Tuesday, March 20, 2018

চিকেন কবিরাজি

আজ শম্পাদির বিয়ে। গত দু'দিন আমাদের খেলা বন্ধ। পাড়ায় একটাই মাঠ। সেখানেই বিয়েবাড়ি হয়। তাই সে ক'দিন আমাদের খেলা বন্ধ থাকে। এতে অবশ্য আমরা কিছু মনে করিনা। কারণ আমরা কেউ খুব একটা বাইরে খাই না। মানে চপ, রোল, এসব খাই। কিন্তু ঐ বিয়েবাড়ির খাওয়া, মানে বাড়ির বাইরে রাতের খাওয়া -- না ওসব  হয়না আমাদের। তাই একটা বিয়েবাড়ি এলে আমরা সবাই খুশি। যদিও বিলুরা খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুশি না। তাপসদের বাড়ির সামনে যে এক ফালি জমি, সেখানেই ওরা চার-পাঁচজন মিলে ক্রিকেট খেলছে। আমরা, মানে আমি, সত্যেন, চন্দন, সুগত, রানা, আমরা যাই না। আমার আবার অন্য ব্যবস্থা আছে। ছোট থেকেই ক্যারামটা ভালো খেলি বলে এই সময় পাড়ার ক্লাবঘরে প্রবেশ করার অনুমতি পাই। রাজুদা, দেবুদা, শুভদারা আমায় খুবই ভালোবাসে। নিজেকে যেন কি'রম বড় বড় মনে হয়। মানে আমার বয়সী বাকিরা তো ক্লাবে ঢুকতে পারে না।

কোথা থেকে কোথায় চলে গেলাম। কথা হচ্ছিল আজকের বিয়েবাড়ি নিয়ে। আজকের বিয়েবাড়ির মূল আকর্ষণ সুরুচি ক্যাটারার। আমাদের এই ছোট জেলা শহরের প্রথম ক্যাটারার। শুনেছি কলকাতায় নাকি এখন সব বিয়েবাড়িতেই ক্যাটারার চলে। তবে কলকাতা বড় শহর, সাড়ে তিন ঘন্টা লাগে ট্রেনে। আমাদের এখানে এটাই প্রথম। বছর দুয়েক হল খুলেছে। আর আমাদের পাড়ায় এই প্রথম আসছে সুরুচি ক্যাটারার। এই দু' বছরেই কিন্তু বেশ নাম করে ফেলেছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় হল ওদের চিকেন কবিরাজি। এই জিনিসটা আমদের জেলা শহরে কেউ খায়নি আগে। সুরুচি নাকি কলকাতা থেকে পাচক আনিয়েছে। মিঠাপুকুরের শ্যামল, আমার স্কুলের বন্ধু,  প্রথম এই দ্রব্যের কথা জানায় আমাদের। ওদের পাড়ায় কার বিয়েতে নাকি সুরুচি এসেছিল। এই চিকেন কবিরাজি করেছিল।

"সে কি খেতে রে!! মাংস, তার উপরে কিরকম যেন ভাজা চাউমিনের মত।"
"ভাজা চাউমিন? ধুর সে তো আমাদের সন্ধ্যা স্ন্যাক্স সেন্টারেই পাওয়া যায়।"
"আরে না রে, এটা সে জিনিস না। বলে বোঝাতে পারব না। খেলে বুঝবি।"
"এটা আর কেউ বানায় না?"
"না রে যা শুনেছি এটা আমাদের শহরে শুধু সুরুচি বানায়।"

বাড়ি ফিরে রাজুদাকে বলেছিলাম। ক'দিন বাদে রাজুদা জানাল কলকাতায় নাকি হামেশাই পাওয়া যায়।

"তুমি খেয়েছ?"
"না রে।"
"আমাকে খাওয়াবে একদিন?"
"হ্যাঁ, কিন্তু তার জন্য তো কলকাতা যেতে হবে।"
"ধুর, সে তো অনেক দূর।"
"দাঁড়া, একটা চাকরি পাই। একদিন তুই আর আমি মিলে কলকাতায় গিয়ে খেয়ে আসব।"

