Friday, December 30, 2016

তারাবাগ রহস্য

                                   ।।১।।
বাইরের ঘরের সোফাতে বসে একটা বই পড়ছিল অপু ডোরবেল বাজতে উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখে সামনে দাঁড়িয়ে সুভাষবাবু
আসুন এত দেরি হল আমি তো ভেবেছিলাম সন্ধ্যেবেলা আসবেন
সেরকমই তো ইচ্ছে ছিল হে অপু কিন্তু বুঝতেই পার, আমাদের কাজ যাকগে, টা বাজে তো? খেয়ে নেওয়া যাক নাকি?”
ঠিক আছে, তাই হবে আপনি বসুন, আমি ভাত বারি
বেশি কিছু রান্না করোনি তো?”
নাহ, তেমন কিছু না আপনি তো বলেছিলেন শুধু মাংস করতে
হ্যাঁ, পাঁঠা তো?”
নিশ্চয়
বেশ, চল খাওয়া যাক
এনারা যতক্ষণ খাওয়া দাওয়া করে, আমরা বরং এদের ব্যাপারে জেনে নিই
সুভাষবাবু বর্ধমানের এস আই আর পাঁচ বছর বাদে অবসর নেবেন সে তুলনায় অপু বাচ্চা ছেলে সত্যি কথা বলতে কি, সুভাষবাবুর মেয়ের চেয়ে অপু মাত্র ছয় বছরের বড় সুভাষবাবুর মেয়ে ছন্দা মার্কিন দেশে পড়তে গেছে সুভাষবাবু বিপত্নীক অপুর সঙ্গে সুভাষবাবুর আলাপ এক বছর আগে অপু বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীর অধ্যাপক বছর তিনেক আগে বিশ্বভারতী থেকে পড়াশুনা শেষ করে বর্ধমানে আসে অপু। গতবছর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি খুনের রহস্য উদ্ধার করতে সুভাষবাবুকে সাহায্য করে অপু সেই থেকে এই অসমবয়সের বন্ধুত্ব মাসে একবার করে অপুর বাড়িতে নৈশভোজে আসেন সুভাষবাবু। তার আর একটা কারণ অবশ্য অপুর রান্না। অকৃতদার অপু নিজেই রান্না করে খায়, এবং অসম্ভব ভালো রান্না করে। অপুর রান্নার লোভেই ইউরিক এসিডের আদেশ অমান্য করেও তাই আজ মাংস খেতে এসেছেন সুভাষবাবু।
“চলুন বারান্দায় বসা যাক।“
খাওয়া শেষ হলে সুভাষবাবুকে ডাকে অপু।
“না হে, আজ একটু হাঁটতে যাই চল।“
“হাঁটতে যাবেন?”
“হ্যাঁ, তোমার হাতের মাংস; লোভে পড়ে অনেকটাই খেয়ে ফেললাম। একটু হাঁটলে হজম হবে।“
“চলুন তাহলে। দাঁড়ান, চাবিটা নিয়ে নি।“
তারাবাগ শিক্ষক আবাসন অনেকগুলি ব্লকে বিভক্ত। প্রতিটি ব্লকে ছটি করে ফ্ল্যাট। এক একটি ব্লক তিন তলা, তাই প্রতি তলায় দুটি করে ফ্ল্যাট। অপু থাকে ডি ব্লকের ৪ নম্বর ফ্ল্যাটে। দোতলায় পুবদিক্মুখী এই ফ্ল্যাট। বারান্দায় বসলে সামনে তারাবাগ মাঠ পরিষ্কার দেখা যায়।
বাড়িতে তালা দিয়ে সুভাষবাবুর সঙ্গে নিচে এল অপু। ব্লকের সামনে লাল সুড়কির রাস্তা। রাত হয়েছে। ব্লকের গেটের বাইরের বাতি ছাড়া আর কোন আলো নেই। তাই সামনেটা অন্ধকার বলাই চলে। সুভাষবাবু টর্চ জ্বালালেন।
“সাবধানে এস অপু।“
সুড়কির রাস্তা দিয়ে কয়েক সেকেন্ড হাঁটলেই সামনে পিচের রাস্তা। রাস্তার উল্টোদিকে তারাবাগ মাঠ। মাঠের মাঝেই পাম্প হাউস। পাম্প হাউসটা যেন মাঠটাকে দু ভাগে ভাগ করে রেখেছে। পাম্প হাউসের বাঁ দিকে খোলা মাঠ, দু ধারে শুধু দুটি গোলপোস্ট। অবশ্য ক্রিকেট খেলে খেলে মাঠের মাঝে একটি ঘাস বিহিন পিচের উদয় হয়েছে। পাম্প হাউসের ডান দিকে দুটি কাঠের বেঞ্চি। লোহার বেস। তার সামনে বাচ্চাদের খেলার জায়গা। স্লিপ, ঢেঁকি, ইত্যাদি আছে। মাঠের একদম দক্ষিণপ্রান্তে কিছু গাছ ও তারাবাগের তারের বেড়া।
            পিচ রাস্তায় উঠে বাঁ দিকে হাঁটা শুরু করল অপু ও সুভাষবাবু। রাত হয়েছে, রাস্তার আলো জ্বললেও তারাবাগের মাঠটি যেন অন্ধকারে ঢাকা। এক অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
            “মাঠটা কেমন অন্ধকারে ঢেকে আছে দেখুন। কোন অপিরিচিত লোক এলে ভূতের ভয় পেতেই পারে।“
            “হুম। অন্ধকার ও রহস্য। এই তারাবাগের মাঠে কম রহস্য নেই অপু।“
            “মানে?”
            “আজ থেকে তিরিশ বছর আগে এই তারাবাগের মাঠে এক নৃশংস খুন হয়েছিল, যার খুনী কে আজও আমি জানি না।“
            “সেকি। এটা তো জানতাম না।“
            “তুমি আর কতটুকু জানো। ক’দিনই বা এসেছ এই পাড়ায়।“
            “বেশ। খুলে বলুন। হাঁটতে হাঁটতে শোনা যাক।“




