এ অনেকদিনের পুরোন গল্প। আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। আমি তখন সবে বর্ধমান মেডিকাল কলেজের থার্ড ইয়ারে পড়ি। আমি তারাবাগে বাড়িতে থেকেই যাতায়াত করি। আমাদের বাড়ির পাশেই একটা গ্রাম, নাম গোদাগ্রাম। ঐ গ্রাম থেকে লোকজন এসে আমাদের পাড়ার সকলের বাড়িতে সাহায্য করতেন। আমাদের বাড়িতে যিনি আসতেন তাঁর নাম কমলাদি। কমলাদির মেয়ে ফুচি। বয়স বছর ৭-৮। স্কুলে টুলে যায় না। বাড়ির কাজকম্ম করে। কমলাদিকে বললে বলে -- "কি হবে বাবু পড়াশুনা করে? তার চেয়ে বাড়ির কাজটা শিখুক। বিয়ে দিতে পারব।"
আমরা কয়েকজন মেডিকাল কলেজের ছাত্র মিলে ঠিক করলাম ছুটির দিনে এরকম ফুচির মত ছেলে মেয়েদের পড়াব। কাউন্সিলার চয়নবাবুর সাহায্যে সে আয়োজনও হয়ে গেল সহজেই। সামান্য অঙ্ক, টাকা পয়সার হিসেব, বাংলা লেখা, ইংরেজি সংখ্যা চেনানো, এসব হত আর কি। ফুচির কিন্তু শেখার ভীষণ আগ্রহ ছিল। আমার মতে প্রচণ্ড শার্প মেয়ে। কমলাদির বড় ছেলে রতন বোধহয় বর্ধমানে রিক্সা চালাত। একদিন মাথায় ভুত চাপে, সব ছেড়ে কলকাতা চলে যায় সিনেমার হিরো হতে। কমলাদি দুঃখ করেন -- "আমার কপাল, ছেলেটা জলে গেল।" ফুচির কিন্তু দাদাকে নিয়ে ভীষণ গর্ব। "দেখবেন কানুদা, আমার দাদা একদিন প্রসেঞ্জিতের মত হিরো হবে। আপনি আমাকে দাদার সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবেন তো?"
একদিন কমলাদি আমাদের বাড়ি এলেন একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে। তাতে গোটা চারেক ছানার কেক। মা জিজ্ঞেস করে -- "কি হল কমলা?"
"আর বৌদি, কি বলবো। আমার ছেলে সিনেমায় চান্স পেয়েছে। রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে। পরের বছর বেরোবে।"
"সেকি গো? দারুণ খবর তো।"
ফুচি আমাদের ছুটির ক্লাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে গেল। "জানেন, আমার দাদার সাথে দেবশ্রী রায় সিনেমা করতে চায়, কিন্তু দাদার শতাব্দীকেই পছন্দ।"
"সেকি? কেন? দেবশ্রী খারাপ কি?"
"নাহ, আমার শতাব্দীকে ভালো লাগে। আপনার কাকে ভালো লাগে কানুদা?"
"মাধুরী।"
"যাহ, আপনি তো আবার শুধু হিন্দি সিনেমা দেখেন।"
ক'দিন যেতে না যেতেই শুরু হল
"আর কয়েক বছর যাক, দাদা এবার বম্বেও যাবে। দেখুন না, দাদা, মিঠুন আর মাধুরী মিলে সিনেমা করবে। আপনি আমায় দেখাবেন কানুদা?"
"ফুচি, অনেক বকেছিস। এবার হাতের লেখা দেখা।"
এরকম করে একদিন ফুচির দাদার সিনেমা বেরোল। নাম "নবাব"। কমলাদি আমাদের বাড়ি এসে বললেন -- "বৌদি, জানো রতনের সিনেমা বেরোচ্ছে শুক্রবার। লবাব। এস্টার-এ আসছে। আমরা তো গ্রাম থেকে সবাই মিলে যাবো। আমাকে শুক্রবার দিন ছুটি দেবে?"
"হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়। ফুচিও যাবে?"
"না বৌদি, ওর ঐটুকু বয়স, যদি হলে ঢুকতে না দেয়। আমি ওকে এসে গল্প বলব। রঞ্জিত মল্লিক আছে, সন্ধ্যা রায় আছে।"
ফুচির পরের দু'দিন ক্লাসে ভীষণ মন খারাপ। আমি শেষকালে বললাম "দাঁড়া এবার পুজোয় যখন পাড়ায় পর্দা ফেলে সিনেমা দেখানো হবে, তখন আমি নবাব নিয়ে আসব।"
"সত্যি কানুদা? আপনি লবাব আনবেন তো?"
