Tuesday, June 9, 2020

প্রবাসীর ডায়রি ৪ঃ প্রথম দিন

যদি কেউ আমাকে বলে একটা টাইম মেশিন দিয়ে আমার জীবনের কোন একদিন ফিরে যেতে, আমি ফিরব ১৪ই আগস্ট ২০০৭। জীবনে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু ঐ দিনটি বোধহয় আমার জীবনের শেষ স্টেবল পয়েন্ট। যেখানে ফিরে গেলে আমি জীবনটাকে নতুন করে লিখতে পারি।

যাই হোক, সেদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙল একটা অদ্ভুত ঝাঁকুনিতে। যে দাদার বাড়ি উঠেছিলাম গেন্সভিলে, সেই দাদার দু'বছরের ছেলে আমার বিছানায় উঠে পড়ে লাফাচ্ছে। উঠে পড়লাম। স্নান করতে যাওয়ার আগে দাদা দেখিয়ে দিল। এখানে বালতি নেই। শাওয়ারে স্নান করতে হবে। আবার পর্দা টানা আছে। পর্দা ভিতর দিকে টানা। জল যেন বাইরে না পড়ে। এ ছাড়া গায়ে মাখার সাবানের জায়গায় বডি ওয়াশ।

সকালে কর্ন ফ্লেক্স খেয়ে বেরোলাম। দাদা, বউদি, দাদার ছেলে আর আমি। দাদার ছেলেকে প্রথমে ডে কেয়ারে রাখা হবে। ডে কেয়ার জিনিসটা আমি আগে জানতাম না। দেখলাম প্রচুর বাচ্চারা রয়েছে। তাদের সকলের মা বাবারা বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করেন। তাই তারা এখানে রয়েছে। দাদার ছেলেকে রেখে আমি বিশ্ববিদ্যালয় এলাম। এই প্রথম আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয় দেখলাম। ইঁট বার করা বেশ কিছু বিল্ডিং। একটা বড় বাড়িতে দাদা গাড়ি রাখলেন। সেখানে দেখলাম শয়ে শয়ে গাড়ি। সেটি নাকি একটি পার্কিং স্ট্রাকচার। অর্থাৎ এখানে সবাই গাড়ি রাখে। অবশ্য সবাই না। ওখানে গাড়ি রাখতে একটা পারমিট লাগে। যেমন ছাত্র ছাত্রীরা ওখানে গাড়ি রাখতে পারেনা। বড় ক্যাম্পাসটা প্রথম দিন পুরো দেখতে পাইনি। চারদিকে বড় বড় গাছ যেগুলি থেকে একরকম অদ্ভুত তন্তর মত জিনিস ঝুলছে। পরে জেনেছিলাম ওগুলিকে স্প্যানিশ মস বলে। ওরকম গাছ নাকি ফ্লোরিডাতে পাওয়া যায়।

প্রথমেই আমার নিজের ডিপার্টমেন্টে গেলাম। সামনেই হলুদ রঙের বড় বড় আলুভাজার মত কিছু মূর্তি। পরে জানতে পেরেছি এই জেলাটির নাম এলাচুয়া, যেটির ইন্ডিয়ান ভাষায় মানে আলুভাজা। ডিপার্টমেন্টে আমাকে একটি চিঠি দিয়ে বলল ইন্টার্নেশনাল সেন্টারে যেতে। গেলাম। পাসপোর্ট, আই টুয়েন্টি, আর অন্যান্য সব কাগজপত্র দেখানোর পর ওরা আমাকে রেজিস্টার করল। তারপর কিছু বই আর একটা টি শার্ট দিয়েছিল। টি শার্টটি আমার খুব পছন্দের ছিল। ওর দু দিকে পৃথিবীর সকল দেশের পতাকা ছিল। এর পর গেলাম গেটর কার্ড বানাতে। এটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডেন্টিটি কার্ড। সব জায়গাতে এটি চলবে। মানে লাইব্রেরি থেকে বই ধার নিতে গেলে যাদবপুরের মত লাইব্রেরি কার্ড বানাতে হবেনা। এই আই ডি কার্ডেই সব কাজ হবে। ১৫ ডলার দিতে এক ভদ্রমহিলা ছবি তুলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে হাতে কার্ড দিয়ে দিলেন। তারপর বললেন -- "এই কার্ডটি তুমি এ টি এম কার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে পারো।" মানে বুঝলাম না। উনি হেসে বললেন -- "ব্যাঙ্কে যাও। বুঝিয়ে দেবে।"


এবার গেলাম ব্যাঙ্ক একাউন্ট খুলতে। এই প্রথম জীবনে ব্যাঙ্ক একাউন্ট খুলব। ব্যাঙ্কের নাম ওয়াকোভিয়া। পরে তা ওয়েলস ফারগো হয়ে গেছে। ব্যাঙ্কের লোক সব কাজ করে আমার আই ডি কার্ডটা নিয়ে কি একটা করে দিল। তারপর বলল "যতদিন না তোমার আসল কার্ড আসে, এটিকে এ টি এম কার্ড হিসেবে  ব্যবহার করতে পারো।" এবার খেয়াল করলাম আমার আই ডি কার্ডের পিছনে একটা ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ আছে।

দুপুরে আমার গাইডের সঙ্গে লাঞ্চে গেলাম। ওয়েন্ডিজ-এ বার্গার আর ফ্রাইস খেলাম। এই প্রথম জীবনে চৌকো প্যাটির বার্গার দেখলাম। দেশে মঞ্জিনিসে যেটা খেতাম সেটাও গোল হত। সেখানেই শুনলাম পরের সপ্তাহ থেকে নাকি কৃষ্ণ লাঞ্চ শুরু হবে। সেটা কি ভালো বুঝলাম না যদিও। দুপুরের দিকে প্রচণ্ড ঘুম পেল। তবু জেগে থাকলাম কষ্ট করে। এর মধ্যে গাইড একটা ল্যাপটপ দিয়েছেন। বিকেলবেলা দাদা বৌদি এলেন আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। দাদার ছেলেকে তুলে আমরা বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। বাড়ি গিয়ে একটু ঘুমলে বাঁচি। দাদারা কিন্তু বাড়ি গেলেন না। আমাকে নিয়ে গেলেন ওয়ালমার্ট বলে একটা দোকানে। কি বিশাল দোকান!! ঐ দেখেই আমার ঘুম গেল কেটে। কি না পাওয়া যায় সেখানে। জামা কাপড় থেকে শুরু করে বাড়ি সাজানোর জিনিস থেকে সাইকেল, ফুটবল, খাবার জিনিস, প্রায় সমস্ত কিছু। পরে জেনেছি দাদা ইচ্ছে করে আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। জানতেন ঐ দেখলে আমি জেগে থাকব। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হল। ফিরেই জলদি ডিনার করে শুয়ে পড়লাম।

সমস্যা হল তার পরের দিন। ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে চারটেয়। দাদারা তখন গভীর ঘুমে। আমেরিকাতে সূর্য ওঠে প্রায় সকাল ছ'টার পড়। অন্ধকারের মধ্যে কি করব বুঝে পেলাম না। ল্যাপটপ খুলে ইউটিউব চালিয়ে "শ্রীমান পৃথ্বিরাজ" দেখতে বসলাম।


No comments:

Post a Comment