"মা বলছিল পুজোর ছুটিতে বেনারাস নিয়ে যেতে, ভালোই হবে বলো?" গাড়িতে উঠেই তপনের প্রশ্ন।
"হুঁ, গেলেই হয়।" -- একটু অন্যমনস্ক গলায় বলল সঞ্চিতা। তার এই ব্যাপারটা একেবারেই নাপসন্দ। এর আগে যতবার শাশুড়ির সঙ্গে বেড়াতে গেছে ততবারই পুরো প্ল্যানটা উনিই ঠিক করেছেন। সঞ্চিতার যেন কোন মতামতই নেই। আর তপনও মায়ের কথা শুনে চলা ছেলে। আর সত্যি কথা বলতে সেভাবে বেনারাস যাওয়ারও তেমন শখ নেই সঞ্চিতার। বরং কতদিন সমুদ্র দেখেনি। পুরী গেলে হত।
"তুমিই তো সেদিন বলছিলে কতদিন বেড়াতে যাওয়া হয়না।"
"হুম, যাওয়া যায় পুজোয়।" এই বলে মিষ্টির প্যাকেটটা শক্ত করে ধরল সঞ্চিতা। ট্যাক্সি ততক্ষণে অনেক দূর চলে এসেছে। তারা যাচ্ছে নিউটাউন। তপনের বন্ধুর বাড়ি। স্কুলের বন্ধু। আজ সেখানে তিন বন্ধুর পরিবার নিয়ে নিমন্ত্রণ। এরা বলে পার্টি। আজকাল কথাগুলো কত পাল্টে যাচ্ছে না? আগে যাকে বলা হত নিমন্ত্রণ, আজ তার নাম পার্টি। আগে যাকে বলত ক্যাপ্সিকাম, আজ তাকে বলে বেল পেপারস।
জানালার দু ধারে বসে আছে তপন আর সঞ্চিতা। মাঝখানে তাদের মেয়ে রুমা। ভীষণ মিষ্টি দেখতে এই সপ্তম বর্ষীয় বালিকা। নিজের মেয়ে বলে মনে করে না সঞ্চিতা, আসে পাশে পাড়া প্রতিবেশীরাও বলে। তবে সঞ্চিতার একটাই চিন্তা। তার মেয়ে যেন ঠিক ভাবে মানুষ হয়। প্রতি সপ্তাহে যখন তপন মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে তার গায়ে হাত তোলে, তখন হাঁ করে তাকিয়ে দেখে রুমা। কার জন্য কাঁদবে বুঝতে পারেনা। বিয়ের আগে সঞ্চিতা ভাবেনি এরকম হবে। তার ধারণা ছিল সমাজের নিম্নস্তরে এগুলি হয়। কবে যে এর অবসান হবে তার দিন গোনে সঞ্চিতা। দায়িত্ব । বড্ড বড় একটা শব্দ। আচ্ছা, দায়িত্ব কি তার একার? আর কেউ সঙ্গ দেবে না তাকে? কতদিন, আর কতদিন এই প্রতীক্ষা চলবে?
