Sunday, March 1, 2020

অনন্ত স্যার

অনন্ত স্যারকে আমি প্রথম দেখি এক বুধবার। সেদিন দুপুরে টিফিন টাইমে আমরা বলটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে পাসিং করছিলাম। দেখতে পেলাম সাদা গোলাপি স্ট্রাইপ জামা পরে এক ভদ্রলোক স্কুলের গেট খুলে ঢুকলেন। ঘণ্টা কয়েক বাদে আমাদের যখন ইতিহাসের ক্লাস চলছিল, হেডস্যার মলয়বাবু ওনাকে নিয়ে ক্লাসে এলেন।

-- তোমাদের অঙ্কের স্যার রতনবাবু এক মাস থাকবেন না। তার বদলে ইনি তোমাদের অঙ্ক করাবেন। এনার নাম অনন্ত সরকার।

অনন্ত স্যার আমাদের স্কুলের বাকি স্যারদের মত অত বয়স্ক নন। বেশ কম বয়সী। প্রথমদিন ক্লাসে এসে অঙ্কের ফাঁকে গল্প করতে শুরু করলেন। একটু বাদেই চলে এল ফুটবল। অতঃপর শুরু হল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান নিয়ে বাদানুবাদ। স্যার তাড়াতাড়ি সেটা থামালেন।
-- স্যার আপনি কার সাপোর্টার?
সেই উত্তর না দিয়ে স্যার চোখ টিপলেন।

বিকেলবেলা স্কুলের শেষে আমরা মসজিদের পাশের মাঠে বল নিয়ে নেমে পড়লাম। খেলে অনেকেই, কিন্তু আমরা চারজন, অর্থাৎ আমি, কুন্তল, রবি আর সরোজ রোজ খেলি। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের চারজনের বন্ধুত্ব অনেকদিনের। কীভাবে এটা শুরু হয়েছিল, সে গল্প পরে বলব। কিন্তু আমাদের এই বিকেলের খেলাটা বহুদিন ধরে চলছে। বাকি লোকজন যাতায়াত করে, কিন্তু আমরা প্রায় রোজ খেলি। প্রায় রোজ।

সেদিন অনন্ত স্যারও আমাদের সাথে যোগ দিলেন। ভদ্রলোক বেশ ভালোই খেলেন। এমনি ব্যাকে খেলেন, আর দৌড়াতেও পারেন প্রচণ্ড। খেলার পর আমরা চারজন মাঠে বসে আড্ডা দি। অনন্ত স্যারও যোগ দিলেন। এমনি আড্ডা হল। স্যারের বাড়ি পলাশগ্রামে। এখানে একটা মেসবাড়িতে থাকেন। স্যারের বাবা নেই, মা আছেন। স্যারের দাদা কলকাতায় চাকরি করেন। স্যার কলকাতা গেছেন শুনে আমাদের হিংসা হল। কবে যে যেতে পারব?

এরকম ভাবে কয়েকদিন চলার পর স্যার একদিন আড্ডায় বসে বললেন
-- শোন, তোদের একটা কথা বলি; কিন্তু সেটা যেন শুধু আমাদের মধ্যে থাকে।
-- নিশ্চয়।
-- আমি আসলে শিক্ষক নই, আমি পুলিশে কাজ করি।
-- পুলিশ?
-- হ্যাঁ, এই শহরে গত কয়েক মাসে একটা করে খুন হচ্ছে জানিস কি তোরা?
-- না তো।
-- না জানার কথা। কারণ ঘটনাটা এত ভয়াবহ যে আমরা কাউকে বলিনি।
-- কি হয়েছে স্যার?
-- হয়েছে কি, গত কয়েক মাস কিছু লোক অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কোন একটা নির্দিস্ট বয়সের না কিন্তু। এই যেমন ধর প্রাইমারী স্কুলের ছেলেও গায়েব হয়েছে, আবার অবসর নেওয়া বৃদ্ধও হয়েছে। থানায় এরকম নিরুদ্দেশদের নিয়ে ডায়রি থাকেই। কিন্তু দু সপ্তাহ আগে শহরের বাইরে যে জঙ্গলটা আছে, সেখানে আমরা কিছু কঙ্কাল পাই। টেস্ট করে দেখা গেছে ঐ কঙ্কালগুলি যারা নিরুদ্দেশ হয়েছে তাদের কঙ্কাল।
--  সেকি?
-- হ্যাঁ। আমি এই কেসটা দেখছি। তাই এই স্কুলে আসা।
-- কিন্তু তার সঙ্গে আপনার স্কুলে পড়ানোর কি সম্পর্ক?
-- বলছি। আমরা ঐ কঙ্কালগুলোর কাছে একটা এই স্কুলের ব্যাজ পেয়েছি। আমরা স্কুলের কোন শিক্ষককে সন্দেহ করছি। তাঁর পকেট থেকে এটা পড়েছে। এখন আমাদের দেখতে হবে কে?
রবি আমার দিকে আতঙ্কের চোখে তাকাল।
-- আমাদের স্কুলে?
-- হ্যাঁ।
-- আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?
-- হ্যাঁ, গত কয়েকদিনে আমি লক্ষ্য করছি কোন কোন শিক্ষক ব্যাজ ব্যবহার করেন। এনাদের মধ্যে কার কার ব্যাজ হারিয়েছে। যা বুঝছি সমীরবাবু আর অরবিন্দবাবু, এদের দুজনের অতি সম্প্রতি ব্যাজ হারিয়েছে।
-- কিন্তু স্যার, একটা কথা বলুন। এনারা ঐ নিরুদ্দেশ হওয়া ব্যাক্তিদের জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে মারবে কেন?
-- তার চেয়েও বড় প্রশ্ন কি জানিস? ঐ ব্যাক্তিদের গায়ে এক ফোটা মাংস নেই।
-- সেকি? শেয়ালে খেয়েছে?
-- হতে পারে। আমরা বুঝছি না। যাই হোক, তোদের যে এসব বললাম, কাউকে বলিস না। এই কেসে তোদের সাহায্য লাগতে পারে।
-- নিশ্চয় স্যার। আপনি ফেলুদা,  আর আমরা সবাই তোপসে।


