অফিসে বসে লেখাটা শেষ করছিলাম। এই সময় অফিসের পিওন রামদেব এসে জানাল আমার ফোন এসেছে। আমার ডেস্কে একটা বড় কাঁচের পেপারওয়েট থাকে। গোল, ভিতরে ডিজাইন। সেটা দিয়ে লেখাটা চাপা দিয়ে ফোন ধরতে এলাম। আমাদের অফিসে এখনো সেই মান্ধাতার আমলের কালো ফোন। গোল করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাম্বার ডায়াল করতে হয়। আমাদের বাড়িতেই এর চেয়ে আধুনিক ফোন আছে। এখন কি প্যাড লাগানো নতুন যে ফোন হয়, সেগুলি একটা কিনলে পারে অফিস।
"হ্যালো, অতনু বলছি।"
"চিনতে পারছিস?"
"না তো, কে?"
"আমি অসীম।"
"অসীম কে? অসীম বসাক?"
"ইয়েস স্যার।"
"আরে, কতদিন বাদে। কোথায় আছিস, আমার অফিসের নম্বর পেলি কোথায়?"
"আজ বিকেল পাঁচটায় কফি হাউসে আসবি? সব জবাব দেব।"
"ঠিক আছে, তবে তোকে চিনব কি করে?"
"ভাবিস না, ঠিক চিনতে পারবি। খুব একটা বদলাই নি।"
বিকেলে চিকেন স্যান্ডইউচ আর কফি খেতে খেতে আমি প্রশ্ন করলাম
"এবার বল, আমার অফিসের নম্বর পেলি কোথা থেকে?"
"খবর পেলাম তুই আজকের সংবাদে চাকরি করিস। ডিরেক্টরি থেকে নম্বর পেলাম।"
"তুই আছিস কোথায়?"
"আমি ব্যাঙ্গালোরে। ইসরোতে চাকরি করছি।"
"আইব্বাস। চাঁদে যাবি কবে?"
"এই তো কাল। চল তোকে নিয়ে যাই।"
"উফ, কতদিন বাদে তোর সাথে দেখা হল।"
"হ্যাঁ, প্রায় ১৫ বছর বাদে।"
"সত্যি। তুই তো মাধ্যমিকের পরই সুন্দরপুর ছেড়েছিলিস?"
"হ্যাঁ। বাবা তার আগের বছর চলে গেল।"
"হ্যাঁ রে, কাকুর কথা খুব মনে পড়ে। ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। কি ভালো ফুটবল খেলতেন! কীভাবে যে এমন ভাবে হার্ট এটাক হলো।"
"হুম। শোন না, তোর একটা সাহায্য দরকার।"
"বল।"
"তুই তো জানিস বাবা কিছুদিনের জন্য ইস্টবেঙ্গলে ট্রায়ালে গিয়েছিল।"
"হ্যাঁ, জানি তো।"
"হ্যাঁ, সেই সময় ইস্টবেঙ্গলের কোচ ছিলেন রবি সেন। এখন যিনি আবার ইস্টবেঙ্গলের কোচ হয়েছেন।"
"হ্যাঁ।"
"বাবা আমাকে বলেছিল উনি নাকি বাবাকে কিছু একটা বলেছিলেন যেটা বাবার সারাজীবন মনে থাকবে। আমি বড় হলে আমাকে বলবেন বলেছিলেন। কিন্তু আমি প্রশ্ন করার আগেই বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তো আমি ভাবছিলেন রবিবাবুকে জিজ্ঞেস করলে হয়না?"
"ওনার কি মনে থাকবে? এত ফুটবলার সামলেছেন।"
"জানি। তবুও। বলে দেখা যাক না। তুই তো ওনার সাক্ষাতকার নিয়েছিস নিশ্চয়। একবার আলাপ করাতে পারবি না?"
"তা আমি চিনি ওনাকে। ঠিক আছে দেখছি। ক'টা দিন সময় দে। সামনে ডার্বি। তুই লিগের খবর রাখিস?"
"না রে, আমি শধুই ক্রিকেট। এখন তো কলকাতার ছেলে ক্যাপ্টেন।"
"হ্যাঁ, সামনে ওয়ার্ল্ড কাপ। দেখা যাক। শচীন এবার জিততে চাইবে।"
"যাই বল, ভালো বোলার নেই। এই জাহির ছেলেটা খারাপ না..."
