Wednesday, July 29, 2020

মফঃস্বলের প্রেমঃ ২

সকালবেলা হাওড়া যাওয়ার লোকাল ট্রেন যখন আওয়াজ করে রওয়ানা দেয়, কুসুম বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে শব্দ শোনে। তারপর ঘরে এসে পেপারে চোখ বোলাতে বোলাতে রত্না এসে যায়। রত্না তাদের বাড়ি কাজ করে। সকালটা রত্নার সঙ্গেই কেটে যায় কুসুমের। রত্নার বাসন মেজে, ঘর ঝাড় মোছ করে, কাপড় কেচে, ফার্নিচার মুছে যেতে যেতে প্রায় বেলা এগারোটা-বারোটা। কুসুম তার আগেই রান্না বসিয়ে দেয়।  রত্না আবার বিকেলে আসে। তার মাঝে তার গল্প চলতে থাকেই। আড়ালে রত্নাকে শেওড়াফুলি গেজেট বলে ডাকে পার্থ। রত্না গেলে স্নান খাওয়া করে পেপার নিয়ে বসে। কোন কোনদিন বাড়িতে মাকে চিঠি লেখে কুসুম। দুপুরে ঘুমোয় না। দুপুরে ঘুমোলে সকালে উঠতে দেরী হয়। পার্থর অফিস যাওয়ার আগে সকালের জলখাবার করে দেওয়া হয়না। লাঞ্চটা পার্থ অফিসেই খায়। বহুদিনের অভ্যাস। কুসুম যে সকালে উঠে রান্না করতে পারেনা তা নয়, কিন্তু পার্থর ঐ শক্তিদা, রঘুদাদের সঙ্গে অফিস ক্যান্টিনে বসে না খেলে নাকি হয়না।

সদ্য দু'মাস হল বিয়ে হয়েছে কুসুমের। তার বাড়ি অন্ডাল। বিয়ের পর পার্থর সঙ্গে সংসার করতে এই শেওড়াফুলিতে এসেছে কুসুম। স্টেশনের কাছে সরকারপাড়ায় বাড়ি। বাড়িটি তৈরি করেছিলেন পার্থর বাবা। ছোট একতলা বাড়ি। তিনটি ঘর। এ ছাড়া আছে একটি রান্নাঘর ও দুটি বাথরুম। হাল্কা গোলাপি রঙের বাড়ি। সামনে ছোট পাঁচিল (যার উপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পোস্টার পড়েছে)। হলুদ রঙের গেট। গেট থেকে একটা ছোট ইঁটের রাস্তা ঢুকে গেছে বাড়ির দিকে। রাস্তার দু'ধারে ফুলের বাগান ছিল একসময়। কুসুম সেগুলি ঠিক করবে ভেবেও করে ওঠা হয়নি। আসলে সত্যি কথা বলতে, কুসুমের সেরকম ফুলের শখ নেই। বাড়িতে ঢুকলেই এক ফালি বারান্দা। সেখানেই পার্থর সাইকেল থাকে। রোজ সকালে সাইকেল করে স্টেশন যায় পার্থ। স্টেশনে শঙ্করের দোকানে সাইকেল জমা রাখে। বারান্দায় দুটি বেতের মোড়া আছে। রোজ বিকেলবেলা বাড়ি ফিরে পার্থ মুড়ি খায়। মুড়ির সঙ্গে কোনদিন তেলেভাজা, কোনদিন ঘুগনি বানায় কুসুম। মুড়ি খেয়ে একটু বাইরে এসে ঐ মোড়ায় বসে পার্থ আর কুসুম। ততক্ষণে গোধূলি লগ্ন। আকাশে একটা হাল্কা আলোর রেখা কুসুমের মনে এক প্রসন্ন ভাব এনে দেয়। সামনেই একটা পুকুর আছে। ভালো হাওয়া দেয়। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেরা ক্রিকেট খেলে বাড়ি ফেরে। পার্থ মাঝে মাঝে গুন গুন করে গান ধরে। নিজের বাড়িতে পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে মানুষ কুসুম যেন এই সময়টুকুর জন্য সারাদিন অপেক্ষা করে। এই সময়টুকু যেন তার জীবন থেকে কোনদিন না চলে যায়।

