Wednesday, March 25, 2020

পিতৃ দায়িত্ব

"নতুন এলেন পাড়ায়?"
"হ্যাঁ এই তো কালকে।"
"নমস্কার, আমি সুবিমল সান্যাল।"
"আমি মলয় সেনগুপ্ত। এটি আমার মেয়ে রত্না।"
"নমস্কার কাকু।" -- মিষ্টি গলায় বলল রত্না।
"নমস্কার। কোথায় উঠেছেন?"
"আমরা লাহাবাবুর বাড়িটা ভাড়া নিয়েছি।"
"ওহ, কোথা থেকে আসছেন?"
"কলকাতা।"
"তা ভালো, এখানে কোন কাজে?"
"নাহ সেরকম কিছু না। আসলে আমি বছর দুয়েক হল রিটায়ার করেছি। এখন আমি আর মেয়ে মিলে এই গাড়িটা করে ঘুরে বেড়াই। এই দেশের বিভিন্ন শহরে শহরে কয়েক মাস করে থাকি।"
"অবাক ব্যাপার মশাই। আপনি কোথায় চাকরি করতেন?"
"আমি রেলের ডাক্তার ছিলাম।"
"আরিব্বাস। ভালোই হল আমাদের বাড়ির কাছে একটা ডাক্তার পাওয়া গেল। গাড়িটা খাসা। কবেকার?"
"এটা যুদ্ধের পর পরই কেনা। অস্টিন।"
"বাহ বাহ বেশ। তো আপনার মেয়ে কি করে?"
"ও আমার সঙ্গেই থাকে, আমার দেখাশোনা করে।"
"সেকি? আপনার মেয়ের তো বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে মশাই। বিয়ে দিচ্ছেন না কেন?"
সুবিমলবাবু কথাটা বলেই লক্ষ্য করলেন রত্নার মুখটা গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। মলয়বাবু খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন
"ঐ আর কি?"

সুবিমলবাবু ধুরন্ধর লোক। বুঝে গেছেন এই নিয়ে কথা বলা পিতা পুত্রী কেউই পছন্দ করবেন না। তাই আর প্রশ্ন না করে বললেন

"চলি আজ। একদিন আসবেন দু'জনে আমাদের বাড়ি। আমার স্ত্রী খুশী হবে।"
"নিশ্চয়।"

সুবিমলবাবু লক্ষ্য করলেন যে মলয়বাবু কিন্তু তাঁকে নেমতন্ন করলেন না।

মলয়বাবুরা থাকতে শুরু করলেন পাড়ায়। খুব একটা কারুর সঙ্গে মিশতেন না। সুবিমলবাবুর বাড়ি আর যাননি তাঁরা। তাঁদের বাড়িও কেউ আসত না। কাজের লোক বীণা সকালে কাজ করে চলে যেত। মলয়বাবুর সঙ্গে সবার দেখা হত সকালবেলা বাজার করার সময়। নিজের গাড়ি নিজেই পরিষ্কার করতেন মলয়বাবু। কিন্তু যেটা সবচেয়ে অদ্ভুত হল রোজ সন্ধ্যেবেলা খানিকক্ষণের জন্য ওনাদের বাড়ি থেকে কান্না শোনা যেত। রত্না কোনদিন ফুঁপিয়ে কাঁদত, কোনদিন চেঁচিয়ে। লাহাবাবু একবার পরেরদিন জানতে চেয়েছিলেন

"কাল রত্না কাঁদছিল, ওর কি কিছু হয়েছে?"

মলয়বাবু হেসে উত্তর দিয়েছিলেন --
"না না, ওর আসলে মাঝে মাঝে পেটে ব্যাথা হয়। এটা একটা অদ্ভুত রোগ জানেন। এর কোন প্রতিকার নেই। হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে যায়। তখন ও কাঁদে।"

আসল ঘটনা কিন্তু অন্য। ঐ সময় কেউ সেনগুপ্ত বাড়ি গেলে দেখতে পারত রত্নার কান্নার কারণ কোন শারীরিক যন্ত্রণা না। রত্না  কাঁদতে কাঁদতে বলত --

"বাবা ওরা আমাকে এখানে মেরেছে, এখানে ব্যাথা দিয়েছে দেখো।" -- এই বলে নিজের শাড়ি টেনে তুলত।

