"ছোটকা, তুমি?”
"ওঠ,
আর কতক্ষণ ঘুমিয়ে
থাকবি? নাটক তো শুরু
হয়ে যাবে।”
"নাটক! কিসের নাটক?"
"আরে আজ আম্রকুঞ্জে নাটক আছে, কিছুই জানিস না দেখছি।"
"কিন্তু তুমি? তুমি কোথা থেকে এলে? তুমি তো ...। "
"আমি তো কি?"
"তবে যে শুনেছিলাম এই বর্ষায় সাপের কামড়ে তুমি ...।"
"ঠিকই শুনেছিলি, পরে সেসব বোঝাব। এখন চল।"
"না মানে বাবা তো এসেছিল সেই সময়। ঠাম্মা ভীষণ কান্নাকাটি করছিল মনে আছে। বাবা বলছিল দিল্লিতে আমাদের সঙ্গে থাকলে এটা কখনওই হত না। তোমার বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো নিয়ে রাগারাগি করছিল।"
"এসব বলেছে নাকি মেজদা? ছোটবেলা থেকে শুধু গুড বয় হয়েই জীবন কাটাল।"
"কিন্তু তুমি কি করে এলে এখানে?"
"আরে দেরি হয়ে যাচ্ছে। চ, রাস্তায় যেতে যেতে বলি।"
"চল। দাঁড়াও, সোয়েটারটা পরে নি।"
"হুঁ, পরে নে, বাইরে ঠাণ্ডা আছে, আর ফিরতে রাতও হতে পারে।"
"আমি রেডি, বল, কিভাবে যাবে? রিকশা নেবে?"
"আরে ধুর, হেঁটেই চলে যাব। কাছেই তো।"
"কাছে কি গো? রিকশা করেই তো পনের কুড়ি মিনিট লেগে যায়।"
"হা হা, আয় আমি একটা শর্টকাট চিনি।"
"আরে, এটা তো বাড়ির পিছনদিকের রাস্তা, পুকুরপাড়ে চলেছে।"
"হ্যাঁ, ওখান দিয়েই যাব, চল।"
"তোমরা নাকি এই পুকুরে সাঁতার কাটতে?"
"শুধু তোর বাবা কাটত না।"
"তুমি এখন বাবার ওপর রেগে আছ?"
"আরে না, সত্যিই কাটত না। তুই শিখেছিস?"
"হ্যাঁ, আমাদের পিতামপুরার সুইমিং পুলেই শিখি।"
"তাও ভাল, আমি তো ভেবেছিলাম মেজদা তোকে সাঁতার শেখাবেই না।"
"আরে পুকুরের পাশের এই রাস্তাটা কি? আগে দেখিনি তো।"
"হুঁ হুঁ বাবা, সব যদি জানবে তাহলে তো হয়েই গেল। তোর বাবাও এই রাস্তাটা চেনে না।"
"আমি কাল সকালে বাবাকে এটা চিনিয়ে দেব।"
"পারবি না। কাল সকালে এই রাস্তা আর থাকবে না।"
"কেন?"
"তুই বড্ড প্রশ্ন করিস। চল, ওই দেখ আমরা আম্রকুঞ্জ এসে গেছি।"
"নাটক কোথায়?"
"হবে, একটু বস।"
"এখানে ঘাসেই বসব ?"
"বাকিরাও তো তাই আছে, তুইও বস।"
"আচ্ছা।"
"ওই দেখ, উনি কে বলত?"
"কে? কার কথা বলছ?"
"ওই দেখ চেয়ারে বসে আছেন।"
"আরে কেউ একটা রবি ঠাকুর সেজে এসেছে দেখছি।"
"উফ, কি উজবুক তুই। কেউ সেজে আসেননি। উনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।"
"যাহ কি যে বল? রবি ঠাকুর তো সেই ১৯৪১ সালে মারা গেছেন।"
"আর আমি? আমি কি বেঁচে আছি?"
"মানে? ছোটকা, তুমি কি বলছ?"
"পরে বোঝাবো, আপাতত নাটক শুরু হচ্ছে, মন দিয়ে নাটক দেখ।"
"কি নাটক হবে?"
