Sunday, July 1, 2018

ব্রেকপয়েন্ট

ঘুম ভাঙল। ঘেমে গেছি প্রায়। পরনে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর পাজামা। ছোট একটা খাটিয়াতে শুয়ে আছি। একটা সাদা রঙের চাদর। ফ্যানটা বন্ধ হয়ে আছে। বোধহয় লোডশেডিং। এ পাড়ায় প্রায়ই হয়। আমার আবার জানালা খোলার উপায় নেই। তাই গরমেই বসে রইলাম। এই বাড়ির দেওয়ালে তেমন রং নেই। একসময় বোধহয় হলুদ রং করা হয়েছিল। তবে এখন তা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আসলে এই ঘরটা ছাদের লাগোয়া। তাই গরমটাও মারাত্মক বেশি। আর এবার যেন বেছে বেছে এত গরম পড়েছে।

আমার ঘরের পাশেই একটা ছোট বাথরুম। একেবারে স্নান করে নিলাম। এই গরমে দিনে ২-৩ বার স্নান না করলে হয় না!! কত শুনেছিলাম কলকাতা শহরে হাওয়া নেই, কিন্তু এসব জেলা শহরে নাকি প্রচুর হাওয়া। সব বাজে কথা!! এক ভ্যাপসা গরম। ঘরে ফিরে হাতঘড়িটা দেখলাম। সকাল সাতটা। আহ, বাড়িতে থাকলে এই সময় মায়ের হাতে এক কাপ চা খেতে খেতে আনন্দবাজার পড়তাম। কতদিন কাগজ পড়িনা। এ বাড়িতে চায়ের রেওয়াজ নেই। সকালে একটু বাদে ছেলেটা এক বাটি মুড়ি দিয়ে যাবে। খাওয়া হয়ে গেলে নিয়ে যায়।

আমার ঘরের একটাই জানালা। এটা সবসময় বন্ধ থাকে। মনে আছে প্রথমদিন যেদিন রাজু এসে আমাকে এখানে রেখে গিয়েছিল, বলেছিল -- "মনে রাখিস, কোনমতেই যেন জানালা খুলবি না। সব জায়গায় পুলিশের চর আছে। তুই যে এই বাড়িতে লুকিয়ে এটা যেন কেউ জানতে না পারে।" 

জানালার নিচেই রাখা আমার সুটকেস। খুলে একটা পাঞ্জাবী বার করতে গিয়ে আমার পিস্তলটা চোখে পড়ল। কে বলবে এটা দিয়ে দুটো খুন হয়েছে। মনে পড়ে ছোটবেলায় গোয়েন্দা গল্প পড়ার সময় ভাবতাম আমি যদি কোনদিন এরকম পিস্তল হাতে নিয়ে ঘুরতাম, কি মজাই না হত! কিন্তু আজ আমি গোয়েন্দা না, বরং যাদের গোয়েন্দারা খোঁজে তাদের একজন। বিশ্বাস করুন, আমার আর ভালো লাগে না। কিন্তু কি করি বলুন, এখান থেকে বেরোনো সম্ভব না। দল ভাঙলেই মৃত্যু।

এসবের শুরু ঐ ক্লাস ইলেভেনে । বাবার কাছে নতুন সাইকেল চেয়ে পাইনি। স্কুলের সিনিয়ার শান্তুদা আমাকে ধরল।

"কিরে ভাই, মুখ গোমড়া কেন?"
"আর এই বাবা একটু পয়সা দেয় না। একটা নতুন সাইকেল কিনব বললাম।"
"তো? তোকে নতুন সাইকেল আমি কিনে দেব।"
"তুমি কোথা থেকে দেবে?"
"আরে আমি না, আমাদের রঞ্জনবাবু দেবেন। রঞ্জনবাবুকে চিনিস তো?"
"কেন চিনব না। আমাদের কাউন্সিলার।"
"হ্যাঁ।"
"কিন্তু উনি আমাকে কেন সাইকেল দেবেন?"
"দেবেন, দেবেন। তোকে ওনার হয়ে কিছু কাজ করতে হবে। তেমন কিছু না। এই ধর সপ্তাহে দু - তিন দিন স্কুলের পর তোকে একটু কাজে যেতে হবে। পারবি না?"
"স্কুলের পর তো আমি খেলতে যাই।"
"খেলবি না। খেলাও চাস, সাইকেলও চাস। সব তো একসাথে হয় না।"