তো আজ শম্পাদির বিয়েতে সেই সুরুচি আসছে। অবশ্যই থাকছে চিকেন কবিরাজি। শম্পাদির বাবা ঘোষজেঠু নাকি নিজে বলেছেন সুগতর বাবাকে। বিকেলবেলা বসে বসে আনন্দমেলায় "পান্ডব গোয়েন্দা" পড়ছি। একটু বাদেই বেরোতে হবে। মা খানিকক্ষণ আগে ডেকে গেল -- "দিদার দেওয়া পাঞ্জাবীটা পরিস। আলমারি থেকে বার করে রেখেছি।" এই সময় বাইরে আমার নাম ধরে কে যেন ডাকল। দেখি রাজুদা।

"কানু, আছিস। বাঁচা গেল। শোন, খুব বিপদ ঘোষজেঠুর।"
"কি হল?"
"আর বলিস না, সুরুচির কি একটা গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়েছে। ওদের ২-৩ জন আহত। তাই ওরা সবাই হাসপাতালে গেছে। আসতে পারবে না। তবে ওরা পাচক ঠাকুর আর তাঁর সাগরেদদের পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন পরিবেশন করার লোক চাই। তো আমরা ক্লাবের ছেলেরাই করছি। কিন্তু আমাদেরও কেউ কেউ নেই আজ। তা তুই কি আসতে পারবি?"
"কেন পারব না। যাচ্ছি।"

মনে মনে ভয় পেলাম। কোনদিন তো করিনি। পারব? রাজুদারা তো বহু বছর করেছে। এতদিন তো ওরাই করত। এই প্রথম সুরুচিকে বলা হচ্ছে। চিকেন কবিরাজি ঠান্ডা হয়ে যাবে না তো? কিন্তু না বললে আবার প্রেস্টিজে লাগবে। এই এতদিন ক্লাবের দাদাদের সঙ্গে মিশি, নিজেকে বড় বড় ভাবি। নাহ, চলেই যাই।

দিদার পাঞ্জাবী পড়ে রইল। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

ও বাবা, প্রথমেই চিকেন কবিরাজি। তবে আমি না, দেবুদা দিতে গেল। আমাকে বলল স্যালাড দিতে। একটা করে কবিরাজি পড়ছে, আর একটু করে স্যালাড দিচ্ছি আমি। সেনগুপ্তকাকু আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন -- "ও বাবা, আমাদের কানুও আজকাল পরিবেশন করছে।"

মা, বাবা এসেছে দেখলাম। মাকে বেশ বড়দের মত বলে এলাম -- "তোমরা খেয়ে নাও। আমি দাদাদের সঙ্গে খাব।"

এই দেবুদাকে নিয়ে সমস্যা। লোককে যেচে বেশি বেশি করে কবিরাজি দিতে চাইছে। কেন বাবা!! শেষ হয়ে গেলে কে দেখবে? তখন তো আমাদেরই জুটবে না। বরং মাংসটা দিক না বেশি করে। আমাদের বাড়িতে প্রতি রবিবার মাংস হয়। তাই ওতে আমার লোভ নেই। এইসব ভাবছি এমন সময় শুভদার ডাক শুনলাম -- "কানু, লুচিগুলো নিয়ে আবার যা।"

যা ভয় পেয়েছিলাম। সব শেষে আমরা যখন খেতে বসলাম তখন পোলাও, মাংস আর রসগোল্লা ছাড়া কিছুই নেই। চোখ ফেটে জল এসে গেল। এত সাধের কবিরাজি, এক টুকরো পেলাম না। সব দোষ এই দেবুদার। রাজুদার পাশেই বসে খাচ্ছিলাম, একবার বললাম -- "কবিরাজি নেই না?"

