অরিন্দমবাবুর যখন ঘুম ভাঙল ততক্ষণে শর্মিলাদেবীর সকালের জলখাবার বানানো হয়ে গেছে। অরিন্দমবাবুর বয়স বাড়ছে। তাই সকালে শুধু ওটস। নিজেও তাই খান শর্মিলাদেবী। ছেলের জন্য অবশ্য ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানিয়েছেন। একে তো আজ শনিবার। বনি সকালে ফ্রেঞ্চ টোস্ট খেতে ভালোবাসে। তার মধ্যে আজ সরস্বতী পুজো। দুপুরে খাওয়া কখন হবে তার ঠিক নেই। এখানে অবশ্য বাচ্চাদের জন্য পিতজা আসে। শর্মিলা শুনেছেন এটা নাকি আমেরিকাতে সব বাঙালিরাই করে। মানে নিজেরা পুজোর দিন দুপুরে খিচুরি, লাবড়া, ভাজা এসব খেলেও বাচ্চাদের এসব দেওয়া হয় না। তারা নাকি "স্পাইস সহ্য করতে পারবে না"। শর্মিলার এই যুক্তিটি খুব একটা মনে ধরেনি। তিনি নিজে অনেক ছোট বয়স থেকেই খিচুরি খেয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কি, আমেরিকা আসার আগে তিনি কোনদিন পিতজা খাননি। কিন্তু কি আর করা যাবে, সবাই যা করছে তাঁকেও তাই করতে হবে। তিনি মেনে নেন। সবই মেনে নেন।
সরস্বতী পুজো ছিল বুধবার। পশ্চিমবঙ্গে সেই দিনেই পুজো হয়েছে। এই দেশে শনি-রবি দেখে পুজো হয়। সবার ছুটির ব্যাপারটাও দেখতে হবে তো। শর্মিলা থাকেন আমেরিকার মধ্যভাগের একটা মাঝারি মাপের শহরে। আগে কিন্তু এখানে এত ঘটা করে পুজো হত না। মাত্র ১০-২০ জন বাঙালি ছিল। কারুর নিজের বাড়িতে ইচ্ছে হল করত, বা বড় পুজো দেখতে হলে শিকাগো যেত। শহরে একটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে। গত কয়েক বছরে প্রচুর বাঙালি ছেলে মেয়েরা সেখানে পড়তে আসতে শুরু করে। মূলত তাদেরই উদ্যোগে এই পুজো শুরু হয় বছর তিনেক আগে। পুজোর দুদিন আগে থেকেই এখানকার বাঙালিদের মধ্যে সাজো সাজো রব। একটা স্কুলের অডিটোরিয়াম ভাড়া করে পুজো হয়। সেই অডিটোরিয়াম সাজানো, সবজি বাজার করা, রান্নার যোগাড় করা, অনেক কাজ। কাল অনেক রাত অবধি সবজি কেটেছেন শর্মিলা। এ ছাড়াও তার কাঁধে আর এক গুরুদায়িত্ব আছে।
সকালে পুজো হয়ে গেলে বিকেল থেকে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতি বছরই ছোটদের অনুষ্ঠানের পরিচালনায় থাকেন শর্মিলা। একদম বাংলা না বলতে পারা বাচ্চাদের ধরে বীরপুরুষ আবৃতি করানো যে কি কঠিন কাজ, যারা করেনি তাদের ধারণাও নেই। শর্মিলা কিন্তু এই কাজে পটু। তাই প্রতিবার পুজোর আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁকে ধরে -- "কাকিমা, ছোটদেরটা আপনি সাম্লাবেন তো?"
এতেই শেষ নয়। তাঁদের এই ছোট শহরের সব বাঙালিরা তাঁর গানের অপেক্ষায় বসে থাকে। অসম্ভব ভালো গানের গলা শর্মিলার। অনেকে তো তাঁকে অনুরোধ করে কলকাতায় গিয়ে গানের সি ডি করাতে। তিনি শুধুই হাসেন। আজও তিনি জানেন, সব অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে শুরু হবে তাঁর গান। একটা দুটো নিজের পচ্ছন্দ মত গান করার পর আসবে অনুরোধ। "কাকিমা অন্তহীনের গানটা করুন না।"
শর্মিলা যখন স্কুলে পৌঁছালেন, তখনো অঞ্জলি শুরু হয়নি।
"এই শর্মিলাদি এস, এদিকে ফুল্গুলো দিয়ে দেবে। বনি কোথায়?"
