Sunday, January 17, 2021

স্বাধীনতা

 এ এক অন্য সময়ের গল্প। যখন বিজন ভট্টাচার্যর নবান্নের চরিত্ররা শহরের পথে ঘাটে ঘুরে বেড়াত। যখন কলকাতার রাস্তায় "ফ্যান দাও" বলে লোকে ডাক দিত। যখন হয়ত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় "কেড়ে খায়নি কেন" লিখছিলেন। যখন স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে হিটলার পরাজয় স্বীকার করছিলেন। যখন চার্চিল সাহেব বার বার ভারতীয়দের মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করেছিলেন, যাতে ইউরোপীয়দের বাঁচানো যায়। যখন প্লুটোনিয়াম তৈরি করতে তামাম মার্কিন দেশের বিজ্ঞানীরা প্রাণপাত পরিশ্রম করছিলেন। 

এমতবস্থায় তমলুক শহরে একদল বাঙালির একদিন সভা বসল। সভাপতি শ্রী তপন সেন। কলকাতায় পড়াশুনো করতে করতে গান্ধীজীর দলে নাম লেখায়। তারপর একদিন গান্ধীজীর আদর্শে তার বিশ্বাস চলে যায়। মনে হয় নেতাজী সুভাষ বোসের দলে নাম লেখাবে। কিন্তু ততদিনে সুভাষবাবু জাপানে। এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই সিঙ্গাপুরে প্রথম স্বাধীন ভারত সরকার গড়ে ওঠে। তপন কিন্তু এই সভায় অন্য কারণে এসেছে। তার দলে আজ গোটা বিশেক বাঙালি ছেলে। সকলেই দেশ স্বাধীন করায় উদগ্রীব। 

"বন্ধুগণ, আজ দেশের অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গিন। একেই আমরা পরাধীন। তার উপর ব্রিটিশ সরকারের নিয়মে দেশে হাজার হাজার মানুষ অনাহারে মরছে। কলকাতার রাস্তাঘাট পুরো শ্মশান। আমাদের গ্রামে গ্রামে লোক মরছে। গান্ধীজীর অহিংসার নীতি কাজ করছে না। ব্রিটিশরা এখন যুদ্ধে ব্যস্ত। ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেবার কথা ওরা কল্পনাও  করতে পারবেনা। নেতাজী সুভাষ বোস  জাপান থেকে চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাও হয়ত সময় লাগবে।"

এবার একটু থামল তপন। একবার চোখ বুলিয়ে নিল সকলের উপর। সবাই এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে।  

"আমাদের এখন প্রথম দায়িত্ব দেশের লোকের ক্ষুধা নিবারণ করা। দেশের লোককে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। লোকে না বাঁচলে দেশ কোনদিন স্বাধীন হবেনা। আপনারা কি এই প্রকল্পে আমার সঙ্গে আছেন? মনে রাখবেন, আপনারা সকলে মেদিনীপুরের ছেলে। আমাদের গায়ে ক্ষুদিরামের রক্ত, বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনীর রক্ত। আমরা কখনো চুপ করে বসে থাকিনি, আজও থাকবনা।"

তারপর তপন  নিজের পরিকল্পনার কথা জানাল সকলকে। প্রথমে কয়েকজন চমকে উঠল। কয়েকজন ভিমড়ি খেল। কয়েকজন পরিষ্কার বলে দিল তারা দলে থাকবেনা। 

"আমি ব্রাম্ভন সন্তান হয়ে এ কাজ করতে পারব না।" --  জানাল সূর্য মুখুজ্যে। 

"বন্ধুগণ, আপনাদের সকলকেই আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল আজকে এলে আপনাকে দলের সঙ্গেই থাকতে হবে। কারণ আমাদের অত্যন্ত সবাধানী হতে হবে। আপনারা দলে না থাকতে চাইলে বাইরে গিয়ে সবাইকে বলে দিতে পারেন।  আমরা সেই ঝুঁকি নিতে পারবনা। তাই দেশের স্বার্থে  আপনাদেরকে আর বেঁচে থাকতে দেওয়া যাবেনা। এবং..." 

"না।"  এবার চমকে উথল সূর্য। 

অবশেষে কুড়িজনই একমত হল। এরপর  একদিন পরিকল্পনা মাফিক মেদিনীপুর থানার সামনে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকল তপনের দল। পুলিশের গাড়ি করে বাড়ি ফিরছিলেন সুপার গিবসন, ইন্সপেক্টর রায় ও দুজন কনস্টেবল। গাড়ির চাকা আগে থেকেই পাল্টে দেওয়া ছিল। মিনিট কয়েকের মধ্যেই চাকা ফেটে গাছে ধাক্কা মারল গাড়ী। রায় তৎক্ষণাৎ মারা গেলেন। গিবসন ও দুই কনস্টেবল বেরিয়ে আসা মাত্রই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তপনের দল। তাঁদের আয়ু বেশিক্ষণ থাকলনা। 

"তপনদা, এরা বাঙালি মনে হচ্ছে। এদের অন্তত ছেড়ে দাও।"

"কি লাভ?" 

সূর্য আর প্রশ্ন করতে পারেনি। 

পরেরদিন যখন নন্দীগ্রামের বহু পরিবার অনাহারে প্রায় মরতে বসেছে, তাদের কাছে খাদ্য নিয়ে গেল তপনরা। ভাত খুব বেশী জোগাড় করতে পারেনি। তবে প্রচুর মাংস। অনাহারে জীর্ণ, কঙ্কালসার মানুষগুলি  যেন জন্তুর মত খেতে লাগল। তপনের চোখে জল। 

সেই সময় মোট ৫০ জন মত পুলিশকর্মী মেদিনীপুরে গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন। কোন বিপ্লবী দল তাদের মারছে কিনা বোঝার জন্য কলকাতা থেকে সি আই ডির এক পুলিশ আসেন। পরে তাঁকেও পাওয়া যায়না।  

একদিন সিধু তপনকে প্রশ্ন করে -- "তপনদা, এটা অন্যায় হচ্ছে না?" 

"মানুষ বাঁচলে তবে তো ন্যায়। মনে রাখিস, সবার আগে  বেঁচে থাকা।"