"না রে, সবাই খুব ভালোবেসে  খেয়েছে ওটা।"
"ওহ।"
"তোর মন খারাপ হয়ে গেছে? ভাবিস না, আমি চাকরি পাই, তোকে কলকাতা থেকে এনে খাওয়াব।"
প্রচন্ড রাগের মাথায় বললাম
"তুমিও আর চাকরি পেয়েছ, আমারো আর কবিরাজি খাওয়া হয়েছে।"
রাজুদা দেখলাম চুপ করে গেল। পুরো সময়টা আর কথাই বলল না।

আমার গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেত। মানে এরপর এই গল্পে আর কিছুই হয়না। আমি পরেরদিন স্কুলে গিয়ে শ্যমলকে মিথ্যা বলি -- "কবিরাজি খেলাম। ভালো। তবে তুই যত ভালো বলেছিলিস, তত ভালো না।"

ও হ্যাঁ, পরের এক সপ্তাহ দেবুদার সঙ্গে কথা বলতাম না। এমনি দু'দিন বাদেই মাঠ থেকে প্যান্ডেল উঠে গিয়েছিল। কাজেই ক্লাবে না গিয়ে আমি মাঠে যেতাম।

গল্পটা শেষ হলনা বিয়েবাড়ির দু'সপ্তাহ পরের একটা ঘটনার জন্য। একদিন মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে দেখি ঘোষজেঠু বসে বাড়িতে। আমি যেতেই আমাকে বললেন

"কানু, তুই সেদিন আমার বিপদের দিনে যা করেছিস, আমি কোনদিন ভুলব না। তুই এইটুকু ছেলে হয়ে এত লোককে পরিবেশন করলি, ভাবাই যায় না। তোকে একটা প্রাইজ তো দিতেই হয়। দেখ তো, তোর পছন্দ হয় কিনা।"

মা হাসি মুখে ঘরে ঢুকল। হাতে প্লেট, তাতে দু' খানা চিকেন কবিরাজি, পাশে একটু সস।

আমি তখনো অবাক।

জেঠু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন। বিয়ে মিটে যাওয়ার ক'দিন বাদে রাজুদা নাকি ওনার বাড়ি গিয়ে বলে আমার চিকেন কবিরাজি খাওয়া হয়নি। কিছুভাবে যদি এর ব্যবস্থা করা যায়, ভালো হয়। পরেরদিন সুরুচির মালিক হিসেব করতে ওনার বাড়ি আসে। উনি প্রথমেই জেঠুর কাছে ক্ষমা চান। জেঠু বলেন উনি ক্ষমা করতে পারেন। একটাই শর্তে। পরের যেদিন কোন বিয়েবাড়িতে সুরুচি খাদ্য পরিবেশন করবে, সেদিন দু'খানা চিকেন কবিরাজি ওনাকে দিতে হবে। মালিক এক কথায় রাজি।

