এ এক অন্য সময়ের গল্প। সেই সময়, যখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরু হয়নি, যখন লিওনেল মেসি একটিও ব্যালন ডি-ওর জেতেননি, যখন সৃজিত মুখার্জি বা দীপিকা পাড়ুকোনকে কেউ সিনেমায় দেখেনি, যখন ইরফান খানের "রোগ"-এর গান লোকের মুখে মুখে ঘুরত। এটা সেই সময়ের গল্প যখন সারা পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল হয়ে উঠেছিল সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নিয়ে, যখন ভারতবর্ষ থমকে গিয়েছিল ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপের প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়ে, যখন লোকে মোবাইলে রিং টোন বানিয়ে বন্ধুদের পাঠাত।
এরকম সময় আমার বাইশ বছর জন্মদিনের দিন আমি সকালে উঠলাম খুশী মনে। গতকাল আমার যাদবপুরের শেষ পরীক্ষা হয়ে গেছে। এখন প্রায় আড়াই মাস ছুটি। তারপর আমার ফ্লোরিডা ভ্রমণ। সকাল থেকেই আত্মীয় স্বজনদের ফোন আসতে শুরু করল। আমাদের পরিবারে একটি কুসংস্কারের জন্য জন্মদিন পালন হয়না। আমি সকালে অন্যান্য দিনের মতই স্নান খাওয়া করে বেরিয়ে পড়লাম। কলেজে যাব। তবে অন্য কারণে। আমাদের বন্ধু আশিস গেটে ভালো র্যঙ্ক করেছে। তাই আজ খাওয়াবে। রোজকার মত অটো করে বেহালা চৌরাস্তা, তারপর বাসে করে যাদবপুর। বাওয়ারচিতে ভরপেট খেয়ে গাছতলায় বসে আড্ডা দিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন সন্ধ্যা হবে। ঠিক হল দু'দিন পর আমরা বর্ধমান যাব।
বাবা বর্ধমানে একাই থাকত। আমরা সকালের ট্রেন নিয়ে দুপুর নাগাদ বাড়ি পৌঁছালাম। ২০০৬ এ আমরা ফ্ল্যাট পালটেছিলাম। কিন্তু আমি তখন দিল্লীতে ইন্টার্নশিপ করছি। তারপর আর কাজের চাপে বর্ধমান যাওয়া হয়নি তেমন। নতুন ফ্ল্যাটের সবার সাথে সেভাবে আলাপ ছিল না। কয়েকজনকে চিনতাম, যেমন আমাদের প্রতিবেশী ছোটু। ছোটু আমার ছোটবেলার বন্ধু। একসাথে ক্রিকেট খেলেছি। আমাদের তারাবাগের এক একটা ব্লকে চারটি করে ফ্ল্যাট থাকত। আমরা আর ছোটুরা দোতলায় থাকতাম। একতলায় তুয়া-টুটু দুই ভাই বোন আর নন্দ জেঠুরা। তিনতলায় সায়নীরা আর শ্রাবণীদিরা। বাকিদের সবার সঙ্গে চেনা জানা থাকলেও একদম চিনতাম না শ্রাবনীদি দেবাঙ্গনদাকে। শ্রাবণীদি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে সদ্য জয়েন করেছে, অধ্যাপক হিসেবে।
কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের একটা দারুণ দল হয়ে গেল। রোজ বিকেলে চা খেতে খেতে ছাদে আড্ডা। দেবাঙ্গনদা রসিয়ে গল্প করতে পারে। আমি কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে যাচ্ছি শুনে বলল -- "জানিস আমি সফটওয়ার শুনে খুব ঘাবড়ে যাই। ছোট থেকে হার্ডওয়ার বলতে বড় বড় দোকান দেখেছি। সফটওয়ার শুনে ভাবলাম এটা কি? হোসিয়ারি?" একদিন তো ছাদে সবাই মিলে পিকনিক করলাম সন্ধ্যাবেলা। যারা সঞ্জীববাবুর শিউলি পড়েছেন, তারা জানবেন, আমরা প্রায় ওরকম জীবন কাটাতাম।
একদিনের কথা মনে পড়ে, সেদিন ছাদে তখনও কেউ আসেনি। আমি একা। চুপচাপ ছাদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মনে মনে ভাবতাম আচ্ছা এরকম ভাবে তারাবাগে আমাদের ছাদে আবার কবে আমি এভাবে বসে থাকতে পারব। হয়ত কালকেই পারব। হয়ত এই পুরো সপ্তাহটা পারব। কিন্তু তারপর? একদিন এই বাড়িটা ছেড়ে আমি অনেক দূরে চলে যাব। তখন কি এটার কথা মনে পড়বে? মনে পড়েছিল। বার বার মনে পড়ত। তাই ২০১৭-এ যেদিন আমরা শেষবারের মত তারাবাগ ছাড়ি, যেদিন মিডলসবরোকে হারিয়ে লিভারপুল চ্যাম্পিয়ান্স লিগে থাকা নিশ্চিত করছে, সেদিনও আমি উঠে গেছিলাম ছাদে।
এর মধ্যে ফ্লোরিডা থেকে আমার আই টুয়েন্টি চলে এল। যারা জানেন না তাদের জন্য বলি -- স্টুডেন্ট ভিসায় মার্কিন দেশে আসতে গেলে এই নথিটি লাগে। অনলাইনে ভিসার দিন ঠিক করলাম। আমার স্কলারশিপ ছিল। তাও কেউ কেউ বলল বাড়ির দলিল, নথি দেখানো উচিত। যদি ঝামেলা করে। আমি আর বাবা বর্ধমানে এক উকিলের বাড়ি গেলাম। তিনি সমস্ত নথি বানিয়ে দিলেন। এরপর জুনের শেষ দিকে আমরা আবার কলকাতা ফিরলাম। ভিসার আগে সবাই দুশ্চিন্তায় ফেলে দিল। তখন স্টুডেন্ট ভিসা, বিশেষত যারা পি এইচ ডি করতে যাচ্ছে, তাদের একটি পিঙ্ক স্লিপ দিত মাঝে মাঝে। কিছুই না, ভিসা হয়ে যেত। কিন্তু দেরী হত কয়েক সপ্তাহ। যাই হোক, আমার ক্ষেত্রে সেসব হলনা। ভিসা অফিসার মহিলা বললেন "ভিসা ইজ এপ্রুভড।" কাউন্টারের বাঙালি মহিলা বললেন -- "আজ শুক্রবার তো? আজকেই পেয়ে যাবেন। বিকেলে আসুন।"
ইন্টার্ভিউ দিয়ে বাইরে বেরোতেই এক দল লোক ছেঁকে ধরল -- "লোন লাগবে?" না জানিয়ে বাবাকে বললাম যে আজকেই ভিসা পাবো। কি করবে? পার্ক স্ট্রিট থেকে আমাদের শকুন্তলা পার্কের বাড়িতে ফিরে আবার চারটের মধ্যে আসা সময়সাপেক্ষ। তাই আমরা ঐ অঞ্চলেই ঘুরে বেড়ালাম। দুপুরে ডমিনোজে পিতজা খেলাম। বাবা সেই প্রথম জীবনে পিতজা খেলেন। আমি এর আগে একবারই খেয়েছি দিল্লীতে। আজকাল হয়ত কলকাতায় কলেজে পড়া ছেলেদের কাছে পিতজাটা কোন বিলাসিতা না। কিন্তু সেই সময় আমাদের মত মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেদের কাছে তা ছিল বইকি।
