Monday, March 30, 2020

তৃষ্ণা

মা বাবার সঙ্গে ক'দিন হল এই নতুন শহরে এসেছে রিঙ্কা। নামেই শহর। প্রায় গ্রাম বললেই চলে। পাহাড়ি জায়গা। বাবা এক টিম্বার কোম্পানিতে চাকরি করেন। তাই রিঙ্কারা এখানে এসেছে। কয়েকটা মাত্র কোয়ার্টার। রিঙ্কাদের পিছনে থাকেন  দে বাবুরা। এ ছাড়া হাসানবাবু, কোলেবাবু, শর্মাবাবু এনারা বাকি কয়েকটা বাড়িতে থাকেন। রিঙ্কাদের কলোনি থেকে বেরোলেই একটা ছোট গ্রাম। সেই গ্রামে একটাই স্কুল। রিঙ্কা অনেক ছোট, তাই ঐ স্কুলে যায়না। এখানে এক বছর থেকেই ট্রান্সফার হয়ে যাওয়ার কথা রিঙ্কার বাবার। তাই রিঙ্কাকে স্কুলে ভর্তি করেননি।

এই জায়গাটা ভীষণ নিরিবিলি। সন্ধ্যা হলেই রাস্তায় তেমন লোকজন দেখা যায়না। রিঙ্কার বাবার যদিও সেটা ভালোই লাগে। মাঝে মাঝেই রাত্রিবেলা বারান্দায় বসে থাকেন একা একা। রিঙ্কাকেও ডাকেন। রিঙ্কা এলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।  রিঙ্কার ভালো লাগেনা। রিঙ্কার বাবার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বাবা কিছুতেই কথা বলতে চাননা। একটা দুটো হ্যাঁ হুঁ উত্তর দিয়ে থেমে যান। রিঙ্কার রাত্রে ভালো লাগেনা। কী সুন্দর কলকাতায় ছিল। রাত অবধি বাড়ির সামনে  রোলের দোকানটা খোলা থাকত। একটু দূরেই মদনকাকুর ওষুধের দোকান ছিল। সেখানেও আলো জ্বলত। আর রাস্তাতেও কত আলো। এখানে রাস্তায় আলো থাকেনা। সারা পাড়া নিঝুম ঘুমে থাকে। মাঝে মাঝে পাতার আওয়াজ শুনেই রিঙ্কার ভয় করে। মনে হয় কে যেন দেখছে থাকে। ছুটে চলে যায় মায়ের কাছে।

রিঙ্কার সবচেয়ে বড় কষ্ট এখানে তার বয়সী কোন বন্ধুবান্ধব নেই। এখানকার স্কুলটা বেশ বাজে বলে প্রায় সবার ছেলে মেয়েই বাইরে হস্টেলে থেকে পড়ে। বিকেলবেলা রিঙ্কা একা একাই পুতুল নিয়ে বা রান্নাবাটি খেলে। মা মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে ঘুরতে বেরোন। কিন্তু মায়ের সঙ্গে হাঁটতে কি ভালো লাগে।  একদিন বলটা নিয়ে বেরিয়েছিল। খানিকক্ষণ খেলার পর বলটা খাদের ধার দিয়ে পড়ে যায়। রিঙ্কাদের কলোনিটা পেরোলেই গভীর খাদ। তারপর থেকে রিঙ্কার মা আর বল নিয়ে বেরোতে দেন না। রিঙ্কা একা একা বারান্দায় বসে থাকে। 

একদিন বিকেলবেলা এরকম বারান্দায় বসে আছে রিঙ্কা। দেখে নিচ দিয়ে এক দিদা হেঁটে যাচ্ছেন। রিঙ্কাকে দেখেই তিনি এক গাল হেসে বললেন
-- কি নাম তোমার?
-- প্রিয়াঙ্কা সেন।
-- ডাক নাম কি?
-- রিঙ্কা।
-- তুমি এরকম একা একা বারান্দায় বসে আছো কেন?
--  আমার কোন বন্ধু নেই।
-- সেকি? কেউ নেই?
-- নাহ, কেউ নেই।
-- তাহলে তো আমাকেই তোমার সাথে খেলতে হয়।

এরকম সময় মা পাশ থেকে এসে গেলেন।

-- কার সাথে কথা বলছিস রিঙ্কা?
-- নমস্কার, আমার নাম পারমিতা রায়। আমি এখানকার স্কুলে আগে পড়াতাম। এখন অবসর নিয়েছি।
-- বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? আসুন না।

সেদিনকেই পারমিতা দিদার সঙ্গে আলাপ জমে গেল রিঙ্কার। ওনাকে মিতাদিদা বলে ডাকতে বললেন। কত গল্প জানেন মিতাদিদা। ব্যাঙ রাজপুত্রের গল্প, রাক্ষসের গল্প, ডাইনি বাবা-ইয়াগার গল্প, শুনতে শুনতে মন ভালো লাগছিল রিঙ্কার। মা এত গল্প জানেননা। মিতা দিদা যাওয়ার সময় ওনার বাড়ি যেতে বললেন। একাই থাকেন। রিঙ্কারা গেলে ওনার ভালোই লাগবে।

পরের রবিবার তিনজনে মিলে মিতাদিদার বাড়ি যাওয়া হল। ওদের কলোনি পেড়িয়ে, পাশের গ্রামের মধ্যে মিতাদিদার বাড়ি। বাবার স্কুটারে যেতে পাঁচ মিনিটও লাগল না। কিন্তু গিয়ে রিঙ্কার প্রথমে মন খারাপ হয়ে গেল। বড়রা তিনজন গল্প করতে লাগলেন। রিঙ্কাকে কেউ পাত্তাই দিলনা। সেটা বুঝতে পেরে মিতাদিদা বললেন

