Sunday, May 31, 2020

প্রবাসীর ডায়রি ৩ঃ যাত্রাপথে

ইমিগ্রেশন করে যখন গেটের দিকে এগোলাম, পিছন থেকে একটা ডাক শুনলাম

-- তুই কণাদ না?

তাকিয়ে দেখি প্রাঞ্জলদা। প্রাঞ্জলদা আমার সঙ্গে ফ্লোরিডা যাচ্ছে অঙ্কে পিএইচডি করতে। অর্কুটে আলাপ ছিল। সামনে প্রথম দেখা। প্রাঞ্জলদা সঙ্গে যাচ্ছে জেনে মন ভালো ছিল বটে, কিন্তু একটু বাদেই জানতে পারলাম ও অন্য প্লেনে যাবে। মানে ফ্রাঙ্কফুর্ট অবধি একসাথে। তারপর আমি ওয়াশিংটন ডি সি। ও মায়ামি। তবু দুজনে কলকাতা এয়ারপোর্টে গেটের সামনে বসে আড্ডা দিলাম। তখন এয়ারপোর্টে একটি ফ্রি ফোন থাকত। শুধু লোকাল কল করা যেত ২ মিনিটের জন্য। একবার গিয়ে মা বাবার সাথে কথা বলে এলাম।

খানিকক্ষণ বাদেই হাজির হল ত্রিশিখিদি। বলেছিলাম আগেই, ত্রিশিখিদি আমাদের তারাবাগের কণিকাকাকিমার ভাইয়ের শ্যালিকা। তখন রাখি ছিল। দিদি তাই আমার জন্য এক বাক্স ক্যাডবারি সেলিব্রেশন নিয়ে এসেছিল। সেটা যদিও পরে আমাদের বেশ কাজে দিয়েছিল। যাই হোক, সে গল্প পরে। এ ছাড়াও এয়ারপোর্টে আলাপ হল আমার যাদবপুরের সিনিয়ার সোমদত্তাদি আর ওর মায়ের সঙ্গে। সোমদত্তাদি ওহায়োতে পড়ে। ২০১০-এ সোমদত্তাদির বাড়ি গিয়েছিলাম ম্যাসাচুসেটসে। ততদিনে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ওর বর ম্যাসাচুসেটসে আর্মহার্স্ট শহরে পিএইচডি করে।

এবার ঘোষণা হল প্লেনে ওঠার জন্য। বাবা যেমন বলেছিল, সেরকম এয়ারব্রিজের ভিতর দিয়ে আমি প্লেনে উঠলাম। এই প্রথম প্লেনে উঠলাম। বসার ব্যবস্থা ছিল ২-৫-২। আমি দু'জনের সিটে ধারে বসেছিলাম। পরে জেনেছি ওটাকে আইল সিট বলে। আমার পাশে এক অসমীয়া ভদ্রলোক বসেছিলেন। বললেন মেয়ের কাছে যাচ্ছেন। পোর্টল্যান্ড। তখন জানতামই না পোর্টল্যান্ড কোথায়। কে জানত আর চার বছর বাদে আমি ৩ মাসের উপর পোর্টল্যান্ডে থাকব।

প্লেনে ওঠার খানিকক্ষণের মধ্যেই খেতে দিল। বেশ খিদে পেয়েছিল বটে। সেই কখন ডিনার করেছি বাড়িতে। তবে খেতে গিয়ে মুস্কিল। জার্মান রুটি কি শক্ত। দাঁত ফোটানো যায়না। আর তার ক'দিন আগেই আমার দাঁতের অপারেশন হয়েছিল। কষ্ট করে খেলাম। ড্রিকন্স দিতে এসেছিল। কোকা কোলা নিলাম। প্লেনে তখন প্রতি সিটের সামনে টি ভি হতনা। কয়েকটা সিট ছেড়ে ছেড়ে মাঝে একটা করে বড় টিভি। সেই টি ভিতে শ্রেক দিয়েছিল। খানিকক্ষণ দেখলাম। তারপর ঘুমাতে গেলাম। যদিও ভালো ঘুম এলোনা। বার বার চিন্তা হতে লাগল আমার ব্যাগটা কেউ চুরি করে নেবে না তো?

