Friday, March 20, 2020

সব জ্যোতিষী ভণ্ড হয়না

ক্লাস সেভেন-এ পড়ে সুজয়। সুজয় তালুকদার। বাড়ি বেগমপুরে । বাবা সরকারি ব্যঙ্কে কর্মরত। মা গৃহবধূ। সুজয় স্কুলে ফার্স্ট হয়না বটে, তবে তেমন খারাপ কিছুও করেনা। মোটামুটি ক্লাসে প্রথম দশেই থাকে। খেলাধুলোতে মোটামুটি। মানে ১০০ মিটার দৌড়ে হিটে ওঠে, তবে মেডেল পায়না। ক্লাসের ফুটবল টিমে বেঞ্চে থাকে। অন্য সব বাড়ির বাবা-মায়ের মত সুজয়ের বাবা মা কিন্তু তেমন চাপ দেন না ছেলের উপর। শুধু অঙ্কে কম পেলে বাবা একটু রাগারাগি করেন। মোটকথা সুজয়ের জীবন ঝঞ্ঝাট শূন্য।

তবে সুজয়ের একটাই সমস্যা। বড্ড পেটের রোগে ভোগে। এই নিয়ে তার মা খুব চিন্তায় থাকেন। এই কয়েকদিন আগে পাড়ার রানিদির বিয়েতে খেয়ে সুজয় পরেরদিন স্কুল যেতে পারেনি। অথচ এমন কিছু বাড়াবাড়ি খায়নি সুজয়। কত ডাক্তার দেখিয়েছেন, কিছুই হয়নি। এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, এমনকি কয়েকদিন আগে এক কবিরাজের ওষুধও খাওয়ালেন, কোন লাভ হলনা।

গত মাসে পাড়ায় এক  নতুন ভদ্রলোক এসেছেন। নাম বলরাম মহাপাত্র। দুটো বাড়ি পরে অরূপদাদের বাড়িতে ভাড়া এসেছেন। একাই থাকেন। খুব একটা কারুর সঙ্গে মেশেন না। শুধু মৃণাল জেঠুর সঙ্গে যা আলাপ। মৃণাল জেঠু কলকাতার কোন এক কলেজে ফিজিক্স পড়াতেন। দু'বছর হল অবসর নিয়েছেন। বিপত্নীক। ওনার এক মেয়ে, দিল্লীতে থাকে। সুজয় শুনেছে বলরামবাবু নাকি প্রায়ই সন্ধ্যাবেলা মৃণাল জেঠুর বাড়ি আড্ডা মারতে যান।

ঘটনাটা ঘটল গত শনিবার। সেদিন সন্ধ্যাবেলা ওয়ার্ল্ড কাপে আর্জেন্টিনা হল্যান্ডের খেলা ছিল। স্কোর ১-১, এই সময় সুজয়দের পাড়ায় লোডশেডিং। এরকম অবস্থা আগেও হয়েছে। হলেই সুজয়, রন্টু, সোমনাথ, এরা ছোটে মৃণাল জেঠুর বাড়ি। ওনার জেনেরেটার কানেকশন আছে। এবার গিয়ে দেখলেন ঘরে বলরামবাবু বসে আছেন। এক গাল চাপ দাড়ির মধ্যে দিয়ে ওদের দেখে উনি হাসলেন। মাথার পাকা চুল দেখে ওনার বয়স আন্দাজ করা শক্ত। টি ভি  চালিয়ে দিলেন জেঠু।  সোমনাথ আর রন্টু ঝগড়া শুরু করল 

-- বাতিস্তুতা আছে, আজ আর্জেন্টিনা জিতবে।
-- ক্লুইভার্ট আর একটা দেবে।

-- বার্গক্যাম্পকে দেখছি না?
এবার বলরামবাবুর গলা শুনল সুজয়রা।
-- ঐ তো দেখুন, ৮ নম্বর জার্সি।
-- হ্যাঁ, দেখতে পেয়েছি। ওর দিকে নজর রেখ।