ভিসা নিয়ে আবার বর্ধমান ফিরলাম। এবার আমি আমার স্কুল জীবনের শিক্ষক শিশিরবাবুর কাছে ভর্তি হলাম জাভা শিখব বলে। আমার পুরনো এটলাস গোল্ডলাইন সুপারটা আবার ঝেড়ে বার করা হল। কতদিন বাদে সেই স্কুল জীবনের মত সাইকেল করে পড়তে যাচ্ছিলাম। একদিন আমরা তারাবাগের ব্লকের সবাই মিলে গাড়ি ভাড়া করে ঘুরতে বেরোলাম। দামোদারের পার ঘুরে, শের আফগানের সমাধি ঘুরে, কঙ্কালিতলা হয়ে দারুণ এক সন্ধ্যা কাটালাম। এর মধ্যে আমার প্লেনের টিকিট কাটা হয়ে গেল। ঠিক হল ৬ আগস্ট ভোর একটার প্লেনে আমরা অনেকে মিলে একসাথে যাব। তখন কলকাতা থেকে লুফথান্সা চলত। সেই প্লেনে আমরা যাদবপুরের বন্ধুরা মিলে যাব ফ্র্যাঙ্কফুর্ট। সঙ্গে থাকবে আমার রুমমেট সায়ক। সেখান থেকে আমি আর সায়ক ওয়াশিংটন ডি সি হয়ে যাব ফ্লোরিডার ওরল্যান্ডো।
বলতে ভুলে গেছি এই ছুটিতেই আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম ফ্লোরিডায় কে কে একসাথে থাকব। তখন ফেসবুকের এত রমরমা ছিল না। ফ্লোরিডার বাঙালি ছাত্র ছাত্রীদের একটা ইয়াহু মেলিং গ্রুপ ছিল। আমি এডমিশন পাওয়ার পর পর সেখানে ঢুকে পরেছিলাম। সায়কের সঙ্গে আলাপ আর এক পরিচিতর মাধ্যমে। একদিন সেই মেলিং গ্রুপে দেখলাম এক বাঙালি ছাত্র, নাম অনিরুদ্ধ, মেল করেছে তার দুটি রুমমেট লাগবে। মেল পড়েই আমরা উত্তর দিলাম আমরা রাজি। অনিরুদ্ধদা এর মধ্যে একদিন কলকাতা এলো। ওর বাড়ি বালিগঞ্জে। একদিন ওর বাড়িতে আমি আর সায়ক দুপুরে লাঞ্চের নেমন্তন্নে গেলাম। প্রচুর আড্ডা হল। অনিদা বলল ও ২০ আগস্ট নাগাদ ফ্লোরিডা ফিরবে। আমরা তার মধ্যে যেন লিজ সই করে বাড়িতে ঢুকে যাই। কিন্তু আমরা যেন বেশী আসবাব বা বাসনপত্র না কিনি। কারণ ওর সব আছে, ও সেগুলো নিয়ে আসবে।
এভাবে একদিন বর্ধমানের পাট শেষ হল ২২শে জুলাই। আর দু সপ্তাহ বাদে আমার যাত্রা। এবার কলকাতা ফিরতে হবে। ব্যাগ কিনতে হবে, ব্যাগ গোছাতে হবে। যেদিন তারাবাগ ছেড়ে এলাম সেদিন আমাদের রিক্সার পাশে ব্লকের ছটা ফ্ল্যাটের সবাই নেমে এসেছিল। কৃষ্ণাদি আমাদের বাড়িতে মাকে সাহায্য করত। আমি চলে যাচ্ছি বলে কেঁদে ফেলেছিল। সবাই বলল সাবধানে থাকিস, দেবাঙ্গনদা বলল চিঠি লিখিস। কথা দিলাম লিখব। কৃষ্ণাদির স্বামী শম্ভুদা আমাদের স্টেশনে নিয়ে এল রিক্সায়। ট্রেনটা যখন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, যখন হলুদ সাইনবোর্ডে বর্ধমান লেখাটা শেষবারের মত দেখলাম, আমার কান্না পাচ্ছিল।
