Monday, November 23, 2020

অপুর সংসার ও বিকেলবেলা

 অপুর সংসার দেখছিলাম। সৌমিত্রবাবু চলে গেছেন বলে আর একবার। অত্যন্ত প্রিয় সিনেমা এটি। যাই হোক, লক্ষ্য করলাম  সিনেমার বেশিরভাগ বড় ঘটনাই  বিকেলবেলা। কিছু কিছু আমি নিজের মনে কল্পনা করে নিয়েছি। সাদা কালো ছবি, তাই বিকেলবেলা ভাবতেই পারা যায়। 

প্রথম যখন অপুর সাথে পুলুর দেখা হয়। মনে করে  দেখুন। কলকাতায় নিজের ভাড়া বাড়িতে ছেঁড়া গেঞ্জি পরে বসে ছিল অপু। হয়ত তখন এক গরমের বিকেল। বিকেলে তেমন হাওয়া নেই, ভ্যাপসা গুমোট। ছাদেও হাওয়া ছিলনা নিশ্চয়। নাহলে অপু তো ছাদে থাকত। এই সময় পুলুর আগমন। 

আবার খুলনায় সেই বিকেলটার কথা। সেটি বিকেল না হয় অবশ্য দুপুরে হতে পারে। তবে কিনা বিয়েবাড়ির মধ্যে দুপুরে খেয়ে দেয়ে ঘুমোতে গেলে বিকেল হয়েই যায়। অপর্ণার বরও তো সেই সময় এসেছিল। অপু নদীর ধারে একটি বই মাথায় দিয়ে শুয়ে। হাতে বাঁশী। হয়ত খানিকক্ষণ আগেই বাজাচ্ছিল। এমনি খুলনায় কলকাতার মত অত লোকজন নেই। তায় নদীর ধার। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। গাছের স্নিগ্ধ ছায়ায় শুয়ে অপুর হয়ত নিশ্চিন্দপুরের কথা মনে পড়ছিল। নদীতে মাঝির গান শুনতে শুনতে হয়ত ভাবছিল নিজের পরিবারের কথা, ছোটবেলার বন্ধুদের কথা। এই সময় পুলু তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। 

অপর্ণার সঙ্গে অপুর শেষ দেখাও পড়তি বিকেলে। প্রায় সন্ধ্যাবেলা। তখন সবে সূর্য ডুবেছে। ট্রেন ছাড়ছে। স্টেশনের ভিড়, লোকের ঠেলা, চা-ওলার আওয়াজ, কয়লার গন্ধ, সব মিলিয়ে এক আলাদা বিকেল যেন। তার মধ্যে অপুর চোখে আটকে আছে অপর্ণার কাজল কালো চোখ। 

অপর্ণার মৃত্যুসংবাদটিও অপু পায় এক বিকেলবেলা। সারাদিন অফিস করে অপর্ণার চিঠি পড়তে  পড়তে  হাসি মুখে বাড়ি এসে দরজা খুলতে গিয়ে দেখে ছাদে মুরারি দাঁড়িয়ে। সেটা বোধহয় শীতকাল। মুরারি শাল গায়ে দিয়েছিল। শীতের বিকেল বড় হয়না, বড্ড কষ্ট দেয়। ফাটা ঠোঁট, শুকনো গা, তার উপর অপর্ণার বিয়োগ, যেন সব কিছুতেই এক অনুপস্থিতিকে  প্রকট করছিল। শীতকালে চড় খেলে লাগে বেশী। বেচারি মুরারি। 

এরপর আসা যাক নাগপুরের কয়লাখনিতে। পুলু যখন অপুকে নিজের ছেলের কথা বলতে আসে। সেটি শীতকাল। তার উপর নাগপুরের ঠাণ্ডা। কেন নিজের ছেলেকে দেখতে পারেনা বলতে গিয়ে সেই  অনুপস্থিতি বার বার যেন অপুকে বিঁধছিল। জানে ভুল  করছে, যা করছে তার কোন যুক্তি নেই। তাও করছে।  পুলু চলে যাওয়ার পর যখন ঐ শীতের মধ্যে ঐ উপত্যকায় একা একা পুলুকে ডাকছিল,  যেন মনে হচ্ছিল কারোর অনুপস্থিতি না, কোন দোষ না, শুধু যেন একাকীত্ব তাকে বার বার গ্রাস করছে। দিদি, বাবা, মা, স্ত্রী, এই একাকীত্ব তাকে যেন ছাড়ছেই না। 

খুলনায় আর এক বিকেল।  অপু এসেছে নিজের ছেলেকে দেখতে। ছেলে শুয়ে আছে। জ্বর। অপু বিছানার পাশে এক কেদারায় বসল। জানালা খোলা। ভাটিয়ালি গানের সুর ভেসে আসছে নদী থেকে। ছেলেটিকে দেখে অপুর কী মনে পড়ল কে জানে। হয়ত নিজের ঐ বয়সের কথা। নিশ্চিন্দপুরে দিদির সাথে খেলত। অথবা নিজের স্কুল জীবনের কথা। যখন ছুটি হলে অপু বাড়ি ফিরতে পারতনা। একা বোর্ডিং-এ বসে থাকত।  

বিয়োগব্যথা, অনুপস্থিতি, একাকীত্ব, অপুর সকল অভিমান যেন মিশে গেছে বিকেলবেলায়।