সকালবেলা যখন ফ্রাঙ্কফুর্টে নামলাম তখন সকাল। উপর থেকে জার্মানিকে অসাধারণ লাগছিল। আমার সেই প্রথম বিদেশ দর্শন। ছোট ছোট বাড়ি। আর রাস্তা দিয়ে ছোট ছোট গাড়ি যাচ্ছে। পুরো মনে হচ্ছিল আমার ছোটবেলার হট উইলসের গাড়ি। ফ্রাঙ্কফুর্টে আমার ৬ ঘণ্টা স্টপ। ত্রিশিখিদির সাড়ে ৬ ঘণ্টা। কলকাতায় আলাপ হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা দেবশ্রীদির সঙ্গে। দেবশ্রীদির সাড়ে ৫ ঘণ্টা। তিনজন মিলে ফ্রাঙ্কফুর্টে একসঙ্গে বসে আড্ডা দিতে লাগলাম। তবে ত্রিশিখিদি খানিকক্ষণেই ঘুমিয়ে পড়ল। তখন আমি আর দেবশ্রীদি মিলে এয়ারপোর্ট ঘুরতে লাগলাম। একটা পে ফোন বুথ দেখে দেবশ্রীদি বলল -- "কণাদ, ফোন করবে বাড়িতে?"

দেবশ্রীদির কলিং কার্ড দিয়ে ফোন করলাম। মার সঙ্গে কয়েক সেকেন্ড কথা হল। তখন আমি বুঝতে অস্বীকার করেছিলাম যে ১২ সেকেন্ড কথা বলা আর ৫২ সেকেন্ড কথা বলার মধ্যে কোন তফাত নেই। একই দাম কাটবে। ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে আমি অনেক ইহুদি লোকজনকে দেখলাম তাদের নিজস্ব পোশাকে। ঘুরতে ঘুরতে আমরা ফিরে এলাম ত্রিশিখিদির কাছে। ত্রিশিখিদি তখন ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। সবার খিদে পেয়েছে হাল্কা। অতএব সেই ক্যাডবেরি সেলিব্রেশন খোলা হল। সবাই মনের আনন্দে তাই ভক্ষণ করলাম।

এবার বিদায় নেয়ার পালা। দেবশ্রীদি আগে বিদায় নিল। তারপর আমি।

এবার প্লেনে খুবই খারাপ সিট পেলাম। এবারে বসার ব্যবস্থা ছিল ৩-৪-৩। আমি একটি তিনের মাঝখানে বসেছিলাম। আমার এক ধারে একটি পোলিশ ছেলে। আমার অন্য পাশে একটি ভিয়েতনামি মেয়ে। বর্ধমানে ছোটবেলা থেকে ভিয়েতনাম নিয়ে এত কথা শুনেছি বলে উচ্ছ্বসিত ছিলাম, কিন্তু মেয়েটি  প্লেন চালু হতেই নাক ডাকিয়ে  ঘুমাল। পোলিশ ছেলেটি যদিও গপ্পে। জানতে পারলাম ছেলেটি নেভিতে কাজ করে। ভার্জিনিয়া যাচ্ছে। আমি জানতে চাইলাম এতদিন বাড়ির বাইরে থাকতে তার মন খারাপ করেনা। ছেলেটি বলল -- "বন্ধু, জাহাজই আমার বাড়ি।" একটি পোলিশ মুদ্রা দিয়েছিল। বহুদিন সেটি আমার সঙ্গে ছিল। এরপর কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল আর খুঁজে পাইনি।

ওয়াশিংটনে নেমে ইমিগ্রেশন করে লাগেজ আইডেন্টিফাই করতে হল। লাগেজ জমা দেওয়ার সময় এক ভদ্রলোক আমাকে "হাউ আর ইউ ডুইয়ং মাই ফ্রেন্ড?" বলায় আমি কি বলব বুঝিনি। এরকম অপরিচিত লোক কেমন আছি আগে কোনদিন জানতে চায়নি।