"আনব। তবে ওটা লবাব না ফুচি, ওটা নবাব।"
শনিবার দিন কমালাদি সিনেমা দেখে এলেন। মা প্রথমেই জানতে চাইল -- "কেমন ছিল সিনেমা?"
"ঐ একরকম। যা হয় বাংলা সিনেমায়। শুধু মারামারি। বাদ দাও বৌদি। বলছি আজকে আলুগুলো কি ডুম ডুম করে কাটব না সরু সরু করে?"
মা যা বোঝার বুঝে গেল। সমস্যা হচ্ছে, মা আমাকে বলেনি। বললে আমি আমিয়বাবুকে হাতে পায়ে ধরে পুজোর সময় নবাব আনতে বলতাম না।
পুজোর সময় আমাদের পাড়ায় মাঠে পর্দা ফেলে সিনেমা দেখানো হয়। একই দিনে দুটো সিনেমা। এবার প্রথমে ছিল সপ্তপদী। তারপর হবে নবাব। সিনেমা শুরুর আগেই ফুচি এসে হাজির। একটা ফাঁকা চেয়ার দেখে ওকে বসতে বললাম। ফেবেছিলাম ওর পাশে বসেই সিনেমা দেখব। কিন্তু তার আগেই আমার অন্য বন্ধুরা টেনে নিয়ে গেল। সিনেমা শুরু হল। রতনকে আমি চিনি। আগে দেখেছি। তাই মুখ জানি। একটু বাদেই রতনকে দেখতে পেলাম পর্দায়। সৌমিত্র ব্যানার্জি একটা চায়ের দোকানে বসে কিছু ছেলের সঙ্গে মাস্তানি করছি। একটি মেয়ের শাড়িতে চা ফেলে ইভ টিজিং করে। এই ইভ টিজারদের দলে ছিল রতন। লাল সাদা ডোরাকাটা একটা টার্টলনেক গেঞ্জি পরিহিত রতন কিছুক্ষণ বাদেই লবাবরুপি রঞ্জিত মল্লিকের হাতে বেধড়ক মার খেল। সে দৃশ্য দেখেই ফুচির জন্য মন কেমন করল। ওর চেয়ারের দিকে তাকাতেই দেখি ফুচি কাঁদতে কাঁদতে চেয়ার ছেড়ে ছুটে পালাল।
বেশ কিছুদিন ক্লাসে আর আসেনি ফুচি। তারপর একদিন এলো। আমার সঙ্গে চোখে চোখ রাখতে লজ্জা পাচ্ছিল। আমি কিছুই হয়নি এরকম ভাব করে, "ফুচি, ৫ এর নামতা বল" বলে শুরু করলাম।
ক্লাসের শেষে ফুচি আমাকে ডাকল - "কানুদা, দাদা হয়ত বম্বে যেতে পারবে না, কিন্তু শতাব্দীর সঙ্গে সিনেমা করবে বলুন?"
আমরা কয়েকজন মেডিকাল কলেজের ছাত্র মিলে ঠিক করলাম ছুটির দিনে এরকম ফুচির মত ছেলে মেয়েদের পড়াব। কাউন্সিলার চয়নবাবুর সাহায্যে সে আয়োজনও হয়ে গেল সহজেই। সামান্য অঙ্ক, টাকা পয়সার হিসেব, বাংলা লেখা, ইংরেজি সংখ্যা চেনানো, এসব হত আর কি। ফুচির কিন্তু শেখার ভীষণ আগ্রহ ছিল। আমার মতে প্রচণ্ড শার্প মেয়ে। কমলাদির বড় ছেলে রতন বোধহয় বর্ধমানে রিক্সা চালাত। একদিন মাথায় ভুত চাপে, সব ছেড়ে কলকাতা চলে যায় সিনেমার হিরো হতে। কমলাদি দুঃখ করেন -- "আমার কপাল, ছেলেটা জলে গেল।" ফুচির কিন্তু দাদাকে নিয়ে ভীষণ গর্ব। "দেখবেন কানুদা, আমার দাদা একদিন প্রসেঞ্জিতের মত হিরো হবে। আপনি আমাকে দাদার সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবেন তো?"
একদিন কমলাদি আমাদের বাড়ি এলেন একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে। তাতে গোটা চারেক ছানার কেক। মা জিজ্ঞেস করে -- "কি হল কমলা?"
"আর বৌদি, কি বলবো। আমার ছেলে সিনেমায় চান্স পেয়েছে। রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে। পরের বছর বেরোবে।"
"সেকি গো? দারুণ খবর তো।"
ফুচি আমাদের ছুটির ক্লাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে গেল। "জানেন, আমার দাদার সাথে দেবশ্রী রায় সিনেমা করতে চায়, কিন্তু দাদার শতাব্দীকেই পছন্দ।"
"সেকি? কেন? দেবশ্রী খারাপ কি?"
