Wednesday, May 9, 2018

উপহার

পার্ক স্ট্রিট থেকে যখন সি বাসে উঠলেন মলয়বাবু, তখন সবে বিকেল পড়ছে। আজ অফিস থেকে হাফ ছুটি নিয়েছিলেন। ভিড় বাসে বসার জায়গা পেলেন না মলয়বাবু। চিন্তায় ছিলেন ট্রেন না মিস করেন। ঘড়ি যে দেখবেন তারও উপায় নেই।  হাওড়া স্টেশনে নেমেই ছুটলেন সাত নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে। কর্ড লাইন সুপার দাঁড়িয়ে আছে। এটা গ্যালোপিং লোকাল। বর্ধমান পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা সাতটা। জনাই-এ এক চা-ওলার কাছ থেকে চা কিনে ভাবতে লাগলেন আজকের দিনটার কথা।

হ্যাঁ, আজ তাঁর বিবাহবার্ষিকী। দু' বছর আগে এই দিনে পারমিতার সঙ্গে তিনি সংসার শুরু করেন। গত বছর এই দিনটাও কিন্তু বিশেষ কিছু ছিল না। কিছুদিন আগে পাশের বাড়ির ঘোষগিন্নী এসে বললেন --
"আর আমার ছেলের তো প্রথম বিবাহবার্ষিকী আজ। তাদের তো দিল্লী থেকে আসার সময়ই হবে না। তা শুনলাম ছেলে বউমাকে নতুন শাড়ী উপহার দিয়েছে। বউমাও অবশ্য ছেলেকে কি একটা নতুন প্যান্ট কিনে দিয়েছে। কি আজকাল জিন না কি হয় না তাই। আমরা বাবা বুড়ো মানুষ। এতবছর বিয়ে হয়েছে, তোমাদের কাকু কোনদিন আমাকে বিবাহবার্ষিকী বলে কিছুই দিলেন না... আর আজকালকার... "

কথা শুনতে শুনতেই মলয়বাবু মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলেন পারমিতাকে কিছু একটা কিনে দেবেন বিবাহবার্ষিকীতে। কি কিনবেন সেটাও ঠিক করে রেখেছিলেন। তাদের অভাবের সংসার। খাওয়া পরার খুব একটা অসুবিধা হয়না ঠিকই, কিন্তু একটু যে বিলাসিতা করবেন, সে জো নেই। বিয়ের পর থেকেই পারমিতা সেই এক হাতে একটি বালা পরে থাকেন। আর এক হাত খালি থাকে। কবে থেকে ভাবছেন আর এক হাতের আর একটি বালা কিনে দেবেন, কিন্তু সে আর হয়ে ওঠে না। এইবার বিবাহবার্ষিকীতে তাঁকে একটা বালা কিনে দেবেন বলে শ্যাকরার কাছে দাম জেনেও এসেছেন মলয়বাবু। কিঞ্চিৎ দামী। সে যাকগে, বিবাহবার্ষিকীর আগের মাসে একটা এরিয়ার পাওয়ার কথা। পেলে কেনাটা কোন ব্যাপার না।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। কোন এক কারণে এরিয়ারটি ক্যান্সেল হয়ে গেল। মলয়বাবুর মাথায় হাত। জমানো টাকা সেরকম নেই যে বালাটা কিনতে পারবেন। বিয়ের এক বছর আগেই চাকরিটা পেয়েছেন। আর এত ধার দেনা করে বিয়ে করতে হয়েছে, যে জমানো শুরুই হয়েছে অনেক পরে। একদিন অফিসের ক্যান্টিনে বসে এসব ভাবছিলেন এই সময় সহকর্মী বিনয়বাবু তাঁকে ডাকেন --

"এই মলয়, কটা বাজে রে? আমার ঘড়িটা গেছে।"

ঘড়ি, তাই তো!! এটা তো ভেবে দেখেননি মলয়বাবু। তাঁর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া একটা দামী ঘড়ি আছে বটে। অফিসের রাকেশ তেওয়ারি এসব এন্টিক নিয়ে উৎসাহী। একদিন তাঁর ঘড়িটা দেখে বলেছিলেন  --

