Thursday, April 19, 2018

আমার ছোটকা



আমার ছোটকা থাকত দোতলার ঘরে। একতলায় কোনদিন নামতে দেখিনি। শুনেছি কলেজে পড়তে ছোটকা নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশের মারে ছোটকা ঠিক মত কথা বলতেও পারত না। উঠে দাঁড়াতেও পারত না। ঠাম্মা যখন খাওয়াতে যেতেন, কোনরকমে বিছানায় ভর দিয়ে উঠে বসে খেত। তবে মাঝে মাঝে একটু একটু করে উঠে জানালার ধারে চেয়ারটায় গিয়ে বসত। বসে চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে থাকত। ওহ, বলতে ভুলেই গেছি। ছোটকা কোন জামাকাপড় পরত না। সারা বছর উলংগ থাকত। আমাদের জেলা শহরে কিন্তু হালকা ঠান্ডা পড়ত। জানি না ছোটকার ঠান্ডা লাগত কিনা। আমি যখন বড় হচ্ছি, তখন ছোটকার ঘরে যেতে অস্বস্তি লাগত। সত্যি বলছি, এক এক সময় তো ভয়ই লাগত। শুনেছি ছোটকা নাকি পড়াশুনায় খুব ভালো ছিল। স্কুলে উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হয়েছিল। কলেজে ফিজিক্স নিয়ে পড়ত। ঠাম্মা তো মাঝে মাঝেই বলে -- "তিন ছেলের মধ্যে ছোটটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমান। কি যে হল!!"

আমাদের পাড়াটা কেমন যেন। সবাই যেন ক্লান্ত, সবাই যেন ধুঁকছে। কারুর কোন শখ আলহাদ বলে কিছু নেই, সবাই যেন সারাদিন নালিশ করে চলেছে। পাড়ায় কারুর সঙ্গে কারুর সদ্ভাব নেই। কোন পুজোও হয়না। সবার কাছে সবাই খারাপ। কারুর দেমাক বেশি, কেউ বা হিংসা করে, কেউই যেন ভালো না। আমরা বন্ধুরা অবশ্য এসব ভাবতাম না। পাড়ায় মাঠ বলে কিছু ছিল না। ঐ পাম্প হাউসের পাশে ছোট এক ফালি জমি। তাতেই আমরা ক্রিকেট খেলতাম। ছয় মারলেই আউট।

আমাদের খেলা নিয়েও বড়দের সমস্যার শেষ নেই।
"পল্টুর বাবাকে দেখ, একটা ব্যাট কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তোর ব্যাট দিয়ে খেলে।"
"ওহ তুই সন্তুর সঙ্গে খেলিস? ওর মা তোদের সাথে ওকে খেলতে দেয়? যা দেমাক।"

কার ভালো লাগে এসব শুনতে? কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমাদের সবার বাড়িতে এই চলত। আমরা ভেবে দেখলাম এসবে পাত্তা দিলে ক্ষতি আমাদের। তাই, প্রত্যেকেই নিজের বাড়ির লোকজনের চেয়ে বন্ধুদের আপন মনে করলাম। শুধু আক্ষেপ একটাই। একটা ভালো মাঠ পেলে আজহারের মত ছয় মারতাম।

একদিন আমাদের পাড়ার কাউন্সিলার বদরুদ্দিনবাবু আমাদের বাড়িতে এলেন। আমাদের বাড়ির সামনেই একটা জলা জমি ছিল। সেটাকে বুজিয়ে একটা মাঠ বানাবেন। এই একটা ব্যাপারে পাড়ার সবাই দেখলাম রাজি। মাঠ হল। আমরাও খুশি। প্রথমদিন আমাদের সবাইকে ডেকে ম্যাচ খেলালেন বদরুবাবু। খেলার পর জলখাবার ছিল। সিংগারা, মন্ডা আর দরবেশ। আমি স্কুলের মাঠে হাত ঘুরিয়ে বল করতাম। পাড়ায় এতদিন করতে পারিনি। আজ করলাম। পর পর দু'বলে দুটো উইকেটও নিলাম। বদরুবাবু বাইরে থেকে হাততালি দিলেন --
"কানু তো এ পাড়ার কপিল।"

খেলতে খেলতে খেয়াল করলাম ছোটকা জানালা দিয়ে আমাকে দেখছে। পরেরদিন সকালে ঠাম্মা বলল ছোটকা নাকি আমাকে দেখতে চেয়েছে। গেলাম। ছোটকা জড়ানো জিভে বলল -- "তুই বল করিস? আমি বল করি।"