পাঠক নিশ্চয় খেয়াল করেছেন কুসুমের দিনের একটা সময়ের কথা আমি এখনও বলিনি। হ্যাঁ দুপুরে পেপার পড়া আর বিকেলবেলা পার্থ ফেরার আগে পর্যন্ত। এই সময়টুকুর মধ্যে হাজির হন পাড়ার দুই "দিদি"। বয়সে তাঁরা কুসুমের মায়ের চেয়ে কিছু ছোট হলেও তাঁদেরকে দিদি বলেই ডাকতে বলেছেন।  এনারা নাকি কুসুমের শাশুড়ির খুব কাছের মানুষ ছিলেন। আজ ওনার অভাব পূর্ণ করতেই বোধহয় এনারা রোজ কুসুমের খোঁজ নিতে আসেন। অবশ্য রোজ খোঁজ নেয়ার কিছু থাকেনা, মানে থাকা সম্ভব হয়না। যেটা চলে সেটা হল রত্নার শেওরাফুলি গেজেটের সরকারপাড়া ভার্সান।
"জানো তো, কবিতার সঙ্গে ওর ছেলের বউয়ের আবার ঝগড়া হয়েছে কাল।"
"রমার মেয়েটাকে দেখেছো, কি কালো। কে ওকে বিয়ে করবে বাবা?"
"ঘোষবাবুর ছেলে এবারো মাধ্যমিকে ফেল করেছে।"

তবে যেটা ভালো দিক হচ্ছে এনারা রোজ যাওয়ার সময় কুসুম কত ভালো, পাড়ার অন্য বউদের কুসুমের মত হওয়া উচিত, তাই বলে যান। প্রথম প্রথম এনারা পার্থ আসার আগেই চলে যেতেন। কখনো কখনো পার্থর সাইকেলের আওয়াজ শুনেই বেরিয়ে পরতেন। আজকাল সেটাও করেন না। এরকম অনেকদিন হয়েছে পার্থ এসে একা ঘরে বসে মুড়ি খেয়েছে। এনারা যেতে যেতে গোধূলি পেড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে। আর বারান্দায় গিয়ে বসা হয়নি। কুসুম মুখে কিছুই বলতে পারেনি। পার্থকেও বলেনি। সত্যি করে বলতে কি এই দুমাসে মানুষটিকে সেভাবে চিনে উঠতে পারেনি কুসুম। তাই এই কথাটা বললে পার্থর কেমন লাগবে বোঝেনি।

আজও দিদিরা এসে হাজির হয়ে গল্প শুরু করলেন। সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ব্যানার্জিবাবুর মেয়ে কেন নিচু জাতে বিয়ে করল তাই নিয়ে আলোচনা শুরু হচ্ছিল, এই সময় বাইরে সাইকেলের শব্দ শুনে অবাক হয়ে বারান্দায় এল কুসুম। গেট দিয়ে সাইকেল ঢোকাচ্ছে পার্থ। চমকে গেল কুসুম। পার্থ যেন বুঝতে পেরেই বলল -- "আজ তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। তাই আগের ট্রেনেই চলে এলাম। শোন না, উদয়নে নবাব এসেছে। যাবে? তুমি তো সেদিন বলছিলে রঞ্জিত মল্লিককে তোমার ভালো লাগে। চলো না।"

ভিতরে যে দিদিরা বসে আছেন, সেটা কি খেয়াল করেনি পার্থ? লজ্জায় লাল হয়ে গেল কুসুম। দিদিরা শুনতে পেলেন পার্থর গলা। তাড়া আছে, পরে আসবেন ইত্যাদি বলে তখনি সেখান থেকে বিদায় নিলেন। "সত্যি যাবে?"
কুসুমের বিস্ময় কাটেই না। পার্থ স্রেফ মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।

