আমার জন্ম বজবজে। এক বছর বয়সে তারাবাগে যে কোয়ার্টারে এসে উঠি সেটি ছিল বি- ওয়ান। বাবা বিয়ের পর থেকেই এখানে থাকতেন। ১৯৯১ সালে, মানে আমার যখন ৬ বছর বয়স তখন আমরা বি-ওয়ান ছেড়ে অন্য কোয়ার্টারে যাই। আমাদের ঠিক উপরের ফ্ল্যাটটাতে মানে বি-থ্রিতে থাকতেন শীল জেঠুরা। প্রফেসর বিজয় শীল আর বাবা দুজনেই রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন।
শীল জেঠুর দুই ছেলে, বাপি আর বুম্বা। বাপিদা আমার থেকে অনেকটাই বড়। বুম্বাদা বছর দশেকের। দুজনেই আমাকে ভীষণ ভালবাসত। বাপিদা রোজ বিকেলে পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলতে যেত। শুনেছি আমাকে নিয়ে মা ঘুরতে বেরোলে বাপিদা মাঠ থেকে ছুটে আসত আমাকে আদর করতে। জেঠিমা নাকি বারান্দা থেকে বাপিদাকে ধমক দিতেন যেন নোংরা হাতে আমাকে না ছোঁয়।
বুম্বাদা আবার সুযোগ পেলেই আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসত। মনে আছে আমার পাঁচ বছরের জন্মদিনে বুম্বাদা একটা বই উপহার দিয়েছিল -- "মা দূর্গার কলকাতা ভ্রমণ।"
শীল জেঠুর কড়া শাসনে মানুষ হত দুই ভাই। একবার মনে আছে আমাদের বাড়ির সামনে নেট টাঙিয়ে দুই ভাই ব্যাডমিন্টন খেলছিল। প্রথম সেটটা বাপিদা একদম খাটেনি। বুম্বাদা কিন্তু প্রচণ্ড খেটে জিতল। পরের সেট খেলতে গিয়েই বুম্বাদা হাঁফিয়ে পড়ল। ব্যাস, বাপিদার সহজ জয়।
একদিন বাপিদা শুনলাম খড়গপুরে পড়তে গেল। জানতামও না সেটা কি। কয়েক বছর বাদে বাপিদা গেল আমেরিকা। এক বছর বাদে যখন বাড়ি ফিরল, আমার জন্য নিয়ে এল নীল-হলুদ এক ফেরারি গাড়ি। এখনও আছে সেটা। তারাবাগের বাকি সবাই আমাকে পিকো বলে ডাকলেও বাপিদা আর বুম্বাদা কিন্তু আমাকে "বাবাই" বলে ডাকত। এখনও ডাকে।
২০০৭-এ যখন আমি ফ্লোরিডা যাচ্ছি, জানতে পারলাম বাপিদাও ফ্লোরিডাতেই থাকে, তবে অন্য শহরে। তার মধ্যেও বাপিদা আমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করতে লাগল। বাপিদা থাকে অরল্যান্ডোতে। ওখানকার Material Science -এর নামকরা প্রফেসর। গেন্সভিল থেকে বার দু-তিন বাপিদার বাড়ি গেছি। বলা বাহুল্য, যা আতিথিয়তা পেয়েছি তা অতুলনীয়। বাপিদার স্ত্রী শান্তাদি লন্ডনের মেয়ে। আমাকে উইম্বিল্ডন দেখার গল্প বলে মুগ্ধ করে রাখতেন। বাপিদার মেয়ে লিলির মত মিষ্টি মেয়ে খুব কমই দেখেছি। সন্ধ্যে হলে বাপিদা আমার কাছে তারাবাগের গল্প শুনতে চাইত। সমস্যাটা হল বাপিদা আমার চেয়ে অনেকটাই বড়। তাই বাপিদা যাদের নাম বলত, আমি তাদের চিনতাম না। তাও কিছু কিছু চেনা জানা থাকত। বুঝতে পারতাম বাপিদা যেন অরল্যান্ডোতে বসেই তারাবাগকে ফেরত পেতে চাইছে।
বুম্বাদা থাকত ম্যাসেচুসেটসে। কথা ছিল দেখা হবে। ২০১২ তে আমি দেশে ফেরার আগে হয়ে উঠল না। এর মাঝে আমি একবার ছুটি কাটাতে বাড়ি এসেছি। যতদূর মনে পড়ছে সালটা ২০১০। দুপুরবেলা বেল বাজতে দরজা খুলে দেখি বাপিদা, শান্তাদি, লিলি আর শীল জেঠু। মা বাবাকে দেখে ভীষণ খুশি বাপিদা। তারাবাগের পুরানো গল্প শুরু হল।
"তারাবাগ কত পাল্টে গেছে কাকিমা, আর কাউকেই চিনি না আপনাদের ছাড়া।"
-- বাপিদার হতাশ উক্তি মনে পড়ে।
আবার ছোটবেলার কথা বলতেই বাপিদা বলে
"মনে পড়ে কাকিমা, বাবা আমাকে কি মারত?"