-- রিঙ্কা মুখ গোমড়া কেন? খেলার সাথি পাচ্ছনা? চল ভেতরে অনেক পুতুল আছে। তোমাকে দেখাচ্ছি।

মিতাদিদা রিঙ্কাকে ভিতরের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরে একটা পুরোন দিনের খাট, একটা আলমারি, আর একটা দেওয়াল আলমারি। সেই দেওয়াল আলমারিতে এক গাদা পুতুল দেখা গেল।

-- তুমি এগুলো নিয়ে খেল, আমরা গল্প করছি।

মিতাদিদা চলে গেলে রিঙ্কা খেলতে শুরু করল। পুতুলগুলো কি সুন্দর। কোনটা হাতি, কোনটা বাঁদর। তবে সবচেয়ে সুন্দর পুতুল হচ্ছে একটা বড় মেয়ে পুতুল। কোঁকড়া সোনালি চুল, পরনে হালকা নীল রঙের ফ্রক। হাতে বালা। পুতুলটার সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে এক মিনিট অন্তর অন্তর চোখ পিট পিট করে। রিঙ্কা তাকে মেয়ে বানিয়ে খেলতে শুরু করল।

খেলতে খেলতে রিঙ্কার মনে হল কেউ যেন তাকে দেখছে। একটু ভয় পেল রিঙ্কা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। না, কেউ তো নেই। জানালার পরদা উড়ছে। বাইরে সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। ঐ তো দূরে ধূলিয়া  নদী দেখা যাচ্ছে। নদী দেখেই রিঙ্কার মাথায় এল, আরে তার মেয়ের তো জল খাওয়া দরকার। তার মা তাকে প্রতি ঘণ্টায় জল খাওয়ায়। মেয়েকে সে খাওয়াবে। পাশেই বাথরুম ছিল। পুতুলগুলোর সঙ্গে যে রান্নাবাটির সরঞ্জাম ছিল, তার থেকে গ্লাস এনে তাতে জল ভরে মেয়েকে খাওয়াতে গেল রিঙ্কা। জল পুতুলের মুখ থেকে জামায় গিয়ে পড়ল।

-- এভাবে তো ও জল খাবে না রিঙ্কা।

মিতাদিদা কখন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন রিঙ্কা খেয়াল করেনি। চমকে উঠল সে।

-- আজ চল, তোমার মা বাবা অপেক্ষা করছেন। তোমাকে আর একদিন দেখাব ও কীভাবে গ্লাস থেকে খায়।

এরপর অনেকবারই রিঙ্কার মিতাদিদার বাড়ি যাতায়াত চলতে লাগল।  একদিন মা কোলে আন্টিদের বাড়ি পার্টিতে যাবে। রিঙ্কা একা বাড়ি থাকতে পারবেনা। তাই মা ঠিক করলেন ওকে মিতাদিদার বাড়ি রেখে আসবেন।

-- আপনার অসুবিধা হবে না তো?
-- একদম না। রিঙ্কা থাকলে আমার খুব ভালো লাগে। আপনার হয়ে গেলে এসে ওকে নিয়ে যাবেন।
-- রিঙ্কা বিস্কুট খাবে?

বিস্কুট খেয়ে মিতাদিদার কাছে দৈত্যের গল্প শুনে রিঙ্কা পুতুলঘরে খেলতে গেল। আজ মিতাদিদাও খেলতে এলেন। বেশ খানিকক্ষণ খেলার পর মিতাদিদার কাছে রিঙ্কা বায়না ধরল তার মেয়েকে জল খাওয়ানোর।

-- তোমার মেয়ের যেন কি নাম দিয়েছ?
-- আমার নাম রিঙ্কা, তাই ওর নাম পিঙ্কা।
-- বাহ ভালো নাম। কিন্তু ঐ নামে ডাকলে তো ও খাবে না। ওকে ডাকতে হবে সোনাই বলে।
-- আচ্ছা, সোনাই জল খা।
-- দাঁড়াও দাঁড়াও ঐ ভাবে বললে ও খাবেনা।
-- তাহলে?
-- ও তো জল খায়না।
-- তাহলে কি খায়?
-- ও একটা লাল শরবত খায়।
-- লাল শরবত?
-- হ্যাঁ।
-- কই দাও। আমি খাওয়াবো।
-- দিতে পারি। কিন্তু তোমার ভীষণ লাগবে।
-- লাগুক। আমি মেয়েকে শরবত খাওয়াবো।
-- তোমার যতই লাগুক তুমি চেঁচাবে না তো? তুমি চেঁচালে কিন্তু ও খাবে না।
-- না চেঁচাব না।
-- আর কাউকে বলতে পারবেনা ওকে তুমি খাইয়েছ? তোমার মা বাবাকেও না।
-- না বলব না।
-- বললে কিন্তু ও সারাজীবনের জন্য চলে যাবে, আর কোনদিন আসবেনা।
-- না দিদা, আমি বলব না।
-- দাঁড়াও, আমি আসছি।

