Friday, September 20, 2019

বিবর্তন

রামহরিপুর বাজারের "মা কালী মেডিকো"-র মালিক জীবনবাবু। মালিক বলতে ভাববেন না তাঁর নিজের বানানো ব্যবসা। দোকানটি আদপে জীবনবাবুর বাবা শ্যামল সেনগুপ্তর। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে দোকানের ভার জীবনবাবুর। তা দোকান মন্দ চলে না। এই অঞ্চলে সবচেয়ে নামকরা ওষুধের দোকান ঐটি। জীবনবাবু রোজ সকাল আটটার মধ্যে এসে দোকান খুলে দেন। দুপুরে ঘণ্টা খানেকের জন্য বাড়ি যান আহার করতে। আবার সন্ধ্যে সাত্টা বাজলেই দোকানের ঝাঁপ ফেলেন। তাঁর বাড়ি কাছেই। সাইকেলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যান। বাড়ি ফিরে সন্ধ্যে সাতটার খবরের খেলার অংশটুকু শুনতে পান। জীবনবাবুর সাদামাটা জীবন। এটি সাদামাটা যে রাতে স্বপ্নও দেখেন না।

একদম নিপাট ভালোমানুষ বলতে যা বোঝায় জীবনবাবু তাই। কারুর সঙ্গে ঝগড়া করেন না। কেউ খারাপ কথা বললে বা অপমান করলেও "থাক কী হবে ঝগড়া করে" ভেবে চুপ করে থাকেন। এমনকি হাতে কোন মশা এলেও তাকে না মেরে ফু দিয়ে ওড়ানোর চেষ্টা করেন। তাঁর স্ত্রী দীপা কিন্তু তাঁর এই চুপচাপ থাকা একেবারেই ভালোভাবে নেন না। হরদম বাড়িতেও কথা শুনতে হয় জীবনবাবুকে। তিনি যে অপদার্থ, তাঁর যে শিরদাঁড়া নেই,  তিনি ভিতু একথা শুনে শুনে কান পচে গেল। সোজা কথায় তাঁদের দাম্পত্য জীবন খুব একটা সুখের না। তাই সই।

জীবনবাবুর জীবন হয়ত এভাবেই চলত যদি না সেদিন ভোলা ঐ মশাটাকে মারত। ভোলা দোকানে কর্মচারী। তখন সবে সন্ধ্যা হবে হবে। ভোলা কচ্ছপ ধূপ জ্বালায়নি। একটি মশা এসে জীবনবাবুর হাতে বসল। জীবনবাবু হয়ত ফু দিতেন, কিন্তু তার আগেই ভোলা এসে এক থাপ্পড়ে মশাটাকে মেরে ফেলল। মশাটি বোধহয় প্রচুর রক্ত খেয়েছিল। বেশ খানিকটা রক্ত জীবনবাবুর হাতে লেগে রইল।

এরপর পর পর দশদিন জীবনবাবু রোজ একটি করে মশা মারলেন। রামহরিপুরে মশার অভাব নেই। কাজেই এটা অসম্ভব কিছু না। জীবনবাবুর প্রথম প্রথম মনে খিঁচ খিঁচ করত। আহা কেন মারলেন! মশাই তো। প্রাণ আছে। কিন্তু এর সঙ্গে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটতে লাগল যা জীবনবাবুর মন পাল্টে দিল। রোজ মশা মারার পর তাঁর জীবনে ভালো কিছু ঘটতে লাগল। যেমন একদিন তার মাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হল। জীবনবাবু বহুদিন লটারির টিকিট কাটেন। কোনদিন কিছু জোটে না কপালে। একদিন খবর পেলেন তিনি লটারিতে একটা হাতঘড়ি জিতেছেন। প্রথম প্রথম জীবনবাবু বুঝতে পারেননি। আস্তে আস্তে বুঝলেন, অবাক হলেন আর মেনে নিলেন।

এর মধ্যে এক কেলেঙ্কারি হল। রামহরিপুরের এম এল এ-র ছেলের গাড়ির আঘাতে মুদির দোকানি বিমলের পা ভাঙল। এম এল এ ফিরেও তাকালেন না। তখন রমহরিপুর ব্যবসায়ী সঙ্ঘের সকলে মিলে এর প্রতিবাদে আন্দোলন করলেন। আজকাল জীবনবাবুর মনে সাহস বেড়েছে। তিনি আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন। যদিও আন্দোলন করে বিমলের কোন লাভ হলনা। এম এল এ একই রকম নিঃস্পৃহ থাকলেন। ব্যবসায়ীরা আবার দোকান খুললেন। লাভ হল বিরোধীপক্ষের প্রধান শ্যামলবাবুর। পরের ইলেকশনে উনি রামহরিপুর থেকে জিতলেন।

