Saturday, November 2, 2019

হোটেল ক্যালকাটা ইন্টার্নেশানাল

(ও'হেনরির একটা গল্প নিজের মত করে লিখলাম।)

হ্যাঁ এই নাম নতুন হোটেলটির। বছর চারেক আগে মুখ্যমন্ত্রী শ্রী জ্যোতি বসু ফিতে কেটে শুভ উদ্বোধন করেন। চৌরঙ্গীর মোড়ে এই হোটেলটি এখন সারা কলকাতার গর্ব। বিখ্যাত ব্যক্তিদের আনাগোনা লেগেই আছে এখানে। এই তো ক'দিন আগে শহরে অনুষ্ঠান করতে এসে এই হোটেলে উঠেছিলেন শাহরুখ খান।

জানুয়ারির শেষ। ঠাণ্ডার রেশ এখনো রয়েছে শহরে। রবিবারের ছুটিতে এখনো সপরিবারে কমলালেবু খেতে খেতে কলকাতা চিড়িয়াখানা যায়। রাস্তা ঘাটে অগুনতি মাঙ্কি ক্যাপ দেখা যায়। এমন এক দিনে হোটেলে চেক ইন করলেন মিস অদিতি সেন।

অদিতি দেবী হোটেলের পাঁচ তলার ঘরে জায়গা পেলেন। সঙ্গে একটা সুটকেস আর একটা ভ্যানিটি ব্যাগ। সুটকেসটি ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য "বয়"কে দশ টাকা টিপস দিলেন।
"আপনাদের এখানে কালার টিভি আছে?"
"হ্যাঁ ম্যাডাম, প্রত্যেক ঘরেই আছে। এই যে আপনার ঘরে, এখানে রিমোট।"
"অনেক চ্যানেল আসে?"
"হ্যাঁ ম্যাডাম, জি টি ভি আসে, স্টার কানেকশান আছে। আপনার কি চাই বলুন?"
"না মানে আমার মানে ..."
"আপনার কোন চ্যানেল লাগবে বলুন?"
"আমার জি টি ভি লাগবে। আমি তো দিল্লীতে থাকি। আমার জি টি ভি না দেখলে হয়না।"
"নিশ্চয় ম্যাডাম, জি টি ভি ১২ নম্বর চ্যানেল। এই যে।"
"থ্যাঙ্ক ইউ ভাই।"
"ওয়েলকাম ম্যাডাম। কোন দরকার লাগলে নিচের রিসেপশনে ফোন করে দেবেন। কেমন?"
"অবশ্যই।"
"আশা করি আমাদের সঙ্গে থাকতে আপনার ভালো লাগবে।"


সেদিন সন্ধ্যায় হোটেলের ডাইনিং রুমে বসে ডিনার সারলেন মিস সেন। ইন্ডিয়ান খাবারের জায়গায় ভাত আর চিকেন কারি। খেতে খেতে লক্ষ্য করলেন কিছু দূরে বসা এক ব্যাক্তি তাঁকে লক্ষ্য করছিলেন। মিস সেন এমনই সুশ্রী। তবে আজকে এই নীল চুড়িদার পরে মিস সেনকে যেন কোন সিনেমার নায়িকা মনে হচ্ছিল। তাঁকে যে লোকে লক্ষ্য করবে এটাই স্বাভাবিক।

সমস্যাটা হল পরেরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের সময়। হোটেলে বুফে ব্রেকফাস্ট। মিস সেন সেখানেই খাচ্ছিলেন। একা একটা টেবিলে বসে ছিলেন তিনি। পরনে গতকাল রাত্রের চুড়িদারটি। এবার ঐ কাল রাত্রের অচেনা ভদ্রলোকটি এলেন তাঁর টেবিলে।
"আমি কি আপনার সঙ্গে বসতে পারি?"

একবার দেখে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ালেন মিস সেন।

"নমস্কার, আমার নাম শমিত চন্দ্র। আমি বম্বেতে থাকি। আপনি?"

এরকম অচেনা ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে ছিলনা মিস সেনের। তবু মুখের উপর কারুর সঙ্গে অভদ্রতা করতে পারেননা তিনি। হাল্কা হেসে নিজের পরিচয় দিলেন।

"আপনাকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করব। প্লিজ খারাপ ভাবে নেবেন না। আপনার এই জামাটা কি গাড়িয়াহাটের অপ্সরা থেকে কেনা?"