টার্মিনাল পাল্টে নতুন বোর্ডিং পাস নিয়ে আমি গেটের সামনে এলাম। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। একটা মেক্সিকান দোকান দেখে খেতে গেলাম। কিন্তু মুস্কিল হল কোন খাবারই তো আমি চিনিনা। তাই কিছুটা ন্যাচোস নিলাম। সমস্যা হল টাকা দিতে গিয়ে। আমি একটা দশ ডলারের নোট দিতে মেয়েটি কিছু খুচরো করে দিল। কিন্তু আমি তো মার্কিন মুদ্রা চিনিনা। এদিকে কেউ আমাকে ঠকাক সেটাও চাইব না। তাই মেয়েটিকে বললাম আমাকে বোঝাও কোনটি কি। ভাগ্যিস আসে পাশে আর কোন খদ্দের ছিলনা।

এই প্লেনে সবচেয়ে খারাপ জায়গায় বসলাম। মাঝের তিন জনের সিটের ঠিক মাঝে। ২ ঘণ্টার প্লেন যখন অরল্যান্ডো এয়ারপোর্টে পৌঁছাল, তখন রাত ১০টা। গেন্সভিলের এক সিনিয়ার দাদার বাড়িতে এক সপ্তাহ থাকব ঠিক ছিল। দাদা এয়ারপোর্টে এসেছিলেন আমাকে নিতে। দাদার বাড়ি যখন পৌঁছালাম তখন মধ্যরাত। কোনওরকমে রাতের ডিনার করে শুয়ে পড়লাম। মার্কিন মাটিতে প্রথম রাতে আমার চোখে, মাথায়, শরীরে, মানে অনুপামদার গানে যেখানে যেখানে "তুমি মেখে আছো" হয়, সেসব জায়গায় শুধুই ঘুম ছিল। 

Sunday, May 10, 2020

লবাব

এ অনেকদিনের পুরোন গল্প। আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। আমি তখন সবে বর্ধমান মেডিকাল কলেজের থার্ড ইয়ারে পড়ি। আমি তারাবাগে বাড়িতে থেকেই যাতায়াত করি। আমাদের বাড়ির পাশেই একটা গ্রাম, নাম গোদাগ্রাম। ঐ গ্রাম থেকে লোকজন এসে আমাদের পাড়ার সকলের বাড়িতে সাহায্য করতেন। আমাদের বাড়িতে যিনি আসতেন তাঁর নাম কমলাদি। কমলাদির মেয়ে ফুচি। বয়স বছর ৭-৮। স্কুলে টুলে যায় না। বাড়ির কাজকম্ম করে। কমলাদিকে বললে বলে -- "কি হবে বাবু পড়াশুনা করে? তার চেয়ে বাড়ির কাজটা শিখুক। বিয়ে দিতে পারব।"

আমরা কয়েকজন মেডিকাল কলেজের ছাত্র মিলে ঠিক করলাম ছুটির দিনে এরকম ফুচির মত ছেলে মেয়েদের পড়াব। কাউন্সিলার চয়নবাবুর সাহায্যে সে আয়োজনও হয়ে গেল সহজেই। সামান্য অঙ্ক, টাকা পয়সার হিসেব, বাংলা লেখা, ইংরেজি সংখ্যা চেনানো, এসব হত আর কি। ফুচির কিন্তু শেখার ভীষণ আগ্রহ ছিল। আমার মতে প্রচণ্ড শার্প মেয়ে। কমলাদির বড় ছেলে রতন বোধহয় বর্ধমানে রিক্সা চালাত। একদিন মাথায় ভুত চাপে, সব ছেড়ে কলকাতা চলে যায় সিনেমার হিরো হতে। কমলাদি দুঃখ করেন  -- "আমার কপাল, ছেলেটা জলে গেল।" ফুচির কিন্তু দাদাকে নিয়ে ভীষণ গর্ব। "দেখবেন কানুদা, আমার দাদা একদিন প্রসেঞ্জিতের মত হিরো হবে। আপনি আমাকে দাদার সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবেন তো?"

