Friday, February 26, 2016

ভারতী

বছর দুয়েক আগে আমার বাড়ির কাজের মেয়ে ভাবিয়া একটি ১২-১৩ বছরের মেয়েকে নিয়ে এলো। আলাপ করালো, তার বোন ভারতী। ভারতী দাদা বৌদির সঙ্গে থাকতে এসেছে। রোগা, ছোট খাটো মেয়েটিকে দেখে মায়া হল। বাড়িতে একটু চকোলেট ছিল, তাই দিলাম। খুশি হয়ে আমাকে "থ্যাঙ্ক ইউ" বলল ভারতী। জানতে চাইলাম স্কুলে পড়ে কিনা। তাতে ভাঙ্গা হিন্দিতে জানাল ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছে। তারপর পড়েনি কেন জিজ্ঞেস করায় লজ্জা পেয়ে হেসে কি একটা বলল। দুর্ভাগ্যবশত আমি কন্নড় ভাষা জানি না, তাই, বুঝলামও না।
 ভাবিয়া আর ভারতীরা আমার বাড়ির নিচেই থাকত। ভারতী শুনলাম আমার বাড়িওয়ালার বাড়িতে কাজ করে। ভাবিয়ার কাছে জানতে চাইলাম ঐ টুকু মেয়েকে কেন কাজে দিল, তাতে এমন ভাবে হাসল যেন প্রশ্নটি করাই আমার মুর্খামি। ভারতী মাঝে মাঝেই আমার বাড়িতে আসত দিদিকে ডাকতে বা কিছু বলতে। হাতের সামনে বিস্কিট, লজেন্স, কিছু থাকলেই দিতাম। একদিন সকালে ভাবিয়া চলে যাওয়ার মিনিট ১০ -এক বাদে এলো। আমাকে বলল দিদি ডাকছে। নিচে যেতে গেলে হেসে উঠে বলল "ভাইয়া, এপ্রিল ফুল।" বলেই জিভ কেটে নিয়ে বলল "সরি ভাইয়া।" ভীষণ অবাক হলাম। আমিও হেসে ফেললাম।
  মাস ৩ এক বাদে ভাবিয়া এসে জানাল কিছু টাকা লাগবে, ভারতীর নাকি বিয়ে।  চমকে জিজ্ঞেস করলাম কত বয়েস ভারতীর। জানতে পারলাম মাত্র ১৪। কেন এত অল্প বয়েসে বিয়ে জানতে চাইলে এবার ভাবিয়া বেশ বিরক্ত হল। আবার কিছু বলল কন্নড়ে যা আমি বুঝলাম না। যা বুঝলাম তা হল কেন ভারতী স্কুল ছেড়েছিল, আর কেনই বা দিদির কাছে এসে ছিল। তখনকার মত টাকা দিয়ে ভাবিয়া কে বিদায় দিলাম। এক বছর বাদে ভারতী আবার ফিরে এল, এবার স্বামীর সঙ্গে। তার স্বামী শুনলাম পাড়ার সুপারমার্কেটে নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি পেয়েছে। ভারতী এবার পুরোদমে কাজে লেগে গেল আশেপাশের দু- তিনটে বাড়িতে। দেখা হতে লাগল আবার। একই রকম হাসিখুশি, যেন তেমন পাল্টায়নি তার জীবন। আমি ভেবে অবাক হতাম যে বয়েসে আমি সাইকেল করে টিউশান পড়তে যেতাম, সে বয়েসে ভারতী কি সুন্দর সংসার করছে।
  কয়েক মাস আগে ভাবিয়া জানাল ভারতী গর্ভবতী। আস্তে আস্তে ভারতী কাজ করা বন্ধ করল। নিচেই থাকত। আমি অফিস যাওয়ার সময় দেখা হত। দিদি, জামাইবাবু, স্বামী সবাই কাজে চলে গেছে। ভারতী একা ঘরে রান্না করছে। আমাকে দেখে হেসে "বাই ভাইয়া" বলত। গত শনিবার থেকে দেখে ভাবিয়াদের বাড়ী বন্ধ। ভাবিয়াও কাজে আসে না। বাড়িওয়ালার কাছে গিয়ে জানলাম, ভারতীর সন্তান প্রসবের জন্য সবাই হাসপাতালে। তাই বলে সাতদিন? বেশ অবাক হয়েছিলাম। আজ বিকেলে পাশের বাড়ীর মহিলা জানালেন ভারতী আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। রক্তের সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ডাক্তারবাবু রক্ত দিলেও তা নিতে পারেনি ভারতী। সন্তান প্রসবের আগেই এই জগতের মায়া ত্যাগ করে।
   খবরটা পাওয়া আর এই লেখাটার মাঝের সময়টা বেশ একটা অদ্ভুত মনের অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেলাম। একদিকে ভীষণ দুঃখ লাগছিল। অন্যদিকে মনে হচ্ছিল, এই আমরা আজ যখন পুরো সময় লড়ে চলেছি, স্বাধীনতার পক্ষে, রাষ্ট্রের পক্ষে, ধর্মের পক্ষে, ভাবাদর্শের পক্ষে; এই লড়াই যেখানে আমরা কে ঠিক, কে ভুল সেই নিয়ে লড়ে যাই; এই ভারতের ভারতীরা বার বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় আমাদের এই লড়াই কতটা প্রহসন; আমরা আসলে সবাই ভুল।