এই বলে দিদা ভিতরে গেলেন । রিঙ্কা একা একা মেয়েকে ডাকল

-- এই সোনাই।

বলা মাত্র দেখল সোনাইয়ের চোখের পাতা পড়ল আবার। এবার দিদা ঘরে ঢুকলেন। হাতে একটা লম্বা গ্লাস, সঙ্গে একটা স্ট্র। আর সঙ্গে একটা ছোট বাক্স। বাক্স খুলে যে জিনিসটা বার করলেন দিদা সেটা রিঙ্কা চেনে; ওর নাম ইনজেকশন। কলকাতায় ডাক্তারকাকু প্রায় দিতেন এটা। খুব লাগে রিঙ্কার।

-- না...
রিঙ্কা কেঁদে উঠল।
-- ঠিক আছে তাহলে  সোনাই আজ খাবে না।
দিদা আবার বাক্স বন্ধ করলেন।
-- না না, সোনাই খাক। কিন্তু আমার ওতে ভয় করে।
-- ভয় করলে তো সোনাইকে খেতে দেখতে পারবেনা।

এবার রাজী হল রিঙ্কা। আস্তে আস্তে রিঙ্কার হাতে ইনজেকশন দিয়ে রক্ত নিলেন দিদা। ইনজেকশনের ভিতরটা লালচে কালো হয়ে গেল। সেটা এবার ঐ বড় গ্লাসে ঢেলে দিলেন। স্ট্রটা দিয়ে এবার গ্লাসটা রিঙ্কার হাতে দিলেন

-- তোমার মেয়েকে খাওয়াবে না রিঙ্কা?

সোনাইয়ের মুখের সামনে স্ট্রটা ধরতেই গেলাস খালি হতে লাগল। রিঙ্কা হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। প্রায় দু মিনিট সময় নিল সোনাই গ্লাসটা খালি করতে। এই দু মিনিটে একবারো কিন্তু সোনাই-এর চোখের পাতা পড়ল না। 

Wednesday, March 25, 2020

পিতৃ দায়িত্ব

"নতুন এলেন পাড়ায়?"
"হ্যাঁ এই তো কালকে।"
"নমস্কার, আমি সুবিমল সান্যাল।"
"আমি মলয় সেনগুপ্ত। এটি আমার মেয়ে রত্না।"
"নমস্কার কাকু।" -- মিষ্টি গলায় বলল রত্না।
"নমস্কার। কোথায় উঠেছেন?"
"আমরা লাহাবাবুর বাড়িটা ভাড়া নিয়েছি।"
"ওহ, কোথা থেকে আসছেন?"
"কলকাতা।"
"তা ভালো, এখানে কোন কাজে?"
"নাহ সেরকম কিছু না। আসলে আমি বছর দুয়েক হল রিটায়ার করেছি। এখন আমি আর মেয়ে মিলে এই গাড়িটা করে ঘুরে বেড়াই। এই দেশের বিভিন্ন শহরে শহরে কয়েক মাস করে থাকি।"
"অবাক ব্যাপার মশাই। আপনি কোথায় চাকরি করতেন?"
"আমি রেলের ডাক্তার ছিলাম।"
"আরিব্বাস। ভালোই হল আমাদের বাড়ির কাছে একটা ডাক্তার পাওয়া গেল। গাড়িটা খাসা। কবেকার?"
"এটা যুদ্ধের পর পরই কেনা। অস্টিন।"
"বাহ বাহ বেশ। তো আপনার মেয়ে কি করে?"
"ও আমার সঙ্গেই থাকে, আমার দেখাশোনা করে।"
"সেকি? আপনার মেয়ের তো বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে মশাই। বিয়ে দিচ্ছেন না কেন?"
সুবিমলবাবু কথাটা বলেই লক্ষ্য করলেন রত্নার মুখটা গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। মলয়বাবু খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন
"ঐ আর কি?"

সুবিমলবাবু ধুরন্ধর লোক। বুঝে গেছেন এই নিয়ে কথা বলা পিতা পুত্রী কেউই পছন্দ করবেন না। তাই আর প্রশ্ন না করে বললেন

"চলি আজ। একদিন আসবেন দু'জনে আমাদের বাড়ি। আমার স্ত্রী খুশী হবে।"
"নিশ্চয়।"

সুবিমলবাবু লক্ষ্য করলেন যে মলয়বাবু কিন্তু তাঁকে নেমতন্ন করলেন না।

মলয়বাবুরা থাকতে শুরু করলেন পাড়ায়। খুব একটা কারুর সঙ্গে মিশতেন না। সুবিমলবাবুর বাড়ি আর যাননি তাঁরা। তাঁদের বাড়িও কেউ আসত না। কাজের লোক বীণা সকালে কাজ করে চলে যেত। মলয়বাবুর সঙ্গে সবার দেখা হত সকালবেলা বাজার করার সময়। নিজের গাড়ি নিজেই পরিষ্কার করতেন মলয়বাবু। কিন্তু যেটা সবচেয়ে অদ্ভুত হল রোজ সন্ধ্যেবেলা খানিকক্ষণের জন্য ওনাদের বাড়ি থেকে কান্না শোনা যেত। রত্না কোনদিন ফুঁপিয়ে কাঁদত, কোনদিন চেঁচিয়ে। লাহাবাবু একবার পরেরদিন জানতে চেয়েছিলেন

"কাল রত্না কাঁদছিল, ওর কি কিছু হয়েছে?"

