সকালবেলা হাওড়া যাওয়ার লোকাল ট্রেন যখন আওয়াজ করে রওয়ানা দেয়, কুসুম বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে শব্দ শোনে। তারপর ঘরে এসে পেপারে চোখ বোলাতে বোলাতে রত্না এসে যায়। রত্না তাদের বাড়ি কাজ করে। সকালটা রত্নার সঙ্গেই কেটে যায় কুসুমের। রত্নার বাসন মেজে, ঘর ঝাড় মোছ করে, কাপড় কেচে, ফার্নিচার মুছে যেতে যেতে প্রায় বেলা এগারোটা-বারোটা। কুসুম তার আগেই রান্না বসিয়ে দেয়। রত্না আবার বিকেলে আসে। তার মাঝে তার গল্প চলতে থাকেই। আড়ালে রত্নাকে শেওড়াফুলি গেজেট বলে ডাকে পার্থ। রত্না গেলে স্নান খাওয়া করে পেপার নিয়ে বসে। কোন কোনদিন বাড়িতে মাকে চিঠি লেখে কুসুম। দুপুরে ঘুমোয় না। দুপুরে ঘুমোলে সকালে উঠতে দেরী হয়। পার্থর অফিস যাওয়ার আগে সকালের জলখাবার করে দেওয়া হয়না। লাঞ্চটা পার্থ অফিসেই খায়। বহুদিনের অভ্যাস। কুসুম যে সকালে উঠে রান্না করতে পারেনা তা নয়, কিন্তু পার্থর ঐ শক্তিদা, রঘুদাদের সঙ্গে অফিস ক্যান্টিনে বসে না খেলে নাকি হয়না।
সদ্য দু'মাস হল বিয়ে হয়েছে কুসুমের। তার বাড়ি অন্ডাল। বিয়ের পর পার্থর সঙ্গে সংসার করতে এই শেওড়াফুলিতে এসেছে কুসুম। স্টেশনের কাছে সরকারপাড়ায় বাড়ি। বাড়িটি তৈরি করেছিলেন পার্থর বাবা। ছোট একতলা বাড়ি। তিনটি ঘর। এ ছাড়া আছে একটি রান্নাঘর ও দুটি বাথরুম। হাল্কা গোলাপি রঙের বাড়ি। সামনে ছোট পাঁচিল (যার উপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পোস্টার পড়েছে)। হলুদ রঙের গেট। গেট থেকে একটা ছোট ইঁটের রাস্তা ঢুকে গেছে বাড়ির দিকে। রাস্তার দু'ধারে ফুলের বাগান ছিল একসময়। কুসুম সেগুলি ঠিক করবে ভেবেও করে ওঠা হয়নি। আসলে সত্যি কথা বলতে, কুসুমের সেরকম ফুলের শখ নেই। বাড়িতে ঢুকলেই এক ফালি বারান্দা। সেখানেই পার্থর সাইকেল থাকে। রোজ সকালে সাইকেল করে স্টেশন যায় পার্থ। স্টেশনে শঙ্করের দোকানে সাইকেল জমা রাখে। বারান্দায় দুটি বেতের মোড়া আছে। রোজ বিকেলবেলা বাড়ি ফিরে পার্থ মুড়ি খায়। মুড়ির সঙ্গে কোনদিন তেলেভাজা, কোনদিন ঘুগনি বানায় কুসুম। মুড়ি খেয়ে একটু বাইরে এসে ঐ মোড়ায় বসে পার্থ আর কুসুম। ততক্ষণে গোধূলি লগ্ন। আকাশে একটা হাল্কা আলোর রেখা কুসুমের মনে এক প্রসন্ন ভাব এনে দেয়। সামনেই একটা পুকুর আছে। ভালো হাওয়া দেয়। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেরা ক্রিকেট খেলে বাড়ি ফেরে। পার্থ মাঝে মাঝে গুন গুন করে গান ধরে। নিজের বাড়িতে পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে মানুষ কুসুম যেন এই সময়টুকুর জন্য সারাদিন অপেক্ষা করে। এই সময়টুকু যেন তার জীবন থেকে কোনদিন না চলে যায়।
