টি ভি এফ-এর "ইয়ে মেরি ফ্যামিলি" সিরিজে একটি দামী কথা বলেছিলেন মোনা সিং। ছেলে কখন বাড়ি ছেড়ে চলে যায় বোঝাই যায় না। মনে হয় পড়তে গেছে, ক'দিন বাদেই ফিরবে। সেই ফেরাটা কোনদিনই আগের মত বাড়ি থাকা হয়না।
কলকাতা পৌঁছে আমি এরকম বাড়ি ছাড়ার জন্য তৈরি হতে লাগলাম। আমার জয় বাংলাটা এক-দু দিনের মধ্যেই সেরে গেল। তারপর একদিন আমরা গেলাম ব্যাগ কিনতে। এখন আমাদের পরিবারে আগে কেউ কোনদিন বিদেশ যায়নি। তাই চেক-ইন লাগেজ কি হতে পারে আমরা ভাবতে লাগলাম। কেউ কেউ বলল হার্ড লাগেজ নিতে, কেউ কেউ বলল সফট লাগেজ। একদিন আমার বড়মামার গাড়ি করে আমরা সকলে, মানে আমি, মা, বাবা, বড় মামা আর মামি মিলে প্যান্টালুন্সে গেলাম ব্যাগ কিনতে। সবাই বলেছিল ভালো ব্যাগ কিনতে -- এত বড় জার্নি, ব্যাগ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অবশেষে আমেরিকান টুরিস্টারের একটা লাল সফট আর একটা নীল হার্ড লাগেজ কেনা হল। দুর্ভাগ্যের কথা, ঐ নীল ব্যাগটি আমেরিকা পৌঁছাতে পৌঁছাতেই ভেঙ্গে যায়। তাই ওটি আর কোনদিন ব্যবহার করতে পারিনি।
সেদিন ব্যাগ কিনে বাড়ি ফিরে বুঝতে পারলাম দাঁতে একটা অস্বস্তি হচ্ছে। পরেরদিন বেহালা চৌরাস্তায় ডাক্তারবাবুকে দেখালাম। উনি দেখে বললেন -- "সর্বনাশ করেছ। তোমার একটা আক্কেল দাঁত দুটো সুস্থ দাঁতের মধ্যে দিয়ে বেরোতে চাইছে; পারছে না। তাই এখানে ইনফেকশন করেছে। দাঁত তুলতে হবে।"
"কিন্তু আমার যে আর ক'দিন বাদেই আমেরিকা যাওয়া।"
"অসম্ভব। তোমার সুস্থ হতে মিনিমাম এক সপ্তাহ লাগবে। টিকিট পাল্টাও।"
পাল্টানো হল। পার্ক স্ট্রিটের আল্পস ট্র্যাভেলসের মালকিন তাড়াহুড়ো করে একটা সস্তার টিকিট করে দিলেন বটে। কিন্তু আমার সব বন্ধুরা আলাদা চলে যাবে। আমি একা এত বড় যাত্রা করব। পাক্কা দু ঘণ্টা ধরে আমার দাঁতের উপর কসরত চালালেন ডাক্তার বর্মন। যার ফলে আমার নর্মাল খাওয়া দাওয়া পুরো বন্ধ হয়ে গেল ৪-৫ দিনের জন্য। আমি শুধু খেতে পেতাম আইসক্রিম আর রসগোল্লা। প্রথম প্রথম কথা বলাও বারণ ছিল। আসতে আসতে সেসব মিটল।
আমার বাবা কয়েক বছর আগে ইউ জি সির কাজে একবার প্লেনে দিল্লী গিয়েছিলেন। বাবা ফিরে এসে গল্প করেছিলেন। সিকিউরিটি চেকের পর একটা বড় ঘরে সবাইকে বসতে দেয়। তারপর একটা করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন প্লেনের ভেতরে ঢুকে পরা হয়।
১১ই আগস্ট ২০০৭ রাত্রে আমি মনে হয় এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমোতে গিয়েছিলাম। পরেরদিন বেলা করে উঠলাম। মা আমার জন্য দুপুরে আলুপোস্ত করে রেখেছিলেন। মাংস খাওয়ার মত দাঁতের অবস্থা নেই। রাত ১টায় প্লেন। আমাকে সবাই বলে দিয়েছিল -- বড় জার্নি, রেস্ট নে বাড়িতে, দুপুরে ঘুমিয়ে নিস। শুলাম। কিন্তু ঘুম এলো না। বাবা দেখি বাইরের ঘরে একা একা বসে আছে। বাবার কোলে মাথা দিয়ে শুলাম। টি ভি-তে "এই ঘর, এই সংসার" চলছিল। তাই দেখলাম দুজন মিলে। বিকেলবেলা তারাবাগ থেকে কণিকাকাকিমা ফোন করলেন। ওনার ভাইয়ের শালী, ত্রিশিখীদিও আমার সঙ্গে একই প্লেনে ফ্র্যাঙ্কফুর্ট যাচ্ছে। তারপর উনি টরোন্টো যাবেন। ভালোই হল, চেনা জানা কেউ তো থাকল।