জেঠু মাথা নিচু করে বলেন --
"সেই, তোদের তো শুধু মেরেইছি!"
"তারাবাগ কত পাল্টে গেছে কাকিমা, আর কাউকেই চিনি না আপনাদের ছাড়া।"
-- বাপিদার হতাশ উক্তি মনে পড়ে।
আবার ছোটবেলার কথা বলতেই বাপিদা বলে
"মনে পড়ে কাকিমা, বাবা আমাকে কি মারত?"
জেঠু মাথা নিচু করে বলেন --
"সেই, তোদের তো শুধু মেরেইছি!"
২০১২-এ আমি আমেরিকা ছাড়ার আগে আমার মা বাবা এসেছিলেন ফ্লোরিডায় আমার কনভকেশনে। একদিন বাপিদার বাড়িতে নিয়ে গেলাম ওদের। শান্তাদি সে সময় লন্ডনে। বাবা মাকে দেখে বাপিদা যে কি খুশি বলে বোঝানো যাবে না। অত বড় একজন অধ্যাপক, যার বিশ্বজোড়া নাম, তার মধ্যে এরকম ছেলেমানুষি আনন্দ দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। সারা সন্ধ্যে ধরে চলল ১৯৮০ র দশকের তারাবাগের গল্প যার আশি শতাংশ আমার অজানা। ফোনে বুম্বাদাদের সঙ্গেও কথা হল।
দু সপ্তাহ আগে জানতে পারলাম বুম্বাদা মাত্র ৪১ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আজ বাপিদার কাছে শুনলাম জেঠুও খুব অসুস্থ। সকাল থেকেই তাই মনটা বেশ খারাপ। এই লেখাটা সেই মন খারাপেরই বহিঃপ্রকাশ। হয়ত খুব বোর করলাম সবাইকে এতটা লিখে, কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই লেখাটা না লিখলে রাত্রে হয়ত ভালো ঘুম হত না।
লোকে বলে জীবন এগিয়ে যায়। আমাদের সকলেরই জীবন এগিয়ে যাবে। হয়ত কাল আমি আবার পাগলু নিয়ে ঠাট্টা করব, বা আমার স্কুল জীবনের কোন মজার গল্পের কথা লিখব। কিন্তু দিনের শেষে হয়ত আবার ফিরে যাব তারাবাগে; সেই তারাবাগ যাকে বাপিদা বার বার খুঁজে বেড়ায়, যা আমরা জানি আর কোনদিন পাওয়া যাবে না -- না, এখনকার তারাবাগে গিয়েও না, যার থেকে হয়ত একদিন আমি সম্পুর্নভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব; কিন্তু যে তারাবাগে আমি, বাপিদা, আমরা সবাই বার বার ফিরে যেতে চাইব।
No comments:
Post a Comment