খেলার অন্তিম লগ্নে এক অসামান্য গোলে হল্যান্ডকে জেতাল ডেনিস বার্গক্যাম্প। গোলটা হতেই সবাই চমকে তাকাল বলরামবাবুর দিকে।
-- আপনি কি করে জানলেন?
-- না না, আন্দাজ আর কি।

কথা চাউর হতে  বেশিদিন  লাগলনা। পাড়ায় অনেকেই বলরামবাবুকে জ্যোতিষী ভাবতে লাগলেন। সবার আগে সুজয়কে নিয়ে এলেন ওর মা।

-- আপনি একবার ওর হাতটা দেখে দিন, দেখুন না করবেন না। কবে ওর এই পেটের সমস্যা মিটবে?
-- না না, আমি জ্যোতিষী নই। এরকম করবেন না।

সুজয়ের মা তবু নাছোড়বান্দা, বার বার ছেলেকে নিয়ে আসতে লাগলেন। একদিন হাল ছেড়ে দিলেন  বলরামবাবু।

-- দাঁড়ান দেখি, তবে হাত লাগবে না।

এই বলে সুজয়ের চোখের দিকে দেখলেন। দেখে কিছুক্ষণ খাতায় কিসব লিখে বললেন

-- দেখুন আপনার ছেলের তেমন কোন সমস্যা নেই। শুধু ওর ভাত হজম হয়না। আপনি ভাবেন ভাত খেলে ওর পেট ঠিক থাকবে, তা নয়। ওকে রুটি দিন দু'বেলা।
-- কিন্তু রুটি হজম করা তো আরো শক্ত।
-- সবার জন্য না। যেটা বললাম করুন, দেখুন কি হয়।

এক সপ্তাহ বাদে আবার এলেন সুজয়ের মা। এবার সুজয় না। সঙ্গে ওর বাবা।  এসেই প্রণাম করলেন বলরামবাবুকে।

-- আপনি সাক্ষাত ভগবান। আমার ছেলেটা একদম সুস্থ এখন। আপনার ফিজ কত বলুন।
-- না না, একদম না। একই, প্রণাম করছেন কেন? ছি ছি!! আমি এসব শখে করি। কোন ফিজ না।
-- আমার আর একটা প্রশ্ন আছে। আমার ছেলেটা খুবই সাধারণ। ও বড় হয়ে চাকরি পাবে তো?
-- কেন পাবে না!! আপনার ছেলে খুবই ভালো। চিন্তা করবেন না, ও খুব ভালো করবে পড়াশুনায়। শুধু ওকে জোর করে কিছু করাবেন না। ও যা করতে চায়, তাই করতে দিন।
-- আমাদের শখ ও ইঞ্জিনিয়ার হোক। এখন শুনছি ঐ লাইনে পড়লেই চাকরি।
-- ও ভুলটা করবেন না। ওর যেটা ইচ্ছে সেটা পড়তে দেবেন।
-- আচ্ছা। আপনি যা বলবেন সেরকমই হবে।
-- একটা কথা, প্লিজ কাউকে বলবেন না আমি আপনাকে সাহায্য করেছিলাম।
-- না না, আপনি ভাববেন না। আমি কথা দিলাম।

কথা দেওয়ার ফল হল পরের এক সপ্তাহের মধ্যে রোজ  সন্ধ্যেবেলা বলরামবাবুর বাড়ির সামনে লোকের ভিড়। টুকটুকিদির বিয়ে কবে হবে, তপনদা চাকরি কবে পাবে, এমনকি সামনের ইলেকসানে দত্তবাবু জিতবেন কিনা, সব জানতে ভিড় চলল। কিছু কিছু ভুল হলেও বলরামবাবু যা বলতেন বেশিরভাগই ফলত।

এইভাবে এক বছর প্রায় চলার পর একদিন বিকেলে যখন সুজয় স্কুল থেকে ফিরছে, বলরামবাবু বারান্দা থেকে ডাকলেন

