আয সকাল থেকেই দিনটা খারাপ যাচ্ছে সন্তুর। সকালে মা রোজ তাকে এক গ্লাস দুধ খাওয়ান। দুধটা যে খেতে খুব একটা ভালো লাগে তা না, কিন্তু ইদানীং মা তাতে চকোলেট ফ্লেভারের একটি মিক্স দেন বলে, সেটি খেতে অতি উত্তম হয়। আজকেও সকালে মনের আনন্দে সেই চকোলেট রঙের দুধ পান করতে যাচ্ছিল সন্তু, এই সময় তার দুধে এসে পড়ে একটা মাছি। অতএব দুধ খাওয়া মাঠে মারা গেল।
স্কুলে যাওয়ার সময় দত্তপাড়া কালীমন্দিরের সামনে তার সাইকেলের চেনটা পড়ল। যা হয়, হাতে কালি মেখে স্কুলে ঢুকতে হল। জামাতেও একটু কালির দাগ পড়েছিল। সুযোগ বুঝে ভূগোল স্যার নৃপতিবাবু দুটো কথাও শুনিয়ে দিলেন। পরের পিরিয়ডে বাংলা ক্লাসে বই আনেনি বলে কান ধরে বসে থাকতে হল সন্তুকে। রোজ মনে করে বইটা নিয়ে আসে সন্তু। আজকে যে কীভাবে ভুলল সেই জানে!! বলছি না, দিনটাই খারাপ!!
টিফিনের সময় দিন আরো খারাপ গেল। কালি মাখা হাতে টিফিন খাওয়া যায়না, তাই বাথরুমে হাত ধুতে গিয়েছিল সন্তু। ফিরে এসে দেখে তার টিফিন বক্স হাওয়া। আজকে টিফিন আনতে ভুলে গেছে নাকি? খেয়াল হতেই ব্যাগের ভিতরটা খুঁজতে লাগল সে। একটু বাদেই অবশ্য চোখ গেল সামনে স্যারের টেবিলে রাখা তার খালি টিফিন বক্সটা। মানে বক্সটা বন্ধই ছিল। সন্তু গিয়ে সেটা খুলেই বুঝতে পেল ভিতরে কিচ্ছু নেই। সে যখন হাত ধুতে গেছে, তখনি এই কাণ্ড। নির্ঘাত রবির কাজ এটা। অনেকদিন ধরেই সন্তুর টিফিনের জন্য ওঁত পেতে থাকে রবি। এবার মাথা গরম হয়ে গেল সন্তুর। ছুটে গিয়ে রবিকে ধাক্কা দিল। রবিও ছাড়বার পাত্র নয়। শুরু হয়ে গেল শুম্ভ নিশুম্ভের লড়াই। মাঝে অঙ্ক স্যার অমিয়বাবু সেটি দেখে ফেলে দুজনকে আলাদা করেন। তারপর হেডস্যারের কাছে নিয়ে যান। কোন প্রমাণ ছাড়া সন্তু রবিকে আক্রমণ করেছে। তাই সন্তুকে সেদিনের মত স্কুল থেকে বার করে দিলেন হেডস্যার। পরেরদিন বাবাকে নিয়ে আসতে হবে।
এখন বাড়ি গেলে মায়ের রোষের মুখে পড়বে সন্তু। বাবা বাড়ি ফিরতে দেরী আছে। বাবা অতটা মারেন না তাকে। তাই বাবা ফেরার পর বাড়ি ঢোকাই মঙ্গল। কিন্তু এই সময়টা কি করবে সন্তু? তাদের পাড়ার কাছেই হাইওয়ে। সাইকেলটা নিয়ে হাইওয়ের ধারে এলো সে। এখানে একটা বড় বটগাছ আছে। তার ছায়ায় বসে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগল সন্তু। এই হাইওয়েটা খুব ভয়ঙ্কর। ভীষণ জোরে গাড়ি যায়। তাই বাবা তাকে বার বার বারণ করেছেন এই হাইওয়ের কাছে যেতে। সবচেয়ে বেশী ভয় করে লরিগুলিকে। তবু বাড়ির কাউকে না জানিয়ে মাঝে মাঝেই এই হাইওয়ের ধারে এসে বসে সন্তু। কত লোক দেখা যায়। উল্টোদিকে একটি চায়ের গুমটি। সেখানে কত লোক খেতে