বার বার চোখ মুছেও দেখলাম চোখের লাল ভাবটা যাচ্ছেনা। বাবা বলল কলকাতা গিয়ে তোর ডাক্তারমামাকে দেখাস। হয়ত জয় বাংলা। তখনো জানতাম না জয় বাংলায় শেষ না, কলকাতায় কি ভয়ানক ব্যাধি অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
এরকম সময় আমার বাইশ বছর জন্মদিনের দিন আমি সকালে উঠলাম খুশী মনে। গতকাল আমার যাদবপুরের শেষ পরীক্ষা হয়ে গেছে। এখন প্রায় আড়াই মাস ছুটি। তারপর আমার ফ্লোরিডা ভ্রমণ। সকাল থেকেই আত্মীয় স্বজনদের ফোন আসতে শুরু করল। আমাদের পরিবারে একটি কুসংস্কারের জন্য জন্মদিন পালন হয়না। আমি সকালে অন্যান্য দিনের মতই স্নান খাওয়া করে বেরিয়ে পড়লাম। কলেজে যাব। তবে অন্য কারণে। আমাদের বন্ধু আশিস গেটে ভালো র্যঙ্ক করেছে। তাই আজ খাওয়াবে। রোজকার মত অটো করে বেহালা চৌরাস্তা, তারপর বাসে করে যাদবপুর। বাওয়ারচিতে ভরপেট খেয়ে গাছতলায় বসে আড্ডা দিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন সন্ধ্যা হবে। ঠিক হল দু'দিন পর আমরা বর্ধমান যাব।
বাবা বর্ধমানে একাই থাকত। আমরা সকালের ট্রেন নিয়ে দুপুর নাগাদ বাড়ি পৌঁছালাম। ২০০৬ এ আমরা ফ্ল্যাট পালটেছিলাম। কিন্তু আমি তখন দিল্লীতে ইন্টার্নশিপ করছি। তারপর আর কাজের চাপে বর্ধমান যাওয়া হয়নি তেমন। নতুন ফ্ল্যাটের সবার সাথে সেভাবে আলাপ ছিল না। কয়েকজনকে চিনতাম, যেমন আমাদের প্রতিবেশী ছোটু। ছোটু আমার ছোটবেলার বন্ধু। একসাথে ক্রিকেট খেলেছি। আমাদের তারাবাগের এক একটা ব্লকে চারটি করে ফ্ল্যাট থাকত। আমরা আর ছোটুরা দোতলায় থাকতাম। একতলায় তুয়া-টুটু দুই ভাই বোন আর নন্দ জেঠুরা। তিনতলায় সায়নীরা আর শ্রাবণীদিরা। বাকিদের সবার সঙ্গে চেনা জানা থাকলেও একদম চিনতাম না শ্রাবনীদি দেবাঙ্গনদাকে। শ্রাবণীদি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে সদ্য জয়েন করেছে, অধ্যাপক হিসেবে।
কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের একটা দারুণ দল হয়ে গেল। রোজ বিকেলে চা খেতে খেতে ছাদে আড্ডা। দেবাঙ্গনদা রসিয়ে গল্প করতে পারে। আমি কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে যাচ্ছি শুনে বলল -- "জানিস আমি সফটওয়ার শুনে খুব ঘাবড়ে যাই। ছোট থেকে হার্ডওয়ার বলতে বড় বড় দোকান দেখেছি। সফটওয়ার শুনে ভাবলাম এটা কি? হোসিয়ারি?" একদিন তো ছাদে সবাই মিলে পিকনিক করলাম সন্ধ্যাবেলা। যারা সঞ্জীববাবুর শিউলি পড়েছেন, তারা জানবেন, আমরা প্রায় ওরকম জীবন কাটাতাম।