সঞ্চিতার মিষ্টির প্যাকেট যেভাবে তপনের বন্ধুর বউ তাচ্ছিল্য করে টেবিলে রেখে দিল তাতে সঞ্চিতার বুঝতে বাকি রইল না ওটি আনা ঠিক হয়নি। আসলে এরা সমাজের উঁচু স্তরের। সঞ্চিতারা যাকে বলে নেহাতই মধ্যবিত্ত। সঞ্চিতা নিজে হুগলীর একটা স্কুলে ইতিহাস পড়ায়। তপন একটা প্রেসে চাকরি করে। যে বন্ধুর বাড়ি নেমতন্ন, তার নিজস্ব গ্যারেজের ব্যবসা আছে।
খানিকক্ষণ বাদেই শুরু হল মদের ফোয়ারা। দুই বন্ধু এবং তাদের স্ত্রীরাও মদ্যপানে ব্যস্ত। তপন একটু বাদেই মাতাল হয়ে গান গাইতে শুরু করল। এর মধ্যে চটুল হিন্দি গান চালিয়ে নাচছে সবাই। সোফার এক কোণে চুপ করে বসে ছিল সঞ্চিতা। তাকে তপনের বন্ধুর স্ত্রীরা মাদক রসে বঞ্চিত করতে চায়না। কিন্তু আজ কঠোর সঞ্চিতা। নিজেকে সংযত রেখেছে। নাচতে নাচতে মাঝে মাঝেই তপনের বন্ধুরা তার হাত ধরে টানছিল। একজন তো বার বার গায়ে পরে যাচ্ছে। রুমা বাচ্চা। সে এসব বোঝে না। সবাই নাচছে দেখে সেও মাঝখানে নাচতে লাগল। মাতালের দল নিজেরা নাচা বন্ধ করে রুমাকে হাততালি দিতে শুরু করে। নিজের মেয়েকে রেয়াত দেয়না তপনও। লজ্জায় কান কট কট করছিল সঞ্চিতার। ইচ্ছে করছিল গিয়ে রুমার গালে কষে একটা থাপ্পড় মারে। কিন্তু নিজেকে সংযত করে রুমার হাত ধরে টেনে আনল সে।
রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ৩ টে বাজল। তপনের বন্ধুরাই ট্যাক্সি ডেকে দিল। তপন মাতাল অবস্থায় অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। বাড়িতেও কষ্ট করে উঠল। এখন বাবা-মেয়ে শুয়ে আছে। সঞ্চিতা আর ঠিক করল শোবে না। সাতটার ট্রেন ধরতে হয় তাকে। এখন আর শুয়ে লাভ নেই। একা একা বারান্দায় এসে দাঁড়াল সঞ্চিতা। গত তিনদিন বৃষ্টি হয়নি। আকাশটা কেমন থমথমে। সঞ্চিতার মনে পড়ে যাচ্ছিল বহুদিন আগে সে একবার মরুভূমি দেখেছিল। সেই মরুভূমির সামনে দাঁড়িয়ে তার যেন মনে হয়েছিল সকল মানব সভ্যতাই মিথ্যা। এক দীগন্ত বিস্তীর্ন জমি যা কাউকে পরোয়া করেনা। কত শত শতাব্দী জুড়ে এই মরুভূমি এখানে অবস্থিত। যেন বলছে দেখ, আমিই সত্য, আমি ধ্রুব, আমি ঈশ্বর। কলকাতার বাড়ির ভিড়ে সেই মরুভূমির অসীম স্পর্ধা যেন হারিয়ে গেছে।
এসব ভাবতেই ভাবতেই সঞ্চিতার ফোন বেজে উঠল। নম্বরটা দেখা যাচ্ছেনা।
"হ্যালো"
"শোন, তৈরি হয়ে নাও। আধ ঘণ্টার মধ্যে আমরা আসব। জিনস আর একটা টপ পরে চলে এস। জিনিসটা আছে তো?"
"হ্যাঁ, কিন্তু মাত্র আধ ঘণ্টা।"
"হ্যাঁ, আর শোন, মেয়েকে আদর করতে যেও না। ওর ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমরা সমস্যায় পড়ব। আমাদের হাতে সময় নেই।"
"একবারও না?"