"ঐ তো বাইরে, লিলিদের সঙ্গে খেলছে।"
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর একটু ছুটি থাকে সবার। সন্ধ্যা নাগাদ অনুষ্ঠান শুরু হয়। ছাত্র-ছাত্রীর দল চেয়ার টেবল পাততে শুরু করল। অরিন্দমবাবু বাকি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে লাগলেন। শর্মিলাদেবীর মনে হল এবার বলা যেতে পারে।
রূপসাকে ডাকলেন। এই মেয়েটি বছর দুয়েক আগে বিয়ে করে তাঁদের শহরে এসেছে।
"শোন না, আমার একটু মাথাটা ধরেছে। তুই একবার বাচ্চাদের দেখে দিতে পারবি। আমি একটু বাড়ি হয়ে আসছি।"
"হ্যাঁ হ্যাঁ, পারব। কিন্তু তোমার কি খুব শরীর খারাপ?"
"না না সেরকম কিছু না। চিন্তা করিস না। আমি একটু এক ঘন্টা শুয়ে নিয়ে শাড়িটা পাল্টে আসছি। জানিসি তো আমার মাইগ্রেন।"
"কোন চিন্তা কর না। অরিন্দমদাকে ডেকে দেব?"
"দরকার নেই, আমি নিজেই ড্রাইভ করে নেব। আসি রে।"
"বিকেলে কটায় আসবে?"
"ছটার মধ্যে চলে আসব। তার আগে তো শুরু হবে না কিছু।"
"ঠিক আছে।"
বাড়ির পিছনের দরজা খুলে লনে চলে এলেন শর্মিলা। তাঁদের বাড়ির পিছনের এই লনটি তাঁর খুব প্রিয়। এখানে দুটি ইজি চেয়ার রাখা আছে। মাঝে মাঝে তিনি আর অরিন্দমবাবু এসে বসেন। লনের উল্টোদিকে একটা পুকুর, পাশে ফোয়ারা। রাত্রিবেলা দেখতে বেশ লাগে। আজ অবশ্য চেয়ারে না বসে ঘাসে বসলেন তিনি। একটা সিগারেট ধরিয়ে ঠোঁটে রাখলেন। পুকুরটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলেন পূর্ণিমার কথা। পূর্ণিমা তাঁর বর্ধমানের সহপাঠি। দর্শনের ছাত্রী। তাঁরা একই হস্টেলে থাকতেন। এখন পূর্ণিমা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সরস্বতী পুজোর ছবি শেয়ার করেছেন ফেসবুকে। তাঁদের হস্টেলের ছবিও। মাঝে মাঝে শর্মিলার মনে হয় ফেসবুক জিনিসটা না থাকলে কত ভালো হত। এই বার বার পিছন ফিরে তাকানো সবসময় ভালো লাগেনা।
কিন্তু এখন সে আক্ষেপ করে লাভ নেই। পিছন ফিরেছেন যখন একবার তখন সেটা আর পাল্টানো যাবে না। সামনের পুকুরটার দিকে তাকিয়ে আর এক পুকুরের কথা মনে পড়ল তাঁর। লালদীঘি।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আবাসন তারাবাগের মধ্যেই অবস্তিত লেডিজ হস্টেলগুলি। ছেলেদের হস্টেল্গুলি বাইরে। নিবেদিতা হস্টেলের ছাত্রীরা সেদিন সকলে মিলে তাদের হস্টেলটি সাজিয়েছিল। টুনি বাতি আর রঙ বেরঙের কাগজের চেন। হস্টেলের সামনে মোরামের রাস্তা। রাস্তা ধরে বাঁদিকে হাঁটলে এক সরু পিচের রাস্তা যার পাশেই লালদীঘি। পিচের রাস্তা আর লালদীঘির মাঝে আক ফালি জমি। সেই জমির উপর সেদিন বসেছিল তারা দুজনে। পিছনে স্ট্যান্ড করা ছিল একটি হিরো সাইকেল।
"মনে রেখ সরস্বতী পুজোর দিন আমি হ্যাঁ বলেছিলাম।"
"প্রত্যেক সরস্বতী পুজোতে মনে রাখব।"
"তোমাদের বাড়িতে তো পুজো হয়, গেলে না?"
"তুমি তো বলেছিলে দরকার আছে, তাই গেলাম না।"
"এ বাবা, বাড়িতে কি বললে?"
"ভোলা তো আমাদের পাড়াতেই থাকে, ও বলে দেবে আমার কিছু কাজ আছে কলেজের, তাই যাইনি।"
"কলেজের?"
"হ্যাঁ, বাড়িতে জানে আমি এম এস সি পাশ করেই কলেজে পড়াব।"
"অঙ্কের অধ্যাপক শ্রী সুজিত কুমার দেবনাথ। হা হা হা।"
"হাসছ কেন? হতে পারিনা?"