সেই সময়, যখন পাড়ার ছেলেরা ব্যাট নিয়ে মাঠে যাচ্ছিল, যখন কলেজ ফেরতা মেয়েটি গাছের তলায় প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল, যখন ধর্মতলার অফিসে বসে কেউ কাজ শেষ করে হাওড়া স্টেশনে আসার পরিকল্পনা করছিল, যখন তার সাধের গোধূলি আসতে ঢের দেরী, তখন ঐ সাইকেল স্ট্যান্ড করানোর শব্দে, দেওয়ালের লাল সবুজ রাজনৈতিক দলের স্লোগানে, রাস্তায় একা ডাকতে থাকা আইসক্রিমওয়ালার ডাকের মধ্যে দিয়ে কুসুম বুঝতে পারল সে না চিনলেও পার্থ তাকে ঠিক চিনেছে।



Friday, July 17, 2020

বহরমপুরের সুতপা

অফিসে কাজের ফাঁকে প্রায়ই অর্কুটটা চেক করে নেয় নিখিল। আর এখন তো বেশী করে করতে হয়। সুতপা মেসেজ করে এই সময়। রোজ বিকেলে এক ঘণ্টার জন্য সুতপা সাইবার ক্যাফে যায় শুধুমাত্র নিখিলের সঙ্গে দেখা করতে। কলেজ পাশ করে বহরমপুরে একটা স্কুলে পড়ায় সুতপা। বাবা নেই। বাড়িতে শুধু মা। হাল্কা শ্যামলা গায়ের রং, তন্বী। প্রথমবার ছবি দেখেই পছন্দ হয়েছিল নিখিলের। অর্কুটেই আলাপ সুতপার সঙ্গে। অনলাইনের মধ্য দিয়ে কলকাতার রাস্তার ভিড় আর বহরমপুরের লোডশেডিং যে কখন মিলেমিশে এক প্রেমকাহিনীর সূচনা করেছিল দু'জনে কেউই বোঝেনি। অনলাইনে এভাবে প্রেমে পড়া শুনলে লোকজন এই ২০০৬-এ অবাক হয় বইকি। তবে দুজনেই দুজনের ছবি দেখেছে। গলা শুনেছে। কাজেই একেবারে অচেনা নয়। সুতপা নতুন একটা মোবাইল ফোন নিয়েছে। তবে ওর বেশী টকটাইম নেই। তাই নিখিল-ই ফোন করে। সারা রাত্রি ধরে সুতপা বলে চলে তার স্কুলের খাতা দেখার গল্প, আর নিখিল তার অফিসের। নিখিলের গলায় সুর আছে। সুতপা বার বার বায়না করলে নিখিল গান শোনায়। কোনদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত, কোনদিন আধুনিক। সুতপা বলে নিখিলের গলা নাকি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মত।

দু'মাস এভাবে অতিবহিত হওয়ার পর দুজনেরই মনে হল এবার সামনাসামনি দেখা হওয়া দরকার। সুতপা ঠিক করল কলকাতায় এসবে। কলকাতায় তার মাসীর বাড়ি। সেখানে উঠে নিখিলের সঙ্গে দেখা করবে। লালগোলা প্যসেঞ্জারে চেপে মাসীর বাড়ি এসে একদিন পর নিখিলের সঙ্গে দেখা করতে গেল সুতপা। ভিক্টোরিয়ার সামনে দেখা করার কথা। বাস থেকে নেমে সুতপা দেখল গেটের সামনে সাদার উপর লাল চেক জামা পরিহিত নিখিল। সুতপা নিজে পরেছে সবুজ রঙের সালোয়ার কামিজ। বেশী গয়না পছন্দ করেনা সুতপা। তাই সামান্য একটা গলায় হার আর কানে দুল। তাতেই নিখিল বলে উঠল -- "বিউটিফুল।"

