প্রাপক:
শ্রী জাফর পানাহী,
তেহরান, ইরান।
প্রিয় জাফরবাবু,
সালাম।
প্রথমেই বলি আমি কোন সিনেমার ছাত্র নই, কোন পেশাদারী চলচ্চিত্র সমলোচক বা সাংবাদিক ও নই। আমি নিতান্ত এক ছাপোষা চলচ্চিত্র প্রেমী। আপনার সিনেমার সঙ্গে প্রথম পরিচয় বছর ৫-৬ আগে। তখন আমি সবে পারস্য সিনেমা দেখা শুরু করেছি। মাজিদ মাজিদির "বাচ্চা-এ-আসমান" বা "রঙ্গ-এ-খোদা" দেখা শেষ হয়েছে। এক বন্ধুর কাছে শুনলাম আপনার সিনেমা "অফসাইড" এর নাম। ফুটবল নিয়ে সিনেমা। ইরানে নাকি মেয়েদের ফুটবল মাঠে খেলা দেখতে যাওয়া বারণ। ইরান-বাহরিন এর ফুটবল খেলায় কিছু মেয়ে খেলা দেখতে যায় ছেলে সেজে, এবং ধরা পরে, তাদের নিয়েই সিনেমা। দেখলাম সে সিনেমা। মন ছুঁয়ে গেল। তারপর একে একে দেখলাম "ওয়াইট বেলুন", "আয়না", "ক্রিমসন গোল্ড"। প্রতিটি সিনেমাই মুগ্ধ করে। একদিন শুনলাম আপনাকে নাকি ইরান সরকার আর সিনেমা করতে বারণ করেছে। নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে আপনার ওপর। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। তারপর বহুদিন হয়ে গেছে। এর মধ্যে পারস্য দেশের অন্যান্য সিনেমা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সমীরা মখমল্বাফের "আপেল" দেখে অবাক হয়ে ভেবেছি, একটি উনিশ বছরের মেয়ে কি করে এর'ম সিনেমা বানায়!! কিওরাস্তামির "উইন্ড উইল ক্যারি আস", মোহসেন মখমল্বাফের "কান্দাহার" দেখে বার বার ভেবেছি ইরানের মত একটা রক্ষণশীল সমাজে যদি এই সিনেমা তৈরী হয়, আমরা কেন পারি না?
শুনেছিলাম নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও নাকি আপনি আরও দু খানা সিনেমা বানিয়েছেন। দেখা হয়নি একটাও। কাল রাত্রে আপনার সাম্প্রতিকতম ছবি "ট্যাক্সি" দেখলাম। সেই কারণেই এই চিঠি। শুনেছি আপনার বাকি দুই সিনেমা নাকি গৃহবন্দি অবস্থায়, এই প্রথম নাকি আপনি বহিরদৃশ্য করলেন। সিনেমা দেখতে দেখতে যেন অনুভব করছিলাম কতটা কষ্ট, কতটা বেদনা দিয়েছে আপনাকে এই নিষেধাজ্ঞা। ছত্রে ছত্রে আপনি তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন। এই সিনেমায় আপনি এক ট্যাক্সিচালক। ট্যাক্সির সহযাত্রীদের কথায় বার বার প্রকাশ পায় ইরানের সরকারের প্রতি আপনার তীব্র আক্রোশ। যে দেশে মেয়েদের জীবন মাছের জীবনের সঙ্গে তুলনীয়, যে দেশে অপরাধের তারতম্য না দেখেই লোককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়; সেই দেশ, সেই সমাজকে আপনি বার বার আক্রমণ করেছেন।