ইদানীং পাড়ায় একটা বিড়ালের উৎপাত শুরু হয়েছে। রোজ ভোর রাতে বিড়ালটির চিৎকারে জীবনবাবুর ঘুম ভাঙ্গে। একদিন জীবনবাবু ঠিক করলেন এভাবে আর চলছে না। এর হেস্ত নেস্ত করতে হবে। ভোর রাতে এলার্ম দিয়ে ঘুম থেকে উঠলেন। তিনি আর দীপাদেবী আলাদা শোন বহুদিন থেকেই। কাজেই বাড়ির আর কেউ বুঝতেও পারলনা। ফ্রিজ থেকে এক টুকরো মাছ বের করলেন। কাল দোকান থেকে আনা শিশিটা পুরো খালি করে দিলেন। মাছ ভর্তি পাত্রটি রেখে এলেন বাড়ির বাইরে। আধ ঘণ্টা বাদে বাইরে এসে বিড়ালটির নিথর দেহ দেখে জীবনবাবুর মনে এক অদ্ভুত প্রশান্ত ভাব এল। জীবনবাবু একটি কালো থলেতে বিড়ালটিকে ভরে সাইকেলে করে রেল লাইনের ধারে বড় ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে এলেন। সাইকেল স্ট্যান্ড করে যখন বাড়ি ঢুকলেন তখনও সুর্য ওঠেনি।

সেদিন দুপুরে দোকানে বসে আছেন জীবনবাবু। এই খানিকক্ষণ আগে খেয়ে এসেছেন। দোকানের ফোন বেজে উঠল।

"জীবনবাবু, ভালো আছেন? আমি শ্যামল চক্রবর্তী বলছি।"
"হ্যাঁ এম এল এ সাহেব, বলুন।"
"তেমন কিছু না, ঐ এবারের ব্যাবসায়ী সঙ্ঘের সভাপতি হিসেবে আমাদের পার্টি কিন্তু আপনাকেই ভাবছে।"
"আমি?"
"কেন নয়? যেভাবে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাতে আমরা মনে করি আগামী দিনে আপনি আমাদের পার্টির একজন নামকরা নেতা হতে পারবেন। না করবেন না প্লিজ।"

সভাপতি হওয়ার পর ধীরে ধীরে পার্টি অফিসে যাতায়াত বাড়ল জীবনবাবুর। অবস্থাও ভালো হতে শুরু করল। বাড়িটা তিনতলা করলেন। একটা মারুতি গাড়িও কিনলেন। যা মনে হচ্ছে সামনের বছর মিউনিসিপালটি নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হলেও হতে পারেন। কিন্তু এর সঙ্গে পালটালো জীবনবাবুর জীবনযাপন। মদটা কোনদিন খেতেন না। আজকাল প্রায়ই শ্যামালবাবুর সঙ্গে সুরাপান করেন। পার্টির আর এক নেত্রী কমলিকাদেবীর সঞেও জীবনবাবুর ঘনিস্টতা বাড়ল। দুর্জনে নানান কথা বলতে লাগল। কিছু সত্যি, কিছু সত্যি হলে হয়ত ভালোই লাগত জীবনবাবুর।

এর মধ্যে এক সন্ধ্যায় জীবনবাবুকে একা ঘরে কিছু বললেন কমলিকাদেবী। জীবনবাবু উত্তর দিলেন -- "দেখি।"

এক সপ্তাহ বাদে গাড়ি করে বাপের বাড়ি শিউড়ি যাওয়ার পথে এক্সিডেন্টে প্রাণ হারালেন দীপাদেবী। দুর্জনে অনেক কিছু বললেও সুজনে বলল -- "জীবনবাবুর মত মানুষ হয়না। স্ত্রীকে কি ভালোবাসতেন ভাবো। কান্নায় ভেঙ্গে পড়া মানুষটা কিন্তু সবার কথা ভাবেন। ড্রাইভারের ছেলের সারা জীবনের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিলেন। কজন হয় এরকম?"

সেদিন রাত্রে আবার ফোন এল শ্যামলবাবুর। মিউনিসিপালটি নির্বাচনে জীবনবাবু প্রার্থী। রাতে শুয়ে একটু অস্বস্তি লাগছিল জীবনবাবুর। আলাদা শুলেও বাড়িতে একটা লোক তো ছিল। আজ তিনি একা। অবশ্য এটা হয়ত সাময়িক।

সেদিন রাতে স্বপ্ন দেখলেন জীবনবাবু। স্বপ্নে দেখলেন মিউনিসিপালটির দরজার কাছে একটা মস্ত ডাস্টবিন। তার মধ্যে থেকে একটি বেড়াল তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছে। হেসেই চলেছে। হেসেই চলেছে।