সারাদিন ভিক্টোরিয়ায় ঘুরে, দুপুরে এক চাইনিজ দোকানে খেয়ে বিকেলবেলা নিখিলের নিউ আলিপুরের বাড়িতে এল সুতপা। ভিক্টোরিয়ার মাঠে সর্বসমক্ষে ঘনিষ্ট হতে আপত্তি ছিল সুতপার। নিখিল একাই থাকে। তাই ওর বাড়িতে আপত্তি নেই। নিখিলের বাড়িটা খুব একটা ছোট না। ওর বাবা বানিয়েছিলেন। বাবা মা দুজনেই এক এক্সিডেন্টে গত হন। তারপর থেকে একাই থাকে নিখিল। বাড়িতে ঢুকেই বাঁ দিকের বন্ধ ঘরটার দিকে এগোচ্ছিল সুতপা। নিখিল বারণ করে। ঐ ঘরটি নাকি নিখিলের বাবা মার। ঐ ঘরটি সে বন্ধই রাখে। নিখিলের লিভিং রুমের সোফায় বসতে যাচ্ছিল সে, এই সময় নিখিল তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। মনে হল সুতপার গায়ে যেন শিহরন খেলে গেল। চকিতে নিখিলের দিকে ঘুরে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। আস্তে আস্তে নিখিলের ওষ্ট সুতপার অধর স্পর্শ করল। সুতপার হাট উঠে গেল নিখিলের কাঁধে। নিখিলের চোখ বন্ধ হল। সুতপারও।  নিখিল তৈরি ছিল। চট করে পকেট থেকে ইনজেকশনটা বার করে সুতপার হাতে তাক করল। এক মিনিটের মধ্যেই সোফায় অজ্ঞান হয়ে পরে গেল সুতপা। এবার নিখিল ফোন করল -- "আমি রেডি তন্ময়দা, আপনার নার্স নিয়ে চলে আসুন।"


কসবা থেকে নিউ আলিপুর আসতে সময় লাগে বলেই চেতলাতে এক বন্ধুর বাড়ি ছিলেন ডাক্তার তন্ময় সেনগুপ্ত। ফোন পাওয়া মাত্রই নিজের নার্স রুমাকে নিয়ে চলে এলেন নিখিলের বাড়ি। নিখিল ততক্ষণে বন্ধ ঘরের দরজা খুলে রেখেছে। সেটি যেন এক পুরোদস্তুর অপারেশন থিয়েটার। সুতপার অবচেতন দেহটা সবাই মিলে ধরে নিয়ে এল। শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল নিখিল। বাইরের ঘরে বসে টিভিটা চালাল। সৌরভ বোধহয় আবার টিমে ফিরবে।

খানিকক্ষণ বাদেই বেরিয়ে এলেন ডাক্তার সেনগুপ্ত। "নিখিল, এই মেয়েটির তো কিডনি নেই!"
"কিডনি নেই মানে? এটা হয় নাকি?"
"আরে দেখে যাও।"
"খারাপ করছেন তন্ময়দা, আমাকে শেয়ার দেবেন না বলে কিডনি লুকিয়ে এখন এসব বলছেন।"
"আরে তুমি নিজেই দেখো না।"

ঘরের ভিতরে তখনো হাল্কা আলোটা জ্বলছে। বেডের পাশে বাকি সব আলো যেন সুতপার কাটা দেহটাকে ঝলসে দিচ্ছে। নার্সটিকে দেখা যাচ্ছেনা। নিখিল এসে কিছুই বুঝলো না। "কোথায় কিডনি নেই তন্ময়দা?"