-- সুজয় শোন।

সুজয় ব্যাগ নিয়ে ওনার বাড়ি ঢুকল।
-- কেমন আছেন কাকু?
-- ভালো। তুমি ভালো?
-- হ্যাঁ।
-- শোন তোমাকে যে কারণে ডাকলাম। আমি কাল এই পাড়া ছেড়ে চলে যাব।
-- সেকি? কেন?
-- সেটা বলার জন্যই তোমাকে ডাকলাম। বস। তুমি মাল্টিভার্স কাকে বলে জানো?
-- না।
-- আমাদের পৃথিবীতে অগুনতি সমান্তরাল জগত আছে। সেই সব জগতেই  তুমি আছো, তোমার মা আছেন, তোমার বাবা আছেন, শুধু জগতগুলো আলাদা। কিছু জগতে  তুমি হয়ত নামকরা ফুটবলার। কিছু জগতে তুমি হয়ত জেলের কয়েদী। এই জগতগুলি বিভিন্ন সময়ে চলে। এখানে এখন ১৯৯৯, অথচ কিছু জগতে এখন ২০০১, কোথাও এখন ২০২০।
-- এ তো প্রোফেসর শঙ্কুর গল্প লাগছে!!
-- হ্যাঁ, শুধু এটা সত্যি। আমি সেরকম এক জগত থেকে এসেছি। আমি এসেছি ২০২০ থেকে। ২০২০ তে পৃথিবীতে করোনাভাইরাস নামক এক ভাইরাস এসে মারাত্মক কোলাহল সৃষ্টি করে। আমি তখন সুইটজারল্যান্ডে সার্নে পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণা করি। আমি এই দরজাটা বানাতে সক্ষম হই যা দিয়ে এক জগত থেকে আর এক জগতে যাতায়াত করা যাবে। সুইটজারল্যান্ডের অবস্থা ভয়ানক খারাপ হওয়ায় আমি পালিয়ে আসি। তবে মাঝে মাঝে গিয়ে দেখতাম কি হয়েছে। এখন পুরোপুরি সুস্থ ওখানে সবাই। তাই কাল ফিরে যাব।
-- সেকি!! তাহলে আপনি আমাদের সকলের ব্যাপারে ঠিক বলতেন কি করে? ভবিষ্যৎ দেখে?
-- হ্যাঁ, কারণ আমি তোমাদের সবাইকেই চিনতাম। কাজেই তোমাদের ১৯৯৮-এ কি হবে সেটা আমি আগে জেনে গেছি। টুকটুকিদির বিয়ে, দুত্তবাবুর ভোট সবই আমি জানতাম। আমি তো সেই সময়টা তোমাদের মধ্যে কাটিয়েছি। যেমন মৃণাল জেঠু পরের বছর চলে যাবেন সবাইকে ছেড়ে। সেই কারণেই আমি গত এক বছর ওনার সঙ্গে সময় কাটিয়েছি। উনি একমাত্র জানতেন আমার পরিচয়। আমাকে মারাত্মক স্নেহ করেন বলে কাউকে বলেননি আমার কথা।
-- মানে, জেঠু মারা যাবেন?
-- হ্যাঁ সুজয়, জানি কষ্ট হচ্ছে শুনতে, আমারো হয়েছিল ওনার মৃত্যুসংবাদ শুনে। কিন্তু এটা সত্যি।
-- এক মিনিট, আপনি যখন আমাদের সম্বন্ধে সব জানেন, তখন আপনি নিশ্চয় আমাদের মধ্যে কেউ। কে আপনি?

এবার নিজের পরচুলা আর দাড়ি খুলে ফেলল বলরামবাবু। সুজয়ের ওনার মুখটা মারাত্মক চেনা চেনা লাগল। কোথায় যেন দেখেছে। ও হ্যাঁ, তাই তো। সেকি!! বলরামবাবু এক গাল হেসে বললেন

-- আমার নাম সুজয় তালুকদার।

No comments:

Post a Comment