বুঝলাম ছোটকা বলতে চাইছে নিজে বল করত এক সময়। এর পর কোথা থেকে একটা ক্রিকেট বল নিয়ে আমাকে দেখাল বলের গ্রিপ। ছোটকার হাত কাঁপছিল। আমি বললাম -- "আমরা তো ক্যাম্বিস বলে খেলি ছোটকা?"
"তো কি ? এই বল, তোর বল।"

এরপর আমি আর ছোটকাকে দেখে ভয় পেতাম না। ছোটকা জামাকাপড় পরত না বলে অস্বস্তিটা ছিল, কিন্তু সেটাও আস্তে আস্তে চলে যেতে লাগল। রোজ খেলে এসে বাড়িতে ছোটকার সঙ্গে আমার গল্প চলত। আমিই বলতাম, ছোটকা মাঝে মাঝে এক-দু' টো শব্দ বলত। ছোটকার ঐ ভাঙ্গা ভাঙ্গা উচ্চারণ আমি সহজেই বুঝে যেতাম। মাঝে মাঝে ঠাম্মাও ছোটকার কথা বুঝত না, আমি বুঝিয়ে দিতাম।

একদিন ছোটকা আমার পড়াশুনা নিয়ে জানতে চাইল। আমি তখনো মন দিয়ে পড়াশুনা করতাম না। আমাদের পাড়াতে কেউই করে না। সবাই কোনরকমে কলেজ পাশ করে রেল বা ব্যাঙ্কের পরীক্ষা দিতে থাকে। দিতে দিতে একদিন না একদিন পেয়েই যায়। আমিও সেরকম ভেবে রেখেছিলাম।

"তুই পড়বি না?"

ছোটকার এই একটা কথা আমাকে মোচর দিয়েছিল। ভেবেছিলাম কি করি? একদিন ঠিক করলাম না, আমি ডাক্তার হব। ছোটকাকে সারিয়ে তুলতে হবে। ছোটকা কে জানাতেই ভীষণ খুশি। তারপর রোজ সন্ধ্যেবেলা আমার বিজ্ঞান আর অঙ্ক দেখতে লাগল ছোটকা। হাত কাঁপত, কথা পরিষ্কার আসত না, তাও ছোটকা খেয়াল রাখত আমি সব বুঝছি কিনা। "মুখস না, বোঝ।" -- মানে না বুঝে মুখস্ত করিস না। শুধু রসায়ন ল্যাবে এসিড নিয়ে কাজ করি শুনে ছোটকা যেন শিউড়ে উঠত। "সাবয়ানে"।

মা তো অবাক হয়ে যেত আমি এত ছোটকার ঘরে যাই দেখে। ঠাম্মা বোঝায়, যাক না, ক্ষতি কি। আর সত্যি বলতে আমার পড়াশুনা নিয়ে মা-বাবা কারুরই খুব একটা মাথা ব্যাথা ছিল না। বাড়ির ঐ দুঃসহ পরিবেশে ছোটকাই যেন ছিল আমার মরুদ্যান। মনে আছে তখন আমি ক্লাস ইলেভেনে। ছোটকা আমার জন্মদিনের দিন আমাকে একটা বই উপহার দিল। নিজের পুরোনো বই। আরণ্যক। আমাকে বলল -- "পড়িস, আমার সেরা।"

আমি যখন মেডিকাল কলেজে পড়ার অনুমতি পেলাম, বাবা অত্যন্ত বিস্মিত। আমি যে ডাক্তারি পড়ব, এরকম কথা বাড়িতে ছোটকাকা ছাড়া কেউ জানত না। মনে আছে যেদিন আমি কলকাতা গিয়েছিলাম প্রথমবার। ছোটকা হাত ধরে রেখেছিল বেশ কিছুক্ষণ।

আমার মেডিকাল পড়ার দ্বিতীয় বছরেই ছোটকা মারা যায়। আমার কথা নাকি সারাদিন বলত ঠাম্মাকে। শনি-রবিবার আমি বাড়ি এলে সারাদিন ছোটকার কাছেই কাটাতে হত। আমি শেষদিন হাসপাতালে থাকতে পারিনি। পরে শুনেছি আমার অভাবে নাকি ছোটকা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল। তবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ছোটকাকে কেউ জামাকাপড় পরাতে পারেনি।

মাঝে মাঝে মনে হয় আমি হেরে গেছি। যে ছোটকাকে সারিয়ে তোলার জন্য আমি ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম, সেই তো আর নেই। অবশ্য ভাবি, আমি ডাক্তার হই এটাই তো ছোটকা চেয়েছিল। আমার ঐ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চারটি বছরে ছোটকাই তো আমার পাশে থেকেছে, আমাকে তৈরি করেছে। আমি হারিনি, ছোটকা জিতেছে।