Friday, October 14, 2016

শহীদ

কমলপুরে আজ সকালটা অনেক তাড়াতাড়ি হয়েছে। এমনি কেউ এই গ্রামের খোঁজ রাখে না। কিন্তু আজ সকাল সকাল একে একে টি ভি চ্যানেল আর পত্র-পত্রিকার সাংবাদিকরা এসে হাজির হয়েছে। এই গ্রামের ছেলে সুদেব পরশু কাশ্মীরে শহীদ হয়েছে।

ভারতীয় সেনায় সবে দু' বছর হল যোগদান করেছে সুদেব। এর মধ্যে একবারই বাড়ি এসেছিল। কাশ্মীরের অনেক গল্প করেছিল গ্রামের সকলের কাছে। ছোট থেকে খেলাধূলায় ভালো সুদেব সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে যাওয়ায় গ্রামের লোকে খুব একটা অবাক হয়নি। তবে হ্যাঁ, এই প্রথম গ্রামের কেউ সৈনিক হল, তাই সুদেবকে সবাই আলাদা চোখে দেখত। গ্রামের ছোটদের কাছে সুদেবদা তো হিরো। সারাদিন শুধু সুদেবকের ধরে গল্প শোনাই নয়, সময়ে সময়ে তাকে দেখে কচিকাচার দল স্যালুট ও ঠুকত।

খবরটা পাওয়ার পর থেকে সুদেবের মা শুধু কেঁদেই গেছেন। এখনো কান্না থামেনি। কাল সারারাত গ্রামের কেউই প্রায় ঘুমোতে পারেনি। কেউ কেউ নিজের কান্নায়, আর কেউ কেউ সুদেবের মায়ের কান্নায়।

কর্নেল মুখার্জীর তত্ত্বাবধানে ট্রাকে করে সুদেবের শব এল গ্রামে। মিডিয়ার ভিড় উপেক্ষা করে কফিন আনা হল সুদেবের মায়ের কাছে। তেরঙ্গায় মোড়া সুদেবের দেহ দেখে যেন তার মায়ের কান্না থেমে গেল। হাঁ করে চেয়ে রইলেন সুদেবের মুখের দিকে।

গান স্যালুট হওয়ার পর কর্নেল মুখার্জী এবার নিজে এগোলেন সুদেবের মায়ের দিকে। চারিদিকে ক্যামেরাম্যান গিজ গিজ করছে। তার মধ্যেই আসতে করে গিয়ে বললেন
"আপনার ছেলে দেশের জন্য যে বলিদান দিয়েছে, তা কোনদিন দেশবাসী ভুলবে না। আপনি..."