ডার্বির পরেরদিন অসীমকে ফোন করলাম। অসীম এখন কলকাতায় আছে ওর জ্যাঠার বাড়ি। সেখানে ফোন করে ডেকে দিতে বললাম
"কি রে, ব্যবস্থা হল? "
"তুই কি একদমই কাগজ পড়িসনা?"
"না মানে কি হয়েছে?"
"ডার্বি জিতে রাত্রে গাড়ির এক্সিডেন্টে রবিবাবু পরলোকগত।"
"যাহ।"
"হ্যাঁ, গতকাল।"
"বুঝলি, আমার প্রশ্নটা করাই হয়না কাউকে।"
"একজন জানতে পারে।"
"কে বলত?"
"লক্ষণদাকে তোর মনে আছে?"
"লক্ষণদা মানে যে মোহনবাগানে খেলত?"
"খেলত মানে দু'বছর খেলেছে। তারপর গোয়া গেল খেলতে। চোট পেয়ে আর খেলা বন্ধ। এখন বড়বাজারের পাশে একটা রোলের দোকান চালায়।"
"আচ্ছা। হ্যাঁ, ওনার সঙ্গে বাবার খুব ভাব ছিল। চল যাওয়া যাক সুন্দরপুর। কবে যাবি?"
"কাল চল?"
সুন্দরপুরে লক্ষণদার রোলের দোকানে একটা করে এগ চিকেন রোল খেতে খেতে আড্ডা হচ্ছিল। পাশে রেডিওতে "সেই যে হলুদ পাখি" গানটা বাজছিল। অসীম শোনেনি। ওকে জানালাম এটা ক্যাকটাস বলে একটা বাংলা ব্যান্ডের।
"লক্ষণদা, তোমার ফুটবল ছেড়ে ভালো লাগে?"
"কে বলল ছেড়েছি!"
"না তো, আজ তো রবিবার। চল একটু বাদে।"
"কোথায়?"
"মসজিদের পাশের মাঠে। আমরা বন্ধুরা মিলে রবিবার বিকেলে ফুটবল খেলি।"
"বন্ধুরা মানে? তোমার বয়সী সবাই?"
"ছোট বড় অনেকেই আছে। কলকাতায় অফিস করে। দুজনেই চলো আজ।"
এবার অসীম প্রশ্ন করল
"লক্ষণদা, তোমার সঙ্গে তো বাবা অনেক গল্প করতেন।"
"তা করতেন। তোমার বাবা এই সুন্দরপুরের একমাত্র স্পোর্টসম্যান ছিলেন, বুঝলে?"
"আচ্ছা বাবা কোনদিন তোমাকে বলেছেন ওনাকে ইস্টবেঙ্গল ট্রেনিং-এ রবি সেন কি বলেছিলেন?"
"না গো। মনে পড়ছে না। আমাকে এরকম কিছু বলেননি।"
অসীম আবার হতাশ হল। এবার লক্ষণদা বললেন
"চলো চলো খেলতে চলো। তোমার বাবা খুশী হবেন তুমি ফুটবল খেলছ দেখলে।"
"এই ফুল প্যান্টে?"
"আরে ধুর, প্যান্ট গুটিয়ে নিও।"
ভালোই খেলা হল। আমি যদিও বা একটু আধটু খেলালাম, অসীম একেবারেই পারল না। মিনিট দশেকের মধ্যেই হাঁপিয়ে বলল -- "আমি গোলকিপার হব।" তবে খেলা শেষের পর ওর মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তির হাসি দেখলাম।
মাসখানেক বাদে আবার কাজে সুন্দরপুর গিয়েছিলাম। লক্ষণদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল স্টেশনে। শুনলাম ব্যান্ডেল যাচ্ছেন বোনের সঙ্গে দেখা করতে। আমাকে দেখে একটু গল্প করে বললেন -- "জানো তোমার বন্ধু অসীমের বাবা আমাকে বলেছিলেন রবি সেনের কথা।"
"মানে আপনি জানতেন রবি সেন ওনাকে কী বলেছে?"
"হ্যাঁ।"
"অসীমকে বললেন না কেন?"
"ওর খারাপ লাগত।"
"কেন?"