"কবিগুরুর লেখা গীতিনাট্য কালমৃগয়া।"
"এটার নাম শুনিনি তো? গল্পটা কি? জানো ছোটকা, গতবছর পুজোতে আমাদের চিত্তরঞ্জন পার্কে তাসের দেশ গীতিনাট্য হয়েছিল।"
"বাহ, তুই কিছু করেছিলি?"
"নাহ, বড়রা করেছিল, তাই আমাকে নেয়নি। বললে না কালমৃগয়ার গল্পটা কি?"
"গল্পটা তোর জানা, দেখতে থাক।"
"যারা করছে, তারা কারা?"
"পাঠভবনের ছাত্র ছাত্রীরা।"
"আরে এই গানটা তো চেনা। এটা তো পূরানো সেই দিনের কথা, তাই না? তাহলে এরা অন্যভাবে গাইছে কেন?"
"এটা আলাদা গান। রবি ঠাকুর অনেক সময়ই একিই গানের সুর দুবার ব্যাবহার করেছেন। এই 'কাল সকালে উঠব মোরা, যাব নদীর কূলে' আর 'পূরানো সেই দিনের কথা' গান দুটির সুর এক। জানিস কি এই সুরটি কবিগুরু এক স্কটিশ লোকসঙ্গীত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পেয়েছিলেন?"
"না তো, কি গান?"
"১৭৮৮ সালে স্কটিশ কবি রবার্ট বার্নসের লেখা 'Auld Lang Syne'। এই লোকসঙ্গীতটি অত্যন্ত জনপ্রিয়, ১৯৪০ সালে বিখ্যাত হলিউড সিনেমা ওয়াটারলু ব্রিজ সিনেমায় গানটি ব্যবহৃত হয়।"
"এই গানটা তো আমি জানি। 'ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে' -- এটি কি এই গীতিনাট্যের গান?"
"হ্যাঁ, কিন্তু আর বকবক না, এবার মন দিয়ে দেখ।"
"ঠিক আছে, শুধু একটা জিনিস, ওই সাহেবটি কে?"
"উনি ইনস্পেকটর জেমস, এই অঞ্চলের ইনস্পেকটর ছিলেন। মারাত্মক রবীন্দ্রভক্ত।"
"উনি বাংলা বোঝেন?"
"হ্যাঁ, এত ভালবাসতেন কবিগুরুর লেখা, কষ্ট করে বাংলা শিখেছিলেন। এবার নাটক শেষ না হওয়া অবধি একদম চুপ।"
"ছোটকা, গল্পটা আমি জানি, এটা তো রামায়ণের গল্প। দশরথ শ্রবণ নামক এক ঋষিকুমার কে হত্যা করেন জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে। শ্রবণের অন্ধ পিতা অভিশাপ দেন দশরথকেও পুত্রশোক ভোগ করতে হবে। তার কারণেই নাকি ওনাকে রামচন্দ্রের থেকে আলাদা হতে হয়।"
"একদম। এবার ভাব এই গল্পটিকে কি সুন্দর একটি গীতিনাট্যের রূপ দিয়েছেন কবিগুরু।"
"সত্যি, সবার জানা গল্প, অথচ কি সুন্দর ভাবে কবিগুরু সাজিয়েছেন এটা।"
"আর কত অল্প বয়েসে!!"
"ভাবাই যায় না।"
"নে বাড়ি এসে গেছে। তুই যা ওপরে গিয়ে শুয়ে পর।"
"তুমি আসবে না?"
"নাহ, আমি কি করতে যাব? তুই আবার যেদিন স্বপ্ন দেখবি, আমি চলে আসব।"
"তার মানে আমি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম, তুমি স্বপ্নে এসেছ।"
"ঠিক তাই। আসি রে বাবুল।"
ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। কি স্বপ্ন!! গত এক সপ্তাহ ধরে বার বার ছোটকার কথা মনে হচ্ছিল, তাই বোধহয় আজ...
আচ্ছা, বিছানার ধারে কে যেন বসে আছে না? চোখটা রগড়ে নিলাম। তাকিয়ে দেখি ছোটকা। প্রচণ্ড অবাক হলাম --
"ছোটকা, তুমি?”
"ওঠ, আর কতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকবি? নাটক তো শুরু হয়ে যাবে।”