি সকলে। এরা আমাকে দয়া করে তনিমার জন্য। তনিমা আর নেই আমার সঙ্গে। কোথায় আছে, কেন নেই এরা কেউ জানে না। আমার এই অসুখের মধ্যেও আমাকে ফেলে চলে গেছে এটা শুনে পাড়ার লোকে নিন্দা করে। শুনি।  এক দু'বার বলতে গেছি -- "থাক না, আর বলে কি হবে?" পরে দেখেছি এরা বলতে ভালোবাসে। আমার প্রতি সহমর্মী হয়ে নয়, যেন নিজেদের ভালোবাসা থেকেই বলে। তাই আমি আর আজকাল প্রতিবাদ করিনা। সকলের জীবন আমার মত শান্ত নয়। কারুর চাকরিতে অশান্তি। কারুর ছেলে বখে যাচ্ছে। কারুর বাড়িতে জলের সমস্যা। এসবের থেকে শান্তি পেতে যদি কাউকে গালাগাল করতে হয়, করুক না। যতই সে আমার ভালোবাসার পাত্রী হোক। 

এই শীতের বিকেলে বারান্দায় বসে থাকতে বেশ লাগে।  স্কুলে পড়া ছেলে মেয়েরা সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফেরে। কেউ কেউ হয়ত এখন টিউশানে বেরোবে। কি  অদ্ভুত না, আমি যখন ছোট ছিলাম, কেউ  টিউশানে পড়লে সেটাকে খারাপ ভাবে দেখা হত। আর এখন টিউশানে না পড়লে নাকি চলবেই না। আচ্ছা আমি টিউশানে পড়লে খরচা কে দিত? বাবার তো আমার স্কুলের টাকা দিতেই কষ্ট  হত। জলপানি পেয়ে শেষের চার বছর চালিয়েছি। তারপর যখন কলেজে ভর্তি হলাম, তখন নেহাত কিছু টিউশানি  শুরু করেছিলাম। যাদের পড়াতাম, কেউ পদের না। তাই সবসময় মনে হত টিউশানি যারা পড়ে, তারা নেহাতই নির্বোধ। তবে টিউশানিতে খুব সুবিধা হত। শুধু কলেজের মাইনে আর হাতখরচা না, রোজ বিকেলে ভালমন্দ জলখাবার পেতাম। তবে তখনও শীতে পড়িয়ে ফিরতে খুব কষ্ট হত। আমাদের এই জেলা শহরে ভালোই ঠাণ্ডা পড়ে। মাথা দিয়ে মাফলার জড়িয়ে সাইকেলে তড়িঘড়ি করে বাড়ি ফিরতাম। বাড়ি ফিরেই গরম গরম চা। তখন জীবনে কত উৎসাহ, কত স্বপ্ন। তখন কি জানতাম জীবন মানে রোজ বিকেলে জানালা দিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ভাবা -- কালকে এ দৃশ্য দেখা হবে তো? 

এই বাড়ির একতলার ঘরগুলি বন্ধ আজ বহু বছর। মাঝে মাঝে কাউকে দিয়ে পরিষ্কার করাই। আবার বন্ধই থাকে। সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নেমে কষ্ট করে শিমুলগাছের তলায় গেলাম। পরে কবিতা জানতে পেরে ভীষণ রাগ করেছিল। একা একা গাছটাকে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ডাকলাম 

"কোথায় তুমি? এসো।" 

কেউ এলোনা।  দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ি ফিরলাম।  প্রায় ন্যাড়া এই শিমুলগাছটার দিকে বার বার চেয়ে থাকি। প্রতিদিন ভাবি সে এসবে। সে এসবে আমাকে নিয়ে যেতে। তাহলে আমার এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হবে। হয়ত শিমুলগাছে ফুল  দেখা হবেনা এবার। দরকার নেই। সে এলেই আমার মুক্তি। কিন্তু সে আসেনা। 


কেন তনিমা? কেন আসোনা?  আমাকে কবে মুক্তি দেবে? আমি যে নিজের হাতে তোমাকে ঐ শিমুলগাছের নিচে পুঁতে দিয়েছিলাম। তুমি কেন আসছ না। আমাকে নিয়ে যাবে না তোমার কাছে? 