"রবি সেন বলেছিলেন -- দেখ, তোমার ইস্টবেঙ্গল বা ময়দানের কোন বড় ক্লাবে তেমন ভবিষ্যৎ নেই। বরং ব্যাঙ্কে দেখ। ওখানে ভালো খেললে তোমার পাকা চাকরি হবে। সংসারে অসুবিধা হবে না।"
"সেকি।"
"সেই কথা শুনেই উনি ব্যাঙ্কে জয়েন করেন। পরে আক্ষেপ করতেন রবিবাবুর কথা না শুনে টিকে থাকলে হত। আমাকে বলতেন বার বার হাল না ছাড়তে। হয়ত অসীমকে ..."
"হ্যালো, অতনু বলছি।"
"চিনতে পারছিস?"
"না তো, কে?"
"আমি অসীম।"
"অসীম কে? অসীম বসাক?"
"ইয়েস স্যার।"
"আরে, কতদিন বাদে। কোথায় আছিস, আমার অফিসের নম্বর পেলি কোথায়?"
"আজ বিকেল পাঁচটায় কফি হাউসে আসবি? সব জবাব দেব।"
"ঠিক আছে, তবে তোকে চিনব কি করে?"
"ভাবিস না, ঠিক চিনতে পারবি। খুব একটা বদলাই নি।"
বিকেলে চিকেন স্যান্ডইউচ আর কফি খেতে খেতে আমি প্রশ্ন করলাম
"এবার বল, আমার অফিসের নম্বর পেলি কোথা থেকে?"
"খবর পেলাম তুই আজকের সংবাদে চাকরি করিস। ডিরেক্টরি থেকে নম্বর পেলাম।"
"তুই আছিস কোথায়?"
"আমি ব্যাঙ্গালোরে। ইসরোতে চাকরি করছি।"
"আইব্বাস। চাঁদে যাবি কবে?"
"এই তো কাল। চল তোকে নিয়ে যাই।"
"উফ, কতদিন বাদে তোর সাথে দেখা হল।"
"হ্যাঁ, প্রায় ১৫ বছর বাদে।"
"সত্যি। তুই তো মাধ্যমিকের পরই সুন্দরপুর ছেড়েছিলিস?"
"হ্যাঁ। বাবা তার আগের বছর চলে গেল।"
"হ্যাঁ রে, কাকুর কথা খুব মনে পড়ে। ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। কি ভালো ফুটবল খেলতেন! কীভাবে যে এমন ভাবে হার্ট এটাক হলো।"
"হুম। শোন না, তোর একটা সাহায্য দরকার।"
"বল।"
"তুই তো জানিস বাবা কিছুদিনের জন্য ইস্টবেঙ্গলে ট্রায়ালে গিয়েছিল।"
"হ্যাঁ, জানি তো।"
"হ্যাঁ, সেই সময় ইস্টবেঙ্গলের কোচ ছিলেন রবি সেন। এখন যিনি আবার ইস্টবেঙ্গলের কোচ হয়েছেন।"
"হ্যাঁ।"
"বাবা আমাকে বলেছিল উনি নাকি বাবাকে কিছু একটা বলেছিলেন যেটা বাবার সারাজীবন মনে থাকবে। আমি বড় হলে আমাকে বলবেন বলেছিলেন। কিন্তু আমি প্রশ্ন করার আগেই বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তো আমি ভাবছিলেন রবিবাবুকে জিজ্ঞেস করলে হয়না?"
"ওনার কি মনে থাকবে? এত ফুটবলার সামলেছেন।"
"জানি। তবুও। বলে দেখা যাক না। তুই তো ওনার সাক্ষাতকার নিয়েছিস নিশ্চয়। একবার আলাপ করাতে পারবি না?"
"তা আমি চিনি ওনাকে। ঠিক আছে দেখছি। ক'টা দিন সময় দে। সামনে ডার্বি। তুই লিগের খবর রাখিস?"
"না রে, আমি শধুই ক্রিকেট। এখন তো কলকাতার ছেলে ক্যাপ্টেন।"
"হ্যাঁ, সামনে ওয়ার্ল্ড কাপ। দেখা যাক। শচীন এবার জিততে চাইবে।"
"যাই বল, ভালো বোলার নেই। এই জাহির ছেলেটা খারাপ না..."
ডার্বির পরেরদিন অসীমকে ফোন করলাম। অসীম এখন কলকাতায় আছে ওর জ্যাঠার বাড়ি। সেখানে ফোন করে ডেকে দিতে বললাম
"কি রে, ব্যবস্থা হল? "
"তুই কি একদমই কাগজ পড়িসনা?"
"না মানে কি হয়েছে?"