Thursday, February 11, 2016

সরস্বতী পুজো

বাঙালীর বড় প্রিয় উৎসব সরস্বতী পুজো। আমার ব্যক্তিগত ধারণা এই পুজোর জন্য টিন-এজাররা যতটা আগ্রহ ভরে থাকে, আর কারুর বোধহয় তেমন উৎসাহ থাকে না, পুরুতমশাই বাদে। প্রথম শাড়ী, হয়ত বা মায়ের শাড়ী, কিন্তু প্রথমবার শাড়ী পরে যেন নিজেকে বড় বড় লাগে। নতুন কেনা রঙ-চঙে পাঞ্জাবী বা পুজোর সময় কেনা পাঞ্জাবীটা কেচে পরিষ্কার করে নতুন করে তোলা হয়েছে। প্রতিবার-ই মায়ের সঙ্গে ঝগড়া লাগে পাঞ্জাবীর সঙ্গে জিন্স না পাজামা নিয়ে। সকাল সকাল অঞ্জলী দেওয়া, কুল খাওয়া আর সামনে পরীক্ষা থাকলেও এই দিনে পড়াশোনার ছুটি।
 
  আমার পুজো কিন্তু আলাদা ছিল। খুব ছোটবেলা, মানে আট বছর বয়স থেকেই নাস্তিক বলে অঞ্জলী দিইনি। তাই আমার এই গল্প আরো আগের। তখন আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি। ১৯৯১ সাল। আমরা তারাবাগে তিন বার ফ্ল্যাট পাল্টেছিলাম। এটা প্রথম পাল্টানোর পরের গল্প। এক বছরের জন্য আমরা এসেছিলাম এফ-৬ ফ্ল্যাটে ( যারা জানেন না, তারাবাগের ফ্ল্যাটের নামকরণ নিয়ে আমি পরে লিখব; আপাতত মেনে নিন)। ১৯৯১ থেকে ১৯৯২ অবধি আমরা ছিলাম ঐ ফ্ল্যাটটিতে। তিনতলায় ফ্ল্যাট, ওঠা নামা অসুবিধের, তাই এক বছরের মধ্যে একটা দোতলার ফ্ল্যাট পেয়ে যাওয়ায় বাবা এফ-৬ ছেড়ে দিলেন। তারাবাগের ফ্ল্যাট বাড়ি গুলোয় এক এক তলায় দুটি করে ফ্ল্যাট। আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক ভাস্কর চ্যাটার্জি। জেঠু জেঠিমা ছাড়াও থাকতেন ওনাদের তিন ছেলে মেয়ে। বড় মুনমুনদি ( বর্ধমান পৌর বালিকা বিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষিকা), মেজ তাতুনদি ( বর্ধমান হরিসভা বালিকা বিদ্যালয়ের ইংরেজীর শিক্ষিকা) এবং ছোট তাতাইদা ( শান্তিনিকেনের পি এইচ ডি ছাত্র)। আমাদের ঠিক নিচের ফ্ল্যাট মানে এফ-৪ এ থাকতেন অর্থনীতির অধ্যাপক আসিত ব্যানার্জি। তিনি ও তাঁর গিন্নী ( কৃষ্ণা জেঠিমা) ছাড়া ছিলেন তাঁর দুই ছেলে শান্তুদা আর অন্তুদা। অন্তুদা বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটার অধ্যাপক। আসিত জেঠুদের নিচের ফ্ল্যাটে থাকতেন সংস্কৃতের অধ্যাপক পন্ডিতমশাই ( দুর্ভাগ্যক্রমে ওনার আসল নামটা ভুলে গেছি। সবাই ওনাকে ঐ নামেই ডাকত।) পন্ডিতমশায়ের এক মেয়ে সুষমাদি। বাকি ফ্ল্যাটগুলি খালি ছিল।