মলয়বাবু হেসে উত্তর দিয়েছিলেন --
"না না, ওর আসলে মাঝে মাঝে পেটে ব্যাথা হয়। এটা একটা অদ্ভুত রোগ জানেন। এর কোন প্রতিকার নেই। হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে যায়। তখন ও কাঁদে।"

আসল ঘটনা কিন্তু অন্য। ঐ সময় কেউ সেনগুপ্ত বাড়ি গেলে দেখতে পারত রত্নার কান্নার কারণ কোন শারীরিক যন্ত্রণা না। রত্না  কাঁদতে কাঁদতে বলত --

"বাবা ওরা আমাকে এখানে মেরেছে, এখানে ব্যাথা দিয়েছে দেখো।" -- এই বলে নিজের শাড়ি টেনে তুলত।

আজকাল আর চোখ বন্ধ করেননা মলয়বাবু। বরং সে জায়গায় হাত বুলিয়ে বলেন

"না মা, কাঁদিস না। আমরা ওদের শাস্তি দেব।"
"কবে বাবা, পুলিশ তো ওদের ছেড়ে দিল।"
"দেব মা, ওদের দেব। তুই ওদের মারবি তো?"
"হ্যাঁ বাবা," -- এবার হাসি ফুটত রত্নার মুখে।
"কীভাবে মারবি বল?"
"ঐ বড় লাঠিটা দিয়ে মারব। মাথায় মারব। চোখে মারব। রক্ত বেরোবে বাবা?"
"অনেক অনেক রক্ত বেরোবে। তুই খুশী হবি তো?"
"হ্যাঁ বাবা। হব। কবে মারব বাবা?"
"হ্যাঁ এবার মারব আমরা একদিন।"

একদিন রত্না বারান্দা থেকে একটা ছেলেকে দেখাল। মলয়বাবু দেখে নিশ্বাস ফেললেন। একে তিনি চেনেন। পাশের পাড়ায় একটা ওষুধের দোকান আছে। নাম তমাল। দু'দিন বাদে ছেলেটিকে বাড়িতে নেমতন্ন করলেন তিনি। তার আগেরদিন বীণাকে মাইনে দিয়ে ছাড়িয়ে দিয়েছেন।

তমালের কিছুদিন ধরেই রত্নাকে ভালো লাগে। কোনদিন কথা বলেনি, তবে বলতে কতক্ষণ। আজ রত্নার বাবা তাকে নেমতন্ন করতে বেশ অবাক লেগেছিল তার।

বাড়ি ঢুকে তমাল দেখল বাড়ির বেশিরভাগ জানালা বন্ধ। বাড়িতে আসবাব পত্র বিশেষ নেই। সে বোধহয় এই পাড়ায় প্রথম যে এ বাড়িতে এল।

"বস তমাল, আছো কেমন?"

আড্ডা চলতে লাগল। তমালের অবাক লাগল সে রত্নাকে দেখতে পেল না। একটু বাদেই রত্না এল চা নিয়ে। চা খাওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই গভীর ঘুমে ঢলে পরল তমাল। এবার মলয়বাবু ব্যাগ থেকে একটা ইনজেকশন বার করে তমালের হাতে দিলেন। মিনিট দুয়েক পর তমালের নাকের তলায় হাত রেখে বুঝলেন তমাল আর ইহলোকে নেই। তখন রত্নাকে ডাকলেন।

"মারবি? কীভাবে মারবি বল?"
"ঐ বড় লাঠিটা দিয়ে মারব। মাথায় মারব। চোখে মারব। রক্ত বেরোবে বাবা?"
"অনেক অনেক রক্ত বেরোবে। তুই খুশী হবি তো?"

রত্না প্রায় আধঘণ্টা ধরে তমালের মৃতদেহটাকে মারল। জায়গা জায়গা থেকে রক্ত বেরোল। পুরো মেঝে ভিজে গেল।

"রক্ত, বাবা রক্ত"
"হ্যাঁ মা, আস্তে কথা বল। কেউ শুনতে পারলে?"
"হে হে, আরো মারব বাবা?"
"মার মার"

এবার উল্টোদিকের চেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরালেন মলয়বাবু। যেভাবে ছোটবেলায় মেয়ের পুতুলখেলা দেখতেন, আজ সেইভাবেই মেয়ের রক্তখেলা দেখছেন।

"বাবা একটু জল দেবে? হাঁফিয়ে উঠেছি।"
"ছেড়ে দে নাকি?"
"না বাবা, আর একটু ... "
"আচ্ছা"

আরো ঘণ্টা দুয়েক বাদে বাপ মেয়ে মিলে সব ব্যাগপত্র নিয়ে গাড়ির পেছনে তুললেন। এই শহরে রাত দশটা বাজলেই সব আলো নিভে যায়। শুধু জ্বলতে লাগল সেই যুদ্ধের পরের কেনা অস্টিনের আলো। মলয়বাবু মনে মনে ভাবছেন --
"দিনাজপুরের একটা শহরের দিকে গেলে হয়। এবার আমার নাম দেব ভাস্কর। আর ওর গৌরী।"

Friday, March 20, 2020

সব জ্যোতিষী ভণ্ড হয়না

ক্লাস সেভেন-এ পড়ে সুজয়। সুজয় তালুকদার। বাড়ি বেগমপুরে । বাবা সরকারি ব্যঙ্কে কর্মরত। মা গৃহবধূ। সুজয় স্কুলে ফার্স্ট হয়না বটে, তবে তেমন খারাপ কিছুও করেনা। মোটামুটি ক্লাসে প্রথম দশেই থাকে। খেলাধুলোতে মোটামুটি। মানে ১০০ মিটার দৌড়ে হিটে ওঠে, তবে মেডেল পায়না। ক্লাসের ফুটবল টিমে বেঞ্চে থাকে। অন্য সব বাড়ির বাবা-মায়ের মত সুজয়ের বাবা মা কিন্তু তেমন চাপ দেন না ছেলের উপর। শুধু অঙ্কে কম পেলে বাবা একটু রাগারাগি করেন। মোটকথা সুজয়ের জীবন ঝঞ্ঝাট শূন্য।