ঘাড় ঘুরিয়ে নিখিল দেখল তন্ময়দা পাশে নেই। ঘরের দরজাটিও এবার বন্ধ হয়ে গেল। বাইরে থেকে কেউ যেন তালাটা ঘোরাচ্ছে। নিখিল ছুটে গেল দরজার দিকে। দু'বার ধাক্কা দিতেও দরজা খুলল না। আবার পাশ ফিরতেই নিখিলের চোখ গেল ঘরের অন্য কোণে। হাল্কা আলোতে এতক্ষণ খেয়াল করেনি। পাশাপাশি পরে আছে তন্ময়দা আর রুমা। দুজনের কারুর জ্ঞান নেই মনে হচ্ছে। নিখিল অবাক হয়ে এগিয়ে গেল তন্ময়দার দিকে।
"তন্ময়দা, তন্ময়দা।"
"ওরা কেউ বেঁচে নেই নিখিল।"
একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে বেডের দিকে ফিরে তাকাল নিখিল। এই সেই গলা, যা রাতের পর রাত নিখিলকে বহরমপুরের গল্প বলেছে, হাজারদুয়ারী বেড়াতে যাবার কথা বলেছে, বিধবা মায়ের কষ্টের কথা বলেছে, স্কুলের বাচ্চাদের বাঁদরামোর কথা বলেছে। নিখিল এতদিন এই গলা শুনে চমকাত না। আজ চমকাল। এখন চমকাল।

নিখিল এবার অবাক হয়ে দেখল সুতপার কাটা দেহটা বেড থেকে নেমে আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে আসছে। নিখিল ভয়ে নড়তেও পারল না। কাটা দেহে কিডনি আছে কিনা, সে বোঝার মত ক্ষমতাও তার নেই। এবার একদম কাছে এসে নিখিলের সামনে ফিসফিসিয়ে সুতপা বলল -- "আমাদের চুম্বন তো শেষ হয়নি নিখিল। আমাকে চুমু খাবে না?"

বলেই নিজের ঠাণ্ডা ওষ্ঠ এবার নিখিলের অধরের উপর চেপে ধরল সুতপা। নিখিল ঠাণ্ডায় ছটফট করতে গেল। কিন্তু ততক্ষণে সুতপার দুই হাত এসে গেছে নিখিলের মাথার পিছনে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিখিলের ধরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। শুধু সুতপার কাটা দেহের হাতে ধরা থাকল নিখিলের চুম্বনরত মস্তক। নিখিলের চোখ এবার সত্যি বন্ধ।


Thursday, July 16, 2020

প্রশ্ন করা হয়নি

অফিসে বসে লেখাটা শেষ করছিলাম। এই সময় অফিসের পিওন রামদেব এসে জানাল আমার ফোন এসেছে। আমার ডেস্কে একটা বড় কাঁচের পেপারওয়েট থাকে। গোল, ভিতরে ডিজাইন। সেটা দিয়ে লেখাটা চাপা দিয়ে ফোন ধরতে এলাম। আমাদের অফিসে এখনো সেই মান্ধাতার আমলের কালো ফোন। গোল করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাম্বার ডায়াল করতে হয়। আমাদের বাড়িতেই এর চেয়ে আধুনিক ফোন আছে। এখন কি প্যাড লাগানো নতুন যে ফোন হয়, সেগুলি একটা কিনলে পারে অফিস।

"হ্যালো, অতনু বলছি।"
"চিনতে পারছিস?"
"না তো, কে?"
"আমি অসীম।"
"অসীম কে? অসীম বসাক?"
"ইয়েস স্যার।"
"আরে, কতদিন বাদে। কোথায় আছিস, আমার অফিসের নম্বর পেলি কোথায়?"
"আজ বিকেল পাঁচটায় কফি হাউসে আসবি? সব জবাব দেব।"
"ঠিক আছে, তবে তোকে চিনব কি করে?"
"ভাবিস না, ঠিক চিনতে পারবি। খুব একটা বদলাই নি।"