   আলাপ পরিচয় পর্ব হল। এবার সরস্বতী পুজোয় ফেরা যাক। পুজোটা হত ভাস্কর জেঠুদের বাড়ি। মূলত জেঠিমার উদ্যোগেই পুজো। পূজোর দিন আমার মা আর কৃষ্ণা জেঠিমা সকাল সকাল ভাস্কর জেঠুদের বাড়ি গিয়ে পুজোর জোগাড় করতেন। পুজো করতেন পন্ডিতমশাই। পন্ডিতমশায়ের স্ত্রী আর সুষমাদিও সকাল বেলাই পৌঁছে যেতেন। মুনমুনদি আর তাতুনদিকেও দেখা যেত পুজোর যোগাড় করতে। তাতাইদা শান্তিনিকেতন থেকে আসত না পুজোর জন্য। বাবা নাস্তিক বলে কেউ ডাকতও না। বাবার কাজ ছিল আমাকে ৮টার মধ্যে ঘুম থেকে তুলে তৈরী করে জেঠুদের বাড়ি পাঠানো পুজোর জন্য। অসিত জেঠুও একটু বেলা করে আসতেন। শান্তুদা গুড বয়। সকাল সকাল স্নান করে হাজির অঞ্জলী দিতে। অন্তুদা তখন যাদবপুরে পড়ে। ৯ টা নাগাদ উশকো খুসকো চুলে কোনরকমে একটা পাঞ্জাবী গলিয়ে হাজির হত। চোখ লাল, সবে ঘুম থেকে উঠেছে বা তাও ওঠেনি। অতঃপর জেঠিমার সঙ্গে অন্তুদার এর'ম একটা বার্তালাপ প্রতিবার হতঃ

"অন্তু, স্নান করেছিস?"
"না তো জেঠিমা, এই উঠলাম ঘুম থেকে।"
কৃষ্ণা জেঠিমা -- "দেখুন না, কতবার বলি..."
"দাঁতটা মেজেছিস তো?"
"না জেঠিমা..."
"দেখুন না, কতবার বলি..."
"যা, দাঁত মাজ। তাতুন, অন্তুকে পেস্টটা দে তো। আঙুল দিয়েই মাজ।"

এসব ব্যাপারে সবচেয়ে উদাসীন ছিলেন বাড়ির কর্তা ভাস্কর জেঠু। সকাল বেলা রোজকার মত খালি গায়ে বারান্দায় ব্যাম করতেন। অঞ্জলী দিতেন না। জেঠিমার শত রাগারাগির উত্তর ছিল একটাই -- "স্নান করিনি তো, অঞ্জলী দিলে ঠাকুর যদি রেগে যান! এমনি সরস্বতী দেবীর কৃপায় সংসার চালাই। আর ওনাকে রাগিয়ে কাজ নেই। আমি বরং বারান্দায় গিয়ে বসি।"