একদিনের কথা মনে পড়ে, সেদিন ছাদে তখনও কেউ আসেনি। আমি একা। চুপচাপ ছাদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মনে মনে ভাবতাম আচ্ছা এরকম ভাবে তারাবাগে আমাদের ছাদে আবার কবে আমি এভাবে বসে থাকতে পারব। হয়ত কালকেই পারব। হয়ত এই পুরো সপ্তাহটা পারব। কিন্তু তারপর? একদিন এই বাড়িটা ছেড়ে আমি অনেক দূরে চলে যাব। তখন কি এটার কথা মনে পড়বে? মনে পড়েছিল। বার বার মনে পড়ত। তাই ২০১৭-এ যেদিন আমরা শেষবারের মত তারাবাগ ছাড়ি, যেদিন মিডলসবরোকে হারিয়ে লিভারপুল চ্যাম্পিয়ান্স লিগে থাকা নিশ্চিত করছে, সেদিনও আমি উঠে গেছিলাম ছাদে।
এর মধ্যে ফ্লোরিডা থেকে আমার আই টুয়েন্টি চলে এল। যারা জানেন না তাদের জন্য বলি -- স্টুডেন্ট ভিসায় মার্কিন দেশে আসতে গেলে এই নথিটি লাগে। অনলাইনে ভিসার দিন ঠিক করলাম। আমার স্কলারশিপ ছিল। তাও কেউ কেউ বলল বাড়ির দলিল, নথি দেখানো উচিত। যদি ঝামেলা করে। আমি আর বাবা বর্ধমানে এক উকিলের বাড়ি গেলাম। তিনি সমস্ত নথি বানিয়ে দিলেন। এরপর জুনের শেষ দিকে আমরা আবার কলকাতা ফিরলাম। ভিসার আগে সবাই দুশ্চিন্তায় ফেলে দিল। তখন স্টুডেন্ট ভিসা, বিশেষত যারা পি এইচ ডি করতে যাচ্ছে, তাদের একটি পিঙ্ক স্লিপ দিত মাঝে মাঝে। কিছুই না, ভিসা হয়ে যেত। কিন্তু দেরী হত কয়েক সপ্তাহ। যাই হোক, আমার ক্ষেত্রে সেসব হলনা। ভিসা অফিসার মহিলা বললেন "ভিসা ইজ এপ্রুভড।" কাউন্টারের বাঙালি মহিলা বললেন -- "আজ শুক্রবার তো? আজকেই পেয়ে যাবেন। বিকেলে আসুন।"
ইন্টার্ভিউ দিয়ে বাইরে বেরোতেই এক দল লোক ছেঁকে ধরল -- "লোন লাগবে?" না জানিয়ে বাবাকে বললাম যে আজকেই ভিসা পাবো। কি করবে? পার্ক স্ট্রিট থেকে আমাদের শকুন্তলা পার্কের বাড়িতে ফিরে আবার চারটের মধ্যে আসা সময়সাপেক্ষ। তাই আমরা ঐ অঞ্চলেই ঘুরে বেড়ালাম। দুপুরে ডমিনোজে পিতজা খেলাম। বাবা সেই প্রথম জীবনে পিতজা খেলেন। আমি এর আগে একবারই খেয়েছি দিল্লীতে। আজকাল হয়ত কলকাতায় কলেজে পড়া ছেলেদের কাছে পিতজাটা কোন বিলাসিতা না। কিন্তু সেই সময় আমাদের মত মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেদের কাছে তা ছিল বইকি।
