Monday, March 30, 2020

তৃষ্ণা

মা বাবার সঙ্গে ক'দিন হল এই নতুন শহরে এসেছে রিঙ্কা। নামেই শহর। প্রায় গ্রাম বললেই চলে। পাহাড়ি জায়গা। বাবা এক টিম্বার কোম্পানিতে চাকরি করেন। তাই রিঙ্কারা এখানে এসেছে। কয়েকটা মাত্র কোয়ার্টার। রিঙ্কাদের পিছনে থাকেন  দে বাবুরা। এ ছাড়া হাসানবাবু, কোলেবাবু, শর্মাবাবু এনারা বাকি কয়েকটা বাড়িতে থাকেন। রিঙ্কাদের কলোনি থেকে বেরোলেই একটা ছোট গ্রাম। সেই গ্রামে একটাই স্কুল। রিঙ্কা অনেক ছোট, তাই ঐ স্কুলে যায়না। এখানে এক বছর থেকেই ট্রান্সফার হয়ে যাওয়ার কথা রিঙ্কার বাবার। তাই রিঙ্কাকে স্কুলে ভর্তি করেননি।

এই জায়গাটা ভীষণ নিরিবিলি। সন্ধ্যা হলেই রাস্তায় তেমন লোকজন দেখা যায়না। রিঙ্কার বাবার যদিও সেটা ভালোই লাগে। মাঝে মাঝেই রাত্রিবেলা বারান্দায় বসে থাকেন একা একা। রিঙ্কাকেও ডাকেন। রিঙ্কা এলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।  রিঙ্কার ভালো লাগেনা। রিঙ্কার বাবার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বাবা কিছুতেই কথা বলতে চাননা। একটা দুটো হ্যাঁ হুঁ উত্তর দিয়ে থেমে যান। রিঙ্কার রাত্রে ভালো লাগেনা। কী সুন্দর কলকাতায় ছিল। রাত অবধি বাড়ির সামনে  রোলের দোকানটা খোলা থাকত। একটু দূরেই মদনকাকুর ওষুধের দোকান ছিল। সেখানেও আলো জ্বলত। আর রাস্তাতেও কত আলো। এখানে রাস্তায় আলো থাকেনা। সারা পাড়া নিঝুম ঘুমে থাকে। মাঝে মাঝে পাতার আওয়াজ শুনেই রিঙ্কার ভয় করে। মনে হয় কে যেন দেখছে থাকে। ছুটে চলে যায় মায়ের কাছে।

রিঙ্কার সবচেয়ে বড় কষ্ট এখানে তার বয়সী কোন বন্ধুবান্ধব নেই। এখানকার স্কুলটা বেশ বাজে বলে প্রায় সবার ছেলে মেয়েই বাইরে হস্টেলে থেকে পড়ে। বিকেলবেলা রিঙ্কা একা একাই পুতুল নিয়ে বা রান্নাবাটি খেলে। মা মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে ঘুরতে বেরোন। কিন্তু মায়ের সঙ্গে হাঁটতে কি ভালো লাগে।  একদিন বলটা নিয়ে বেরিয়েছিল। খানিকক্ষণ খেলার পর বলটা খাদের ধার দিয়ে পড়ে যায়। রিঙ্কাদের কলোনিটা পেরোলেই গভীর খাদ। তারপর থেকে রিঙ্কার মা আর বল নিয়ে বেরোতে দেন না। রিঙ্কা একা একা বারান্দায় বসে থাকে। 

একদিন বিকেলবেলা এরকম বারান্দায় বসে আছে রিঙ্কা। দেখে নিচ দিয়ে এক দিদা হেঁটে যাচ্ছেন। রিঙ্কাকে দেখেই তিনি এক গাল হেসে বললেন
-- কি নাম তোমার?
-- প্রিয়াঙ্কা সেন।
-- ডাক নাম কি?
-- রিঙ্কা।
-- তুমি এরকম একা একা বারান্দায় বসে আছো কেন?
--  আমার কোন বন্ধু নেই।
-- সেকি? কেউ নেই?
-- নাহ, কেউ নেই।
-- তাহলে তো আমাকেই তোমার সাথে খেলতে হয়।