তবে আমার প্রিয় সময় ছিল পুজো শুরু হওয়ার আগে। জেঠু আমাকে ডেকে নিতেন বারান্দায়। দুই চেয়ারে পাশাপাশি বসতাম দুজনে। জেঠু আমাকে একের পর এক গল্প বলে যেতেন। আলেকজান্ডারের গল্প, ফা হিয়েনের গল্প, মার্কো পোলোর গল্প, আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতাম। এখন মনে হয় আমার ভ্রমণের নেশা হয়ত তৈরী হয়েছে ঐ সরস্বতী পুজোর দিন এইসব গল্প শুনে। পুজোর প্রসাদ খাওয়ার পর অন্তুদা চলে যেত ঘুমোতে আর আমি আর জেঠু আবার শুরু করতাম আমাদের আড্ডা। দুপুরের খাওয়া অবধি চলত সেই গল্প। তখন আমাদের ইতিহাস পড়ানোই হত না। তাই জেঠুর এই গল্প গুলো যেন আমাকে এক রূপকথার জগতে নিয়ে যেত।


পরের বছর আমরা এফ-৬ থেকে চলে গেলাম। তাতুনদি, তাতাইদার বিয়ে দিয়ে জেঠিমাও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন বছর ১৫ আগে। মুনমুনদিও বিয়ে করল তারপর। জেঠুও অবসর নিয়ে তারাবাগ ছেড়ে চলে গেলেন।জেঠুর সঙ্গে শেষ দেখা বছর ৪-৫ আগে। আমি তখন আমেরিকা থেকে ফিরেছি ছুটি কাটাতে। খবর পেয়ে জেঠু আর মুনমুনদি সপরিবারে এসে হাজির। অনেক গল্পের মাঝে জেঠু আমাকে বললেন -- "বড় হয়েছিস, পারলে পোল্যান্ড যা। ওখানকার কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প গুলো শুনেছি দেখা যায়। দেখে আয়।"

গত বছর আমার পোল্যান্ড ভ্রমণ মূলত জেঠুর উপদেশ মেনেই। ভেবেছিলাম ফিরে এসে জেঠুকে ছবি দেখাব ওখানকার। সময়ের অভাবে জেঠুর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া হয়নি। কাল মায়ের কাছে শুনলাম জেঠু খুব অসুস্থ। ভেন্টিলেশনে আছেন। আশা করি জেঠু খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন, পরেরবার বর্ধমান গেলে আবার আড্ডা বসবে, আবার পথ চলা শুরু হবে মার্কো পোলোর।