আসে। কারুর হাতে বড় ব্যাগ। কারুর সঙ্গে বাঁধা ছাগল। সন্তুর বেশ লাগে। আচ্ছা এই যে রাস্তাটা, এটা কতদূর গেছে? কলকাতা? দিল্লী? বম্বে? মাদ্রাজ? নাকি আরো দূর!! লন্ডন? প্যারিস? বাবাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। বড় হলে সন্তুও এরকম রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাবে। অনেক দূর দূর যাবে।
এই সময় আচমকা একটি গাড়ি এসে থামল সন্তুর সামনে। দুধ সাদা একটা আম্ব্যাসাডর। গাড়ির সামনের জানালা দিয়ে ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল
-- এই যে খোকা, এটা কি দয়ালপুর?
-- না এটা তো খনা। সামনেই স্টেশন পাবেন।
-- ওহ খনা, তাহলে কাছেই আছি।
এই বলে ড্রাইভার ভদ্রলোক গাড়ি চালু করছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে পিছনে বসে থাকা ব্যাক্তিকে দেখে ফেলেছে সন্তু। শুধু দেখেছে না, চিনেও ফেলেছে। আরে ইনি যে শচীন। আনন্দে কিছু না ভেবেই চিৎকার করে উঠল সন্তু
-- শচীন, শচীন।
ড্রাইভার গাড়ি থামালেন। পিছনের জানালা খুলে গেল। এবার জানালা দিয়ে বেরিয়ে এলো একটি হাত।
-- হাই।
ছুটে গিয়ে সে হাত ধরল সন্তু। তার ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল
-- আই এম বিগ ফ্যান।
-- থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ ফর হেল্পিং আস উইথ দ্য ডিরেকশন। গড ব্লেস ইউ।
এবার হাত ছাড়িয়ে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালেন বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার। জানালার কাঁচ আসতে আসতে বন্ধ হয়ে গেল। গাড়িটিও গা ঝাড়া দিয়ে চলতে লাগল। যতক্ষণ গাড়িটি দেখা গেল, সন্তু হাত নেড়ে গেল।
সন্তু সেদিন বাড়িতে প্রচণ্ড বকা খেল। আজকে বাবাও ছাড়লেন না। ভুলের মধ্যে সন্তু বলে ফেলেছিল শচীনের সঙ্গে দেখা করার কথাটি। বাবা বিশ্বাস তো করলেনই না, উল্টে সন্তু কেন হাইওয়ের ধারে গিয়েছিল তাই নিয়ে বকা খেল। পরেরদিন স্কুলের বন্ধুদের সবাইকে বলল সন্তু। প্রথম প্রথম দু- একজন বিশ্বাস করলেও বাংলার স্যার নির্মলবাবু -- "বাহ সন্তু, তুমি তো খুব গুছিয়ে গল্প বলতে পারো। বড় হয়ে শরৎচন্দ্র হবে?"
বলায় সমস্ত ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়েছিল। চোখ ফেটে কান্না এল সন্তুর। নাহ, আর কাউকে বলবে না সন্তু এই কথাটি।
আজ বহুবছর বাদে ছেলের জন্য রচনা লিখতে বসলেন তন্ময়বাবু ওরফে সন্তু। রচনার বিষয় -- "জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন"। লিখতে বসেই সেই বহুবছর আগের দিনটির কথা মনে পড়ে গেল। আচ্ছা, সত্যি কি সেদিন শচীনকে দেখেছিলেন তিনি?