একসময় ট্যাক্সিতে উঠেছে আপনার ভাগ্নি হানা ( ইংরেজিতে নিস লেখা, ভাইঝি বা ভাগ্নি দুইই হয়, আমি ভাগ্নি ধরলাম)। হানার স্কুলের প্রোজেক্ট একটি সিনেমা বানানো। কিন্তু স্কুলের শিক্ষক বলে দিয়েছেন কিরম সিনেমা বানাতে হবে। আর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক বক্তব্য রাখা যাবে না, ছেলেদের টাই পরানো যাবে না, চরিত্রের নাম ধার্মিক নাম হতে হবে। একসময় গাড়ি চালাতে চালাতে সে সব আর শুনতে চাইলেন না আপনি, বিরক্ত হয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। আসলে এই শিক্ষক যে ইরান সরকার, যারা এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেয় পরিচালকদের ওপর। কিছু পরে আপনার পুরনো সিনেমার অভিনেত্রী ও একিই অভিযোগ করেন। এবং হানাকে বলতে শোনা যায় "ওরা নিজেরাই তো দুঃখ তৈরি করে, তবে তা দেখাতে দেয় না কেন? আমি গুলিয়ে ফেলেছি কোনটা বাস্তব আর কোনটা কল্পনা।" ব্যাথা দেয় জাফরবাবু, হানার কথা আমাদেরও ব্যাথা দেয়। সিনেমার শেষে তো আপনি সেই কথাই বলেন, "সরকার মনে করে না আমার সিনেমা জনসাধারণকে দেখানোর যোগ্য।"
এবার বলি সিনেমায় আমার প্রিয় দৃশ্যের কথা। আপনি ট্যাক্সিতে হানাকে রেখে বেড়িয়েছেন। হানা জানালা দিয়ে দেখে এক সদ্য বিবাহিত দম্পতি গাড়িতে উঠছে, এবং এক পেশাদারী ফোটোগ্রাফার হ্যান্ডিক্যাম দিয়ে তাদের ছবি তুলছে। হানা পুরো দৃশ্যটি নিজের স্কুলের প্রজেক্টের জন্য নিজের ছোট ক্যানন ক্যামেরাতে তুলে রাখছে। হঠাৎ দেখে একটি ছেলে কাঁধে এক বড় বস্তা নিয়ে সেখান দিয়ে যেতে গিয়ে রাস্তা থেকে একটি টাকা কুড়িয়ে নেয়। ঘটনাক্রমে টাকাটি খানিক্ষন আগেই বরের পকেট থেকে পরেছে। ছেলেটি এরপর যখন একটি ডাস্টবিন এর মধ্যে কাজের জিনিস খুঁজতে যায়, হানা তাকে ডাকে আর বলে টাকাটি ফেরত দিয়ে আসতে। তাহলে আত্মত্যাগের মত একটি দরকারি গুণ প্রকাশ পাবে, এবং এটি হানার সিনেমায় কাজে দেবে। হানা ছেলেটিকে নিজের সিনেমার নায়ক করারও প্রস্তাব দেয়। ছেলেটি বলে ওঠে -- "আত্মত্যাগ, দানধ্যান, এসব কি ফালতু জিনিস।" গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে জাফরবাবু, খানিক্ষণের জন্য সিনেমাটা থামাই। অবশেষে ছেলেটি যখন রাজি হয় টাকাটি ফেরত দিতে, তখন ওই পেশাদারী ফোটোগ্রাফার তাকে সরিয়ে দিতে থাকে গাড়ির সামনে থেকে। কি অপূর্ব দৃশ্য। ফোটোগ্রাফারের বড় ক্যামেরাতে ধরা পড়ছে শুধুই দম্পতি, দূরে গাড়ির মধ্যে বসে ছোট ক্যামেরাতে হানা তুলে নিচ্ছে পুরো দৃশ্য। কার ক্যামেরা বড়, কার ছবি বড়। সারাজীবন ওই দৃশ্যটা ভুলতে পারব না জাফরবাবু।
শুনলাম বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে "গোল্ডেন বেয়ার" জেতার পর ট্যাক্সি সম্বন্ধে বিখ্যাত পরিচালক ড্যারেন আফ্রোন্সকি নাকি বলেছেন এই সিনেমা হচ্ছে প্রেমপত্র, এই শিল্প, সমাজ, দেশ, দর্শকের প্রতি আপনার প্রেমপত্র। আমার এই চিঠি হয়ত আপনার কাছে কোনদিন যাবে না, গেলেও হয়ত আপনি বাংলাভাষা বুঝবেন না। তা হোক, আপনি যে ভাষা বোঝেন, যে ভাষায় কথা বলেন, সেই সিনেমার ভাষা, সেই প্রেমের ভাষায় আমাদের মত দর্শকদের সঙ্গে কথা বলুন। আর আমরা মুগ্ধ হয়ে আপনার কথা শুনি।
ভালো থাকবেন। খুদা হাফিজ।
ইতি,
কণাদ
শ্রী জাফর পানাহী,
