Sunday, May 31, 2020

প্রবাসীর ডায়রি ৩ঃ যাত্রাপথে

ইমিগ্রেশন করে যখন গেটের দিকে এগোলাম, পিছন থেকে একটা ডাক শুনলাম

-- তুই কণাদ না?

তাকিয়ে দেখি প্রাঞ্জলদা। প্রাঞ্জলদা আমার সঙ্গে ফ্লোরিডা যাচ্ছে অঙ্কে পিএইচডি করতে। অর্কুটে আলাপ ছিল। সামনে প্রথম দেখা। প্রাঞ্জলদা সঙ্গে যাচ্ছে জেনে মন ভালো ছিল বটে, কিন্তু একটু বাদেই জানতে পারলাম ও অন্য প্লেনে যাবে। মানে ফ্রাঙ্কফুর্ট অবধি একসাথে। তারপর আমি ওয়াশিংটন ডি সি। ও মায়ামি। তবু দুজনে কলকাতা এয়ারপোর্টে গেটের সামনে বসে আড্ডা দিলাম। তখন এয়ারপোর্টে একটি ফ্রি ফোন থাকত। শুধু লোকাল কল করা যেত ২ মিনিটের জন্য। একবার গিয়ে মা বাবার সাথে কথা বলে এলাম।

খানিকক্ষণ বাদেই হাজির হল ত্রিশিখিদি। বলেছিলাম আগেই, ত্রিশিখিদি আমাদের তারাবাগের কণিকাকাকিমার ভাইয়ের শ্যালিকা। তখন রাখি ছিল। দিদি তাই আমার জন্য এক বাক্স ক্যাডবারি সেলিব্রেশন নিয়ে এসেছিল। সেটা যদিও পরে আমাদের বেশ কাজে দিয়েছিল। যাই হোক, সে গল্প পরে। এ ছাড়াও এয়ারপোর্টে আলাপ হল আমার যাদবপুরের সিনিয়ার সোমদত্তাদি আর ওর মায়ের সঙ্গে। সোমদত্তাদি ওহায়োতে পড়ে। ২০১০-এ সোমদত্তাদির বাড়ি গিয়েছিলাম ম্যাসাচুসেটসে। ততদিনে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ওর বর ম্যাসাচুসেটসে আর্মহার্স্ট শহরে পিএইচডি করে।

এবার ঘোষণা হল প্লেনে ওঠার জন্য। বাবা যেমন বলেছিল, সেরকম এয়ারব্রিজের ভিতর দিয়ে আমি প্লেনে উঠলাম। এই প্রথম প্লেনে উঠলাম। বসার ব্যবস্থা ছিল ২-৫-২। আমি দু'জনের সিটে ধারে বসেছিলাম। পরে জেনেছি ওটাকে আইল সিট বলে। আমার পাশে এক অসমীয়া ভদ্রলোক বসেছিলেন। বললেন মেয়ের কাছে যাচ্ছেন। পোর্টল্যান্ড। তখন জানতামই না পোর্টল্যান্ড কোথায়। কে জানত আর চার বছর বাদে আমি ৩ মাসের উপর পোর্টল্যান্ডে থাকব।

প্লেনে ওঠার খানিকক্ষণের মধ্যেই খেতে দিল। বেশ খিদে পেয়েছিল বটে। সেই কখন ডিনার করেছি বাড়িতে। তবে খেতে গিয়ে মুস্কিল। জার্মান রুটি কি শক্ত। দাঁত ফোটানো যায়না। আর তার ক'দিন আগেই আমার দাঁতের অপারেশন হয়েছিল। কষ্ট করে খেলাম। ড্রিকন্স দিতে এসেছিল। কোকা কোলা নিলাম। প্লেনে তখন প্রতি সিটের সামনে টি ভি হতনা। কয়েকটা সিট ছেড়ে ছেড়ে মাঝে একটা করে বড় টিভি। সেই টি ভিতে শ্রেক দিয়েছিল। খানিকক্ষণ দেখলাম। তারপর ঘুমাতে গেলাম। যদিও ভালো ঘুম এলোনা। বার বার চিন্তা হতে লাগল আমার ব্যাগটা কেউ চুরি করে নেবে না তো?

সকালবেলা যখন ফ্রাঙ্কফুর্টে নামলাম তখন সকাল। উপর থেকে জার্মানিকে অসাধারণ লাগছিল। আমার সেই প্রথম বিদেশ দর্শন। ছোট ছোট বাড়ি। আর রাস্তা দিয়ে ছোট ছোট গাড়ি যাচ্ছে। পুরো মনে হচ্ছিল আমার ছোটবেলার হট উইলসের গাড়ি। ফ্রাঙ্কফুর্টে আমার ৬ ঘণ্টা স্টপ। ত্রিশিখিদির সাড়ে ৬ ঘণ্টা। কলকাতায় আলাপ হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা দেবশ্রীদির সঙ্গে। দেবশ্রীদির সাড়ে ৫ ঘণ্টা। তিনজন মিলে ফ্রাঙ্কফুর্টে একসঙ্গে বসে আড্ডা দিতে লাগলাম। তবে ত্রিশিখিদি খানিকক্ষণেই ঘুমিয়ে পড়ল। তখন আমি আর দেবশ্রীদি মিলে এয়ারপোর্ট ঘুরতে লাগলাম। একটা পে ফোন বুথ দেখে দেবশ্রীদি বলল -- "কণাদ, ফোন করবে বাড়িতে?"