তবে সুজয়ের একটাই সমস্যা। বড্ড পেটের রোগে ভোগে। এই নিয়ে তার মা খুব চিন্তায় থাকেন। এই কয়েকদিন আগে পাড়ার রানিদির বিয়েতে খেয়ে সুজয় পরেরদিন স্কুল যেতে পারেনি। অথচ এমন কিছু বাড়াবাড়ি খায়নি সুজয়। কত ডাক্তার দেখিয়েছেন, কিছুই হয়নি। এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, এমনকি কয়েকদিন আগে এক কবিরাজের ওষুধও খাওয়ালেন, কোন লাভ হলনা।

গত মাসে পাড়ায় এক  নতুন ভদ্রলোক এসেছেন। নাম বলরাম মহাপাত্র। দুটো বাড়ি পরে অরূপদাদের বাড়িতে ভাড়া এসেছেন। একাই থাকেন। খুব একটা কারুর সঙ্গে মেশেন না। শুধু মৃণাল জেঠুর সঙ্গে যা আলাপ। মৃণাল জেঠু কলকাতার কোন এক কলেজে ফিজিক্স পড়াতেন। দু'বছর হল অবসর নিয়েছেন। বিপত্নীক। ওনার এক মেয়ে, দিল্লীতে থাকে। সুজয় শুনেছে বলরামবাবু নাকি প্রায়ই সন্ধ্যাবেলা মৃণাল জেঠুর বাড়ি আড্ডা মারতে যান।

ঘটনাটা ঘটল গত শনিবার। সেদিন সন্ধ্যাবেলা ওয়ার্ল্ড কাপে আর্জেন্টিনা হল্যান্ডের খেলা ছিল। স্কোর ১-১, এই সময় সুজয়দের পাড়ায় লোডশেডিং। এরকম অবস্থা আগেও হয়েছে। হলেই সুজয়, রন্টু, সোমনাথ, এরা ছোটে মৃণাল জেঠুর বাড়ি। ওনার জেনেরেটার কানেকশন আছে। এবার গিয়ে দেখলেন ঘরে বলরামবাবু বসে আছেন। এক গাল চাপ দাড়ির মধ্যে দিয়ে ওদের দেখে উনি হাসলেন। মাথার পাকা চুল দেখে ওনার বয়স আন্দাজ করা শক্ত। টি ভি  চালিয়ে দিলেন জেঠু।  সোমনাথ আর রন্টু ঝগড়া শুরু করল 

-- বাতিস্তুতা আছে, আজ আর্জেন্টিনা জিতবে।
-- ক্লুইভার্ট আর একটা দেবে।

-- বার্গক্যাম্পকে দেখছি না?
এবার বলরামবাবুর গলা শুনল সুজয়রা।
-- ঐ তো দেখুন, ৮ নম্বর জার্সি।
-- হ্যাঁ, দেখতে পেয়েছি। ওর দিকে নজর রেখ।

খেলার অন্তিম লগ্নে এক অসামান্য গোলে হল্যান্ডকে জেতাল ডেনিস বার্গক্যাম্প। গোলটা হতেই সবাই চমকে তাকাল বলরামবাবুর দিকে।
-- আপনি কি করে জানলেন?
-- না না, আন্দাজ আর কি।

কথা চাউর হতে  বেশিদিন  লাগলনা। পাড়ায় অনেকেই বলরামবাবুকে জ্যোতিষী ভাবতে লাগলেন। সবার আগে সুজয়কে নিয়ে এলেন ওর মা।

-- আপনি একবার ওর হাতটা দেখে দিন, দেখুন না করবেন না। কবে ওর এই পেটের সমস্যা মিটবে?
-- না না, আমি জ্যোতিষী নই। এরকম করবেন না।

সুজয়ের মা তবু নাছোড়বান্দা, বার বার ছেলেকে নিয়ে আসতে লাগলেন। একদিন হাল ছেড়ে দিলেন  বলরামবাবু।

-- দাঁড়ান দেখি, তবে হাত লাগবে না।

এই বলে সুজয়ের চোখের দিকে দেখলেন। দেখে কিছুক্ষণ খাতায় কিসব লিখে বললেন

-- দেখুন আপনার ছেলের তেমন কোন সমস্যা নেই। শুধু ওর ভাত হজম হয়না। আপনি ভাবেন ভাত খেলে ওর পেট ঠিক থাকবে, তা নয়। ওকে রুটি দিন দু'বেলা।
-- কিন্তু রুটি হজম করা তো আরো শক্ত।
-- সবার জন্য না। যেটা বললাম করুন, দেখুন কি হয়।

এক সপ্তাহ বাদে আবার এলেন সুজয়ের মা। এবার সুজয় না। সঙ্গে ওর বাবা।  এসেই প্রণাম করলেন বলরামবাবুকে।

