Friday, March 9, 2018

সহযাত্রী

সহযাত্রী
************
বুধবারের বিকেল। বর্ষাকাল। হাওড়া স্টেশনে থিকথিকে ভিড়। তার মধ্যে জায়গায় জায়গায় জল পড়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। একটা কিরকম যেন গুমোট দম বন্ধ করা ভাব।
সাত নম্বর প্ল্যাটফর্মে পাঁচটা তেইশের বর্ধমান কর্ড লোকাল দাঁড়িয়ে। জানালার ধারে একটা সিট পেয়েছেন অলকবাবু। খানিক্ষণ আগে, মানে ট্রেনে উঠে ভীষণ ঘামছিলেন। এখন অনেকটা ঠিক ঠাক। আস্তে আস্তে ট্রেন ভর্তি হয়ে গেল। তিনজনের সিটে কোথাও চারজন, কোথাও বা পাঁচজন বসে। একদম নিত্যযাত্রী তাস খেলতে লাগলেন।
লিলুয়াতে ট্রেনে এক চা-ওলা উঠল। গলা শুকিয়ে কাঠ। একটা চা দিতে বললেন অলকবাবু। উল্টোদিকের ভদ্রলোক-ও তাই বললেন। উনিও হাওড়া থেকেই উঠেছেন। বয়স হয়ত অলকবাবুর চেয়ে একটু বেশি হবে। কাঁচা-পাকা চুল, যদিও পাকার ভাগটাই বেশি। পরনে হাফ হাতা চেক শার্ট, খয়েরি প্যান্ট ও চটি। কোন ব্যাগ চোখে পড়ল না যদিও।
-- দাদা কতদূর?
ভদ্রলোক নিজেই আলাপ করতে এলেন।
-- আমি এই গুড়াপ। আপনি?
-- আমি... দেখি, মানে আমি বর্ধমান।
-- ও তা আপনি সুপার নিলেন না কেন? এর চেয়ে জলদি পৌঁছাতেন।
-- হ্যাঁ নিতেই পারতাম, ঐ আর কি। সুপার মানে গ্যালোপিং-টা তো?
-- হ্যাঁ।
-- তা আপনার অফিস কি কলকাতাতেই?
-- হ্যাঁ, আমি ধর্মতলার মঞ্জুষাতে বসি।
নিজের তৈরী উত্তর বললেন অলকবাবু।
-- ওহ, মঞ্জুষা। ওখানে একবার গিয়েছিলাম মনে হয়। আপনাকে কি দেখেছি? মনে নেই যদিও।
-- হয়ত অফ ডে ছিল।
এবারো তৈরী উত্তর।
-- তা হবে। তা কতদিন আছেন ওখানে?
-- এই হল বেশ কয়েক বছর। আপনার অফিস কোথায়?
নিজের দিক থেকে আলোচোনাটা সরানো দরকার। গুড়াপ আসতে ঢের দেরী।
-- আমার পার্ক স্ট্রিটের কাছে। রয় এয়ান্ড সন্স চেনেন?
-- না, মানে আমি ঠিক ঐ দিকটা ...
একটু চমকালেন অলকবাবু।
-- বড় সওদাগরী অফিস। ওদের পাশেই আমার অফিস। বেঙ্গল এস্কপোর্টস কোম্পানি।
এবার আরো একটু বেশি চমকালেন অলকবাবু। একটু একটু ঘাম যেন আবার আসতে শুরু করল।
-- সেকি মশাই, ঘামছেন কেন? এত চমকাবার কি আছে?
-- না না চমকাচ্ছি কই? তা কতদিন আছেন আপনি ওখানে?
-- ১৪ বছর হল। রোজ এক রুটিন। সকাল বেলা বাড়ি থেকে বেরোই, অফিসে লাঞ্চ, তারপর বিকেলে একটা সিগারেট আর পাঁচটায় টা টা। হে হে ...
-- পাঁচটায়? তাহলে আজ নিশ্চয় আগে বেরিয়েছেন? পাঁচটায় বেরোলে তো এই ট্রেন ...
-- ধরতে পারতাম না তো। ঠিকি বলেছেন। আজ না কি হল জানেন, রুটিনটা একটু পাল্টে গেল। আমি আর আমার এক কলিগ সহদেব পাল, রোজ বিকেলে অফিসের সামনে সিগারেট খেতে যাই। তো আজ হয়েছে কি... একি মশাই এত ঘামছেন কেন?
-- কি কি নাম বললেন?
-- সহদেব পাল। চেনেন নাকি?
-- না আমি কিভাবে চিনব? আমি চিনি না।
-- তাই বলুন, তা আমরা সবে দু'টান মেরেছি কি মারিনি, হঠাত কি হল জানেন?
-- নাহ, আমার না শরীরটা ঠিক লাগছে না, পরে শুনছি। কেমন?
-- সে কি মশাই কি হল? শুয়ে পড়ুন। শুয়ে পড়ুন।
এবার পাশ ফিরে অলকবাবু দেখলেন কামরা পুরো ফাঁকা, শুধু তিনি আর সামনের ভদ্রলোক। এই যে খানিক্ষণ আগেও তাসের ডাক, চাওলার আওয়াজ ছিল, সব শুন শান। শুধু ট্রেন চলার শব্দ।
-- কি হল? সবাই গেল কোথায়?
-- আর কোথায় বলুন অলকবাবু? এত কাঁচা হাতের টিপ থাকলে কি হয়? মারতে গেলেন সহদেবকে আর গুলিটা খেলাম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমি? একবার দেখলেন-ও না কাকে মেরেছেন? ক'দিন হল এই কাজে? একটা বডি পড়ছে দেখেই পালালেন?
-- না না আমি মানে...
-- আর মানে... যাকগে, একটা কথা। আমাদের না ঠিক মিথ্যা বলা সাজে না। আপনাকে একটা মিথ্যা বলতে হয়েছে। ঠিক করে যাই। আমার বাড়ি নাগেরবাজার।

No comments:

Post a Comment