একদিন কমলাদি আমাদের বাড়ি এলেন একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে। তাতে গোটা চারেক ছানার কেক। মা জিজ্ঞেস করে -- "কি হল কমলা?"
"আর বৌদি, কি বলবো। আমার ছেলে সিনেমায় চান্স পেয়েছে। রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে। পরের বছর বেরোবে।"
"সেকি গো? দারুণ খবর তো।"

ফুচি আমাদের ছুটির ক্লাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে গেল। "জানেন, আমার দাদার সাথে দেবশ্রী রায় সিনেমা করতে চায়, কিন্তু দাদার শতাব্দীকেই পছন্দ।"
"সেকি? কেন? দেবশ্রী খারাপ কি?"
"নাহ, আমার শতাব্দীকে ভালো লাগে। আপনার কাকে ভালো লাগে কানুদা?"
"মাধুরী।"
"যাহ, আপনি তো আবার শুধু হিন্দি সিনেমা দেখেন।"

ক'দিন যেতে না যেতেই শুরু হল
"আর কয়েক বছর যাক, দাদা এবার বম্বেও যাবে। দেখুন না, দাদা, মিঠুন আর মাধুরী মিলে সিনেমা করবে। আপনি আমায় দেখাবেন কানুদা?"
"ফুচি, অনেক বকেছিস। এবার হাতের লেখা দেখা।"

এরকম করে একদিন ফুচির দাদার সিনেমা বেরোল। নাম "নবাব"। কমলাদি আমাদের বাড়ি এসে বললেন -- "বৌদি, জানো রতনের সিনেমা বেরোচ্ছে শুক্রবার। লবাব। এস্টার-এ আসছে। আমরা তো গ্রাম থেকে সবাই মিলে যাবো। আমাকে শুক্রবার দিন ছুটি দেবে?"
"হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়। ফুচিও যাবে?"
"না বৌদি, ওর ঐটুকু বয়স, যদি হলে ঢুকতে না দেয়। আমি ওকে এসে গল্প বলব। রঞ্জিত মল্লিক আছে, সন্ধ্যা রায় আছে।"

ফুচির পরের দু'দিন ক্লাসে ভীষণ মন খারাপ। আমি শেষকালে বললাম "দাঁড়া এবার পুজোয় যখন পাড়ায় পর্দা ফেলে সিনেমা দেখানো হবে, তখন আমি নবাব নিয়ে আসব।"
"সত্যি কানুদা? আপনি লবাব আনবেন তো?"
"আনব। তবে ওটা লবাব না ফুচি, ওটা নবাব।"

শনিবার দিন কমালাদি সিনেমা দেখে এলেন। মা প্রথমেই জানতে চাইল -- "কেমন ছিল সিনেমা?"
"ঐ একরকম। যা হয় বাংলা সিনেমায়। শুধু মারামারি। বাদ দাও বৌদি। বলছি আজকে আলুগুলো কি ডুম ডুম করে কাটব না সরু সরু করে?"
মা যা বোঝার বুঝে গেল। সমস্যা হচ্ছে, মা আমাকে বলেনি। বললে আমি আমিয়বাবুকে হাতে পায়ে ধরে পুজোর সময় নবাব আনতে বলতাম না।

পুজোর সময় আমাদের পাড়ায় মাঠে পর্দা ফেলে সিনেমা দেখানো হয়। একই দিনে দুটো সিনেমা। এবার প্রথমে ছিল সপ্তপদী। তারপর হবে নবাব। সিনেমা শুরুর আগেই ফুচি এসে হাজির। একটা ফাঁকা চেয়ার দেখে ওকে বসতে বললাম। ফেবেছিলাম ওর পাশে বসেই সিনেমা দেখব। কিন্তু তার আগেই আমার অন্য বন্ধুরা টেনে নিয়ে গেল। সিনেমা শুরু হল। রতনকে আমি চিনি। আগে দেখেছি। তাই মুখ জানি। একটু বাদেই রতনকে দেখতে পেলাম পর্দায়। সৌমিত্র ব্যানার্জি একটা চায়ের দোকানে বসে কিছু ছেলের সঙ্গে মাস্তানি করছি। একটি মেয়ের শাড়িতে চা ফেলে ইভ টিজিং করে। এই ইভ টিজারদের দলে ছিল রতন। লাল সাদা ডোরাকাটা একটা টার্টলনেক গেঞ্জি পরিহিত রতন কিছুক্ষণ বাদেই লবাবরুপি রঞ্জিত মল্লিকের হাতে বেধড়ক মার খেল। সে দৃশ্য দেখেই ফুচির জন্য মন কেমন করল। ওর চেয়ারের দিকে তাকাতেই দেখি ফুচি কাঁদতে কাঁদতে চেয়ার ছেড়ে ছুটে পালাল।