"নাহ, আমার শতাব্দীকে ভালো লাগে। আপনার কাকে ভালো লাগে কানুদা?"
"মাধুরী।"
"যাহ, আপনি তো আবার শুধু হিন্দি সিনেমা দেখেন।"
ক'দিন যেতে না যেতেই শুরু হল
"আর কয়েক বছর যাক, দাদা এবার বম্বেও যাবে। দেখুন না, দাদা, মিঠুন আর মাধুরী মিলে সিনেমা করবে। আপনি আমায় দেখাবেন কানুদা?"
"ফুচি, অনেক বকেছিস। এবার হাতের লেখা দেখা।"
এরকম করে একদিন ফুচির দাদার সিনেমা বেরোল। নাম "নবাব"। কমলাদি আমাদের বাড়ি এসে বললেন -- "বৌদি, জানো রতনের সিনেমা বেরোচ্ছে শুক্রবার। লবাব। এস্টার-এ আসছে। আমরা তো গ্রাম থেকে সবাই মিলে যাবো। আমাকে শুক্রবার দিন ছুটি দেবে?"
"হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়। ফুচিও যাবে?"
"না বৌদি, ওর ঐটুকু বয়স, যদি হলে ঢুকতে না দেয়। আমি ওকে এসে গল্প বলব। রঞ্জিত মল্লিক আছে, সন্ধ্যা রায় আছে।"
ফুচির পরের দু'দিন ক্লাসে ভীষণ মন খারাপ। আমি শেষকালে বললাম "দাঁড়া এবার পুজোয় যখন পাড়ায় পর্দা ফেলে সিনেমা দেখানো হবে, তখন আমি নবাব নিয়ে আসব।"
"সত্যি কানুদা? আপনি লবাব আনবেন তো?"
"আনব। তবে ওটা লবাব না ফুচি, ওটা নবাব।"
শনিবার দিন কমালাদি সিনেমা দেখে এলেন। মা প্রথমেই জানতে চাইল -- "কেমন ছিল সিনেমা?"
"ঐ একরকম। যা হয় বাংলা সিনেমায়। শুধু মারামারি। বাদ দাও বৌদি। বলছি আজকে আলুগুলো কি ডুম ডুম করে কাটব না সরু সরু করে?"
মা যা বোঝার বুঝে গেল। সমস্যা হচ্ছে, মা আমাকে বলেনি। বললে আমি আমিয়বাবুকে হাতে পায়ে ধরে পুজোর সময় নবাব আনতে বলতাম না।
পুজোর সময় আমাদের পাড়ায় মাঠে পর্দা ফেলে সিনেমা দেখানো হয়। একই দিনে দুটো সিনেমা। এবার প্রথমে ছিল সপ্তপদী। তারপর হবে নবাব। সিনেমা শুরুর আগেই ফুচি এসে হাজির। একটা ফাঁকা চেয়ার দেখে ওকে বসতে বললাম। ফেবেছিলাম ওর পাশে বসেই সিনেমা দেখব। কিন্তু তার আগেই আমার অন্য বন্ধুরা টেনে নিয়ে গেল। সিনেমা শুরু হল। রতনকে আমি চিনি। আগে দেখেছি। তাই মুখ জানি। একটু বাদেই রতনকে দেখতে পেলাম পর্দায়। সৌমিত্র ব্যানার্জি একটা চায়ের দোকানে বসে কিছু ছেলের সঙ্গে মাস্তানি করছি। একটি মেয়ের শাড়িতে চা ফেলে ইভ টিজিং করে। এই ইভ টিজারদের দলে ছিল রতন। লাল সাদা ডোরাকাটা একটা টার্টলনেক গেঞ্জি পরিহিত রতন কিছুক্ষণ বাদেই লবাবরুপি রঞ্জিত মল্লিকের হাতে বেধড়ক মার খেল। সে দৃশ্য দেখেই ফুচির জন্য মন কেমন করল। ওর চেয়ারের দিকে তাকাতেই দেখি ফুচি কাঁদতে কাঁদতে চেয়ার ছেড়ে ছুটে পালাল।
বেশ কিছুদিন ক্লাসে আর আসেনি ফুচি। তারপর একদিন এলো। আমার সঙ্গে চোখে চোখ রাখতে লজ্জা পাচ্ছিল। আমি কিছুই হয়নি এরকম ভাব করে, "ফুচি, ৫ এর নামতা বল" বলে শুরু করলাম।
ক্লাসের শেষে ফুচি আমাকে ডাকল - "কানুদা, দাদা হয়ত বম্বে যেতে পারবে না, কিন্তু শতাব্দীর সঙ্গে সিনেমা করবে বলুন?"
No comments:
Post a Comment