"না, একবারও না। চিন্তা করো না। তোমার মেয়ে ভালো থাকবে, আমরা দায়িত্ব নেব।"
"আচ্ছা, আমি তপনকে একটা শাস্তি দিয়ে যেতে চাই।"
"না, আমরা চাই না এসবের মধ্যে পুলিশ কেস হোক। কথা দিচ্ছি, যদি তুমি আমি দুজনেই বেঁচে থাকি, প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ তোমায় দেব। এবার রাখছি, আমাদের হাতে সময় নেই। তোমার বাড়ির সামনে একটা হিরো হোন্ডা বাইক থাকবে। উঠে পড়।"
চটজলদি নিজের পোশাক পরিবর্তন করল সঞ্চিতা। উফ, অবশেষে মুক্তি। এবার নিজের আলমারির গয়নার বাক্সটা খুলল সে। এই জায়গায় শাশুড়ির অধিকার নেই। জড়োয়ার সেটের বাক্সটা খুলল। তার বিয়েতে এটি উপহার দেওয়া হয়েছিল। সবাই অবাক হয়েছিল এত দামী গয়না কে দিল, কেউ বুঝতে পারেনি, নাম লেখা ছিলোনা। শুধু সঞ্চিতা জানত। উপরের ডালাটা সরাতেই নিচের খালি জায়গাটাই দৃশ্যমান হল একটি মসকিউটো। মশা না, বন্দুক।
বেরিয়ে আসার সময় রুমার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখে জল এল সঞ্চিতার। স্যার যখন বলেছেন, রুমা ঠিক থাকবেই।
বাইকটা তাকে নামিয়ে দিল একটা বড় বাসের সামনে। বাস না বলে ভ্যানও বলা যায়। বাইরে অপেক্ষা করছিলেন সেই মানুষটি যাকে এতবছর বাদে দেখে আবার চোখে জল এল সঞ্চিতার।
"স্যার কেমন আছেন?" প্রণাম করল সঞ্চিতা।
"ভালো, এতদিন আন্ডার কভার ভালো লাগল?"
"আপনি তো সবই জানেন।"
"জানি, বেশ, আলাপ করো। এরা হল সুমেধা, আলম, তমাল আর অঙ্কিতা।"
"হাই।"
"বেশ সঞ্চিতা, এবার তো তোমাকে ঘুমোতে হবে।"
"স্যার, আমার ঘুম পাচ্ছে না। "
"তোমার ঘুম না পেলেও ঘুমোতে হবে সঞ্চিতা। 'অগ্নীশ্বর"-এ উত্তমবাবু যেমন বলেছিলেন, 'দেশের আগে কিচ্ছু না'। ঘুমও না। কাল তোমার অনেক কাজ। দাঁড়াও একজনের সাথে তোমার দেখা করাই। দেখো তো চিনতে পারছ কিনা?"
"আরে ডাক্তার সেন?"
"হ্যাঁ, সেই রেশমি সেন। রেশমি, সঞ্চিতাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। সবাই গাড়িতে ওঠো। অনেকটা পথ যেতে হবে।"
গাড়ির মধ্যেই একটা বিছানা ছিল। ইনজেকশন পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর নিদ্রায় নিমজ্জিত হল সঞ্চিতা। গাড়ী তখন দিল্লী রোড ধরে ছুটেছে।
সঞ্চিতার ঘুম ভাঙ্গল এক বিছানায়। কোন একটা ঘরে সে শুয়ে আছে। এখানে কী করে এল সে নিজেও জানে না। নিশ্চয় স্যার এনেছেন। ঘরের বাইরেই একটা বারান্দা। বারান্দায় এসে দেখল সূর্য মধ্যগগন থেকে অস্তগামী। হাতঘড়ি দেখে বুঝল এক দিন হয়ে গেছে। গতকাল এই সময় সে স্কুলে মেয়েদের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজীর ভূমিকা পড়াচ্ছিল। আর আজ এ কোথায় সে।
পাশেই সিঁড়ি। নিচে নামল সঞ্চিতা। একটা বড় দালান মত জায়গায় সকলে বসে চা খাচ্ছে।
"গুড আফটারনুন, তুমি কখন উঠেব সেটাই ভাবছিলাম।"
"এটা আমরা কোথায় স্যার?"
"এটা, মাই ডিয়ার সঞ্চিতা হচ্ছে বেনারাস।"