Wednesday, October 10, 2018

স্মৃতি

ট্রেনটা যখন হাওড়া স্টেশন থেকে গা ঝাড়া দিয়ে বেরোলো, তখন কামরায় রতনবাবু একা নন। তবে লোক খুব বেশি নেই। বেশ ফাঁকা ফাঁকা কামরা। তাঁর সিটের উল্টোদিকে এক বয়স্ক ব্যক্তি বসে। ধুতি পাঞ্জাবী পরিহিত। বেশ নোংরা জামাকাপড়। হয় ঠিক মত পরিষ্কার করেননা, অথবা সারাদিনের ধকল গেছে। ভদ্রলোকের সঙ্গে একটা চটের বড় থলে। তিনজনের সিটে তিনি একা। ওপাশের একদিকে এক মা-ছেলে বসে। ছেলেটির বয়স বড়জোর সাত-আট হবে। ছেলেটি বসে বসে এক মনে বই পড়ছে। কি বই কে জানে। তাঁদের উল্টোদিকে দুজন ছেলে। কলেজে পড়ে বোধহয়। ছুটিতে বাড়ি ফিরছে।

লোকাল ট্রেনের কামরা। বাদামী রঙের সিট। জানালার রেলিং-এ জং ধরেছে। দেওয়ালে লেখা "রেলের সম্পত্তি আপনার সম্পত্তি"। পড়ে হাসলেন রতনবাবু। তিনি যখন ছোট ছিলেন, প্রায়ই খবর আসত ট্রেনের পাখা, জানালার পাল্লা, এসব নাকি কেউ চুরি করেছে। একদিন তাঁর বাবা বলেছিলেন --

"আসলে কি বলতো, লেখা থাকে না, রেলের সম্পত্তি আপনার সম্পত্তি? লোকে ভাবে আমার সম্পত্তি তো এখানে কেন, বাড়ি নিয়ে যাই।"

হাওড়া পার করে ট্রেনটা কারশেডের পাশ দিয়ে চলল। এই ট্রেনের নিত্যযাত্রীরা এখানটাকে "হালুয়া" বলে -- মানে, হাওড়া আর লিলুয়ার মাঝে। অনেক আপ ট্রেনই এখানে থামে। কেউ কেউ এখানেই নেমে যান।

লিলুয়া এলে রতনবাবু এক কাপ চা কিনলেন। পার্স খুলে চায়ের দাম দিতে গিয়ে দেখলেন সেই ছোটবেলার একটা দুটাকার নোট। ভারতবর্ষের এক কৃত্রিম উপগ্রহের ছবি দেওয়া।  ঐ নোটটা চাওলাকে দিয়ে চা খেতে লাগলেন। লিলুয়া থেকে একটি ছেলে উঠল। ছেলেটি তাঁর পাশেই বসল। পরনে স্কুল ইউনিফর্ম।

"কোন স্কুল তোমার?"
"ডন বস্কো, লিলুয়া।"
"কোন ক্লাস?"
"ক্লাস সেভেন।"
"বাড়ি কোথায়?"
"মধুসূদনপুর।"

ছেলেটার সঙ্গে আলাপ জমে গেল। ছেলেটির বাবা ডাক্তার। পড়াশুনোয় ভাল ছেলেটি। ক্লাসে প্রথম তিনজনের মধ্যেই থাকে নিয়মিত। বই পড়তে ভালোবাসে। প্রিয় লেখক অনিল ভৌমিক। শুকতারা নেয় প্রতি মাসে। গর্ব করে বলল

"জানেন, দাদুমনি আমার চিঠি ছেপেছিলেন।"
"বাহ, তুমি খেলাধুলা কর না?"
"করি তো। ক্রিকেট খেলি।"
"বাহ, ব্যাটসম্যান না বোলার?"
"বোলার। কপিল দেবের মত।"

রতনবাবু বুঝলেন ছেলেটির প্রিয় খেলোয়াড় কপিল।

"তোমার আর কি ভালো লাগে?"
 "আমার খুব ছবি আঁকতে ভালো লাগে।"
"কিসের ছবি?"
"এই জায়গার। পাহাড়, সমুদ্র, মাঠ।"
"তুমি সমুদ্র দেখেছ?"
"না, বাবা বলে প্রতিবার পুরী নিয়ে যাবে। যাওয়া আর হয়না। বইয়ে ছবি দেখেছি। আপনি দেখেছেন?"
"হ্যাঁ, তা দেখেছি।"
"ছবি এঁকেছেন?"
"না, আমি তো ভালো আঁকতে পারিনা।"

মধুসূদনপুরে ছেলেটি নামা অবধি রতনবাবু ওর সাথেই গল্প করে গেলেন। জনাই-এ এক ঝালমুড়ি ওয়ালা উঠেছিল। তিনি ছেলেটিকে ঝালমুড়ি কিনে দিলেন। নিজেও খেলেন। ছেলেটি খেতে চায়নি।

"বাবা বলেছেন, ট্রেনে অপরিচিত কারুর থেকে কিছু না খেতে।"
"সেটা তোমার বাবা ঠিকই বলেছেন। তবে কিনা, এটা তো কেনা ঝালমুড়ি। তুমি নিজেও পয়সা দিয়ে খেলে একই হত।"

ট্রেন নবগ্রাম পেরোতেই আকাশ অন্ধকার হতে শুরু করল। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকলেন রতনবাবু। একটা ছেলে একদল গোরু চরিয়ে বাড়ি ফিরছে। ট্রেন লাইনের পাশ দিয়ে একটা লোক গান করতে করতে কোথায় হেঁটে গেল। বোধহয় আংটি চাটুজ্যের ভাই।

ওপাশের বাচ্চা ছেলেটার হাতের বই এবার দেখতে পেলেন রতনবাবু। গোলাপি মলাটের বই। "একের পিঠে দুই"। এখানেই "বোসপুকুরে খুনখারাপি" আছে, মনে পড়ল তাঁর। কলেজের ছেলে দুটো এক মনে কিসব বলে হাসছিল। উল্টোদিকের বয়স্ক মানুষটি ঘুমিয়ে কাদা।

শক্তিগড়ে ট্রেন থামতেই দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন রতনবাবু। নামবেন?

এই সময় তাঁর কাঁধে একটা হাতের ছোঁয়া পেলেন।

"বাবা, অনেকক্ষণ হয়েছে। এবার শুতে যাও।"

চোখ খুলে বুঝতে পারলেন তিনি এখন ক্যালিফোর্নিয়ার মিলপিটাসে। ছেলের বাড়ি। মাথা থেকে যন্ত্রটি খুলে ফেললেন রতনবাবু। এই যন্ত্রটি তাঁর ছেলে কয়েক মাস হল কিনেছে। মাথায় পরলে এটি পুরনো স্মৃতি তুলে এনে নিজের মত গল্প বানিয়ে দেয়। মনে হয় যেন রতনবাবু নিজেই সেই যুগে ফিরে গেছেন। অথচ তাঁর বয়স এখনকার মত।

"চল শুতে যাই, কটা বাজে?"
"রাত বারোটা। তুমি তো খাওয়ার পর থেকেই এই নিয়ে আছো। তাই সময়ের খেয়াল নেই। তা আজ কোথায় গেলে? শক্তিগড় না মধুসূদনপুর?"