বিকেলে চিকেন স্যান্ডইউচ আর কফি খেতে খেতে আমি প্রশ্ন করলাম
"এবার বল, আমার অফিসের নম্বর পেলি কোথা থেকে?"
"খবর পেলাম তুই আজকের সংবাদে চাকরি করিস। ডিরেক্টরি থেকে নম্বর পেলাম।"
"তুই আছিস কোথায়?"
"আমি ব্যাঙ্গালোরে। ইসরোতে চাকরি করছি।"
"আইব্বাস। চাঁদে যাবি কবে?"
"এই তো কাল। চল তোকে নিয়ে যাই।"
"উফ, কতদিন বাদে তোর সাথে দেখা হল।"
"হ্যাঁ, প্রায় ১৫ বছর বাদে।"
"সত্যি। তুই তো মাধ্যমিকের পরই সুন্দরপুর ছেড়েছিলিস?"
"হ্যাঁ। বাবা তার আগের বছর চলে গেল।"
"হ্যাঁ রে, কাকুর কথা খুব মনে পড়ে। ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। কি ভালো ফুটবল খেলতেন! কীভাবে যে এমন ভাবে হার্ট এটাক হলো।"
"হুম। শোন না, তোর একটা সাহায্য দরকার।"
"বল।"
"তুই তো জানিস বাবা কিছুদিনের জন্য ইস্টবেঙ্গলে ট্রায়ালে গিয়েছিল।"
"হ্যাঁ, জানি তো।"
"হ্যাঁ, সেই সময় ইস্টবেঙ্গলের কোচ ছিলেন রবি সেন। এখন যিনি আবার ইস্টবেঙ্গলের কোচ হয়েছেন।"
"হ্যাঁ।"
"বাবা আমাকে বলেছিল উনি নাকি বাবাকে কিছু একটা বলেছিলেন যেটা বাবার সারাজীবন মনে থাকবে। আমি বড় হলে আমাকে বলবেন বলেছিলেন। কিন্তু আমি প্রশ্ন করার আগেই বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তো আমি ভাবছিলেন রবিবাবুকে জিজ্ঞেস করলে হয়না?"
"ওনার কি মনে থাকবে? এত ফুটবলার সামলেছেন।"
"জানি। তবুও। বলে দেখা যাক না। তুই তো ওনার সাক্ষাতকার নিয়েছিস নিশ্চয়। একবার আলাপ করাতে পারবি না?"
"তা আমি চিনি ওনাকে। ঠিক আছে দেখছি। ক'টা দিন সময় দে। সামনে ডার্বি। তুই লিগের খবর রাখিস?"
"না রে, আমি শধুই ক্রিকেট। এখন তো কলকাতার ছেলে ক্যাপ্টেন।"
"হ্যাঁ, সামনে ওয়ার্ল্ড কাপ। দেখা যাক। শচীন এবার জিততে চাইবে।"
"যাই বল, ভালো বোলার নেই। এই জাহির ছেলেটা খারাপ না..."


ডার্বির পরেরদিন অসীমকে ফোন করলাম। অসীম এখন কলকাতায় আছে ওর জ্যাঠার বাড়ি। সেখানে ফোন করে ডেকে দিতে বললাম
"কি রে, ব্যবস্থা হল? "
"তুই কি একদমই কাগজ পড়িসনা?"
"না মানে কি হয়েছে?"
"ডার্বি জিতে রাত্রে গাড়ির এক্সিডেন্টে রবিবাবু পরলোকগত।"
"যাহ।"
"হ্যাঁ, গতকাল।"
"বুঝলি, আমার প্রশ্নটা করাই হয়না কাউকে।"
"একজন জানতে পারে।"
"কে বলত?"
"লক্ষণদাকে তোর মনে আছে?"
"লক্ষণদা মানে যে মোহনবাগানে খেলত?"
"খেলত মানে দু'বছর খেলেছে। তারপর গোয়া গেল খেলতে। চোট পেয়ে আর খেলা বন্ধ। এখন বড়বাজারের পাশে একটা রোলের দোকান চালায়।"
"আচ্ছা। হ্যাঁ, ওনার সঙ্গে বাবার খুব ভাব ছিল। চল যাওয়া যাক সুন্দরপুর। কবে যাবি?"
"কাল চল?"