পাঠক নিশ্চয় খেয়াল করেছেন কুসুমের দিনের একটা সময়ের কথা আমি এখনও বলিনি। হ্যাঁ দুপুরে পেপার পড়া আর বিকেলবেলা পার্থ ফেরার আগে পর্যন্ত। এই সময়টুকুর মধ্যে হাজির হন পাড়ার দুই "দিদি"। বয়সে তাঁরা কুসুমের মায়ের চেয়ে কিছু ছোট হলেও তাঁদেরকে দিদি বলেই ডাকতে বলেছেন। এনারা নাকি কুসুমের শাশুড়ির খুব কাছের মানুষ ছিলেন। আজ ওনার অভাব পূর্ণ করতেই বোধহয় এনারা রোজ কুসুমের খোঁজ নিতে আসেন। অবশ্য রোজ খোঁজ নেয়ার কিছু থাকেনা, মানে থাকা সম্ভব হয়না। যেটা চলে সেটা হল রত্নার শেওরাফুলি গেজেটের সরকারপাড়া ভার্সান।
"জানো তো, কবিতার সঙ্গে ওর ছেলের বউয়ের আবার ঝগড়া হয়েছে কাল।"
"রমার মেয়েটাকে দেখেছো, কি কালো। কে ওকে বিয়ে করবে বাবা?"
"ঘোষবাবুর ছেলে এবারো মাধ্যমিকে ফেল করেছে।"
তবে যেটা ভালো দিক হচ্ছে এনারা রোজ যাওয়ার সময় কুসুম কত ভালো, পাড়ার অন্য বউদের কুসুমের মত হওয়া উচিত, তাই বলে যান। প্রথম প্রথম এনারা পার্থ আসার আগেই চলে যেতেন। কখনো কখনো পার্থর সাইকেলের আওয়াজ শুনেই বেরিয়ে পরতেন। আজকাল সেটাও করেন না। এরকম অনেকদিন হয়েছে পার্থ এসে একা ঘরে বসে মুড়ি খেয়েছে। এনারা যেতে যেতে গোধূলি পেড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে। আর বারান্দায় গিয়ে বসা হয়নি। কুসুম মুখে কিছুই বলতে পারেনি। পার্থকেও বলেনি। সত্যি করে বলতে কি এই দুমাসে মানুষটিকে সেভাবে চিনে উঠতে পারেনি কুসুম। তাই এই কথাটা বললে পার্থর কেমন লাগবে বোঝেনি।
আজও দিদিরা এসে হাজির হয়ে গল্প শুরু করলেন। সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ব্যানার্জিবাবুর মেয়ে কেন নিচু জাতে বিয়ে করল তাই নিয়ে আলোচনা শুরু হচ্ছিল, এই সময় বাইরে সাইকেলের শব্দ শুনে অবাক হয়ে বারান্দায় এল কুসুম। গেট দিয়ে সাইকেল ঢোকাচ্ছে পার্থ। চমকে গেল কুসুম। পার্থ যেন বুঝতে পেরেই বলল -- "আজ তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। তাই আগের ট্রেনেই চলে এলাম। শোন না, উদয়নে নবাব এসেছে। যাবে? তুমি তো সেদিন বলছিলে রঞ্জিত মল্লিককে তোমার ভালো লাগে। চলো না।"
ভিতরে যে দিদিরা বসে আছেন, সেটা কি খেয়াল করেনি পার্থ? লজ্জায় লাল হয়ে গেল কুসুম। দিদিরা শুনতে পেলেন পার্থর গলা। তাড়া আছে, পরে আসবেন ইত্যাদি বলে তখনি সেখান থেকে বিদায় নিলেন। "সত্যি যাবে?"