-- আপনি সাক্ষাত ভগবান। আমার ছেলেটা একদম সুস্থ এখন। আপনার ফিজ কত বলুন।
-- না না, একদম না। একই, প্রণাম করছেন কেন? ছি ছি!! আমি এসব শখে করি। কোন ফিজ না।
-- আমার আর একটা প্রশ্ন আছে। আমার ছেলেটা খুবই সাধারণ। ও বড় হয়ে চাকরি পাবে তো?
-- কেন পাবে না!! আপনার ছেলে খুবই ভালো। চিন্তা করবেন না, ও খুব ভালো করবে পড়াশুনায়। শুধু ওকে জোর করে কিছু করাবেন না। ও যা করতে চায়, তাই করতে দিন।
-- আমাদের শখ ও ইঞ্জিনিয়ার হোক। এখন শুনছি ঐ লাইনে পড়লেই চাকরি।
-- ও ভুলটা করবেন না। ওর যেটা ইচ্ছে সেটা পড়তে দেবেন।
-- আচ্ছা। আপনি যা বলবেন সেরকমই হবে।
-- একটা কথা, প্লিজ কাউকে বলবেন না আমি আপনাকে সাহায্য করেছিলাম।
-- না না, আপনি ভাববেন না। আমি কথা দিলাম।

কথা দেওয়ার ফল হল পরের এক সপ্তাহের মধ্যে রোজ  সন্ধ্যেবেলা বলরামবাবুর বাড়ির সামনে লোকের ভিড়। টুকটুকিদির বিয়ে কবে হবে, তপনদা চাকরি কবে পাবে, এমনকি সামনের ইলেকসানে দত্তবাবু জিতবেন কিনা, সব জানতে ভিড় চলল। কিছু কিছু ভুল হলেও বলরামবাবু যা বলতেন বেশিরভাগই ফলত।

এইভাবে এক বছর প্রায় চলার পর একদিন বিকেলে যখন সুজয় স্কুল থেকে ফিরছে, বলরামবাবু বারান্দা থেকে ডাকলেন

-- সুজয় শোন।

সুজয় ব্যাগ নিয়ে ওনার বাড়ি ঢুকল।
-- কেমন আছেন কাকু?
-- ভালো। তুমি ভালো?
-- হ্যাঁ।
-- শোন তোমাকে যে কারণে ডাকলাম। আমি কাল এই পাড়া ছেড়ে চলে যাব।
-- সেকি? কেন?
-- সেটা বলার জন্যই তোমাকে ডাকলাম। বস। তুমি মাল্টিভার্স কাকে বলে জানো?
-- না।
-- আমাদের পৃথিবীতে অগুনতি সমান্তরাল জগত আছে। সেই সব জগতেই  তুমি আছো, তোমার মা আছেন, তোমার বাবা আছেন, শুধু জগতগুলো আলাদা। কিছু জগতে  তুমি হয়ত নামকরা ফুটবলার। কিছু জগতে তুমি হয়ত জেলের কয়েদী। এই জগতগুলি বিভিন্ন সময়ে চলে। এখানে এখন ১৯৯৯, অথচ কিছু জগতে এখন ২০০১, কোথাও এখন ২০২০।
-- এ তো প্রোফেসর শঙ্কুর গল্প লাগছে!!
-- হ্যাঁ, শুধু এটা সত্যি। আমি সেরকম এক জগত থেকে এসেছি। আমি এসেছি ২০২০ থেকে। ২০২০ তে পৃথিবীতে করোনাভাইরাস নামক এক ভাইরাস এসে মারাত্মক কোলাহল সৃষ্টি করে। আমি তখন সুইটজারল্যান্ডে সার্নে পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণা করি। আমি এই দরজাটা বানাতে সক্ষম হই যা দিয়ে এক জগত থেকে আর এক জগতে যাতায়াত করা যাবে। সুইটজারল্যান্ডের অবস্থা ভয়ানক খারাপ হওয়ায় আমি পালিয়ে আসি। তবে মাঝে মাঝে গিয়ে দেখতাম কি হয়েছে। এখন পুরোপুরি সুস্থ ওখানে সবাই। তাই কাল ফিরে যাব।
-- সেকি!! তাহলে আপনি আমাদের সকলের ব্যাপারে ঠিক বলতেন কি করে? ভবিষ্যৎ দেখে?
-- হ্যাঁ, কারণ আমি তোমাদের সবাইকেই চিনতাম। কাজেই তোমাদের ১৯৯৮-এ কি হবে সেটা আমি আগে জেনে গেছি। টুকটুকিদির বিয়ে, দুত্তবাবুর ভোট সবই আমি জানতাম। আমি তো সেই সময়টা তোমাদের মধ্যে কাটিয়েছি। যেমন মৃণাল জেঠু পরের বছর চলে যাবেন সবাইকে ছেড়ে। সেই কারণেই আমি গত এক বছর ওনার সঙ্গে সময় কাটিয়েছি। উনি একমাত্র জানতেন আমার পরিচয়। আমাকে মারাত্মক স্নেহ করেন বলে কাউকে বলেননি আমার কথা।
-- মানে, জেঠু মারা যাবেন?
-- হ্যাঁ সুজয়, জানি কষ্ট হচ্ছে শুনতে, আমারো হয়েছিল ওনার মৃত্যুসংবাদ শুনে। কিন্তু এটা সত্যি।
-- এক মিনিট, আপনি যখন আমাদের সম্বন্ধে সব জানেন, তখন আপনি নিশ্চয় আমাদের মধ্যে কেউ। কে আপনি?

