আজ ঠাণ্ডাটা একটু কম। তাই বারান্দায় এসে বসলাম। নইলে রোজ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। ডাক্তার বারণ করেছে। কবিতা বিকেলে এসে আমাকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখলে বকা দেয় --
"দাদাবাবু, আপনাকে কতদিন বারণ করেছি এভাবে একা বসে থাকতে?"
হাসি পায়। মনে হয় যেন কবিতা আমার গুরুজন। হাসি। বলি --
"কি আর হবে, খুব বেশী হলে কয়েকদিন কম বাঁচব তাই তো?"
"তুমি এসব কথা বলবে না দাদাবাবু, দুপুরে ওষুধ খেয়েছিলে?"
সম্মতি জানাই। কবিতাও জানে আমি আর বেশিদিন নেই। শুধু কবিতা কেন, পাড়ার সকলেই জানে। ডাক্তারবাবু বলতে চাননি, কিন্তু একদিন বলে ফেলেছিলেন। আর খুব বেশী হলে মাস দুয়েক। আমার বাড়ির সামনে একটা শিমুলগাছ আছে। আর কয়েকদিন বাদেই ফুল হবে। খুব সুন্দর লাগে যখন শিমুলফুল ফোটে। আমাদের বাড়ির চারিদিকটা যেন রাঙিয়ে যায়। কেন যে আমাদের বললাম কে জানে? তনিমাও নেই, আমিও আর কিছুদিন বাদে থাকব না। এই বাড়িটার কি হবে কে জানে!! হয়ত সরকার নিয়ে নেবে। আমার কোন উইল করা নেই। ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে শোনার পর ইচ্ছে হয়েছিল করি। কিন্তু তারপর মনে হল কেন করব? কে দেখবে? ধুর। এবার যখন শিমুলফুল ফুটবে, আমি থাকব না।
পাড়ার লোকে আমাকে আমার অসুখের জন্য দয়া করেনা। অসুখের কথা খুব বেশীদিন জানেনি সকলে। এরা আমাকে দয়া করে তনিমার জন্য। তনিমা আর নেই আমার সঙ্গে। কোথায় আছে, কেন নেই এরা কেউ জানে না। আমার এই অসুখের মধ্যেও আমাকে ফেলে চলে গেছে এটা শুনে পাড়ার লোকে নিন্দা করে। শুনি। এক দু'বার বলতে গেছি -- "থাক না, আর বলে কি হবে?" পরে দেখেছি এরা বলতে ভালোবাসে। আমার প্রতি সহমর্মী হয়ে নয়, যেন নিজেদের ভালোবাসা থেকেই বলে। তাই আমি আর আজকাল প্রতিবাদ করিনা। সকলের জীবন আমার মত শান্ত নয়। কারুর চাকরিতে অশান্তি। কারুর ছেলে বখে যাচ্ছে। কারুর বাড়িতে জলের সমস্যা। এসবের থেকে শান্তি পেতে যদি কাউকে গালাগাল করতে হয়, করুক না। যতই সে আমার ভালোবাসার পাত্রী হোক।
এই শীতের বিকেলে বারান্দায় বসে থাকতে বেশ লাগে। স্কুলে পড়া ছেলে মেয়েরা সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফেরে। কেউ কেউ হয়ত এখন টিউশানে বেরোবে। কি অদ্ভুত না, আমি যখন ছোট ছিলাম, কেউ টিউশানে পড়লে সেটাকে খারাপ ভাবে দেখা হত। আর এখন টিউশানে না পড়লে নাকি চলবেই না। আচ্ছা আমি টিউশানে পড়লে খরচা কে দিত? বাবার তো আমার স্কুলের টাকা দিতেই কষ্ট হত। জলপানি পেয়ে শেষের চার বছর চালিয়েছি। তারপর যখন কলেজে ভর্তি হলাম, তখন নেহাত কিছু টিউশানি শুরু করেছিলাম। যাদের পড়াতাম, কেউ পদের না। তাই সবসময় মনে হত টিউশানি যারা পড়ে, তারা নেহাতই নির্বোধ। তবে টিউশানিতে খুব সুবিধা হত। শুধু কলেজের মাইনে আর হাতখরচা না, রোজ বিকেলে ভালমন্দ জলখাবার পেতাম। তবে তখনও শীতে পড়িয়ে ফিরতে খুব কষ্ট হত। আমাদের এই জেলা শহরে ভালোই ঠাণ্ডা পড়ে। মাথা দিয়ে মাফলার জড়িয়ে সাইকেলে তড়িঘড়ি করে বাড়ি ফিরতাম। বাড়ি ফিরেই গরম গরম চা। তখন জীবনে কত উৎসাহ, কত স্বপ্ন। তখন কি জানতাম জীবন মানে রোজ বিকেলে জানালা দিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ভাবা -- কালকে এ দৃশ্য দেখা হবে তো?
এই বাড়ির একতলার ঘরগুলি বন্ধ আজ বহু বছর। মাঝে মাঝে কাউকে দিয়ে পরিষ্কার করাই। আবার বন্ধই থাকে। সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নেমে কষ্ট করে শিমুলগাছের তলায় গেলাম। পরে কবিতা জানতে পেরে ভীষণ রাগ করেছিল। একা একা গাছটাকে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ডাকলাম
"কোথায় তুমি? এসো।"
কেউ এলোনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ি ফিরলাম। প্রায় ন্যাড়া এই শিমুলগাছটার দিকে বার বার চেয়ে থাকি। প্রতিদিন ভাবি সে এসবে। সে এসবে আমাকে নিয়ে যেতে। তাহলে আমার এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হবে। হয়ত শিমুলগাছে ফুল দেখা হবেনা এবার। দরকার নেই। সে এলেই আমার মুক্তি। কিন্তু সে আসেনা।
কেন তনিমা? কেন আসোনা? আমাকে কবে মুক্তি দেবে? আমি যে নিজের হাতে তোমাকে ঐ শিমুলগাছের নিচে পুঁতে দিয়েছিলাম। তুমি কেন আসছ না। আমাকে নিয়ে যাবে না তোমার কাছে?
No comments:
Post a Comment