সন্ধ্যেবেলা গোপু মামা আর জয়া মাইমা এলেন আমাদের বাড়ি। ওনারা জানতেন না সেদিন আমাদের যাত্রা। গোপুমামা ঠিক করল রাত্রে এয়ারপোর্ট যাবেন আমাদের সাথে। রাত নটা নাগাদ আমরা বেরোলাম। বৃষ্টি পরছিল। প্রথমে গেলাম মামাবাড়ি। দিদাকে প্রণাম করলাম। দিদা জানতে চাইল পুজোতে আসব কিনা।
অবশেষে দুই গাড়ি ভর্তি বেহালাবাসী আমাকে সি অফ করতে দমদম ছুটল। এক গাড়িতে বাবা, গোপুমামা, আমার বড় মামা আর আমার সেজ মামা। অন্য গাড়িতে বড় মামি, ফুল মামির সঙ্গে মা আর আমি। মা পুরো সময়টা আমার হাত ধরে ছিলেন। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি তো বড় হয়ে গেছি। বাড়ির বাইরে, দেশের বাইরে পড়তে যাচ্ছি। দমদমে নেমে সব ব্যাগ গুছিয়ে আবার এক রাউন্ড প্রণাম সেরে আমি গেটম্যানকে টিকিট দেখিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। সবাই বাইরে থেকে হাত নাড়ছিল। কথা দিয়েছিলাম আমার লাগেজ চেক ইন হয়ে গেলে আর একবার কাঁচের ভেতর থেকে হাত নেড়ে যাব। লাগেজের লাইনে আলাপ হল যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপিকা দেবশ্রী দত্তরায়ের সঙ্গে। লাগেজ চেক ইন করে যখন হাত নাড়লাম, সবাইকে দেখতে পেলাম। মায়ের চোখে জলটাও দেখতে ভুল করলাম না। আমার মোবাইল ফোনটা না আনার জন্য আক্ষেপ করলাম। অবশেষে আমি ইমিগ্রেশনের লাইনে অগ্রসর হলাম।
কলকাতা পৌঁছে আমি এরকম বাড়ি ছাড়ার জন্য তৈরি হতে লাগলাম। আমার জয় বাংলাটা এক-দু দিনের মধ্যেই সেরে গেল। তারপর একদিন আমরা গেলাম ব্যাগ কিনতে। এখন আমাদের পরিবারে আগে কেউ কোনদিন বিদেশ যায়নি। তাই চেক-ইন লাগেজ কি হতে পারে আমরা ভাবতে লাগলাম। কেউ কেউ বলল হার্ড লাগেজ নিতে, কেউ কেউ বলল সফট লাগেজ। একদিন আমার বড়মামার গাড়ি করে আমরা সকলে, মানে আমি, মা, বাবা, বড় মামা আর মামি মিলে প্যান্টালুন্সে গেলাম ব্যাগ কিনতে। সবাই বলেছিল ভালো ব্যাগ কিনতে -- এত বড় জার্নি, ব্যাগ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অবশেষে আমেরিকান টুরিস্টারের একটা লাল সফট আর একটা নীল হার্ড লাগেজ কেনা হল। দুর্ভাগ্যের কথা, ঐ নীল ব্যাগটি আমেরিকা পৌঁছাতে পৌঁছাতেই ভেঙ্গে যায়। তাই ওটি আর কোনদিন ব্যবহার করতে পারিনি।
সেদিন ব্যাগ কিনে বাড়ি ফিরে বুঝতে পারলাম দাঁতে একটা অস্বস্তি হচ্ছে। পরেরদিন বেহালা চৌরাস্তায় ডাক্তারবাবুকে দেখালাম। উনি দেখে বললেন -- "সর্বনাশ করেছ। তোমার একটা আক্কেল দাঁত দুটো সুস্থ দাঁতের মধ্যে দিয়ে বেরোতে চাইছে; পারছে না। তাই এখানে ইনফেকশন করেছে। দাঁত তুলতে হবে।"
"কিন্তু আমার যে আর ক'দিন বাদেই আমেরিকা যাওয়া।"
"অসম্ভব। তোমার সুস্থ হতে মিনিমাম এক সপ্তাহ লাগবে। টিকিট পাল্টাও।"