তেহরান, ইরান।
প্রিয় জাফরবাবু,
সালাম।
প্রথমেই বলি আমি কোন সিনেমার ছাত্র নই, কোন পেশাদারী চলচ্চিত্র সমলোচক বা সাংবাদিক ও নই। আমি নিতান্ত এক ছাপোষা চলচ্চিত্র প্রেমী। আপনার সিনেমার সঙ্গে প্রথম পরিচয় বছর ৫-৬ আগে। তখন আমি সবে পারস্য সিনেমা দেখা শুরু করেছি। মাজিদ মাজিদির "বাচ্চা-এ-আসমান" বা "রঙ্গ-এ-খোদা" দেখা শেষ হয়েছে। এক বন্ধুর কাছে শুনলাম আপনার সিনেমা "অফসাইড" এর নাম। ফুটবল নিয়ে সিনেমা। ইরানে নাকি মেয়েদের ফুটবল মাঠে খেলা দেখতে যাওয়া বারণ। ইরান-বাহরিন এর ফুটবল খেলায় কিছু মেয়ে খেলা দেখতে যায় ছেলে সেজে, এবং ধরা পরে, তাদের নিয়েই সিনেমা। দেখলাম সে সিনেমা। মন ছুঁয়ে গেল। তারপর একে একে দেখলাম "ওয়াইট বেলুন", "আয়না", "ক্রিমসন গোল্ড"। প্রতিটি সিনেমাই মুগ্ধ করে। একদিন শুনলাম আপনাকে নাকি ইরান সরকার আর সিনেমা করতে বারণ করেছে। নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে আপনার ওপর। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। তারপর বহুদিন হয়ে গেছে। এর মধ্যে পারস্য দেশের অন্যান্য সিনেমা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সমীরা মখমল্বাফের "আপেল" দেখে অবাক হয়ে ভেবেছি, একটি উনিশ বছরের মেয়ে কি করে এর'ম সিনেমা বানায়!! কিওরাস্তামির "উইন্ড উইল ক্যারি আস", মোহসেন মখমল্বাফের "কান্দাহার" দেখে বার বার ভেবেছি ইরানের মত একটা রক্ষণশীল সমাজে যদি এই সিনেমা তৈরী হয়, আমরা কেন পারি না?
শুনেছিলাম নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও নাকি আপনি আরও দু খানা সিনেমা বানিয়েছেন। দেখা হয়নি একটাও। কাল রাত্রে আপনার সাম্প্রতিকতম ছবি "ট্যাক্সি" দেখলাম। সেই কারণেই এই চিঠি। শুনেছি আপনার বাকি দুই সিনেমা নাকি গৃহবন্দি অবস্থায়, এই প্রথম নাকি আপনি বহিরদৃশ্য করলেন। সিনেমা দেখতে দেখতে যেন অনুভব করছিলাম কতটা কষ্ট, কতটা বেদনা দিয়েছে আপনাকে এই নিষেধাজ্ঞা। ছত্রে ছত্রে আপনি তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন। এই সিনেমায় আপনি এক ট্যাক্সিচালক। ট্যাক্সির সহযাত্রীদের কথায় বার বার প্রকাশ পায় ইরানের সরকারের প্রতি আপনার তীব্র আক্রোশ। যে দেশে মেয়েদের জীবন মাছের জীবনের সঙ্গে তুলনীয়, যে দেশে অপরাধের তারতম্য না দেখেই লোককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়; সেই দেশ, সেই সমাজকে আপনি বার বার আক্রমণ করেছেন।