এবার নিজের পরচুলা আর দাড়ি খুলে ফেলল বলরামবাবু। সুজয়ের ওনার মুখটা মারাত্মক চেনা চেনা লাগল। কোথায় যেন দেখেছে। ও হ্যাঁ, তাই তো। সেকি!! বলরামবাবু এক গাল হেসে বললেন

-- আমার নাম সুজয় তালুকদার।

Sunday, March 1, 2020

অনন্ত স্যার

অনন্ত স্যারকে আমি প্রথম দেখি এক বুধবার। সেদিন দুপুরে টিফিন টাইমে আমরা বলটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে পাসিং করছিলাম। দেখতে পেলাম সাদা গোলাপি স্ট্রাইপ জামা পরে এক ভদ্রলোক স্কুলের গেট খুলে ঢুকলেন। ঘণ্টা কয়েক বাদে আমাদের যখন ইতিহাসের ক্লাস চলছিল, হেডস্যার মলয়বাবু ওনাকে নিয়ে ক্লাসে এলেন।

-- তোমাদের অঙ্কের স্যার রতনবাবু এক মাস থাকবেন না। তার বদলে ইনি তোমাদের অঙ্ক করাবেন। এনার নাম অনন্ত সরকার।

অনন্ত স্যার আমাদের স্কুলের বাকি স্যারদের মত অত বয়স্ক নন। বেশ কম বয়সী। প্রথমদিন ক্লাসে এসে অঙ্কের ফাঁকে গল্প করতে শুরু করলেন। একটু বাদেই চলে এল ফুটবল। অতঃপর শুরু হল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান নিয়ে বাদানুবাদ। স্যার তাড়াতাড়ি সেটা থামালেন।
-- স্যার আপনি কার সাপোর্টার?
সেই উত্তর না দিয়ে স্যার চোখ টিপলেন।

বিকেলবেলা স্কুলের শেষে আমরা মসজিদের পাশের মাঠে বল নিয়ে নেমে পড়লাম। খেলে অনেকেই, কিন্তু আমরা চারজন, অর্থাৎ আমি, কুন্তল, রবি আর সরোজ রোজ খেলি। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের চারজনের বন্ধুত্ব অনেকদিনের। কীভাবে এটা শুরু হয়েছিল, সে গল্প পরে বলব। কিন্তু আমাদের এই বিকেলের খেলাটা বহুদিন ধরে চলছে। বাকি লোকজন যাতায়াত করে, কিন্তু আমরা প্রায় রোজ খেলি। প্রায় রোজ।

সেদিন অনন্ত স্যারও আমাদের সাথে যোগ দিলেন। ভদ্রলোক বেশ ভালোই খেলেন। এমনি ব্যাকে খেলেন, আর দৌড়াতেও পারেন প্রচণ্ড। খেলার পর আমরা চারজন মাঠে বসে আড্ডা দি। অনন্ত স্যারও যোগ দিলেন। এমনি আড্ডা হল। স্যারের বাড়ি পলাশগ্রামে। এখানে একটা মেসবাড়িতে থাকেন। স্যারের বাবা নেই, মা আছেন। স্যারের দাদা কলকাতায় চাকরি করেন। স্যার কলকাতা গেছেন শুনে আমাদের হিংসা হল। কবে যে যেতে পারব?

এরকম ভাবে কয়েকদিন চলার পর স্যার একদিন আড্ডায় বসে বললেন
-- শোন, তোদের একটা কথা বলি; কিন্তু সেটা যেন শুধু আমাদের মধ্যে থাকে।
-- নিশ্চয়।
-- আমি আসলে শিক্ষক নই, আমি পুলিশে কাজ করি।
-- পুলিশ?
-- হ্যাঁ, এই শহরে গত কয়েক মাসে একটা করে খুন হচ্ছে জানিস কি তোরা?
-- না তো।
-- না জানার কথা। কারণ ঘটনাটা এত ভয়াবহ যে আমরা কাউকে বলিনি।
-- কি হয়েছে স্যার?
-- হয়েছে কি, গত কয়েক মাস কিছু লোক অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কোন একটা নির্দিস্ট বয়সের না কিন্তু। এই যেমন ধর প্রাইমারী স্কুলের ছেলেও গায়েব হয়েছে, আবার অবসর নেওয়া বৃদ্ধও হয়েছে। থানায় এরকম নিরুদ্দেশদের নিয়ে ডায়রি থাকেই। কিন্তু দু সপ্তাহ আগে শহরের বাইরে যে জঙ্গলটা আছে, সেখানে আমরা কিছু কঙ্কাল পাই। টেস্ট করে দেখা গেছে ঐ কঙ্কালগুলি যারা নিরুদ্দেশ হয়েছে তাদের কঙ্কাল।
--  সেকি?
-- হ্যাঁ। আমি এই কেসটা দেখছি। তাই এই স্কুলে আসা।
-- কিন্তু তার সঙ্গে আপনার স্কুলে পড়ানোর কি সম্পর্ক?
-- বলছি। আমরা ঐ কঙ্কালগুলোর কাছে একটা এই স্কুলের ব্যাজ পেয়েছি। আমরা স্কুলের কোন শিক্ষককে সন্দেহ করছি। তাঁর পকেট থেকে এটা পড়েছে। এখন আমাদের দেখতে হবে কে?
রবি আমার দিকে আতঙ্কের চোখে তাকাল।
-- আমাদের স্কুলে?
-- হ্যাঁ।
-- আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?
-- হ্যাঁ, গত কয়েকদিনে আমি লক্ষ্য করছি কোন কোন শিক্ষক ব্যাজ ব্যবহার করেন। এনাদের মধ্যে কার কার ব্যাজ হারিয়েছে। যা বুঝছি সমীরবাবু আর অরবিন্দবাবু, এদের দুজনের অতি সম্প্রতি ব্যাজ হারিয়েছে।
-- কিন্তু স্যার, একটা কথা বলুন। এনারা ঐ নিরুদ্দেশ হওয়া ব্যাক্তিদের জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে মারবে কেন?
-- তার চেয়েও বড় প্রশ্ন কি জানিস? ঐ ব্যাক্তিদের গায়ে এক ফোটা মাংস নেই।
-- সেকি? শেয়ালে খেয়েছে?
-- হতে পারে। আমরা বুঝছি না। যাই হোক, তোদের যে এসব বললাম, কাউকে বলিস না। এই কেসে তোদের সাহায্য লাগতে পারে।
-- নিশ্চয় স্যার। আপনি ফেলুদা,  আর আমরা সবাই তোপসে।