"না না হতে পারবে না কেন? আচ্ছা তোমার পি এইচ ডি করার ইচ্ছে নেই?"
"থাকবে না কেন? কিন্তু জানোই তো বহু বছর ধরে বাবার কারখানায় লক-আউট। আমাকে তো বাবা বলেছিল কলেজ পাশ করেই স্কুলে পড়াতে। এই দু' বছর কোন রকমে পেয়েছি। বাড়িতে ছোট ভাই আছে। এ অবস্থায় আমি পি এইচ ডি করতে ঢুকলে হয়? কলেজে পড়াতে পড়াতে পার্ট টাইমে করব ভেবেছি। তুমি?"
"আমার তো বাবা বলেইছে এম এস সির পর বিয়ে দিয়ে দেবে। এই সিগারেটটা নেভাও।"
"একটাই তো খাই সারাদিনে।"
"কি দুর্গন্ধ বাবা।"
"তুমি বিয়ে করে নেবে?"
"মাথা খারাপ? আমি বলে দিয়েছি ওসব হবে না।"
"আচ্ছা তোমার বাবা আমাকে মেনে নেবেন তো?"
"কেন?"
"তোমরা বামুন। আমরা নই। তুমি দূর্গাপুর শহরের মেয়ে। আমি রসুলপুরের গ্রামে থাকি। তোমার বাবা কি এরকম বাড়িতে মেয়েকে ছাড়বেন? হয়ত শহরের বা বিদেশে থাকা কোন ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দেবেন।"
"খালি বাজে কথা। বাবা বললেই হল, আমার মতের দাম নেই? এত কষ্ট করে পড়াশুনা করলাম কেন? বাবার পছন্দ করা ছেলেকেই যদি বিয়ে করি। এই তুমি সারাক্ষণ এরকম আজে বাজে চিন্তা কর কেন? একটু ভালো কিছু বলতে পারো না?"
"আচ্ছা বাবা। বলছি। তোমার কানের দুলটা বেশ সুন্দর।"
"কি ন্যাকামো!! আমি চলে যাচ্ছি।"
"আরে না থাকো না। একটা গান শোনাবে?"
"কি গান?"
আরে তুমি এতদিন ধরে দূর্গাপুরে গান শিখেছ, একটা গান গাইতে পারবে না?"
"শর্মিলাদি এলে? এখুনি বীরপুরুষ শুরু হবে।"
"হ্যাঁ চল চল। লিলি, বনি, বুবুনরা তৈরি তো?"
"একদম।"
সব অনুষ্ঠানের শেষে স্টেজে গান গাইতে উঠলেন শর্মিলা। সামনে রাখা হারমোনিয়ামটা নিয়ে একবার চোখ বন্ধ করলেন। তারপর সেই গানটাই ধরলেন যেটা গেয়েছিলেন আজ থেকে বহু বছর আগে, এক সরস্বতী পুজোর দিন, লালদীঘির পারে।
সরস্বতী পুজো ছিল বুধবার। পশ্চিমবঙ্গে সেই দিনেই পুজো হয়েছে। এই দেশে শনি-রবি দেখে পুজো হয়। সবার ছুটির ব্যাপারটাও দেখতে হবে তো। শর্মিলা থাকেন আমেরিকার মধ্যভাগের একটা মাঝারি মাপের শহরে। আগে কিন্তু এখানে এত ঘটা করে পুজো হত না। মাত্র ১০-২০ জন বাঙালি ছিল। কারুর নিজের বাড়িতে ইচ্ছে হল করত, বা বড় পুজো দেখতে হলে শিকাগো যেত। শহরে একটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে। গত কয়েক বছরে প্রচুর বাঙালি ছেলে মেয়েরা সেখানে পড়তে আসতে শুরু করে। মূলত তাদেরই উদ্যোগে এই পুজো শুরু হয় বছর তিনেক আগে। পুজোর দুদিন আগে থেকেই এখানকার বাঙালিদের মধ্যে সাজো সাজো রব। একটা স্কুলের অডিটোরিয়াম ভাড়া করে পুজো হয়। সেই অডিটোরিয়াম সাজানো, সবজি বাজার করা, রান্নার যোগাড় করা, অনেক কাজ। কাল অনেক রাত অবধি সবজি কেটেছেন শর্মিলা। এ ছাড়াও তার কাঁধে আর এক গুরুদায়িত্ব আছে।
সকালে পুজো হয়ে গেলে বিকেল থেকে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতি বছরই ছোটদের অনুষ্ঠানের পরিচালনায় থাকেন শর্মিলা। একদম বাংলা না বলতে পারা বাচ্চাদের ধরে বীরপুরুষ আবৃতি করানো যে কি কঠিন কাজ, যারা করেনি তাদের ধারণাও নেই। শর্মিলা কিন্তু এই কাজে পটু। তাই প্রতিবার পুজোর আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁকে ধরে -- "কাকিমা, ছোটদেরটা আপনি সাম্লাবেন তো?"
