ইন্টার্নশিপের অফারটা পেলাম ২০০৮-এর ফেব্রুয়ারির শেষে। এতদিন সেলফোন ছিলোনা। এবার নিলাম। একটা ক্রেডিট কার্ড-ও এপ্লাই করেছিলাম। সেটা পেলাম। বলা হয়নি এর মধ্যে আমার একটি পেপার এক্সেপ্টেড হয়েছে। সেটি পড়তে যেতে হবে অরল্যান্ডো। আমরা যেখানে থাকতাম, অর্থাৎ গেন্সভিল থেকে অরল্যান্ডো মাত্র ২ ঘণ্টা দূর। মে মাসে আমি আর আমার গাইড গেলাম পেপার পড়তে। সেই প্রথম এরকম স্তরের কনফারেন্স আমার। কত লোক। দূর দূরান্ত থেকে এসেছে। আলাপ হল। পেপার পড়লাম। প্রশ্ন করল লোকজন। উত্তরও দিলাম। সেখানে আলাপ হল দক্ষিণ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ডঃ সংযুক্তা ভঞ্জর সাথে। উনি আমার নাম শুনে বললেন -- "আরে আমার ছেলের নাম-ও তো কণাদ!!"
বিকেল বেলা কনফারেন্স করে ফিরে এলাম। পড়ন্ত বিকেলের আলোতে গাড়িতে বসে বসে সবুজ ফ্লোরিডা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, আর তো কয়েকদিন, তারপর আমার যাত্রা সোনালি রাজ্যে -- ক্যালিফোর্নিয়ায়। সেখানে কী এই সবুজ বনানী, এই বিস্তীর্ন জলভূমি দেখতে পারব? এর মধ্যে একটা মজার কথা বলি। ইন্টেলের নিয়ম ছিল ইন্টার্নদের জয়েন করার আগে ড্রাগ টেস্ট করতে হবে। তো সেই মত আমি গেলাম হাসপাতালে। জানতাম না ড্রাগ টেস্ট কাকে বলে। গিয়ে শুনলাম মূত্র বিসর্জন করতে হবে। এবার আমার সেই সময় মূত্র ত্যাগের মত অবস্থা না। রিসেপ্সনিস্ট বলল -- "জল খাও, পাশেই ফিল্টার আছে।" এবার আমেরিকানদের একটা খুব বিরক্তিকর স্বভাবের কথা বলি। এরা জল বলতে ঠাণ্ডা জল খায়। আমি আবার বেশী ঠাণ্ডা জল খেতে পারিনা। অতএব প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করে শৌচালয় যাত্রা করলাম।
আমার ক্যালিফোর্নিয়ার ফ্লাইট ছিল অরল্যান্ডো -- ডেনভার -- স্যাক্রাম্যান্টো। আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম ওখানে এক তামিল ছেলের সঙ্গে থাকব। নাম দশরথারামান চন্দ্রমৌলী, সংক্ষেপে দশা। দশা আমার এক সপ্তাহ আগেই জয়েন করবে। সে উত্তর ক্যারোলিনা রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নির্দিষ্ট দিনে আমার রুমমেট অনিদা আমাকে অরল্যান্ডো বিমানবন্দরে পৌঁছে দিলো। সেখান থেকে লম্বা ফ্লাইট করে ডেনভার। কলোরাডো রাজ্যটা কি সুন্দর সেটি প্লেন থেকেই দেখতে পেলাম। কলোরাডোতে আমার প্রায় ৩ ঘণ্টা মত সময় ছিল। এয়ারপোর্টে ঘুরতে লাগলাম। এক জায়গায় দেখলাম জুতো পালিশ চলছে। ব্যাপারটা খুব মজা লাগল দেখে। বেশ কিছু উঁচু উঁচু চেয়ারে লোকে বসবে, জুতো খুলবেও না। আর কিছু লোক সেটা পরিষ্কার করে দেবে। মনে পড়ল ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে বিরজু আসত প্রতি রবিবার জুতো পরিষ্কার করতে। কতদিন বিরজুর খবর পাইনা। বেঁচে আছে কিনা কে জানে। আমার জীবনের অনেক কিছুর মতই বিরজু একদিন না বলে হারিয়ে গিয়েছিল। বলেও যায়নি আর দেখা হবে না।
একটা আইসক্রিমের দোকান দেখে এগোতেই এই ভারতীয় ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। নাম হিতেশ লাথ। গুজারাটের লোক। স্যান হোশেতে চাকরি করেন। অনেকক্ষণ গল্প হল। একসাথে আইসক্রিম খেলাম। দেশের কথা, ক্যালিফোর্নিয়ার কথা, কলেজের কথা, চাকরির কথা, শাহরুখ খান, কুমার শানু, কিছুই বাকি রইল না। মনে হচ্ছিল সেই সময়, শুধু সেই কয়েক ঘণ্টার জন্য উনি একমাত্র আমার পরিচিত, আর কেউ না। অবশেষে বিদায়ের সময় এল। উনি আমাকে নিজের একটা কার্ড দিলেন। পরে ওনাকে একদিন মেল করেছিলাম, উত্তরও দিয়েছিলেন। কিন্তু যা হয়, বিরজুর মত হিতেশবাবুও আমার জীবন থেকে একদিন হারিয়ে গেলেন। অথচ সেদিন উত্তর আমেরিকার এক পাহাড়ি শহরের বিমানবন্দরে উনি ছিলেন আমার সবচেয়ে কাছের।
ক্যালিফোর্নিয়ার রাজধানী স্যাক্রাম্যান্টো। যখন পৌঁছালাম তখন রাত প্রায় ৭:৩০। এয়ারপোর্টেই খেয়ে নিয়েছিলাম। একটা শাটল বলা ছিল। তাতেই উঠলাম। কিন্তু শাটল একে এলো দেরী করে। তার উপর আমি শেষ স্টপ। অতএব সবাইকে নামাতে নামাতে যখন আমার বাড়ি পৌঁছাল তখন রাত ৯:৩০। দশাকে ফোন করতেই দোতলা থেকে নেমে এলো। আমার ব্যাগ নিয়ে ওপরে উঠতে সাহায্য করল। বাড়িতে পিতজা আছে, খাবো কিনা জিজ্ঞেস করলো। আমি না বললাম, এয়ারপোর্টে খেয়ে এসেছি জানালাম। আমরা যে জায়গাটায় থাকছি সেটি স্যাক্রাম্যান্টোর শহরতলি। নাম র্যাঞ্চো কর্দোভা। পশ্চিমবঙ্গ ও ফ্লোরিডা কাটিয়ে মরুভূমির দেশে এসে বুঝতে পারলাম গরম কাকে বলে। রাত ১০টা তেও প্রায় ৩৮ ডিগ্রী। অতএব স্নান করে শুতে গেলাম। মনে মনে ভাবছিলাম -- আর তো ক'দিন বাদেই আমার জন্মদিন। গতবছর ঐ দিনে আমার যাদবপুরের পরীক্ষা শেষ হয়েছিল। সকালে অয়ন, সপ্তর্ষি, সোমসুভ্রদের সঙ্গে কাটিয়ে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। আর এবার, একা একা এই প্রবাসে সোনালি রাজ্যে কাটাব।
No comments:
Post a Comment