এরকম সময় মা পাশ থেকে এসে গেলেন।

-- কার সাথে কথা বলছিস রিঙ্কা?
-- নমস্কার, আমার নাম পারমিতা রায়। আমি এখানকার স্কুলে আগে পড়াতাম। এখন অবসর নিয়েছি।
-- বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? আসুন না।

সেদিনকেই পারমিতা দিদার সঙ্গে আলাপ জমে গেল রিঙ্কার। ওনাকে মিতাদিদা বলে ডাকতে বললেন। কত গল্প জানেন মিতাদিদা। ব্যাঙ রাজপুত্রের গল্প, রাক্ষসের গল্প, ডাইনি বাবা-ইয়াগার গল্প, শুনতে শুনতে মন ভালো লাগছিল রিঙ্কার। মা এত গল্প জানেননা। মিতা দিদা যাওয়ার সময় ওনার বাড়ি যেতে বললেন। একাই থাকেন। রিঙ্কারা গেলে ওনার ভালোই লাগবে।

পরের রবিবার তিনজনে মিলে মিতাদিদার বাড়ি যাওয়া হল। ওদের কলোনি পেড়িয়ে, পাশের গ্রামের মধ্যে মিতাদিদার বাড়ি। বাবার স্কুটারে যেতে পাঁচ মিনিটও লাগল না। কিন্তু গিয়ে রিঙ্কার প্রথমে মন খারাপ হয়ে গেল। বড়রা তিনজন গল্প করতে লাগলেন। রিঙ্কাকে কেউ পাত্তাই দিলনা। সেটা বুঝতে পেরে মিতাদিদা বললেন

-- রিঙ্কা মুখ গোমড়া কেন? খেলার সাথি পাচ্ছনা? চল ভেতরে অনেক পুতুল আছে। তোমাকে দেখাচ্ছি।

মিতাদিদা রিঙ্কাকে ভিতরের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরে একটা পুরোন দিনের খাট, একটা আলমারি, আর একটা দেওয়াল আলমারি। সেই দেওয়াল আলমারিতে এক গাদা পুতুল দেখা গেল।

-- তুমি এগুলো নিয়ে খেল, আমরা গল্প করছি।

মিতাদিদা চলে গেলে রিঙ্কা খেলতে শুরু করল। পুতুলগুলো কি সুন্দর। কোনটা হাতি, কোনটা বাঁদর। তবে সবচেয়ে সুন্দর পুতুল হচ্ছে একটা বড় মেয়ে পুতুল। কোঁকড়া সোনালি চুল, পরনে হালকা নীল রঙের ফ্রক। হাতে বালা। পুতুলটার সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে এক মিনিট অন্তর অন্তর চোখ পিট পিট করে। রিঙ্কা তাকে মেয়ে বানিয়ে খেলতে শুরু করল।

খেলতে খেলতে রিঙ্কার মনে হল কেউ যেন তাকে দেখছে। একটু ভয় পেল রিঙ্কা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। না, কেউ তো নেই। জানালার পরদা উড়ছে। বাইরে সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। ঐ তো দূরে ধূলিয়া  নদী দেখা যাচ্ছে। নদী দেখেই রিঙ্কার মাথায় এল, আরে তার মেয়ের তো জল খাওয়া দরকার। তার মা তাকে প্রতি ঘণ্টায় জল খাওয়ায়। মেয়েকে সে খাওয়াবে। পাশেই বাথরুম ছিল। পুতুলগুলোর সঙ্গে যে রান্নাবাটির সরঞ্জাম ছিল, তার থেকে গ্লাস এনে তাতে জল ভরে মেয়েকে খাওয়াতে গেল রিঙ্কা। জল পুতুলের মুখ থেকে জামায় গিয়ে পড়ল।

-- এভাবে তো ও জল খাবে না রিঙ্কা।

মিতাদিদা কখন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন রিঙ্কা খেয়াল করেনি। চমকে উঠল সে।

-- আজ চল, তোমার মা বাবা অপেক্ষা করছেন। তোমাকে আর একদিন দেখাব ও কীভাবে গ্লাস থেকে খায়।

এরপর অনেকবারই রিঙ্কার মিতাদিদার বাড়ি যাতায়াত চলতে লাগল।  একদিন মা কোলে আন্টিদের বাড়ি পার্টিতে যাবে। রিঙ্কা একা বাড়ি থাকতে পারবেনা। তাই মা ঠিক করলেন ওকে মিতাদিদার বাড়ি রেখে আসবেন।

-- আপনার অসুবিধা হবে না তো?
-- একদম না। রিঙ্কা থাকলে আমার খুব ভালো লাগে। আপনার হয়ে গেলে এসে ওকে নিয়ে যাবেন।
-- রিঙ্কা বিস্কুট খাবে?