Sunday, January 17, 2021

স্বাধীনতা

 এ এক অন্য সময়ের গল্প। যখন বিজন ভট্টাচার্যর নবান্নের চরিত্ররা শহরের পথে ঘাটে ঘুরে বেড়াত। যখন কলকাতার রাস্তায় "ফ্যান দাও" বলে লোকে ডাক দিত। যখন হয়ত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় "কেড়ে খায়নি কেন" লিখছিলেন। যখন স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে হিটলার পরাজয় স্বীকার করছিলেন। যখন চার্চিল সাহেব বার বার ভারতীয়দের মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করেছিলেন, যাতে ইউরোপীয়দের বাঁচানো যায়। যখন প্লুটোনিয়াম তৈরি করতে তামাম মার্কিন দেশের বিজ্ঞানীরা প্রাণপাত পরিশ্রম করছিলেন। 

এমতবস্থায় তমলুক শহরে একদল বাঙালির একদিন সভা বসল। সভাপতি শ্রী তপন সেন। কলকাতায় পড়াশুনো করতে করতে গান্ধীজীর দলে নাম লেখায়। তারপর একদিন গান্ধীজীর আদর্শে তার বিশ্বাস চলে যায়। মনে হয় নেতাজী সুভাষ বোসের দলে নাম লেখাবে। কিন্তু ততদিনে সুভাষবাবু জাপানে। এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই সিঙ্গাপুরে প্রথম স্বাধীন ভারত সরকার গড়ে ওঠে। তপন কিন্তু এই সভায় অন্য কারণে এসেছে। তার দলে আজ গোটা বিশেক বাঙালি ছেলে। সকলেই দেশ স্বাধীন করায় উদগ্রীব। 

"বন্ধুগণ, আজ দেশের অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গিন। একেই আমরা পরাধীন। তার উপর ব্রিটিশ সরকারের নিয়মে দেশে হাজার হাজার মানুষ অনাহারে মরছে। কলকাতার রাস্তাঘাট পুরো শ্মশান। আমাদের গ্রামে গ্রামে লোক মরছে। গান্ধীজীর অহিংসার নীতি কাজ করছে না। ব্রিটিশরা এখন যুদ্ধে ব্যস্ত। ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেবার কথা ওরা কল্পনাও  করতে পারবেনা। নেতাজী সুভাষ বোস  জাপান থেকে চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাও হয়ত সময় লাগবে।"

এবার একটু থামল তপন। একবার চোখ বুলিয়ে নিল সকলের উপর। সবাই এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে।  

"আমাদের এখন প্রথম দায়িত্ব দেশের লোকের ক্ষুধা নিবারণ করা। দেশের লোককে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। লোকে না বাঁচলে দেশ কোনদিন স্বাধীন হবেনা। আপনারা কি এই প্রকল্পে আমার সঙ্গে আছেন? মনে রাখবেন, আপনারা সকলে মেদিনীপুরের ছেলে। আমাদের গায়ে ক্ষুদিরামের রক্ত, বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনীর রক্ত। আমরা কখনো চুপ করে বসে থাকিনি, আজও থাকবনা।"

তারপর তপন  নিজের পরিকল্পনার কথা জানাল সকলকে। প্রথমে কয়েকজন চমকে উঠল। কয়েকজন ভিমড়ি খেল। কয়েকজন পরিষ্কার বলে দিল তারা দলে থাকবেনা। 

"আমি ব্রাম্ভন সন্তান হয়ে এ কাজ করতে পারব না।" --  জানাল সূর্য মুখুজ্যে। 

"বন্ধুগণ, আপনাদের সকলকেই আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল আজকে এলে আপনাকে দলের সঙ্গেই থাকতে হবে। কারণ আমাদের অত্যন্ত সবাধানী হতে হবে। আপনারা দলে না থাকতে চাইলে বাইরে গিয়ে সবাইকে বলে দিতে পারেন।  আমরা সেই ঝুঁকি নিতে পারবনা। তাই দেশের স্বার্থে  আপনাদেরকে আর বেঁচে থাকতে দেওয়া যাবেনা। এবং..." 