পাল্টানো হল। পার্ক স্ট্রিটের আল্পস ট্র্যাভেলসের মালকিন তাড়াহুড়ো করে একটা সস্তার টিকিট করে দিলেন বটে। কিন্তু আমার সব বন্ধুরা আলাদা চলে যাবে। আমি একা এত বড় যাত্রা করব। পাক্কা দু ঘণ্টা ধরে আমার দাঁতের উপর কসরত চালালেন ডাক্তার বর্মন। যার ফলে আমার নর্মাল খাওয়া দাওয়া পুরো বন্ধ হয়ে গেল ৪-৫ দিনের জন্য। আমি শুধু খেতে পেতাম আইসক্রিম আর রসগোল্লা। প্রথম প্রথম কথা বলাও বারণ ছিল। আসতে আসতে সেসব মিটল।
আমার বাবা কয়েক বছর আগে ইউ জি সির কাজে একবার প্লেনে দিল্লী গিয়েছিলেন। বাবা ফিরে এসে গল্প করেছিলেন। সিকিউরিটি চেকের পর একটা বড় ঘরে সবাইকে বসতে দেয়। তারপর একটা করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন প্লেনের ভেতরে ঢুকে পরা হয়।
১১ই আগস্ট ২০০৭ রাত্রে আমি মনে হয় এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমোতে গিয়েছিলাম। পরেরদিন বেলা করে উঠলাম। মা আমার জন্য দুপুরে আলুপোস্ত করে রেখেছিলেন। মাংস খাওয়ার মত দাঁতের অবস্থা নেই। রাত ১টায় প্লেন। আমাকে সবাই বলে দিয়েছিল -- বড় জার্নি, রেস্ট নে বাড়িতে, দুপুরে ঘুমিয়ে নিস। শুলাম। কিন্তু ঘুম এলো না। বাবা দেখি বাইরের ঘরে একা একা বসে আছে। বাবার কোলে মাথা দিয়ে শুলাম। টি ভি-তে "এই ঘর, এই সংসার" চলছিল। তাই দেখলাম দুজন মিলে। বিকেলবেলা তারাবাগ থেকে কণিকাকাকিমা ফোন করলেন। ওনার ভাইয়ের শালী, ত্রিশিখীদিও আমার সঙ্গে একই প্লেনে ফ্র্যাঙ্কফুর্ট যাচ্ছে। তারপর উনি টরোন্টো যাবেন। ভালোই হল, চেনা জানা কেউ তো থাকল।
সন্ধ্যেবেলা গোপু মামা আর জয়া মাইমা এলেন আমাদের বাড়ি। ওনারা জানতেন না সেদিন আমাদের যাত্রা। গোপুমামা ঠিক করল রাত্রে এয়ারপোর্ট যাবেন আমাদের সাথে। রাত নটা নাগাদ আমরা বেরোলাম। বৃষ্টি পরছিল। প্রথমে গেলাম মামাবাড়ি। দিদাকে প্রণাম করলাম। দিদা জানতে চাইল পুজোতে আসব কিনা।
অবশেষে দুই গাড়ি ভর্তি বেহালাবাসী আমাকে সি অফ করতে দমদম ছুটল। এক গাড়িতে বাবা, গোপুমামা, আমার বড় মামা আর আমার সেজ মামা। অন্য গাড়িতে বড় মামি, ফুল মামির সঙ্গে মা আর আমি। মা পুরো সময়টা আমার হাত ধরে ছিলেন। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি তো বড় হয়ে গেছি। বাড়ির বাইরে, দেশের বাইরে পড়তে যাচ্ছি। দমদমে নেমে সব ব্যাগ গুছিয়ে আবার এক রাউন্ড প্রণাম সেরে আমি গেটম্যানকে টিকিট দেখিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। সবাই বাইরে থেকে হাত নাড়ছিল। কথা দিয়েছিলাম আমার লাগেজ চেক ইন হয়ে গেলে আর একবার কাঁচের ভেতর থেকে হাত নেড়ে যাব। লাগেজের লাইনে আলাপ হল যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপিকা দেবশ্রী দত্তরায়ের সঙ্গে। লাগেজ চেক ইন করে যখন হাত নাড়লাম, সবাইকে দেখতে পেলাম। মায়ের চোখে জলটাও দেখতে ভুল করলাম না। আমার মোবাইল ফোনটা না আনার জন্য আক্ষেপ করলাম। অবশেষে আমি ইমিগ্রেশনের লাইনে অগ্রসর হলাম।
No comments:
Post a Comment