কয়েকদিন বাদে স্যার আবার বসলেন আমাদের সাথে।
-- কাল আবার একটা খুন হয়েছে।
-- কে?
-- রেলধারের বস্তির ছোটন।
-- কঙ্কাল পাওয়া গেছে?
-- হ্যাঁ, এবার চন্ডীতলার ছোট জঙ্গলে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কি জানিস? এক দিনের মধ্যেই পাওয়া গেছে কঙ্কাল। কিন্তু এবারো কোন মাংস নেই।
-- সেকি?
-- হ্যাঁ, শেয়াল এরকম পরিপাটি করে খাবে না। আমার বস বললেন কেউ হয়ত মানুষের মাংস চুরি করছে। কিন্তু আমার তা মনে হয়না। আমার এক আলাদা সন্দেহ হয়।
-- কি স্যার?
-- বিশ্বাস করবি কিনা জানি না। গতকাল পূর্নিমা ছিল।
-- জানি তো স্যার।
-- গল্পে পড়েছি বিলেতে এক ধরণের জন্তু হয়। যারা পুর্নিমার রাতে মানুষ থেকে নেকড়ে হয়ে যায়। আমি খোঁজ নিয়ে দেখলাম প্রতিটা খুন হয়েছে কোন এক পুর্নিমার রাতে। কেউ মাংস চুরি করলে  কেন শুধু পুর্নিমার রাতে করবে বল?
-- মানে আপনি কি বলতে চাইছেন?
-- আমি বলছি যে এই শহরে একটা নেকড়ে-মানব আছে। এবং আমার ধারণা সেটা সমীরবাবু।
-- কেন স্যার?
-- সমীরবাবুকে ক'দিন ধরে স্টাফ রুমে দেখছি। ওনার দাঁত দেখবি, শ্বদন্ত আছে। এছাড়া উনি নাকি রোজ রাত্রে খেয়ে দেয়ে পাড়ায় হাঁটতে বেরোন। মর্নিং ওয়াক শুনেছিস, কোনদিন নাইট ওয়াক শুনেছিস?
-- তবে কি সমীরবাবু নেকড়ে মানব?
-- আমাদের পরের পুর্নিমা অবধি অপেক্ষা করতে হবে।


পরের মাসে  পূর্ণিমার আগের রাতে অনন্ত স্যার আমাদের ধরলেন।
-- শোন, কাল আমি সমীরবাবুর বাড়ির উপর নজর রাখব। তোরা  আসবি?
সরোজ ভয় পেল।

-- স্যার, উনি যদি সত্যি নেকড়ে মানব হন, আমরা কি করব?
-- চিন্তা করিস না, আমার সার্ভিস রিভল্বারটা থাকবে সঙ্গে।
আমরা তবুও কিন্তু কিন্তু করছিলাম। কিন্তু স্যারের তেজ দেখে আমরাও রাজি হলাম। এই প্রথম এরকম একটা কর্মকান্ডের অংশ হব আমরা।


পরেরদিন রাতে আমরা আস্তানা নিলাম সমীরবাবুর বাড়ির ঠিক পাশের গলিতে। আমাদের জেলা শহরে এই রাত্রে কাক পক্ষীটিও দেখা যায় না। চারদিক যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। সবাই মাথায় শাল জড়িয়ে আছি, তাই লোকে আমাদের পাড়ার রিক্সাওয়ালা ভাববে। স্যার আগে। আমরা পিছনে। একটু বাদে সমীরবাবু বাড়ি থেকে বেরোলেন। হেঁটে হেঁটে  সামনের গলি ঘুরে আবার এদিকে ফিরলেন। আমরা অপেক্ষা করছি। আকাশে পুর্নিমার চাঁদ। সমীরবাবু একটু বাদেই বাড়ি ঢুকে পড়লেন। আর বেরচ্ছেন না। আমাদের অপেক্ষা চলছে।

রাত তখন প্রায় বারোটা। পাশের গির্জার ঘড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। আমরা সকলেই খুব ভয়ে ভয়ে আছি। রবি দেখলাম চিন্তায় একবার কেশেও ফেলল। কিন্তু আর আটকাতে পারল না।

অনন্ত স্যার এবার বললেন -- "আমার কি তবে ভুল হল?"
এই বলে স্যার পিছন ফিরে আমাদের দেখে -- "একি তোরা..."

স্যার বন্দুকটা বার করার সময় পেলেন না।


স্যারের কঙ্কালটা  আমরা জংগলে ফেলে এসে কুন্তলদের আউট হাউসটায় উঠলাম। এভাবে মাসের পর মাস আমরা রাত্রে পড়াশুনো করব বলে এই আউট হাউসটায় রাত কাটাই পুর্নিমার রাতে। কতদিন এভাবে চলবে জানি না। কিন্তু  এ আমাদের হাতে নেই।

No comments:

Post a Comment