"এটা বেচে দিন মলয়বাবু, প্রচুর দাম পাবেন। কি হবে এই পুরনো ঘড়ি পরে? দেখতেও তো কেমন হয়ে গেছে? "

কথাটা যে মিথ্যা তাও না। ঘড়ির স্ট্র্যাপ্টা শতজীর্ণ। কবে থেকে ভাবছেন ওটা পালটাবেন, কিন্তু ঐ, পয়সা কোথায়? তবে পৈত্রিক স্মৃতি তাই ছাড়তে পারেননি। মনে আছে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর তাঁর বাবা নিজের হাত থেকে ঘড়িটি খুলে দেন।

ট্রেনের জানালা দিয়ে চায়ের ভাঁড়টা বাইরে ফেলে নিজের খালি হাতের দিকে তাকালেন মলয়বাবু। তারপরই ব্যাগের উপর দিয়ে শ্যাকরার দোকানের বাক্সটা অনুভব করলেন।

স্টেশন থেকে বেড়িয়ে নিজের সাইকেলটা স্ট্যান্ড থেকে নিলেন মলয়বাবু। এবার রওয়ানা হলেন বাড়ির দিকে। আজ যেন মনটা নিজের থেকেই ভালো লাগছে। জি টি রোড পার হয়ে নটরাজ সিনেমার সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে থামলেন একবার। সামনেই মিষ্টির দোকানে সিঙ্গারা ভাজছে। নিয়ে যাবেন? না থাক, বালাটা যদি কোন কারণে খোয়া যায় এই করতে গিয়ে। আবার সাইকেলের প্যাডেলে পা দিলেন।

যখন রোলের দোকানের চাটুতে প্রথম তেল পড়ল, তুলসীতলায় শঙ্খের ধ্বনি শোনা গেল, খেলা শেষে ছেলের দল মাঠ থেকে উইকেট তুলল,  মফঃস্বলে সন্ধ্যা নামল,  মলয়বাবু বাড়ি ফিরলেন। সাইকেলটা রেখে কলতলায় পা ধুয়ে নিলেন। পারমিতা গামছাটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন

-- "ট্রেন ঠিক ছিল? তুমি যাও আমি মুড়ি নিয়ে আসছি।"

ঘরে বসে ব্যাগ থেকে আস্তে আস্তে বাক্সটা বার করে সবে বালাটা দেখবেন, এই সময় লোডশেডিং। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। মলয়বাবু আলতো করে হাত বোলালেন বালাটার উপরে। এই সময় লণ্ঠন ও বাটি ভর্তি মুড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন পারমিতা।

"দাঁড়াও চা বসাচ্ছি।"
"শোন না একবার, একটা জিনিস দেখাই।"
"ওহ, দাঁড়াও, তবে আমি আগে দেখাই।"

এক ছুটে বেরিয়ে গেলেন পারমিতা। একটু বাদেই ঘরে ঢুকলেন হাতে একটা ছোট বাক্স। বাক্স খুলতেই লণ্ঠনের আলোয় মলয়বাবু দেখতে পেলেন এক জোড়া ঘড়ির ব্যান্ড। বাদামী চামড়ার ব্যান্ড। উপরে কাটা-কাটা ডিজাইন করা। ধারে সেলাই। লণ্ঠনের  আলোতেও চকচক করছে। একটা অদ্ভুত নতুন রকমের গন্ধও পেলেন তিনি।

"দেখি তোমার ঘড়িটা দাও, আমি লাগিয়ে দি।"

এতক্ষণ বোধহয় অন্ধকারে বুঝতে পারেননি পারমিতা।

"একি, তোমার ঘড়ি কই?"

এবার বালার বাক্সটা এগিয়ে দিলেন মলয়বাবু। ততক্ষণ তিনি দেখে নিয়েছেন, পারমিতার দু হাত খালি। এই অন্ধকারের মধ্যে যে ক্ষুদ্র নাটিকাটি অভিনীত হল, তা যেন সেই আলতামিরার গুহামানবদের সময় থেকে যুগ যুগ ধরে হয়েই চলেছে। হয়ত একেই বলে ভালোবাসা। 

No comments:

Post a Comment