দেবশ্রীদির কলিং কার্ড দিয়ে ফোন করলাম। মার সঙ্গে কয়েক সেকেন্ড কথা হল। তখন আমি বুঝতে অস্বীকার করেছিলাম যে ১২ সেকেন্ড কথা বলা আর ৫২ সেকেন্ড কথা বলার মধ্যে কোন তফাত নেই। একই দাম কাটবে। ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে আমি অনেক ইহুদি লোকজনকে দেখলাম তাদের নিজস্ব পোশাকে। ঘুরতে ঘুরতে আমরা ফিরে এলাম ত্রিশিখিদির কাছে। ত্রিশিখিদি তখন ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। সবার খিদে পেয়েছে হাল্কা। অতএব সেই ক্যাডবেরি সেলিব্রেশন খোলা হল। সবাই মনের আনন্দে তাই ভক্ষণ করলাম।

এবার বিদায় নেয়ার পালা। দেবশ্রীদি আগে বিদায় নিল। তারপর আমি।

এবার প্লেনে খুবই খারাপ সিট পেলাম। এবারে বসার ব্যবস্থা ছিল ৩-৪-৩। আমি একটি তিনের মাঝখানে বসেছিলাম। আমার এক ধারে একটি পোলিশ ছেলে। আমার অন্য পাশে একটি ভিয়েতনামি মেয়ে। বর্ধমানে ছোটবেলা থেকে ভিয়েতনাম নিয়ে এত কথা শুনেছি বলে উচ্ছ্বসিত ছিলাম, কিন্তু মেয়েটি  প্লেন চালু হতেই নাক ডাকিয়ে  ঘুমাল। পোলিশ ছেলেটি যদিও গপ্পে। জানতে পারলাম ছেলেটি নেভিতে কাজ করে। ভার্জিনিয়া যাচ্ছে। আমি জানতে চাইলাম এতদিন বাড়ির বাইরে থাকতে তার মন খারাপ করেনা। ছেলেটি বলল -- "বন্ধু, জাহাজই আমার বাড়ি।" একটি পোলিশ মুদ্রা দিয়েছিল। বহুদিন সেটি আমার সঙ্গে ছিল। এরপর কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল আর খুঁজে পাইনি।

ওয়াশিংটনে নেমে ইমিগ্রেশন করে লাগেজ আইডেন্টিফাই করতে হল। লাগেজ জমা দেওয়ার সময় এক ভদ্রলোক আমাকে "হাউ আর ইউ ডুইয়ং মাই ফ্রেন্ড?" বলায় আমি কি বলব বুঝিনি। এরকম অপরিচিত লোক কেমন আছি আগে কোনদিন জানতে চায়নি।

টার্মিনাল পাল্টে নতুন বোর্ডিং পাস নিয়ে আমি গেটের সামনে এলাম। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। একটা মেক্সিকান দোকান দেখে খেতে গেলাম। কিন্তু মুস্কিল হল কোন খাবারই তো আমি চিনিনা। তাই কিছুটা ন্যাচোস নিলাম। সমস্যা হল টাকা দিতে গিয়ে। আমি একটা দশ ডলারের নোট দিতে মেয়েটি কিছু খুচরো করে দিল। কিন্তু আমি তো মার্কিন মুদ্রা চিনিনা। এদিকে কেউ আমাকে ঠকাক সেটাও চাইব না। তাই মেয়েটিকে বললাম আমাকে বোঝাও কোনটি কি। ভাগ্যিস আসে পাশে আর কোন খদ্দের ছিলনা।

এই প্লেনে সবচেয়ে খারাপ জায়গায় বসলাম। মাঝের তিন জনের সিটের ঠিক মাঝে। ২ ঘণ্টার প্লেন যখন অরল্যান্ডো এয়ারপোর্টে পৌঁছাল, তখন রাত ১০টা। গেন্সভিলের এক সিনিয়ার দাদার বাড়িতে এক সপ্তাহ থাকব ঠিক ছিল। দাদা এয়ারপোর্টে এসেছিলেন আমাকে নিতে। দাদার বাড়ি যখন পৌঁছালাম তখন মধ্যরাত। কোনওরকমে রাতের ডিনার করে শুয়ে পড়লাম। মার্কিন মাটিতে প্রথম রাতে আমার চোখে, মাথায়, শরীরে, মানে অনুপামদার গানে যেখানে যেখানে "তুমি মেখে আছো" হয়, সেসব জায়গায় শুধুই ঘুম ছিল। 

No comments:

Post a Comment