Tuesday, February 13, 2018

মধুসূদনপুরের জমিদারবাড়ি


"যাহ, কি যে বলিস? ওমনি ভূত এসে গেল।"
"আরে বলছি ওখানে ভূত আছে।"
"তোরা শালা গাঁইয়াই রয়ে গেলি।"
"কি এমন তুই শহুরে রে, থাকিস তো বর্ধমানে?"
"তাও ভালো। তোদের এই মধুসূদনপুরের মত ভূতের গল্প বানাই না।"
পলাশের দিদির বিয়েতে আমরা এসেছি মধুসূদনপুরে। হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনে পরিচিত স্টেশন। আমরা মানে আমি, তন্ময় আর রজত। আমরা চারজন বর্ধমান রাজ কলেজে ফিজিক্স অনার্স পড়ি। আমার আর রজতের বাড়ি বর্ধমানে। তন্ময় থাকে গুসকরায়। আর পলাশ -- আগেই বলেছি। এই মধুসূদনপুরে। বিয়ে বাড়ি মিটে যাওয়ার পরও আমরা ঠিক করলাম ২-৩ দিন থেকে যাবো। এই সময় কলেজ বন্ধ। তাই আজ সন্ধ্যেবেলা পলাশদের বারান্দায় বসে মুড়ি চানাচুর খেতে খেতে আড্ডা হচ্ছিল।
"আরে বলছি শোন, জমিদারি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও জমিদারবাবুর বড় ছেলে সূর্যকান্তবাবু সপরিবারে ঐ বাড়িতে থাকত। একদিন সকালে তাঁকে সপরিবারে মৃত দেখা যায় ঐ বাড়ির মধ্যে।"
"সপরিবারে মৃত মানে?"
"মানে সূর্যকান্ত বাবু, তাঁর স্ত্রী রত্নাদেবী আর তঁদের ১০ বছরের মেয়েকে দেখা যায় বিষ খেয়ে মৃত।"
"আরে দেখা যায় মানে কি? কেউ বিষ খেতে দেখেছে?"
"না তা নয়, তবে পরে ময়না তদন্তে তাই বেরোয়। এই ঘটনার ক'দিন আগে থেকেই ঐ বাড়িতে এক তান্ত্রিক এসে থাকত। পুলিশ তাকেই সন্দেহ করে, কিন্তু তার খোঁজ পাওয়া যায়না।"
"কিছু চুরি গেছিল?"
"নাহ, সেটা অবশ্য আমি জানি না। আসলে এই সব ঘটনা তো বহু আগের। আমি বাবা কাকাদের মুখে যা শুনেছি।"
"তা ভূত এলো কোথা থেকে?"
"আরে ঐ বাড়িতে কেউ রাত কাটাতে পারে না। কতজন গেছে, কেউ ফেরেনি?"
"সবাই মারা গেছে?"
"আরে না, কারুর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।"
"মানে? ভ্যানিশ?"
"হ্যাঁ।"
জেদের মাথায় ঠিক করে ফেললাম পরেরদিন রাত্রে আমি একাই ঐ বাড়িতে কাটাবো। তন্ময় বা রজতের সাহস হল না। পলাশ তো বলাই বাহুল্য। ঠিক করা হল পলাশের মা-বাবাকে বলা হবে না। তাহলে ওঁরা হয়ত রাজি হবেন না।
সবাই শুয়ে পড়লে আমরা চুপি চুপি বেরোলাম। জমিদারবাড়ি সকালে একবার দেখে গেছি। পাঁচিল দেওয়া বিশাল জায়গা। মাঝে একটা দীঘিও আছে। যদিও পর্যবেক্ষণের অভাবে দীঘিটি পাঁকে ভর্তি। একটা পানকৌড়ি ছাড়া কিছুই দেখলাম না। ঘরগুলোতেও ধুলো ভর্তি। সকালেই আমরা একটা ঘর সাফ করে রেখেছি।
বিছানা তোষক পেতে, লন্ঠন জ্বালিয়ে পাশে জলের বোতল রাখল তন্ময়।
"এখনো ভেবে দেখ। থাকবি?"
"তুই থাক না একসাথে?"
"নাহ ভাই। কাল সকালে আসব আমরা।"
"হ্যাঁ কথা দিচ্ছি হারিয়ে যাব না, কিছু না হোক অনাথবাবুর মত দাঁতন করতে করতে আসব।"
ওরা চলে গেল। ব্যাগ থেকে একটা গল্পের বই বার করে পড়তে লাগলাম। খানিক্ষণ পড়তে পড়তেই চোখ জুড়িয়ে এল। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। ঘুম ভেঙ্গে গেল গরমে। এতো গরম কেন ঘরটা? আগুন জ্বলছে কোথাও? না তো। এটা ডিসেম্বর মাস, এত গরম তো হবে না। যখন ঘরে এসেছিলাম তখনো এত গরম ছিল না।
শালটা জড়িয়ে বাইরে বেরোলাম। দূরে একটা ট্রেন যাওয়ার আওয়াজ পেলাম। কোথাও একতা তক্ষক ডাকছে। একটা সিগারেট ধরালাম। ক'দিন পলাশদের বাড়িতে খাওয়া হয়নি।
ঘুমটা কেটে গেছে। এবার খেয়াল করলাম কেন আমার রাত থেকেই এই বাড়িটা অদ্ভুত লাগছে। সারা মধুসূদনপুরে যেখানে মশার দৌরাত্ম্য, এই বাড়িতে একটাও মশা নেই!!
এবার চোখ গেল দীঘিটার দিকে। একটা ঠান্ডা হাওয়া আসছে যেন। আরে এখন তো একটা না, দু-দুটো পানকৌড়ি। দীঘির জলটাও একটু পরিষ্কার লাগছে না? কাছে গেলাম। না, শ্যাওলা তো উল্টোদিকে, এই দিকটা একদমই পরিষ্কার। সিগারেটটা প্রায় শেষ হয়ে আসছে। যাই একটু দীঘির ধারে গিয়ে বসি। আজকে আকাশটাও বেশ পরিষ্কার। প্রচুর তারা দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু এই বাড়ির চারপাশে কি গরম!! শুধু যে ঘরের মধ্যে তা নয়, বাইরেও বেশ গরম। দীঘির ঠান্ডা জলের হাওয়া ছাড়া তেমন হাওয়াও নেই। বাইরে গাছের পাতাও নড়ছে না। একটু পা ডোবালে কেমন হয়?
আহ কি আরাম, এই গরমে দীঘির জল পায়ে লাগতে যেন শান্তি হল। আচ্ছা সাঁতার কাটলে কেমন হয়? রাতে যদিও কোনদিন সাঁতার কাটিনি, কিন্তু এইটুকু তো দীঘি, কি আর হবে। একটা গামছাও ব্যাগে আছে।
জামাকাপড় ছেড়ে নেমে পড়লাম দীঘিতে। কি অসাধারণ ঠান্ডা, আরামের জল। এই জল গায়ে লাগতেই মনে হল প্রাণ যেন জুড়িয়ে গেল। উঠব? নাহ, উঠে কি হবে? এই আরাম কি আর পাব? আমি দীঘির জলে আরো তলিয়ে যেতে লাগলাম......