Thursday, February 11, 2016

সরস্বতী পুজো

বাঙালীর বড় প্রিয় উৎসব সরস্বতী পুজো। আমার ব্যক্তিগত ধারণা এই পুজোর জন্য টিন-এজাররা যতটা আগ্রহ ভরে থাকে, আর কারুর বোধহয় তেমন উৎসাহ থাকে না, পুরুতমশাই বাদে। প্রথম শাড়ী, হয়ত বা মায়ের শাড়ী, কিন্তু প্রথমবার শাড়ী পরে যেন নিজেকে বড় বড় লাগে। নতুন কেনা রঙ-চঙে পাঞ্জাবী বা পুজোর সময় কেনা পাঞ্জাবীটা কেচে পরিষ্কার করে নতুন করে তোলা হয়েছে। প্রতিবার-ই মায়ের সঙ্গে ঝগড়া লাগে পাঞ্জাবীর সঙ্গে জিন্স না পাজামা নিয়ে। সকাল সকাল অঞ্জলী দেওয়া, কুল খাওয়া আর সামনে পরীক্ষা থাকলেও এই দিনে পড়াশোনার ছুটি।
 
  আমার পুজো কিন্তু আলাদা ছিল। খুব ছোটবেলা, মানে আট বছর বয়স থেকেই নাস্তিক বলে অঞ্জলী দিইনি। তাই আমার এই গল্প আরো আগের। তখন আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি। ১৯৯১ সাল। আমরা তারাবাগে তিন বার ফ্ল্যাট পাল্টেছিলাম। এটা প্রথম পাল্টানোর পরের গল্প। এক বছরের জন্য আমরা এসেছিলাম এফ-৬ ফ্ল্যাটে ( যারা জানেন না, তারাবাগের ফ্ল্যাটের নামকরণ নিয়ে আমি পরে লিখব; আপাতত মেনে নিন)। ১৯৯১ থেকে ১৯৯২ অবধি আমরা ছিলাম ঐ ফ্ল্যাটটিতে। তিনতলায় ফ্ল্যাট, ওঠা নামা অসুবিধের, তাই এক বছরের মধ্যে একটা দোতলার ফ্ল্যাট পেয়ে যাওয়ায় বাবা এফ-৬ ছেড়ে দিলেন। তারাবাগের ফ্ল্যাট বাড়ি গুলোয় এক এক তলায় দুটি করে ফ্ল্যাট। আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক ভাস্কর চ্যাটার্জি। জেঠু জেঠিমা ছাড়াও থাকতেন ওনাদের তিন ছেলে মেয়ে। বড় মুনমুনদি ( বর্ধমান পৌর বালিকা বিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষিকা), মেজ তাতুনদি ( বর্ধমান হরিসভা বালিকা বিদ্যালয়ের ইংরেজীর শিক্ষিকা) এবং ছোট তাতাইদা ( শান্তিনিকেনের পি এইচ ডি ছাত্র)। আমাদের ঠিক নিচের ফ্ল্যাট মানে এফ-৪ এ থাকতেন অর্থনীতির অধ্যাপক আসিত ব্যানার্জি। তিনি ও তাঁর গিন্নী ( কৃষ্ণা জেঠিমা) ছাড়া ছিলেন তাঁর দুই ছেলে শান্তুদা আর অন্তুদা। অন্তুদা বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটার অধ্যাপক। আসিত জেঠুদের নিচের ফ্ল্যাটে থাকতেন সংস্কৃতের অধ্যাপক পন্ডিতমশাই ( দুর্ভাগ্যক্রমে ওনার আসল নামটা ভুলে গেছি। সবাই ওনাকে ঐ নামেই ডাকত।) পন্ডিতমশায়ের এক মেয়ে সুষমাদি। বাকি ফ্ল্যাটগুলি খালি ছিল।