বেশ কিছুদিন ক্লাসে আর আসেনি ফুচি। তারপর একদিন এলো। আমার সঙ্গে চোখে চোখ রাখতে লজ্জা পাচ্ছিল। আমি কিছুই হয়নি এরকম ভাব করে, "ফুচি, ৫ এর নামতা বল" বলে শুরু করলাম।

ক্লাসের শেষে ফুচি আমাকে ডাকল - "কানুদা, দাদা হয়ত বম্বে যেতে পারবে না, কিন্তু শতাব্দীর সঙ্গে সিনেমা করবে বলুন?" 

Thursday, May 7, 2020

প্রবাসীর ডায়রি ২ঃ যাত্রা শুরু

টি ভি এফ-এর "ইয়ে মেরি ফ্যামিলি" সিরিজে একটি দামী কথা বলেছিলেন মোনা সিং। ছেলে কখন বাড়ি ছেড়ে চলে যায় বোঝাই যায় না। মনে হয় পড়তে গেছে, ক'দিন বাদেই ফিরবে। সেই ফেরাটা কোনদিনই আগের মত বাড়ি থাকা হয়না।

কলকাতা পৌঁছে আমি এরকম বাড়ি ছাড়ার জন্য তৈরি হতে লাগলাম। আমার জয় বাংলাটা এক-দু দিনের মধ্যেই সেরে গেল। তারপর একদিন আমরা গেলাম ব্যাগ কিনতে। এখন আমাদের পরিবারে আগে কেউ কোনদিন বিদেশ যায়নি। তাই চেক-ইন লাগেজ কি হতে পারে আমরা ভাবতে লাগলাম। কেউ কেউ বলল হার্ড লাগেজ নিতে, কেউ কেউ বলল সফট লাগেজ। একদিন আমার বড়মামার গাড়ি করে আমরা সকলে, মানে আমি, মা, বাবা, বড় মামা আর মামি মিলে প্যান্টালুন্সে গেলাম ব্যাগ কিনতে। সবাই বলেছিল ভালো ব্যাগ কিনতে -- এত বড় জার্নি, ব্যাগ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অবশেষে আমেরিকান টুরিস্টারের একটা লাল সফট আর একটা নীল হার্ড লাগেজ কেনা হল। দুর্ভাগ্যের কথা, ঐ নীল ব্যাগটি আমেরিকা পৌঁছাতে পৌঁছাতেই ভেঙ্গে যায়। তাই ওটি আর কোনদিন ব্যবহার করতে পারিনি।

সেদিন ব্যাগ কিনে বাড়ি ফিরে বুঝতে পারলাম দাঁতে একটা অস্বস্তি হচ্ছে। পরেরদিন বেহালা চৌরাস্তায় ডাক্তারবাবুকে দেখালাম। উনি দেখে বললেন -- "সর্বনাশ করেছ। তোমার একটা আক্কেল দাঁত দুটো সুস্থ দাঁতের মধ্যে দিয়ে বেরোতে চাইছে; পারছে না। তাই এখানে ইনফেকশন  করেছে। দাঁত তুলতে হবে।"
"কিন্তু আমার যে আর ক'দিন বাদেই আমেরিকা যাওয়া।"
"অসম্ভব। তোমার সুস্থ হতে মিনিমাম এক সপ্তাহ লাগবে। টিকিট পাল্টাও।"