Tuesday, February 9, 2016

এক হপ্তা পরে

"কি বলল ডাক্তারবাবু?"
"খুব বেশি হলে আর এক সপ্তাহ।"
"মেসোমশাই এখন কথা বলতে পারছেন?"
"ধুর, চোখই খুলছে না সেভাবে, কথা বলা।"
"হুম। ধরা পড়েছিল যেন কবে? দু বছর আগে, তাই না?"
"হ্যাঁ, প্রায় আড়াই। ডাক্তারবাবু সেটাই বলছিলেন, উনি দেখেননি কাউকে এত দিন টিকে থাকতে। যাকগে, ছাদে চল।"
"চল।"
"একটা ফ্লেক দে তো।"
"এই নে।"
"আর এক সপ্তাহ..."
"দেখ যদি কোনভাবে..."
"সান্ত্বনা দিস না। জানিস, বাবা চলে গেলে কোন জিনিসটা সবচেয়ে মিস করব?"
"এটা বোধহয় জানি। তোকে তো গত কুড়ি বছর ধরে দেখছি। ঐ তুই ক্লান্ত থাকলে মেসোমশাই এসে তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। মনে আছে সেই স্কুলে পড়তে ক্রিকেট খেলে এসে তুই সোফায় পড়ে হাঁপাতিস, আর মেসোমশাই তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি সামনে ছিলাম বলে তুই লজ্জা পেয়ে গেছিলি। বারণ করলি ওনাকে। এ ছাড়াও বহুবার দেখেছি; মনে আছে সেই পুরী বেড়াতে গিয়ে..."
"থাম, ওটা না। আমি সবচেয়ে মিস করব বাবার ওপর চেঁচানোটা।"
"চেঁচানো?"
"হ্যাঁ, যখনই বাবা কিছু ভুল করত, কিছু পারত না, আমি ভীষণ চেঁচাতাম। ঝগড়া বলব না, কারণ বাবা কদাচিৎ চেঁচাত। আমিই রেগে যেতাম। সবচেয়ে হাস্যকর কি জানিস? অনেক সময় আমার নিজের ভুল, বাবার নামে দোষ দিয়ে চেঁচাতাম। যেন তাতে একটা সান্ত্বনা পাওয়া যেত যে আমি কোন ভুল করিনি। আশ্চর্যজনক ভাবে বাবাও যেন সেগুলো মেনে নিত, যে দোষটা বাবারই। লোকে বলে না মাথার ওপর একটা ছাদ সরে যায়; এখন বুঝছি, নিজের ভুলের হিসেব নিজেকেই দিতে হবে রে, কাউকে আর দায়ী করতে পারব না।"




Sunday, February 7, 2016

সুমিতের স্বপ্ন

সুমিতের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ক্লাস সিক্স থেকে। সেই যে স্যার সেবছর আমাকে আর সুমিতকে পাশাপাশি বসতে বললেন, আর সারা বছর আমরা ক্লাসরুমের দ্বিতীয় সারির চতুর্থ বেঞ্চে বসলাম। সুমিতকে বয়সের তুলনায় একটু বড়ই লাগত। অন্তত আমার থেকে তো বড়ই। তখন সবে সাইকেল চালানো শিখেছি। মফস্বলের ছেলেদের কাছে এ এক অন্য স্বাধীনতা। তবু স্কুলে সাইকেলে করে আসার অনুমতি পাওয়া যায়নি। ছোটকার বাইকের পেছনে চেপে স্কুলে আসতে হত। সুমিত কিন্তু সেই বয়সেই নিজে সাইকেল করে স্কুলে আসত। হিংসা করতাম ওকে। আমি অনুমতি পেয়েছিলাম পাক্কা এক বছর বাদে, যখন আমি ক্লাস সেভেন-এ । তাও তো আমাকে ছোটকা নিজে হাতে ধরে সাইকেল চালাতে শিখিয়েছে; সুমিত নিজে নিজেই হাফ প্যাডেল মারতে মারতে শিখেছে। একদিন ক্লাস শুরু হওয়ার আগে বলে, "জানিস, কাল আমি সাইকেল চালিয়ে গাংপুর গেছি।"
   আমাদের বর্ধমানের পরের স্টেশন গাংপুর। তেমন কিছু দূর নয় হয়ত। কিন্তু একটা ক্লাস সিক্সের ছেলে একা একা সাইকেল চালিয়ে সেখানে যাওয়াটা আমার কাছে তার আগের বছর কলকাতায় গিয়ে দেখা "হোম এলোন" সিনেমার সেই ছেলেটার চেয়ে কম অ্যাডভেঞ্চার কিছু মনে হয়নি। খালি ভাবতাম কবে আমিও সাইকেল চালিয়ে গাংপুর যাবো। দুঃখের কথা, আজও সে সাধ অপূর্ণ রয়ে গেছে। সুমিতের যে কথাটা প্রায়ই মনে পড়ে ওর বড় হওয়ার স্বপ্ন। "বড় হয়ে কী হতে চাস?" জিজ্ঞেস করলেই সুমিতের জবাব ছিল, "আমি ট্রেন চালাতে চাই।"
"ট্রেন চালাবি?"
"হ্যাঁ, ট্রেন চালাব। মজা না? ট্রেন চালিয়ে সারা দেশটা ঘুরব। দিল্লী, বম্বে, ম্যাড্রাস, সব যাব। আর তুই কি চাস আগে বল?"
"কাউকে বলবি না তো?"
"না, মা কালীর দিব্যি। বল।"
"আমি মহাকাশচারী হব।"
"রাকেশ শর্মার মত?"
"না, নীল আর্মস্ট্রং-এর মত। উনি যেমন প্রথম মানুষ চাঁদে গেছিলেন, আমিও মঙ্গল গ্রহে পা রাখা প্রথম মানুষ হব। কাউকে বলবি না কিন্তু।"
"আরে না না, বলব না বলছি তো।"
"তুই কি ট্রেন চালাবি? আমাদের কর্ড লাইন সুপার?"
"ফু, আমি তুফান মেল চালাব। পূর্বা চালাব, কালকা চালাব।"
"রাজধানী এক্সপ্রেস চালাবি না।"
"না, ওটা বাজে ট্রেন।"
"সে কি রে? রাজধানী তো সবচেয়ে জোরে চলে।"
"চলুক, যে ট্রেন আমার বর্ধমানে থামে না, সেটা বাজে ট্রেন।"