এতেই শেষ নয়। তাঁদের এই ছোট শহরের সব বাঙালিরা তাঁর গানের অপেক্ষায় বসে থাকে। অসম্ভব ভালো গানের গলা শর্মিলার। অনেকে তো তাঁকে অনুরোধ করে কলকাতায় গিয়ে গানের সি ডি করাতে। তিনি শুধুই হাসেন। আজও তিনি জানেন, সব অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে শুরু হবে তাঁর গান। একটা দুটো নিজের পচ্ছন্দ মত গান করার পর আসবে অনুরোধ। "কাকিমা অন্তহীনের গানটা করুন না।"
শর্মিলা যখন স্কুলে পৌঁছালেন, তখনো অঞ্জলি শুরু হয়নি।
"এই শর্মিলাদি এস, এদিকে ফুল্গুলো দিয়ে দেবে। বনি কোথায়?"
"ঐ তো বাইরে, লিলিদের সঙ্গে খেলছে।"
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর একটু ছুটি থাকে সবার। সন্ধ্যা নাগাদ অনুষ্ঠান শুরু হয়। ছাত্র-ছাত্রীর দল চেয়ার টেবল পাততে শুরু করল। অরিন্দমবাবু বাকি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে লাগলেন। শর্মিলাদেবীর মনে হল এবার বলা যেতে পারে।
রূপসাকে ডাকলেন। এই মেয়েটি বছর দুয়েক আগে বিয়ে করে তাঁদের শহরে এসেছে।
"শোন না, আমার একটু মাথাটা ধরেছে। তুই একবার বাচ্চাদের দেখে দিতে পারবি। আমি একটু বাড়ি হয়ে আসছি।"
"হ্যাঁ হ্যাঁ, পারব। কিন্তু তোমার কি খুব শরীর খারাপ?"
"না না সেরকম কিছু না। চিন্তা করিস না। আমি একটু এক ঘন্টা শুয়ে নিয়ে শাড়িটা পাল্টে আসছি। জানিসি তো আমার মাইগ্রেন।"
"কোন চিন্তা কর না। অরিন্দমদাকে ডেকে দেব?"
"দরকার নেই, আমি নিজেই ড্রাইভ করে নেব। আসি রে।"
"বিকেলে কটায় আসবে?"
"ছটার মধ্যে চলে আসব। তার আগে তো শুরু হবে না কিছু।"
"ঠিক আছে।"
বাড়ির পিছনের দরজা খুলে লনে চলে এলেন শর্মিলা। তাঁদের বাড়ির পিছনের এই লনটি তাঁর খুব প্রিয়। এখানে দুটি ইজি চেয়ার রাখা আছে। মাঝে মাঝে তিনি আর অরিন্দমবাবু এসে বসেন। লনের উল্টোদিকে একটা পুকুর, পাশে ফোয়ারা। রাত্রিবেলা দেখতে বেশ লাগে। আজ অবশ্য চেয়ারে না বসে ঘাসে বসলেন তিনি। একটা সিগারেট ধরিয়ে ঠোঁটে রাখলেন। পুকুরটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলেন পূর্ণিমার কথা। পূর্ণিমা তাঁর বর্ধমানের সহপাঠি। দর্শনের ছাত্রী। তাঁরা একই হস্টেলে থাকতেন। এখন পূর্ণিমা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সরস্বতী পুজোর ছবি শেয়ার করেছেন ফেসবুকে। তাঁদের হস্টেলের ছবিও। মাঝে মাঝে শর্মিলার মনে হয় ফেসবুক জিনিসটা না থাকলে কত ভালো হত। এই বার বার পিছন ফিরে তাকানো সবসময় ভালো লাগেনা।
কিন্তু এখন সে আক্ষেপ করে লাভ নেই। পিছন ফিরেছেন যখন একবার তখন সেটা আর পাল্টানো যাবে না। সামনের পুকুরটার দিকে তাকিয়ে আর এক পুকুরের কথা মনে পড়ল তাঁর। লালদীঘি।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আবাসন তারাবাগের মধ্যেই অবস্তিত লেডিজ হস্টেলগুলি। ছেলেদের হস্টেল্গুলি বাইরে। নিবেদিতা হস্টেলের ছাত্রীরা সেদিন সকলে মিলে তাদের হস্টেলটি সাজিয়েছিল। টুনি বাতি আর রঙ বেরঙের কাগজের চেন। হস্টেলের সামনে মোরামের রাস্তা। রাস্তা ধরে বাঁদিকে হাঁটলে এক সরু পিচের রাস্তা যার পাশেই লালদীঘি। পিচের রাস্তা আর লালদীঘির মাঝে আক ফালি জমি। সেই জমির উপর সেদিন বসেছিল তারা দুজনে। পিছনে স্ট্যান্ড করা ছিল একটি হিরো সাইকেল।
"মনে রেখ সরস্বতী পুজোর দিন আমি হ্যাঁ বলেছিলাম।"
"প্রত্যেক সরস্বতী পুজোতে মনে রাখব।"
"তোমাদের বাড়িতে তো পুজো হয়, গেলে না?"