"না।"  এবার চমকে উথল সূর্য। 

অবশেষে কুড়িজনই একমত হল। এরপর  একদিন পরিকল্পনা মাফিক মেদিনীপুর থানার সামনে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকল তপনের দল। পুলিশের গাড়ি করে বাড়ি ফিরছিলেন সুপার গিবসন, ইন্সপেক্টর রায় ও দুজন কনস্টেবল। গাড়ির চাকা আগে থেকেই পাল্টে দেওয়া ছিল। মিনিট কয়েকের মধ্যেই চাকা ফেটে গাছে ধাক্কা মারল গাড়ী। রায় তৎক্ষণাৎ মারা গেলেন। গিবসন ও দুই কনস্টেবল বেরিয়ে আসা মাত্রই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তপনের দল। তাঁদের আয়ু বেশিক্ষণ থাকলনা। 

"তপনদা, এরা বাঙালি মনে হচ্ছে। এদের অন্তত ছেড়ে দাও।"

"কি লাভ?" 

সূর্য আর প্রশ্ন করতে পারেনি। 

পরেরদিন যখন নন্দীগ্রামের বহু পরিবার অনাহারে প্রায় মরতে বসেছে, তাদের কাছে খাদ্য নিয়ে গেল তপনরা। ভাত খুব বেশী জোগাড় করতে পারেনি। তবে প্রচুর মাংস। অনাহারে জীর্ণ, কঙ্কালসার মানুষগুলি  যেন জন্তুর মত খেতে লাগল। তপনের চোখে জল। 

সেই সময় মোট ৫০ জন মত পুলিশকর্মী মেদিনীপুরে গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন। কোন বিপ্লবী দল তাদের মারছে কিনা বোঝার জন্য কলকাতা থেকে সি আই ডির এক পুলিশ আসেন। পরে তাঁকেও পাওয়া যায়না।  

একদিন সিধু তপনকে প্রশ্ন করে -- "তপনদা, এটা অন্যায় হচ্ছে না?" 

"মানুষ বাঁচলে তবে তো ন্যায়। মনে রাখিস, সবার আগে  বেঁচে থাকা।" 


Thursday, December 17, 2020

মফঃস্বলের প্রেম -- ৩

 ট্রেন থেকে নেমে আস্তে আস্তে হেঁটে ওভারব্রিজের কাছে এলেন অভয়বাবু। বহুদিন পরে এলেন। আগে হলে তরতরিয়ে উঠে যেতেন। এখন আর পারবেন না। এক ধার ধরে ধীরে ধীরে ওঠাই শ্রেয়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। আজ আকাশ ফরসা। বর্ষা শেষ। ক'দিন বাদেই পুজো। কলকাতার রাস্তাঘাটে পুজোর বাজারের ভিড়। এই মফঃস্বলে কি অবস্থা কে জানে? 

সুবিনয় ছাড়া আর কোন বন্ধু এখানে থাকে না। সুবিনয় নিজের পারিবারিক ব্যবসা সামলাচ্ছে। বলেই দিয়েছে -- "স্টেশনে নেমে রিক্সাকে বলিস ইন্ডিয়ান সিল্ক হাউজ। ঠিক নিয়ে এসবে। দোকানের পাশেই বাড়ি। আমি তোকে নিয়ে যাব। তবে তুই সকালে আয়। বয়স হয়েছে। রাতে অসুবিধা হবে না?"

"না  না, চিন্তা করিসনা। ঠিক পৌঁছে যাব।"

আসলে সকালে যে আসতে পারতেন না তা নয়। সকালে তেমন কাজ ছিলনা। কিন্তু তিনি এই সন্ধ্যাবেলাই আসতে চেয়েছিলেন। তিনি তো সন্ধ্যাবেলাই আসতেন। কলেজে ক্লাস না থাকলে দুপুরের দিকে বাসে চড়ে সোজা হাওড়া স্টেশন। তারপর ট্রেনে নিজের বাড়ির স্টেশন আসতে আসতে সন্ধ্যা নামত। তখন মোবাইল ছিল না। রওয়ানা হওয়ার আগে শুক্রবার বিকেলে বাস স্ট্যান্ডের পাশের বুথ থেকে ফোন করে দিতেন। 

ট্রেন থেকে নেমে যখন ওভারব্রিজে উঠতেন, তখন আকাশে  আলো নেই। কিন্তু তাঁর জন্য মুখ আলো করে দাঁড়িয়ে থাকতেন আলোদেবী। আলো রায়। পাশের পাড়ায় বাড়ি। তখনো ক্লাস টুয়েলভে পড়েন। সারাদিন ক্লাস, বাস জার্নি, ট্রেন জার্নির ক্লান্তি এক নিমেষে মুছে যেত অভয়বাবুর। 

