Friday, April 2, 2021

বাড়ির খোঁজে

 আচ্ছা, আপনাদের কারুর বাড়ি হারিয়ে গেছে?  মার্কিন দেশের নেভাডা রাজ্যের এম্পায়ার শহরের ফার্নের হারিয়ে গিয়েছিল। এম্পায়ারে একটি কন্সট্রাকশন কোম্পানি ছিল। প্রায় ৭৫০ লোক থাকত। কোম্পানির বাড়িতে ছিল। একদিন কোম্পানি উঠে যায়। চাকরির খোঁজে সবাই এম্পায়ার ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। এম্পায়ার খালি হয়ে যায়। ফার্ন বেছে নেয় এক যাযাবর জীবন। নিজের ক্যারাভানে চেপে দেশের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে এমাজনে কাজ করে। একদিন সে ফিরে আসে এম্পায়ারে। নিজের পুরনো বাড়িতে যায়। কেউ নেই। দরজা খোলা। বেডরুম খালি। আলমারি খোলা। এক শূন্যতা তাকে পেয়ে বসে। খানিকক্ষণ সময় কাটিয়ে সে ফিরে যায়। এতক্ষণে হয়ত অনেকেই বুঝে ফেলেছেন আমি কার কথা বলছি। হ্যাঁ, এটি এবছরে ছয়টি অস্কারের জন্য মনোনীত সিনেমা "নোমাডল্যান্ড"। 

কিন্তু এ কী শুধুই মার্কিন দেশের গল্প? আমাদের দেশে কি নেই? আমার শ্বশুরমশাই চাকরি করতেন আসামে হিন্দুস্তান পেপার মিলসে। উনি অবসর নিয়েছেন বহয় আগে। বহুদিন হল সেটি বন্ধ। ইতিমধ্যেই প্রায় ৮০ জন আত্মহত্যা করেছে। আমার স্ত্রী এবং অন্যরা যারা ঐ মিলের হাউজিং-এ বড় হয়েছে, তাদের সেই বাড়ি কি আর থাকবে? ঐ মিল যদি না খোলে কোনদিন, তাহলে ও বাড়িও হারিয়ে যাবে। 

অনেক বাড়ি অচেনা হয়ে যায়। আমার তারাবাগের যে কোয়ার্টারে থাকতাম, যেটা জীবনের প্রায় ১১ বছর আমার বাড়ি ছিল, আজ সেখানে আমি চাইলেই ঢুকতে পারবনা। কে থাকেন চিনি না, দুম করে "এটা আমার বাড়ি ছিল, দেখব" বলে যাওয়া যায়না। অথচ সত্যি ওখানে আমি থাকতাম। আই সি এস ই, উচ্চমাধ্যমিক, জয়েন্ট সব ঐ বাড়িতে থাকতেই দেওয়া। ২০০১ এ অসুস্থ হয়ে নার্সিং হোম থেকে ফিরে ঐ বাড়িতেই উঠেছিলাম। সাইকেল চালাতে শিখে পড়ে গিয়ে পা কেটে ঐ বাড়িতেই গেছিলাম। আজ সেই বাড়ি আমার অচেনা। তবে হারিয়ে যায়নি। আমি তারাবাগ গেলেই বাড়িটি দেখতে পাই। হয়ত ঢুকতে পারিনা। 