"ডার্বি জিতে রাত্রে গাড়ির এক্সিডেন্টে রবিবাবু পরলোকগত।"
"যাহ।"
"হ্যাঁ, গতকাল।"
"বুঝলি, আমার প্রশ্নটা করাই হয়না কাউকে।"
"একজন জানতে পারে।"
"কে বলত?"
"লক্ষণদাকে তোর মনে আছে?"
"লক্ষণদা মানে যে মোহনবাগানে খেলত?"
"খেলত মানে দু'বছর খেলেছে। তারপর গোয়া গেল খেলতে। চোট পেয়ে আর খেলা বন্ধ। এখন বড়বাজারের পাশে একটা রোলের দোকান চালায়।"
"আচ্ছা। হ্যাঁ, ওনার সঙ্গে বাবার খুব ভাব ছিল। চল যাওয়া যাক সুন্দরপুর। কবে যাবি?"
"কাল চল?"
সুন্দরপুরে লক্ষণদার রোলের দোকানে একটা করে এগ চিকেন রোল খেতে খেতে আড্ডা হচ্ছিল। পাশে রেডিওতে "সেই যে হলুদ পাখি" গানটা বাজছিল। অসীম শোনেনি। ওকে জানালাম এটা ক্যাকটাস বলে একটা বাংলা ব্যান্ডের।
"লক্ষণদা, তোমার ফুটবল ছেড়ে ভালো লাগে?"
"কে বলল ছেড়েছি!"
"না তো, আজ তো রবিবার। চল একটু বাদে।"
"কোথায়?"
"মসজিদের পাশের মাঠে। আমরা বন্ধুরা মিলে রবিবার বিকেলে ফুটবল খেলি।"
"বন্ধুরা মানে? তোমার বয়সী সবাই?"
"ছোট বড় অনেকেই আছে। কলকাতায় অফিস করে। দুজনেই চলো আজ।"
এবার অসীম প্রশ্ন করল
"লক্ষণদা, তোমার সঙ্গে তো বাবা অনেক গল্প করতেন।"
"তা করতেন। তোমার বাবা এই সুন্দরপুরের একমাত্র স্পোর্টসম্যান ছিলেন, বুঝলে?"
"আচ্ছা বাবা কোনদিন তোমাকে বলেছেন ওনাকে ইস্টবেঙ্গল ট্রেনিং-এ রবি সেন কি বলেছিলেন?"
"না গো। মনে পড়ছে না। আমাকে এরকম কিছু বলেননি।"
অসীম আবার হতাশ হল। এবার লক্ষণদা বললেন
"চলো চলো খেলতে চলো। তোমার বাবা খুশী হবেন তুমি ফুটবল খেলছ দেখলে।"
"এই ফুল প্যান্টে?"
"আরে ধুর, প্যান্ট গুটিয়ে নিও।"
ভালোই খেলা হল। আমি যদিও বা একটু আধটু খেলালাম, অসীম একেবারেই পারল না। মিনিট দশেকের মধ্যেই হাঁপিয়ে বলল -- "আমি গোলকিপার হব।" তবে খেলা শেষের পর ওর মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তির হাসি দেখলাম।
মাসখানেক বাদে আবার কাজে সুন্দরপুর গিয়েছিলাম। লক্ষণদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল স্টেশনে। শুনলাম ব্যান্ডেল যাচ্ছেন বোনের সঙ্গে দেখা করতে। আমাকে দেখে একটু গল্প করে বললেন -- "জানো তোমার বন্ধু অসীমের বাবা আমাকে বলেছিলেন রবি সেনের কথা।"
"মানে আপনি জানতেন রবি সেন ওনাকে কী বলেছে?"
"হ্যাঁ।"
"অসীমকে বললেন না কেন?"
"ওর খারাপ লাগত।"
"কেন?"
"রবি সেন বলেছিলেন -- দেখ, তোমার ইস্টবেঙ্গল বা ময়দানের কোন বড় ক্লাবে তেমন ভবিষ্যৎ নেই। বরং ব্যাঙ্কে দেখ। ওখানে ভালো খেললে তোমার পাকা চাকরি হবে। সংসারে অসুবিধা হবে না।"
"সেকি।"
"সেই কথা শুনেই উনি ব্যাঙ্কে জয়েন করেন। পরে আক্ষেপ করতেন রবিবাবুর কথা না শুনে টিকে থাকলে হত। আমাকে বলতেন বার বার হাল না ছাড়তে। হয়ত অসীমকে ..."
No comments:
Post a Comment