কুসুমের বিস্ময় কাটেই না। পার্থ স্রেফ মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।
সেই সময়, যখন পাড়ার ছেলেরা ব্যাট নিয়ে মাঠে যাচ্ছিল, যখন কলেজ ফেরতা মেয়েটি গাছের তলায় প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল, যখন ধর্মতলার অফিসে বসে কেউ কাজ শেষ করে হাওড়া স্টেশনে আসার পরিকল্পনা করছিল, যখন তার সাধের গোধূলি আসতে ঢের দেরী, তখন ঐ সাইকেল স্ট্যান্ড করানোর শব্দে, দেওয়ালের লাল সবুজ রাজনৈতিক দলের স্লোগানে, রাস্তায় একা ডাকতে থাকা আইসক্রিমওয়ালার ডাকের মধ্যে দিয়ে কুসুম বুঝতে পারল সে না চিনলেও পার্থ তাকে ঠিক চিনেছে।
সদ্য দু'মাস হল বিয়ে হয়েছে কুসুমের। তার বাড়ি অন্ডাল। বিয়ের পর পার্থর সঙ্গে সংসার করতে এই শেওড়াফুলিতে এসেছে কুসুম। স্টেশনের কাছে সরকারপাড়ায় বাড়ি। বাড়িটি তৈরি করেছিলেন পার্থর বাবা। ছোট একতলা বাড়ি। তিনটি ঘর। এ ছাড়া আছে একটি রান্নাঘর ও দুটি বাথরুম। হাল্কা গোলাপি রঙের বাড়ি। সামনে ছোট পাঁচিল (যার উপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পোস্টার পড়েছে)। হলুদ রঙের গেট। গেট থেকে একটা ছোট ইঁটের রাস্তা ঢুকে গেছে বাড়ির দিকে। রাস্তার দু'ধারে ফুলের বাগান ছিল একসময়। কুসুম সেগুলি ঠিক করবে ভেবেও করে ওঠা হয়নি। আসলে সত্যি কথা বলতে, কুসুমের সেরকম ফুলের শখ নেই। বাড়িতে ঢুকলেই এক ফালি বারান্দা। সেখানেই পার্থর সাইকেল থাকে। রোজ সকালে সাইকেল করে স্টেশন যায় পার্থ। স্টেশনে শঙ্করের দোকানে সাইকেল জমা রাখে। বারান্দায় দুটি বেতের মোড়া আছে। রোজ বিকেলবেলা বাড়ি ফিরে পার্থ মুড়ি খায়। মুড়ির সঙ্গে কোনদিন তেলেভাজা, কোনদিন ঘুগনি বানায় কুসুম। মুড়ি খেয়ে একটু বাইরে এসে ঐ মোড়ায় বসে পার্থ আর কুসুম। ততক্ষণে গোধূলি লগ্ন। আকাশে একটা হাল্কা আলোর রেখা কুসুমের মনে এক প্রসন্ন ভাব এনে দেয়। সামনেই একটা পুকুর আছে। ভালো হাওয়া দেয়। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেরা ক্রিকেট খেলে বাড়ি ফেরে। পার্থ মাঝে মাঝে গুন গুন করে গান ধরে। নিজের বাড়িতে পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে মানুষ কুসুম যেন এই সময়টুকুর জন্য সারাদিন অপেক্ষা করে। এই সময়টুকু যেন তার জীবন থেকে কোনদিন না চলে যায়।
পাঠক নিশ্চয় খেয়াল করেছেন কুসুমের দিনের একটা সময়ের কথা আমি এখনও বলিনি। হ্যাঁ দুপুরে পেপার পড়া আর বিকেলবেলা পার্থ ফেরার আগে পর্যন্ত। এই সময়টুকুর মধ্যে হাজির হন পাড়ার দুই "দিদি"। বয়সে তাঁরা কুসুমের মায়ের চেয়ে কিছু ছোট হলেও তাঁদেরকে দিদি বলেই ডাকতে বলেছেন। এনারা নাকি কুসুমের শাশুড়ির খুব কাছের মানুষ ছিলেন। আজ ওনার অভাব পূর্ণ করতেই বোধহয় এনারা রোজ কুসুমের খোঁজ নিতে আসেন। অবশ্য রোজ খোঁজ নেয়ার কিছু থাকেনা, মানে থাকা সম্ভব হয়না। যেটা চলে সেটা হল রত্নার শেওরাফুলি গেজেটের সরকারপাড়া ভার্সান।
"জানো তো, কবিতার সঙ্গে ওর ছেলের বউয়ের আবার ঝগড়া হয়েছে কাল।"
"রমার মেয়েটাকে দেখেছো, কি কালো। কে ওকে বিয়ে করবে বাবা?"