পাল্টানো হল। পার্ক স্ট্রিটের আল্পস ট্র্যাভেলসের মালকিন তাড়াহুড়ো করে একটা সস্তার টিকিট করে দিলেন বটে। কিন্তু আমার সব বন্ধুরা আলাদা চলে যাবে। আমি একা এত বড় যাত্রা করব। পাক্কা দু ঘণ্টা ধরে আমার দাঁতের উপর কসরত চালালেন ডাক্তার বর্মন। যার ফলে আমার নর্মাল খাওয়া দাওয়া পুরো বন্ধ হয়ে গেল ৪-৫ দিনের জন্য। আমি শুধু খেতে পেতাম আইসক্রিম আর রসগোল্লা। প্রথম প্রথম কথা বলাও বারণ ছিল। আসতে আসতে সেসব মিটল।

আমার বাবা কয়েক বছর আগে ইউ জি সির কাজে একবার প্লেনে দিল্লী গিয়েছিলেন। বাবা ফিরে এসে গল্প করেছিলেন। সিকিউরিটি চেকের পর একটা বড় ঘরে সবাইকে বসতে দেয়। তারপর একটা করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন প্লেনের ভেতরে ঢুকে পরা হয়।

১১ই আগস্ট ২০০৭ রাত্রে আমি মনে হয় এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমোতে গিয়েছিলাম। পরেরদিন বেলা করে উঠলাম। মা আমার জন্য দুপুরে আলুপোস্ত করে রেখেছিলেন। মাংস খাওয়ার মত দাঁতের অবস্থা নেই। রাত ১টায় প্লেন। আমাকে সবাই বলে দিয়েছিল -- বড় জার্নি, রেস্ট নে বাড়িতে, দুপুরে ঘুমিয়ে নিস। শুলাম। কিন্তু ঘুম এলো না। বাবা দেখি বাইরের ঘরে একা একা বসে আছে। বাবার কোলে মাথা দিয়ে শুলাম। টি ভি-তে "এই ঘর, এই সংসার" চলছিল। তাই দেখলাম দুজন মিলে। বিকেলবেলা তারাবাগ থেকে কণিকাকাকিমা ফোন করলেন। ওনার ভাইয়ের শালী, ত্রিশিখীদিও আমার সঙ্গে একই প্লেনে ফ্র্যাঙ্কফুর্ট যাচ্ছে। তারপর উনি টরোন্টো যাবেন। ভালোই হল, চেনা জানা কেউ তো থাকল।

সন্ধ্যেবেলা গোপু মামা আর জয়া মাইমা এলেন আমাদের বাড়ি। ওনারা জানতেন না সেদিন আমাদের যাত্রা। গোপুমামা ঠিক করল রাত্রে এয়ারপোর্ট যাবেন আমাদের সাথে। রাত নটা নাগাদ আমরা বেরোলাম। বৃষ্টি পরছিল। প্রথমে গেলাম মামাবাড়ি। দিদাকে প্রণাম করলাম। দিদা জানতে চাইল পুজোতে আসব কিনা।

অবশেষে দুই গাড়ি ভর্তি বেহালাবাসী আমাকে সি অফ করতে দমদম ছুটল। এক গাড়িতে বাবা, গোপুমামা, আমার বড় মামা আর আমার সেজ মামা। অন্য গাড়িতে বড় মামি, ফুল মামির সঙ্গে মা আর আমি। মা পুরো সময়টা আমার হাত ধরে ছিলেন। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি তো বড় হয়ে গেছি। বাড়ির বাইরে, দেশের বাইরে পড়তে যাচ্ছি। দমদমে নেমে সব ব্যাগ গুছিয়ে আবার এক রাউন্ড প্রণাম সেরে আমি গেটম্যানকে টিকিট দেখিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। সবাই বাইরে থেকে হাত নাড়ছিল। কথা দিয়েছিলাম আমার লাগেজ চেক ইন হয়ে গেলে আর একবার কাঁচের ভেতর থেকে হাত নেড়ে যাব। লাগেজের লাইনে আলাপ হল যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপিকা দেবশ্রী দত্তরায়ের সঙ্গে। লাগেজ চেক ইন করে যখন হাত নাড়লাম, সবাইকে দেখতে পেলাম। মায়ের চোখে জলটাও দেখতে ভুল করলাম না। আমার মোবাইল ফোনটা না আনার জন্য আক্ষেপ করলাম। অবশেষে আমি ইমিগ্রেশনের লাইনে অগ্রসর হলাম।