আলোদেবী লেবু লজেন্স খুব ভালোবাসতেন। তাই ট্রেনে কিনে রাখতেন অভয়বাবু। ওভারব্রিজে উঠেই সেই  প্যাকেটটি হস্তরান্ত হত। একসাথে হাঁটতেন দু'জনে স্টেশনের বাইরে রাখা সাইকেল স্ট্যান্ড অবধি। মনে আছে আজও হাত ধরতেন না। পাছে কেউ দেখে ফেলে। কিছু বলে। কেউ শোনে। যদি আর  দেখা না হয়। 

সাইকেল নিয়ে দুজনেই চলে আসতেন বিলুদার দোকানে। এই দোকানে জোড়ায় জোড়ায় কপোত কপোতী আসত। তাই তাঁদের আলাদা করে চিনতে পারা  শক্ত। দুজনে দুটো এগ রোল নিয়ে বসতেন। মনে পড়ে সেই দিনটার কথা, যেদিন তিনি এক অন্য স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন -- 

"জানো, জয়েন্ট নিয়ে খুব চিন্তায় থাকি। যদি না পাই, তোমার মত ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবনা।"

"কেন পাবে না? তুমি তো সুধীনবাবুর কাছে অঙ্ক করছ। উনি যখন বলেছেন তুমি পাবে,  তখন পাবেই। আরে তুমি গার্লস স্কুলের সেকেন্ড। তুমি পাবে না?"

"যদি না পাই?"

"পরের বছর চেষ্টা করবে। তোমার যখন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে, নিশ্চয় হবে।"

"কে জানে। দেখি।"

"দেখো তুমি ইঞ্জিনিয়ার হলে না আমরা দুজনে একই কোম্পানিতে চাকরি করব। তারপর অনসাইটে যাব।"

"সেটা কি?"

"আরে আমিও নতুন শিখলাম। অনসাইট মানে হচ্ছে বিদেশ যাওয়া। জান আমার ইচ্ছে আমরা প্যারিস যাব। আইফেল  টাওয়ারের ছবি দেখেছ তো?"

"না  বাবা,  আমি অত দূরে যাব  না। আমি বলে আজ পর্যন্ত কলকাতাই গেছি জীবনে একবার। ওখানে গিয়ে পড়তে হবে শুনলেই  ভয় করে। আমি প্যারিস যাব না। তার চেয়ে বরং দেখো না, এখানেই যদি কোন চাকরি পাওয়া যায়, আমরা রোজ অফিসের পর বিকেলে বিলুদার দোকানে রোল খেয়ে ঐ অজয়ের  ধারে গিয়ে  বসব।" 

"ধুর, কোথায় আইফেল আর কোথায় অজয়!!"

"আমার এই ভালো লাগে জানো, এই রিক্সা, সাইকেল, বিলুদার দোকান,  অজয় নদী, তোমার পাশে থাকা।" 


বিলুদা আজ বহুদিন মারা গেছেন। গতবছর স্ত্রীর মৃত্যুর পর অভয়বাবু বুঝতে পারলেন আস্তে আস্তে তার স্মৃতি হারিয়ে যাওয়া শুরু হয়েছে। অনেক ঘটনাই মনে পড়ে না। পাছে এই ওভারব্রিজের ঘটনাগুলি ভুলে যান, তাই তড়িঘড়ি করে এলেন এতদিন বাদে। যদি কিছু মনে পড়ে। এরম করে আস্তে আস্তে তো সারা জীবনটাই একদিন ভুলে যাবেন। 

অনেকক্ষণ  ওভারব্রিজের উপর ধীরে ধীরে হাঁটলেন অভয়বাবু। কেউ কেউ ধাক্কা মারল। "একটু সরুন দাদু" থেকে "এক্সকিউজ মি", সবই শুনলেন।  তবু কিছুতেই মনে পড়লনা। অথচ খবরটা শুনে এই ওভারব্রিজেই এসেছিলেন অভয়বাবু, সেটা মনে আছে। আলোদেবী বিয়ের পর ঘাটশিলা না বালুরঘাট কোথায় গিয়েছিলেন, একদম মনে পড়ল না।