   আলাপ পরিচয় পর্ব হল। এবার সরস্বতী পুজোয় ফেরা যাক। পুজোটা হত ভাস্কর জেঠুদের বাড়ি। মূলত জেঠিমার উদ্যোগেই পুজো। পূজোর দিন আমার মা আর কৃষ্ণা জেঠিমা সকাল সকাল ভাস্কর জেঠুদের বাড়ি গিয়ে পুজোর জোগাড় করতেন। পুজো করতেন পন্ডিতমশাই। পন্ডিতমশায়ের স্ত্রী আর সুষমাদিও সকাল বেলাই পৌঁছে যেতেন। মুনমুনদি আর তাতুনদিকেও দেখা যেত পুজোর যোগাড় করতে। তাতাইদা শান্তিনিকেতন থেকে আসত না পুজোর জন্য। বাবা নাস্তিক বলে কেউ ডাকতও না। বাবার কাজ ছিল আমাকে ৮টার মধ্যে ঘুম থেকে তুলে তৈরী করে জেঠুদের বাড়ি পাঠানো পুজোর জন্য। অসিত জেঠুও একটু বেলা করে আসতেন। শান্তুদা গুড বয়। সকাল সকাল স্নান করে হাজির অঞ্জলী দিতে। অন্তুদা তখন যাদবপুরে পড়ে। ৯ টা নাগাদ উশকো খুসকো চুলে কোনরকমে একটা পাঞ্জাবী গলিয়ে হাজির হত। চোখ লাল, সবে ঘুম থেকে উঠেছে বা তাও ওঠেনি। অতঃপর জেঠিমার সঙ্গে অন্তুদার এর'ম একটা বার্তালাপ প্রতিবার হতঃ

"অন্তু, স্নান করেছিস?"
"না তো জেঠিমা, এই উঠলাম ঘুম থেকে।"
কৃষ্ণা জেঠিমা -- "দেখুন না, কতবার বলি..."
"দাঁতটা মেজেছিস তো?"
"না জেঠিমা..."
"দেখুন না, কতবার বলি..."
"যা, দাঁত মাজ। তাতুন, অন্তুকে পেস্টটা দে তো। আঙুল দিয়েই মাজ।"

এসব ব্যাপারে সবচেয়ে উদাসীন ছিলেন বাড়ির কর্তা ভাস্কর জেঠু। সকাল বেলা রোজকার মত খালি গায়ে বারান্দায় ব্যাম করতেন। অঞ্জলী দিতেন না। জেঠিমার শত রাগারাগির উত্তর ছিল একটাই -- "স্নান করিনি তো, অঞ্জলী দিলে ঠাকুর যদি রেগে যান! এমনি সরস্বতী দেবীর কৃপায় সংসার চালাই। আর ওনাকে রাগিয়ে কাজ নেই। আমি বরং বারান্দায় গিয়ে বসি।"


তবে আমার প্রিয় সময় ছিল পুজো শুরু হওয়ার আগে। জেঠু আমাকে ডেকে নিতেন বারান্দায়। দুই চেয়ারে পাশাপাশি বসতাম দুজনে। জেঠু আমাকে একের পর এক গল্প বলে যেতেন। আলেকজান্ডারের গল্প, ফা হিয়েনের গল্প, মার্কো পোলোর গল্প, আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতাম। এখন মনে হয় আমার ভ্রমণের নেশা হয়ত তৈরী হয়েছে ঐ সরস্বতী পুজোর দিন এইসব গল্প শুনে। পুজোর প্রসাদ খাওয়ার পর অন্তুদা চলে যেত ঘুমোতে আর আমি আর জেঠু আবার শুরু করতাম আমাদের আড্ডা। দুপুরের খাওয়া অবধি চলত সেই গল্প। তখন আমাদের ইতিহাস পড়ানোই হত না। তাই জেঠুর এই গল্প গুলো যেন আমাকে এক রূপকথার জগতে নিয়ে যেত।


পরের বছর আমরা এফ-৬ থেকে চলে গেলাম। তাতুনদি, তাতাইদার বিয়ে দিয়ে জেঠিমাও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন বছর ১৫ আগে। মুনমুনদিও বিয়ে করল তারপর। জেঠুও অবসর নিয়ে তারাবাগ ছেড়ে চলে গেলেন।জেঠুর সঙ্গে শেষ দেখা বছর ৪-৫ আগে। আমি তখন আমেরিকা থেকে ফিরেছি ছুটি কাটাতে। খবর পেয়ে জেঠু আর মুনমুনদি সপরিবারে এসে হাজির। অনেক গল্পের মাঝে জেঠু আমাকে বললেন -- "বড় হয়েছিস, পারলে পোল্যান্ড যা। ওখানকার কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প গুলো শুনেছি দেখা যায়। দেখে আয়।"

গত বছর আমার পোল্যান্ড ভ্রমণ মূলত জেঠুর উপদেশ মেনেই। ভেবেছিলাম ফিরে এসে জেঠুকে ছবি দেখাব ওখানকার। সময়ের অভাবে জেঠুর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া হয়নি। কাল মায়ের কাছে শুনলাম জেঠু খুব অসুস্থ। ভেন্টিলেশনে আছেন। আশা করি জেঠু খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন, পরেরবার বর্ধমান গেলে আবার আড্ডা বসবে, আবার পথ চলা শুরু হবে মার্কো পোলোর।



No comments:

Post a Comment