বিস্কুট খেয়ে মিতাদিদার কাছে দৈত্যের গল্প শুনে রিঙ্কা পুতুলঘরে খেলতে গেল। আজ মিতাদিদাও খেলতে এলেন। বেশ খানিকক্ষণ খেলার পর মিতাদিদার কাছে রিঙ্কা বায়না ধরল তার মেয়েকে জল খাওয়ানোর।

-- তোমার মেয়ের যেন কি নাম দিয়েছ?
-- আমার নাম রিঙ্কা, তাই ওর নাম পিঙ্কা।
-- বাহ ভালো নাম। কিন্তু ঐ নামে ডাকলে তো ও খাবে না। ওকে ডাকতে হবে সোনাই বলে।
-- আচ্ছা, সোনাই জল খা।
-- দাঁড়াও দাঁড়াও ঐ ভাবে বললে ও খাবেনা।
-- তাহলে?
-- ও তো জল খায়না।
-- তাহলে কি খায়?
-- ও একটা লাল শরবত খায়।
-- লাল শরবত?
-- হ্যাঁ।
-- কই দাও। আমি খাওয়াবো।
-- দিতে পারি। কিন্তু তোমার ভীষণ লাগবে।
-- লাগুক। আমি মেয়েকে শরবত খাওয়াবো।
-- তোমার যতই লাগুক তুমি চেঁচাবে না তো? তুমি চেঁচালে কিন্তু ও খাবে না।
-- না চেঁচাব না।
-- আর কাউকে বলতে পারবেনা ওকে তুমি খাইয়েছ? তোমার মা বাবাকেও না।
-- না বলব না।
-- বললে কিন্তু ও সারাজীবনের জন্য চলে যাবে, আর কোনদিন আসবেনা।
-- না দিদা, আমি বলব না।
-- দাঁড়াও, আমি আসছি।

এই বলে দিদা ভিতরে গেলেন । রিঙ্কা একা একা মেয়েকে ডাকল

-- এই সোনাই।

বলা মাত্র দেখল সোনাইয়ের চোখের পাতা পড়ল আবার। এবার দিদা ঘরে ঢুকলেন। হাতে একটা লম্বা গ্লাস, সঙ্গে একটা স্ট্র। আর সঙ্গে একটা ছোট বাক্স। বাক্স খুলে যে জিনিসটা বার করলেন দিদা সেটা রিঙ্কা চেনে; ওর নাম ইনজেকশন। কলকাতায় ডাক্তারকাকু প্রায় দিতেন এটা। খুব লাগে রিঙ্কার।

-- না...
রিঙ্কা কেঁদে উঠল।
-- ঠিক আছে তাহলে  সোনাই আজ খাবে না।
দিদা আবার বাক্স বন্ধ করলেন।
-- না না, সোনাই খাক। কিন্তু আমার ওতে ভয় করে।
-- ভয় করলে তো সোনাইকে খেতে দেখতে পারবেনা।

এবার রাজী হল রিঙ্কা। আস্তে আস্তে রিঙ্কার হাতে ইনজেকশন দিয়ে রক্ত নিলেন দিদা। ইনজেকশনের ভিতরটা লালচে কালো হয়ে গেল। সেটা এবার ঐ বড় গ্লাসে ঢেলে দিলেন। স্ট্রটা দিয়ে এবার গ্লাসটা রিঙ্কার হাতে দিলেন

-- তোমার মেয়েকে খাওয়াবে না রিঙ্কা?

সোনাইয়ের মুখের সামনে স্ট্রটা ধরতেই গেলাস খালি হতে লাগল। রিঙ্কা হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। প্রায় দু মিনিট সময় নিল সোনাই গ্লাসটা খালি করতে। এই দু মিনিটে একবারো কিন্তু সোনাই-এর চোখের পাতা পড়ল না। 

No comments:

Post a Comment