আজকাল আর চোখ বন্ধ করেননা মলয়বাবু। বরং সে জায়গায় হাত বুলিয়ে বলেন

"না মা, কাঁদিস না। আমরা ওদের শাস্তি দেব।"
"কবে বাবা, পুলিশ তো ওদের ছেড়ে দিল।"
"দেব মা, ওদের দেব। তুই ওদের মারবি তো?"
"হ্যাঁ বাবা," -- এবার হাসি ফুটত রত্নার মুখে।
"কীভাবে মারবি বল?"
"ঐ বড় লাঠিটা দিয়ে মারব। মাথায় মারব। চোখে মারব। রক্ত বেরোবে বাবা?"
"অনেক অনেক রক্ত বেরোবে। তুই খুশী হবি তো?"
"হ্যাঁ বাবা। হব। কবে মারব বাবা?"
"হ্যাঁ এবার মারব আমরা একদিন।"

একদিন রত্না বারান্দা থেকে একটা ছেলেকে দেখাল। মলয়বাবু দেখে নিশ্বাস ফেললেন। একে তিনি চেনেন। পাশের পাড়ায় একটা ওষুধের দোকান আছে। নাম তমাল। দু'দিন বাদে ছেলেটিকে বাড়িতে নেমতন্ন করলেন তিনি। তার আগেরদিন বীণাকে মাইনে দিয়ে ছাড়িয়ে দিয়েছেন।

তমালের কিছুদিন ধরেই রত্নাকে ভালো লাগে। কোনদিন কথা বলেনি, তবে বলতে কতক্ষণ। আজ রত্নার বাবা তাকে নেমতন্ন করতে বেশ অবাক লেগেছিল তার।

বাড়ি ঢুকে তমাল দেখল বাড়ির বেশিরভাগ জানালা বন্ধ। বাড়িতে আসবাব পত্র বিশেষ নেই। সে বোধহয় এই পাড়ায় প্রথম যে এ বাড়িতে এল।

"বস তমাল, আছো কেমন?"

আড্ডা চলতে লাগল। তমালের অবাক লাগল সে রত্নাকে দেখতে পেল না। একটু বাদেই রত্না এল চা নিয়ে। চা খাওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই গভীর ঘুমে ঢলে পরল তমাল। এবার মলয়বাবু ব্যাগ থেকে একটা ইনজেকশন বার করে তমালের হাতে দিলেন। মিনিট দুয়েক পর তমালের নাকের তলায় হাত রেখে বুঝলেন তমাল আর ইহলোকে নেই। তখন রত্নাকে ডাকলেন।

"মারবি? কীভাবে মারবি বল?"
"ঐ বড় লাঠিটা দিয়ে মারব। মাথায় মারব। চোখে মারব। রক্ত বেরোবে বাবা?"
"অনেক অনেক রক্ত বেরোবে। তুই খুশী হবি তো?"

রত্না প্রায় আধঘণ্টা ধরে তমালের মৃতদেহটাকে মারল। জায়গা জায়গা থেকে রক্ত বেরোল। পুরো মেঝে ভিজে গেল।

"রক্ত, বাবা রক্ত"
"হ্যাঁ মা, আস্তে কথা বল। কেউ শুনতে পারলে?"
"হে হে, আরো মারব বাবা?"
"মার মার"

এবার উল্টোদিকের চেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরালেন মলয়বাবু। যেভাবে ছোটবেলায় মেয়ের পুতুলখেলা দেখতেন, আজ সেইভাবেই মেয়ের রক্তখেলা দেখছেন।

"বাবা একটু জল দেবে? হাঁফিয়ে উঠেছি।"
"ছেড়ে দে নাকি?"
"না বাবা, আর একটু ... "
"আচ্ছা"

আরো ঘণ্টা দুয়েক বাদে বাপ মেয়ে মিলে সব ব্যাগপত্র নিয়ে গাড়ির পেছনে তুললেন। এই শহরে রাত দশটা বাজলেই সব আলো নিভে যায়। শুধু জ্বলতে লাগল সেই যুদ্ধের পরের কেনা অস্টিনের আলো। মলয়বাবু মনে মনে ভাবছেন --
"দিনাজপুরের একটা শহরের দিকে গেলে হয়। এবার আমার নাম দেব ভাস্কর। আর ওর গৌরী।"

No comments:

Post a Comment