একসময় ট্যাক্সিতে উঠেছে আপনার ভাগ্নি হানা ( ইংরেজিতে নিস লেখা, ভাইঝি বা ভাগ্নি দুইই হয়, আমি ভাগ্নি ধরলাম)। হানার স্কুলের প্রোজেক্ট একটি সিনেমা বানানো। কিন্তু স্কুলের শিক্ষক বলে দিয়েছেন কিরম সিনেমা বানাতে হবে। আর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক বক্তব্য রাখা যাবে না, ছেলেদের টাই পরানো যাবে না, চরিত্রের নাম ধার্মিক নাম হতে হবে। একসময় গাড়ি চালাতে চালাতে সে সব আর শুনতে চাইলেন না আপনি, বিরক্ত হয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। আসলে এই শিক্ষক যে ইরান সরকার, যারা এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেয় পরিচালকদের ওপর। কিছু পরে আপনার পুরনো সিনেমার অভিনেত্রী ও একিই অভিযোগ করেন। এবং হানাকে বলতে শোনা যায় "ওরা নিজেরাই তো দুঃখ তৈরি করে, তবে তা দেখাতে দেয় না কেন? আমি গুলিয়ে ফেলেছি কোনটা বাস্তব আর কোনটা কল্পনা।" ব্যাথা দেয় জাফরবাবু, হানার কথা আমাদেরও ব্যাথা দেয়। সিনেমার শেষে তো আপনি সেই কথাই বলেন, "সরকার মনে করে না আমার সিনেমা জনসাধারণকে দেখানোর যোগ্য।"
এবার বলি সিনেমায় আমার প্রিয় দৃশ্যের কথা। আপনি ট্যাক্সিতে হানাকে রেখে বেড়িয়েছেন। হানা জানালা দিয়ে দেখে এক সদ্য বিবাহিত দম্পতি গাড়িতে উঠছে, এবং এক পেশাদারী ফোটোগ্রাফার হ্যান্ডিক্যাম দিয়ে তাদের ছবি তুলছে। হানা পুরো দৃশ্যটি নিজের স্কুলের প্রজেক্টের জন্য নিজের ছোট ক্যানন ক্যামেরাতে তুলে রাখছে। হঠাৎ দেখে একটি ছেলে কাঁধে এক বড় বস্তা নিয়ে সেখান দিয়ে যেতে গিয়ে রাস্তা থেকে একটি টাকা কুড়িয়ে নেয়। ঘটনাক্রমে টাকাটি খানিক্ষন আগেই বরের পকেট থেকে পরেছে। ছেলেটি এরপর যখন একটি ডাস্টবিন এর মধ্যে কাজের জিনিস খুঁজতে যায়, হানা তাকে ডাকে আর বলে টাকাটি ফেরত দিয়ে আসতে। তাহলে আত্মত্যাগের মত একটি দরকারি গুণ প্রকাশ পাবে, এবং এটি হানার সিনেমায় কাজে দেবে। হানা ছেলেটিকে নিজের সিনেমার নায়ক করারও প্রস্তাব দেয়। ছেলেটি বলে ওঠে -- "আত্মত্যাগ, দানধ্যান, এসব কি ফালতু জিনিস।" গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে জাফরবাবু, খানিক্ষণের জন্য সিনেমাটা থামাই। অবশেষে ছেলেটি যখন রাজি হয় টাকাটি ফেরত দিতে, তখন ওই পেশাদারী ফোটোগ্রাফার তাকে সরিয়ে দিতে থাকে গাড়ির সামনে থেকে। কি অপূর্ব দৃশ্য। ফোটোগ্রাফারের বড় ক্যামেরাতে ধরা পড়ছে শুধুই দম্পতি, দূরে গাড়ির মধ্যে বসে ছোট ক্যামেরাতে হানা তুলে নিচ্ছে পুরো দৃশ্য। কার ক্যামেরা বড়, কার ছবি বড়। সারাজীবন ওই দৃশ্যটা ভুলতে পারব না জাফরবাবু।
শুনলাম বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে "গোল্ডেন বেয়ার" জেতার পর ট্যাক্সি সম্বন্ধে বিখ্যাত পরিচালক ড্যারেন আফ্রোন্সকি নাকি বলেছেন এই সিনেমা হচ্ছে প্রেমপত্র, এই শিল্প, সমাজ, দেশ, দর্শকের প্রতি আপনার প্রেমপত্র। আমার এই চিঠি হয়ত আপনার কাছে কোনদিন যাবে না, গেলেও হয়ত আপনি বাংলাভাষা বুঝবেন না। তা হোক, আপনি যে ভাষা বোঝেন, যে ভাষায় কথা বলেন, সেই সিনেমার ভাষা, সেই প্রেমের ভাষায় আমাদের মত দর্শকদের সঙ্গে কথা বলুন। আর আমরা মুগ্ধ হয়ে আপনার কথা শুনি।
ভালো থাকবেন। খুদা হাফিজ।
ইতি,
কণাদ
No comments:
Post a Comment