"ঘোষবাবুর ছেলে এবারো মাধ্যমিকে ফেল করেছে।"
তবে যেটা ভালো দিক হচ্ছে এনারা রোজ যাওয়ার সময় কুসুম কত ভালো, পাড়ার অন্য বউদের কুসুমের মত হওয়া উচিত, তাই বলে যান। প্রথম প্রথম এনারা পার্থ আসার আগেই চলে যেতেন। কখনো কখনো পার্থর সাইকেলের আওয়াজ শুনেই বেরিয়ে পরতেন। আজকাল সেটাও করেন না। এরকম অনেকদিন হয়েছে পার্থ এসে একা ঘরে বসে মুড়ি খেয়েছে। এনারা যেতে যেতে গোধূলি পেড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে। আর বারান্দায় গিয়ে বসা হয়নি। কুসুম মুখে কিছুই বলতে পারেনি। পার্থকেও বলেনি। সত্যি করে বলতে কি এই দুমাসে মানুষটিকে সেভাবে চিনে উঠতে পারেনি কুসুম। তাই এই কথাটা বললে পার্থর কেমন লাগবে বোঝেনি।
আজও দিদিরা এসে হাজির হয়ে গল্প শুরু করলেন। সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ব্যানার্জিবাবুর মেয়ে কেন নিচু জাতে বিয়ে করল তাই নিয়ে আলোচনা শুরু হচ্ছিল, এই সময় বাইরে সাইকেলের শব্দ শুনে অবাক হয়ে বারান্দায় এল কুসুম। গেট দিয়ে সাইকেল ঢোকাচ্ছে পার্থ। চমকে গেল কুসুম। পার্থ যেন বুঝতে পেরেই বলল -- "আজ তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। তাই আগের ট্রেনেই চলে এলাম। শোন না, উদয়নে নবাব এসেছে। যাবে? তুমি তো সেদিন বলছিলে রঞ্জিত মল্লিককে তোমার ভালো লাগে। চলো না।"
ভিতরে যে দিদিরা বসে আছেন, সেটা কি খেয়াল করেনি পার্থ? লজ্জায় লাল হয়ে গেল কুসুম। দিদিরা শুনতে পেলেন পার্থর গলা। তাড়া আছে, পরে আসবেন ইত্যাদি বলে তখনি সেখান থেকে বিদায় নিলেন। "সত্যি যাবে?"
কুসুমের বিস্ময় কাটেই না। পার্থ স্রেফ মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।
সেই সময়, যখন পাড়ার ছেলেরা ব্যাট নিয়ে মাঠে যাচ্ছিল, যখন কলেজ ফেরতা মেয়েটি গাছের তলায় প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল, যখন ধর্মতলার অফিসে বসে কেউ কাজ শেষ করে হাওড়া স্টেশনে আসার পরিকল্পনা করছিল, যখন তার সাধের গোধূলি আসতে ঢের দেরী, তখন ঐ সাইকেল স্ট্যান্ড করানোর শব্দে, দেওয়ালের লাল সবুজ রাজনৈতিক দলের স্লোগানে, রাস্তায় একা ডাকতে থাকা আইসক্রিমওয়ালার ডাকের মধ্যে দিয়ে কুসুম বুঝতে পারল সে না চিনলেও পার্থ তাকে ঠিক চিনেছে।