এরপর একদিন ক্লাস সিক্স শেষ হয়ে সেভেনে পা দিলাম আমরা। সুমিত নয়, আমার পাশে বসল ধীমান। ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত ধীমান আমার পাশেই বসত। অন্যান্য বন্ধুদের মাঝে সুমিত যেন কোথায় হারিয়ে গেল। আসলে আমাদের অনেক ফারাক। সুমিত আমার মত ক্রিকেট খেলতে বা ফেলুদা পড়তে ভালবাসত না। আমি, ধীমান, তন্ময়, দেবাঞ্জনরা যখন মিত্তিরদের মাঠে চুটিয়ে ক্রিকেট খেলছি, বা খেলা শেষে অপ্সরা থিয়েটারের মামলা নিয়ে আলোচনা করছি, সুমিত হয়ত তখন রেল লাইনের পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে কোথাও যাচ্ছে। তারপর একদিন আমিও বর্ধমানের পাট চুকিয়ে দিলাম। কলকাতা, কানপুর ঘুরে এই মার্কিন দেশে এসে থিতু হলাম। বাবার চাকরিও কলকাতার ব্যাঙ্কে। তাই নতুন ফ্ল্যাট কিনে বাবা মাও চলে এল লেকটাউনে। ছোটকাও বেশিদিন থাকল না বর্ধমানে। কাজের সূত্রে চলে গেল দিল্লী। শুধু রয়ে গেল মেজকা আর কাকিমণি। মেজকার মেয়ে পুতুলদিদির বিয়ে হল দুর্গাপুরে, তাই মেজকা শত অনুরোধেও বর্ধমান ছাড়ল না।
   আমার এই বহু বছর বাদে বর্ধমান আসার কারণটা কিন্তু আলাদা। রূপসার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর আর ও দেশে থাকতে ইচ্ছে করল না। প্রথমে তো ভেবেছিলাম চাকরি বাকরি ছেড়ে দেব। কিন্তু আমার সহকর্মী প্রোফেসর গিবস বারণ করলেন। তাই আপাতত স্যাবাটিকাল নিয়ে ভারতবর্ষে। ভাবলাম অনেক বছর বর্ধমান যাইনা। তাই মা-বাবা-আমি তিন জন মিলেই এবার বর্ধমানে। মেজকা তো ভীষণ খুশি। কাকিমণি রোজ নিত্য নতুন রান্না খাওয়াচ্ছে। একটা ভালো, এই বাড়িটা বিশাল। তাই মাঝে মাঝেই আমি তিনতলার কোন ঘরে একা একা থাকি। কেউ ডাকতেও আসে না। দেখছেন আবার বাজে বকছি, গল্পটা তো আমার একা থাকা নিয়ে নয়, গল্পটা তো সুমিতকে নিয়ে।
   সুমিতের সঙ্গে আমার আবার দেখা হল পরশু বিকেলে। বর্ধমান গত কয়েক বছরে এত পাল্টে যাবে আমি ভাবতেও পারিনি। আগে যেমন ছিল শুধুই সাইকেল রিক্সা, এখন পুরো শহরে টোটো ছেয়ে গেছে। টোটো এক ধরনের ব্যাটারি চালিত রিকশা। উঠলেই দশ টাকা ভাড়া, যতদূর খুশি যেতে পারেন। বর্ধমানে বিগ বাজার, ডমিনোজ পিতজা, আইনক্স সিনেমা সব হয়েছে দেখলাম। পুরনো সিনেমা হলগুলি প্রায় সব বন্ধ হয়ে গেছে। সেদিন আইনক্স থেকে একটা সিনেমা দেখে বেড়িয়ে ভাবলাম হেঁটেই বাড়ি ফিরি। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে, তেমন গরমও নেই। মিনিট দুয়েক হাঁটার পর একটা সাইকেল যেন ঘাড়ের কাছে এসে থামল।
"চিনতে পারছিস? তোকে আইনক্সের সামনেই দেখেছিলাম। ডাকলাম, শুনতে পারিসনি বোধহয়।"
চিনতে পারিনি। তবে সাইকেলটার দিকে চোখ যেতেই পারলাম।
"সুমিত না?"
"আরে, তুই চিনতে পেরেছিস। আমি সত্যি ভাবিনি পারবি?"
"তোর সাইকেল দেখে পারলাম। এখনও বদলাসনি?"
"নো স্যার, গত ২০ বছর ধরে সেই সাইকেল। অনেকবার সারাতে হয়েছে। চল, ওই চায়ের দোকানে গিয়ে বসি। তুই এখানকার চা খাস তো?"
"কেন খাব না? চল।"
"না তুই এখন বিদেশি মানুষ ভাই।"
"ধুর, চল, চা খাওয়া যাক। তুই কি এখনও সেই পুরনো বাড়িতেই আছিস, নার্স কোয়ার্টারের কাছে?"
"একদম। কতদিন আছিস, একদিন চলে আসিস। আমার গিন্নী, মেয়ের সাথে তোর আলাপ করিয়ে দেব।"
"তোর মেয়ে আছে? বাহ, কত বড়?"
"এই ৪ বছরের। তোর কি খবর? বিয়ে থা করিসনি?"
বুঝলাম সুমিত জানে না। ইচ্ছে করেই মিথ্যে কথা বললাম।
"নাহ করিনি।"
"কর কর, বুড়ো হয়ে গেলি তো? এই কৃষ্ণ, এদিকে দুটো স্পেশাল চা দে।"
"তা তুই কি চাকরি করছিস?"
"হ্যাঁ রে ভাই, আমার তো জানিস। রেলে আছি।"
"ওহ, কোন স্টেশনে? বর্ধমানেই?"
"আরে না রে ভাই, আমি ড্রাইভার। ট্রেন চালাই। মনে আছে তোকে বলতাম স্কুলে পড়তে। আজই তো সকালে দুন এক্সপ্রেস নিয়ে ফিরলাম। হে হে হে ... এই নে চা।"
গরম চা টা হাতে নিয়ে এক মুহূর্ত যেন থমকে দাঁড়ালাম। এই সুমিত, যে ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখত ট্রেন চালাবে, আজ নিজের স্বপ্ন সত্যি করেছে। আর আমি, আমি যেন সেই গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়া এক সাধারণ মানুষদের একজন, যারা কোন আরামের অবস্থান পেলেই নিজেদের স্বপ্ন ত্যাগ করতে দুবার ভাবে না, বা নিজেদের স্বপ্নটা পাল্টে ফেলে।

একবার চট করে আকাশের দিকে চোখ গেল। মঙ্গল গ্রহে এখনও মানুষের পা পড়েনি।