ভীষণ চমকালেন মিস সেন। কিন্তু ঘাবড়ালেন না।

"হ্যাঁ। গত বছর কোলকাতায় এসে এটা বানিয়েছিলাম। কেন বলুন তো?"
"আসলে আপনাকে খুলেই বলি। আমার বম্বেতে একটা গারমেনটের ব্যবসা আছে। নিউ বম্বে টেক্সটাইলস নাম। এই সেম ডিজাইনের চুড়িদার আমরা প্রথম বম্বেতে ছাড়ি। তারপর অনেকের কাছেই শুনি অপ্সরা আমাদের ডিজাইন চুরি করেছে। তাই আপনাকে ঐ প্রশ্ন করি।"

এবার মিস্টার চন্দ্রর দিকে ভালো করে তাকালেন মিস সেন। তামাটে গায়ের রং, হাল্কা গোঁফ, পরনে বাদামী স্যুট।

"ওহ তাই বলুন। আমিও আপনার প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম।"
"সেকি? আমি তো দেখলাম আপনি পাঊরুটি খাচ্ছেন।"
 মিস সেন সেই প্রথমবার হোটেলে হাসলেন। পর পর তিন দিন হাসি চলতে থাকল মাঝে মাঝেই। হোটেলের বাইরে চৌরঙ্গীর ব্যস্ত ফুটপাথের উপর দিয়ে মাঙ্কি ক্যাপ পরিহিত জনতার মধ্যে কখন যে এক বাচ্চা ছেলে পিঠে ডানা লাগিয়ে এসে হাসির মধ্যে এক তীর ছুড়ে দিল, কেউ দেখতেও পারল না। বুঝতে পারল যদিও।

"কাল আমি ফিরে যাচ্ছি।"
"তোমার দিল্লীর ফোন নাম্বারটা দিয়ে যেও। আমি গিয়ে যোগাযোগ করব।"
"ইয়ে শমিত, তোমাকে একটা কথা বলার আছে। কথা দাও আমাকে ভুল ভাববে না।"
"না। বল।"
"দেখ আমার নাম অদিতি সেন না। আমি রত্না তলাপাত্র। আমি পিকনিক গার্ডেনে থাকি। দিল্লী না। আমি খুবই সাধারণ মেয়ে। দাদা বৌদির বাড়িতে থাকি। ভবানী ভবনে সামান্য চাকরি করি। এই হোটেলটা দেখে বহুদিন ভাবতাম কয়েকদিনের জন্য এসে থাকব। প্রতি মাসে পয়সা বাঁচিয়েছি যাতে এখানে তিন দিন থাকতে পারি। এই তিন দিন আমি রানির মত ছিলাম। আমাকে সকালে উঠে নিজের চা বানাতে হয়নি। ভিড় বাসে ধাক্কা খেতে খেতে যেতে হয়নি। কেউ জানতেও পারেনি আমি পিকনিক গার্ডেনের ছোট বাড়িতে বাইরের ঘরে একা শুই। শুধু এখানে থাকব বলে অপ্সরা থেকে এই জামাগুলি বানাই। এগুলো আমার বাড়ির লোক জানেও না। ক্ষমা কর। তোমাকে অনেক মিথ্যে বলেছি।"

মিস্টার চন্দ্রের মুখে আবার হাল্কা হাসি দেখা দিল। হাত বাড়িয়ে মিস সেনের হাত ধরলেন।

"আমি জানি। তোমার অপ্সরার জামাটা আমি তৈরি করেছি। তুমি যেদিন অপ্সরা এলে, আমি তোমায় দেখেছিলাম। আমি অপ্সরাতে টেলার। আমার নাম রতন ঘোষ। তোমার মত আমারও শখ ছিল এখানে কিছুদিন থাকব। রোজ ঐ বারুইপুর থেকে যাতায়াত করতে হয়। তার থেকে মুক্তি। আমিও কালকেই চলে যাব আমার নিজের জীবনে। তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো?"

মিস সেন আবার হাসলেন। যদিও সেই সময় ফুটপাথে কেউ ধনুক নিয়ে ছিল কিনা লেখক জানে না।

"পরের রবিবার ময়দানে দেখা করবে?"
"ঠিক আছে, আমি ওখানে খুব ভালো একটা চা-ওলা কে চিনি। এই ঠাণ্ডায় জমিয়ে লেবু চা খাব।"
"আমি বাপুজি কেক নিয়ে আসব।"



No comments:

Post a Comment