সুন্দরপুরে লক্ষণদার রোলের দোকানে একটা করে এগ চিকেন রোল খেতে খেতে আড্ডা হচ্ছিল। পাশে রেডিওতে "সেই যে হলুদ পাখি" গানটা বাজছিল। অসীম শোনেনি। ওকে জানালাম এটা ক্যাকটাস বলে একটা বাংলা ব্যান্ডের।
"লক্ষণদা, তোমার ফুটবল ছেড়ে ভালো লাগে?"
"কে বলল ছেড়েছি!"
"না তো, আজ তো রবিবার। চল একটু বাদে।"
"কোথায়?"
"মসজিদের পাশের মাঠে। আমরা বন্ধুরা মিলে রবিবার বিকেলে ফুটবল খেলি।"
"বন্ধুরা মানে? তোমার বয়সী সবাই?"
"ছোট বড় অনেকেই আছে। কলকাতায় অফিস করে। দুজনেই চলো আজ।"
এবার অসীম প্রশ্ন করল
"লক্ষণদা, তোমার সঙ্গে তো বাবা অনেক গল্প করতেন।"
"তা করতেন। তোমার বাবা এই সুন্দরপুরের একমাত্র স্পোর্টসম্যান ছিলেন, বুঝলে?"
"আচ্ছা বাবা কোনদিন তোমাকে বলেছেন ওনাকে ইস্টবেঙ্গল ট্রেনিং-এ রবি সেন কি বলেছিলেন?"
"না গো। মনে পড়ছে না। আমাকে এরকম কিছু বলেননি।"

অসীম আবার হতাশ হল। এবার লক্ষণদা বললেন
"চলো চলো খেলতে চলো। তোমার বাবা খুশী হবেন তুমি ফুটবল খেলছ দেখলে।"
"এই ফুল প্যান্টে?"
"আরে ধুর, প্যান্ট গুটিয়ে নিও।"

ভালোই খেলা হল। আমি যদিও বা একটু আধটু খেলালাম, অসীম একেবারেই পারল না। মিনিট দশেকের মধ্যেই হাঁপিয়ে বলল -- "আমি গোলকিপার হব।" তবে খেলা শেষের পর ওর মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তির হাসি দেখলাম।

মাসখানেক বাদে আবার কাজে সুন্দরপুর গিয়েছিলাম। লক্ষণদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল স্টেশনে। শুনলাম ব্যান্ডেল যাচ্ছেন বোনের সঙ্গে দেখা করতে। আমাকে দেখে একটু গল্প করে বললেন -- "জানো তোমার বন্ধু অসীমের বাবা আমাকে বলেছিলেন রবি সেনের কথা।"
"মানে আপনি জানতেন রবি সেন ওনাকে কী বলেছে?"
"হ্যাঁ।"
"অসীমকে বললেন না কেন?"
"ওর খারাপ লাগত।"
"কেন?"
"রবি সেন বলেছিলেন -- দেখ, তোমার ইস্টবেঙ্গল বা ময়দানের কোন বড় ক্লাবে তেমন ভবিষ্যৎ নেই। বরং ব্যাঙ্কে দেখ। ওখানে ভালো খেললে তোমার পাকা চাকরি হবে। সংসারে অসুবিধা হবে না।"
"সেকি।"
"সেই কথা শুনেই উনি ব্যাঙ্কে জয়েন করেন। পরে আক্ষেপ করতেন রবিবাবুর কথা না শুনে টিকে থাকলে হত। আমাকে বলতেন বার বার হাল না ছাড়তে। হয়ত অসীমকে ..."