আজ পাওয়ার হাউস পাড়ায় দত্তদের ছোট ছেলের বউভাত।





Friday, March 9, 2018

সহযাত্রী

সহযাত্রী
************
বুধবারের বিকেল। বর্ষাকাল। হাওড়া স্টেশনে থিকথিকে ভিড়। তার মধ্যে জায়গায় জায়গায় জল পড়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। একটা কিরকম যেন গুমোট দম বন্ধ করা ভাব।
সাত নম্বর প্ল্যাটফর্মে পাঁচটা তেইশের বর্ধমান কর্ড লোকাল দাঁড়িয়ে। জানালার ধারে একটা সিট পেয়েছেন অলকবাবু। খানিক্ষণ আগে, মানে ট্রেনে উঠে ভীষণ ঘামছিলেন। এখন অনেকটা ঠিক ঠাক। আস্তে আস্তে ট্রেন ভর্তি হয়ে গেল। তিনজনের সিটে কোথাও চারজন, কোথাও বা পাঁচজন বসে। একদম নিত্যযাত্রী তাস খেলতে লাগলেন।
লিলুয়াতে ট্রেনে এক চা-ওলা উঠল। গলা শুকিয়ে কাঠ। একটা চা দিতে বললেন অলকবাবু। উল্টোদিকের ভদ্রলোক-ও তাই বললেন। উনিও হাওড়া থেকেই উঠেছেন। বয়স হয়ত অলকবাবুর চেয়ে একটু বেশি হবে। কাঁচা-পাকা চুল, যদিও পাকার ভাগটাই বেশি। পরনে হাফ হাতা চেক শার্ট, খয়েরি প্যান্ট ও চটি। কোন ব্যাগ চোখে পড়ল না যদিও।
-- দাদা কতদূর?
ভদ্রলোক নিজেই আলাপ করতে এলেন।
-- আমি এই গুড়াপ। আপনি?
-- আমি... দেখি, মানে আমি বর্ধমান।
-- ও তা আপনি সুপার নিলেন না কেন? এর চেয়ে জলদি পৌঁছাতেন।
-- হ্যাঁ নিতেই পারতাম, ঐ আর কি। সুপার মানে গ্যালোপিং-টা তো?
-- হ্যাঁ।
-- তা আপনার অফিস কি কলকাতাতেই?
-- হ্যাঁ, আমি ধর্মতলার মঞ্জুষাতে বসি।
নিজের তৈরী উত্তর বললেন অলকবাবু।
-- ওহ, মঞ্জুষা। ওখানে একবার গিয়েছিলাম মনে হয়। আপনাকে কি দেখেছি? মনে নেই যদিও।
-- হয়ত অফ ডে ছিল।
এবারো তৈরী উত্তর।
-- তা হবে। তা কতদিন আছেন ওখানে?
-- এই হল বেশ কয়েক বছর। আপনার অফিস কোথায়?
নিজের দিক থেকে আলোচোনাটা সরানো দরকার। গুড়াপ আসতে ঢের দেরী।
-- আমার পার্ক স্ট্রিটের কাছে। রয় এয়ান্ড সন্স চেনেন?
-- না, মানে আমি ঠিক ঐ দিকটা ...
একটু চমকালেন অলকবাবু।
-- বড় সওদাগরী অফিস। ওদের পাশেই আমার অফিস। বেঙ্গল এস্কপোর্টস কোম্পানি।
এবার আরো একটু বেশি চমকালেন অলকবাবু। একটু একটু ঘাম যেন আবার আসতে শুরু করল।
-- সেকি মশাই, ঘামছেন কেন? এত চমকাবার কি আছে?
-- না না চমকাচ্ছি কই? তা কতদিন আছেন আপনি ওখানে?
-- ১৪ বছর হল। রোজ এক রুটিন। সকাল বেলা বাড়ি থেকে বেরোই, অফিসে লাঞ্চ, তারপর বিকেলে একটা সিগারেট আর পাঁচটায় টা টা। হে হে ...
-- পাঁচটায়? তাহলে আজ নিশ্চয় আগে বেরিয়েছেন? পাঁচটায় বেরোলে তো এই ট্রেন ...
-- ধরতে পারতাম না তো। ঠিকি বলেছেন। আজ না কি হল জানেন, রুটিনটা একটু পাল্টে গেল। আমি আর আমার এক কলিগ সহদেব পাল, রোজ বিকেলে অফিসের সামনে সিগারেট খেতে যাই। তো আজ হয়েছে কি... একি মশাই এত ঘামছেন কেন?
-- কি কি নাম বললেন?
-- সহদেব পাল। চেনেন নাকি?
-- না আমি কিভাবে চিনব? আমি চিনি না।
-- তাই বলুন, তা আমরা সবে দু'টান মেরেছি কি মারিনি, হঠাত কি হল জানেন?
-- নাহ, আমার না শরীরটা ঠিক লাগছে না, পরে শুনছি। কেমন?
-- সে কি মশাই কি হল? শুয়ে পড়ুন। শুয়ে পড়ুন।
এবার পাশ ফিরে অলকবাবু দেখলেন কামরা পুরো ফাঁকা, শুধু তিনি আর সামনের ভদ্রলোক। এই যে খানিক্ষণ আগেও তাসের ডাক, চাওলার আওয়াজ ছিল, সব শুন শান। শুধু ট্রেন চলার শব্দ।
-- কি হল? সবাই গেল কোথায়?
-- আর কোথায় বলুন অলকবাবু? এত কাঁচা হাতের টিপ থাকলে কি হয়? মারতে গেলেন সহদেবকে আর গুলিটা খেলাম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমি? একবার দেখলেন-ও না কাকে মেরেছেন? ক'দিন হল এই কাজে? একটা বডি পড়ছে দেখেই পালালেন?
-- না না আমি মানে...
-- আর মানে... যাকগে, একটা কথা। আমাদের না ঠিক মিথ্যা বলা সাজে না। আপনাকে একটা মিথ্যা বলতে হয়েছে। ঠিক করে যাই। আমার বাড়ি নাগেরবাজার।