"তুমি তো বলেছিলে দরকার আছে, তাই গেলাম না।"
"এ বাবা, বাড়িতে কি বললে?"
"ভোলা তো আমাদের পাড়াতেই থাকে, ও বলে দেবে আমার কিছু কাজ আছে কলেজের, তাই যাইনি।"
"কলেজের?"
"হ্যাঁ, বাড়িতে জানে আমি এম এস সি পাশ করেই কলেজে পড়াব।"
"অঙ্কের অধ্যাপক শ্রী সুজিত কুমার দেবনাথ। হা হা হা।"
"হাসছ কেন? হতে পারিনা?"
"না না হতে পারবে না কেন? আচ্ছা তোমার পি এইচ ডি করার ইচ্ছে নেই?"
"থাকবে না কেন? কিন্তু জানোই তো বহু বছর ধরে বাবার কারখানায় লক-আউট। আমাকে তো বাবা বলেছিল কলেজ পাশ করেই স্কুলে পড়াতে। এই দু' বছর কোন রকমে পেয়েছি। বাড়িতে ছোট ভাই আছে। এ অবস্থায় আমি পি এইচ ডি করতে ঢুকলে হয়? কলেজে পড়াতে পড়াতে পার্ট টাইমে করব ভেবেছি। তুমি?"
"আমার তো বাবা বলেইছে এম এস সির পর বিয়ে দিয়ে দেবে। এই সিগারেটটা নেভাও।"
"একটাই তো খাই সারাদিনে।"
"কি দুর্গন্ধ বাবা।"
"তুমি বিয়ে করে নেবে?"
"মাথা খারাপ? আমি বলে দিয়েছি ওসব হবে না।"
"আচ্ছা তোমার বাবা আমাকে মেনে নেবেন তো?"
"কেন?"
"তোমরা বামুন। আমরা নই। তুমি দূর্গাপুর শহরের মেয়ে। আমি রসুলপুরের গ্রামে থাকি। তোমার বাবা কি এরকম বাড়িতে মেয়েকে ছাড়বেন? হয়ত শহরের বা বিদেশে থাকা কোন ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দেবেন।"
"খালি বাজে কথা। বাবা বললেই হল, আমার মতের দাম নেই? এত কষ্ট করে পড়াশুনা করলাম কেন? বাবার পছন্দ করা ছেলেকেই যদি বিয়ে করি। এই তুমি সারাক্ষণ এরকম আজে বাজে চিন্তা কর কেন? একটু ভালো কিছু বলতে পারো না?"
"আচ্ছা বাবা। বলছি। তোমার কানের দুলটা বেশ সুন্দর।"
"কি ন্যাকামো!! আমি চলে যাচ্ছি।"
"আরে না থাকো না। একটা গান শোনাবে?"
"কি গান?"
আরে তুমি এতদিন ধরে দূর্গাপুরে গান শিখেছ, একটা গান গাইতে পারবে না?"
"শর্মিলাদি এলে? এখুনি বীরপুরুষ শুরু হবে।"
"হ্যাঁ চল চল। লিলি, বনি, বুবুনরা তৈরি তো?"
"একদম।"
সব অনুষ্ঠানের শেষে স্টেজে গান গাইতে উঠলেন শর্মিলা। সামনে রাখা হারমোনিয়ামটা নিয়ে একবার চোখ বন্ধ করলেন। তারপর সেই গানটাই ধরলেন যেটা গেয়েছিলেন আজ থেকে বহু বছর আগে, এক সরস্বতী পুজোর দিন, লালদীঘির পারে।
besh lekha,bhalo laglo
ReplyDelete