কয়েকদিন বাদে স্যার আবার বসলেন আমাদের সাথে।
-- কাল আবার একটা খুন হয়েছে।
-- কে?
-- রেলধারের বস্তির ছোটন।
-- কঙ্কাল পাওয়া গেছে?
-- হ্যাঁ, এবার চন্ডীতলার ছোট জঙ্গলে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কি জানিস? এক দিনের মধ্যেই পাওয়া গেছে কঙ্কাল। কিন্তু এবারো কোন মাংস নেই।
-- সেকি?
-- হ্যাঁ, শেয়াল এরকম পরিপাটি করে খাবে না। আমার বস বললেন কেউ হয়ত মানুষের মাংস চুরি করছে। কিন্তু আমার তা মনে হয়না। আমার এক আলাদা সন্দেহ হয়।
-- কি স্যার?
-- বিশ্বাস করবি কিনা জানি না। গতকাল পূর্নিমা ছিল।
-- জানি তো স্যার।
-- গল্পে পড়েছি বিলেতে এক ধরণের জন্তু হয়। যারা পুর্নিমার রাতে মানুষ থেকে নেকড়ে হয়ে যায়। আমি খোঁজ নিয়ে দেখলাম প্রতিটা খুন হয়েছে কোন এক পুর্নিমার রাতে। কেউ মাংস চুরি করলে  কেন শুধু পুর্নিমার রাতে করবে বল?
-- মানে আপনি কি বলতে চাইছেন?
-- আমি বলছি যে এই শহরে একটা নেকড়ে-মানব আছে। এবং আমার ধারণা সেটা সমীরবাবু।
-- কেন স্যার?
-- সমীরবাবুকে ক'দিন ধরে স্টাফ রুমে দেখছি। ওনার দাঁত দেখবি, শ্বদন্ত আছে। এছাড়া উনি নাকি রোজ রাত্রে খেয়ে দেয়ে পাড়ায় হাঁটতে বেরোন। মর্নিং ওয়াক শুনেছিস, কোনদিন নাইট ওয়াক শুনেছিস?
-- তবে কি সমীরবাবু নেকড়ে মানব?
-- আমাদের পরের পুর্নিমা অবধি অপেক্ষা করতে হবে।


পরের মাসে  পূর্ণিমার আগের রাতে অনন্ত স্যার আমাদের ধরলেন।
-- শোন, কাল আমি সমীরবাবুর বাড়ির উপর নজর রাখব। তোরা  আসবি?
সরোজ ভয় পেল।

-- স্যার, উনি যদি সত্যি নেকড়ে মানব হন, আমরা কি করব?
-- চিন্তা করিস না, আমার সার্ভিস রিভল্বারটা থাকবে সঙ্গে।
আমরা তবুও কিন্তু কিন্তু করছিলাম। কিন্তু স্যারের তেজ দেখে আমরাও রাজি হলাম। এই প্রথম এরকম একটা কর্মকান্ডের অংশ হব আমরা।


পরেরদিন রাতে আমরা আস্তানা নিলাম সমীরবাবুর বাড়ির ঠিক পাশের গলিতে। আমাদের জেলা শহরে এই রাত্রে কাক পক্ষীটিও দেখা যায় না। চারদিক যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। সবাই মাথায় শাল জড়িয়ে আছি, তাই লোকে আমাদের পাড়ার রিক্সাওয়ালা ভাববে। স্যার আগে। আমরা পিছনে। একটু বাদে সমীরবাবু বাড়ি থেকে বেরোলেন। হেঁটে হেঁটে  সামনের গলি ঘুরে আবার এদিকে ফিরলেন। আমরা অপেক্ষা করছি। আকাশে পুর্নিমার চাঁদ। সমীরবাবু একটু বাদেই বাড়ি ঢুকে পড়লেন। আর বেরচ্ছেন না। আমাদের অপেক্ষা চলছে।

রাত তখন প্রায় বারোটা। পাশের গির্জার ঘড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। আমরা সকলেই খুব ভয়ে ভয়ে আছি। রবি দেখলাম চিন্তায় একবার কেশেও ফেলল। কিন্তু আর আটকাতে পারল না।

অনন্ত স্যার এবার বললেন -- "আমার কি তবে ভুল হল?"
এই বলে স্যার পিছন ফিরে আমাদের দেখে -- "একি তোরা..."

স্যার বন্দুকটা বার করার সময় পেলেন না।


স্যারের কঙ্কালটা  আমরা জংগলে ফেলে এসে কুন্তলদের আউট হাউসটায় উঠলাম। এভাবে মাসের পর মাস আমরা রাত্রে পড়াশুনো করব বলে এই আউট হাউসটায় রাত কাটাই পুর্নিমার রাতে। কতদিন এভাবে চলবে জানি না। কিন্তু  এ আমাদের হাতে নেই।