আমার জীবনে একটি বাড়ি হারিয়ে গেছে। খুবই গুরুত্বপূর্ন বাড়ি। আমি ২০০৭ সালে প্রথম বাড়ি ছাড়ি। এই দেখুন, এতবার বাড়ি বলছি, আপনি হয়ত বুঝতে পারছেন না আমি কিসের কথা বলছি। আমি ২০০৭ এ প্রথম মা বাবাকে ছেড়ে আলাদা থাকি। ততদিন আমার বাড়ি ছিল কখনো বর্ধমানের কোয়ার্টার, কখনো শকুন্তলা পার্কের ফ্ল্যাট। ২০০৭ এ আমার বাড়ি হয় ফ্লোরিডার গেন্সভিলের এক টাউনহাউস। বিশ্বাস করুন, আমিও জানতাম না টাউনহাউস মানে কি। আমাদের কমপ্লেক্সের নাম ছিল সান হার্বার। বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার দুটি বাস ছিল -- ১৬ আর ১৭। দোতলা বাড়ি। একতলায় রান্নাঘর, একটি ছোট শৌচালয়, এবং বাইরের ঘর বা লিভিং রুম। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলে দুটি বেডরুম এবং একটি স্নানঘর। আমি থাকতাম পশ্চিমমুখী ঘরে। আমার রুমমেট সায়ক থাকত পূর্বমুখী ঘরটিতে। আমরা যখন প্রথম যাই, আমাদের সঙ্গে অনিরুদ্ধদাও থাকত। ২০০৭ এ বাড়িটির রং ছিল সাদা, আর লাল দরজা।

আমার যেন রোজকার রুটিন হয়ে গিয়েছিল সকালে বাড়ির তালা লাগিয়ে হেঁটে রাস্তা পেড়িয়ে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে বাস ধরা। ফেরার সময় আবার বাস স্ট্যান্ড থেকে হেঁটে বাড়ি ফেরা। আপনাদের হয়ত মনে হতে পারে এই ক্লিশে রোজকার যাতায়াত নিয়ে কেন লিখছি। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় ঐ ক্লিশে জিনিসটাই যদি আবার ফেরত পেতাম। 

মনে আছে, আমাদের দরজার একটু দূরে একটি ময়লা ফেলার জায়গা ছিল। রাত্রিবেলা সেখানে র‍্যাকুনের দল আসত। কয়েকবার ছবি তুলতে গিয়ে পারিনি। আমরা গাড়ি কেনার পড় বাড়ির সামনে রাখতাম। গবেষণার শেষদিকে কাজের প্রচণ্ড চাপ চলছিল। বাধ্য হয়ে রাত করে ফিরতাম ল্যাব থেকে। বাড়ির সামনে গাড়িটি যখন পার্ক করতাম, মনে হত যাক বাড়ি ফিরেছি, সারাদিনের ঝক্কি শেষ। পাঁচ বছরে আমি বাড়ি পাল্টায়নি। ঐ বাড়িতেই আমার বহু বন্ধু এসেছে, থেকেছে। জন্মদিনে কেক কাটা, একসাথে সিনেমা দেখা, ওয়ার্ল্ড কাপ, ইউরো কাপ দেখা কত স্মৃতি। 

২০১২-তে আমি যখন ব্যাঙ্গালোর ফিরি, ঐ বাড়িটা বার বার মিস করতে থাকি। কতবার যে গুগল ম্যাপ্সে গিয়ে স্ট্রিট ভিউ করে বাড়ির সামনে ঘুরে আসি। ২০১৬ নাগাদ বাড়িটি ভাঙা হয়। ওর জায়গায় নতুন লাক্সারি কমপ্লেক্স তৈরি হয়। আমি ভাবিনি আবার কোনদিন গেন্সভিল যেতে পারব। ২০১৮-তে যাই। প্রথমেই নিজের পুরনো বাড়ির কাছে যাই। বাড়ি আর নেই। আমার সেই বাড়ি হারিয়ে গেছে। আর কোনদিন চাইলেও আমি ফিরতে পারবনা। এখন শুধুই স্মৃতি আর গুগল ম্যাপ্সের টাইমলাইন স্ট্রিট ভিউ। তবু মনে হয় টাইম মেশিন পেলে একবার ফিরে যেতাম সেই ২০১০ এর গেন্সভিল। সেই ১৬ নম্বর বাসে চেপে বাস স্ট্যান্ডে নেমে বাড়ির দিকে হাঁটতাম। 

No comments:

Post a Comment