ভিসা নিয়ে আবার বর্ধমান ফিরলাম। এবার আমি আমার স্কুল জীবনের শিক্ষক শিশিরবাবুর কাছে ভর্তি হলাম জাভা শিখব বলে। আমার পুরনো এটলাস গোল্ডলাইন সুপারটা আবার ঝেড়ে বার করা হল। কতদিন বাদে সেই স্কুল জীবনের মত সাইকেল করে পড়তে যাচ্ছিলাম। একদিন আমরা তারাবাগের ব্লকের সবাই মিলে গাড়ি ভাড়া করে ঘুরতে বেরোলাম। দামোদারের পার ঘুরে, শের আফগানের সমাধি ঘুরে, কঙ্কালিতলা হয়ে দারুণ এক সন্ধ্যা কাটালাম। এর মধ্যে আমার প্লেনের টিকিট কাটা হয়ে গেল। ঠিক হল ৬ আগস্ট ভোর একটার প্লেনে আমরা অনেকে মিলে একসাথে যাব। তখন কলকাতা থেকে লুফথান্সা চলত। সেই প্লেনে আমরা যাদবপুরের বন্ধুরা মিলে যাব ফ্র্যাঙ্কফুর্ট। সঙ্গে থাকবে আমার রুমমেট সায়ক। সেখান থেকে আমি আর সায়ক ওয়াশিংটন ডি সি হয়ে যাব ফ্লোরিডার ওরল্যান্ডো।
বলতে ভুলে গেছি এই ছুটিতেই আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম ফ্লোরিডায় কে কে একসাথে থাকব। তখন ফেসবুকের এত রমরমা ছিল না। ফ্লোরিডার বাঙালি ছাত্র ছাত্রীদের একটা ইয়াহু মেলিং গ্রুপ ছিল। আমি এডমিশন পাওয়ার পর পর সেখানে ঢুকে পরেছিলাম। সায়কের সঙ্গে আলাপ আর এক পরিচিতর মাধ্যমে। একদিন সেই মেলিং গ্রুপে দেখলাম এক বাঙালি ছাত্র, নাম অনিরুদ্ধ, মেল করেছে তার দুটি রুমমেট লাগবে। মেল পড়েই আমরা উত্তর দিলাম আমরা রাজি। অনিরুদ্ধদা এর মধ্যে একদিন কলকাতা এলো। ওর বাড়ি বালিগঞ্জে। একদিন ওর বাড়িতে আমি আর সায়ক দুপুরে লাঞ্চের নেমন্তন্নে গেলাম। প্রচুর আড্ডা হল। অনিদা বলল ও ২০ আগস্ট নাগাদ ফ্লোরিডা ফিরবে। আমরা তার মধ্যে যেন লিজ সই করে বাড়িতে ঢুকে যাই। কিন্তু আমরা যেন বেশী আসবাব বা বাসনপত্র না কিনি। কারণ ওর সব আছে, ও সেগুলো নিয়ে আসবে।
এভাবে একদিন বর্ধমানের পাট শেষ হল ২২শে জুলাই। আর দু সপ্তাহ বাদে আমার যাত্রা। এবার কলকাতা ফিরতে হবে। ব্যাগ কিনতে হবে, ব্যাগ গোছাতে হবে। যেদিন তারাবাগ ছেড়ে এলাম সেদিন আমাদের রিক্সার পাশে ব্লকের ছটা ফ্ল্যাটের সবাই নেমে এসেছিল। কৃষ্ণাদি আমাদের বাড়িতে মাকে সাহায্য করত। আমি চলে যাচ্ছি বলে কেঁদে ফেলেছিল। সবাই বলল সাবধানে থাকিস, দেবাঙ্গনদা বলল চিঠি লিখিস। কথা দিলাম লিখব। কৃষ্ণাদির স্বামী শম্ভুদা আমাদের স্টেশনে নিয়ে এল রিক্সায়। ট্রেনটা যখন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, যখন হলুদ সাইনবোর্ডে বর্ধমান লেখাটা শেষবারের মত দেখলাম, আমার কান্না পাচ্ছিল।
বার বার চোখ মুছেও দেখলাম চোখের লাল ভাবটা যাচ্ছেনা। বাবা বলল কলকাতা গিয়ে তোর ডাক্তারমামাকে দেখাস। হয়ত জয় বাংলা। তখনো জানতাম না জয় বাংলায় শেষ না, কলকাতায় কি ভয়ানক ব্যাধি অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
No comments:
Post a Comment