সেই থেকে শুরু। আজ মাঝে মাঝে মনে হয় কেন যে সেদিন মরতে শান্তুদার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম।

"আপনাকে নিচে ডাকছে।" -- চাকর রঘু এসে বলে গেল।

গিয়ে দেখি রাজু দাঁড়িয়ে।

"সর্বনাশ হয়েছে, পুলিশ জানতে পেরেছে। চল পালাই।"

দুজন মিলে ছুটতে লাগলাম পিছনের দরজা দিয়ে। পাশের বাড়ি থেকে আতপ চাল আর বিউলীর ডালের গন্ধ এল। আহা, কতদিন খাইনা। কিন্তু এখন দাঁড়ানোর সময় নেই। বেঁচে থাকলে আবার বিউলীর ডাল খাব।

কয়েকটা বাড়ি পেড়িয়ে আমরা স্টেশনের কাছে চলে এলাম। এবার পিছনে পায়ের আওয়াজ।

"দাঁড়াও, নইলে গুলি চালাব।"

গুলিটা যখন আমার বুকে লাগল, তখন রাজুর হাত আর আমার হাতে নেই। স্টেশনে পড়ার সময় একটা পুরনো সাইকেল দেখলাম। আমার একটা এরকম হিরো জেট ছিল।


**************************

ঘুম ভাঙল। ঘেমে গেছি প্রায়। পরনে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর পাজামা। আমার ঘরে শুয়ে আছি। নিজের বিছানায়। মশারিটা নামিয়ে নিচে নামলাম। আমাদের বাড়ির দেওয়াল হাল্কা গোলাপি রঙের। মেঝেটা লাল রঙের। কোনগুলো আবার সেমি-সার্কেল করা। কালো রঙের। আমার ঘরে ধারে আমার জামাকাপড়ের আলমারি। বাথরুমে যেতে গিয়ে দেখি দরজা বন্ধ। একটু বাদেই মা বেরোল। মায়ের ভেজা পায়ের ছাপ মেঝের লাল রঙে ফুটে উঠল।

"যা, তাড়াতাড়ি চা খেতে আয়। বাবা অপেক্ষা করছে।"

থিন এরোরুট বিস্কুট আর চা খেতে খেতে বাবা প্রশ্ন করল

"তুমি নতুন সাইকেল চাইছিলে কেন? তোমার পুরনো সাইকেল কি খারাপ হয়ে গেছে?"
"না তা নয়, তবে এটা এতো পুরনো।"
"হোক। সোজা কথা শুনে রাখো। আমি নতুন সাইকেল কিনে দিতে পারব না।"

স্কুলে টিফিনের সময় বসে ছিলাম। শান্তুদা এল।

"কিরে মুখ গোমড়া কেন?"
"ঐ গত সপ্তাহে রসায়ন ল্যাবে টেস্ট টিউব ভাঙ্গায় স্যার খুব মেরেছেন। আজ আবার ল্যাব।"
"দুর এটা মন খারাপের কারণ হল। শোন না, তোর তো খুব নতুন সাইকেলের শখ। কাল দেখছিলাম আমিয়কে বলছিলি। একটা নতুন সাইকেল নিবি?"
"না শান্তুদা, বাবা বলেছে পরের মাসের মাইনে পেলে দেবে।"
"ওহ। আরে বাবার কি দরকার? নিজে রোজগার করবি?"
"না শান্তুদা, ঠিক আছে। বাবাই দিক।"
"ধুর শালা, তোদের মত ছেলেরা কোনদিন উপরে উঠতে পারে না। দেখে নিস। তোর কোন এম্বিশান-ই নেই।"

হাসলাম শুধু। শান্তুদা চলে গেল।

সেদিন বাড়ি ফিরে দেখি মা বিউলীর ডাল রেঁধেছে।


No comments:

Post a Comment