লাল চোখে কর্নেলের দিকে তাকালেন সুদেবের মা। এক ঝটকায় সুদেবের দেহের থেকে তেরঙ্গা তুলে দিয়ে রেগে বললেন --

"দূর হ। ঝাঁটা মারি তোর দেশের মুখে। আমার ছেলেটাকে ফিরিয়ে দে।"

Sunday, September 25, 2016

গেন্সভিল ডায়রিজঃ কাশফুল

পুজো মানেই কাশফুল। সেই কবে মানিকবাবু দেখিয়ে গিয়েছিলেন অপু-দূর্গা ট্রেনলাইনের পাশে কাশফুল দেখেছিল, তারপর থেকে বাঙালি কাশফুলের প্রতি এক অপত্য স্নেহ বয়ে চলেছে।

আমি ছোটবেলায় খুব একটা কাশফুল দেখিনি। জানতামও না এরকম একটি ফুল হয়। তারাবাগে কাশফুল হত না। হয়ত পাশের ফার্মটায় হত, কিন্তু সেখানে আমার যাওয়া বারণ ছিল, তাই দেখিনি।
ক্লাস ফোরে পড়তে স্কুল থেকে দেখানো হল "পথের পাঁচালী"। সেখানে প্রথম কাশফুল দেখলাম। মানে সেভাবে লক্ষ্য করিনি সত্যি কথা বলতে। লক্ষ্য করলাম যখন পরের সপ্তাহে ড্রয়িং ম্যাডাম এসে বললেন সবাইকে ঐ দৃশ্যটির ছবি বাড়ি থেকে এঁকে আনতে। হোম-ওয়ার্ক। বাড়ি ফিরে বাবাকে বলতে বাবা পুরোনো আনন্দমেলা খুলে ছবিটি বার করলেন। সেই প্রথম ঠিক ভাবে কাশফুল দেখা।

তার পরের বছর পুজোয় কলকাতা যাই। মামারবাড়ি। ট্রেনে করে যেতে যেতে রেল লাইনের ধারে কাশফুল দেখলাম এবার। মনে হল - বাহ, অপুর মত আমিও তাহলে রেললাইনের ধারেই প্রথম কাশফুল দেখলাম।

বহুবছর পরের কথা। ২০০৭। আমি তখন সবে গেন্সভিলে গিয়েছি। গেন্সভিলে পুজো হবে কিনা ভাবতে ভাবতে শুনি হবে। না, এটি গেন্সভিলের পুজোর গল্প না, সেই  গল্প পড়ে বলব। যাই হোক, পুজোর ক'দিন আগে ইস্কনে খেতে গেছি দুপুরে। অতনুদার সঙ্গে দেখা। খেতে খেতে অতনুদা বলল

"আমাদের ডিপার্ট্মেন্টের পাশে কিছু কাশফুল হয়েছে।"

বেশ অবাক হলাম। কাশফুল যে দেশের বাইরে হয়, তাই ধারণা ছিল না। খাওয়ার পর ছুটলাম সয়েল সায়েন্স ডিপার্ট্মেন্টের দিকে। অতনুদা ভুল বলেনি। দেখলাম ডিপার্ট্মেন্টের পাশেই এক দঙ্গল কাশফুল হাওয়ায় দুলছে। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে যেন মনে হল সত্যি এবার পুজো শুরু হবে। ঢাকিরা যেন ঢাক তুলছে বাদ্যি শুরু করার জন্য। পাড়ায় বাঁশ পড়ছে প্যান্ডেল তৈরীর জন্য। আসলে জানেন তো, মানুষ বাড়ির বাইরে বেরোলে
 বাড়িকে সবচেয়ে মিস করে। সবাই করে। প্রথম এক বছর এটা ভীষণ কষ্ট দেয়। তারপর আস্তে আস্তে মানিয়ে নেওয়ার সময়টা আসে। অনেকেই মানিয়ে নেয়, ভাবে "বাড়ি হলে ভালো হত, কিন্তু এটাই বা কম কি?"
কেউ কেউ পারে না, তারা হয়ত বাড়ি ফিরে যায়। সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে যারা মানিয়ে নিতে পারে না, অথচ পরিস্থিতির চাপে ফিরতেও পারে না।

আমি তখন সবে দু'মাস হল বাড়ি ছেড়েছি, কাজেই মন খারাপটা তুঙ্গে। কাশফুল দেখে ওর'ম আকাশপাতাল ভাবছি। হঠাৎ পাশে এক গলা

"Excuse me, can you tell me the way to Marston Science Library?"

ঢাকিরা বাদ্যি নামিয়ে রাখল, মুহূর্তটা নষ্ট হয়ে গেল।

২০১২ তে আমি গেন্সভিল ছাড়ি। ২০১১-র পুজোটা আমার গেন্সভিলে শেষ পুজো। ভেবেছিলাম খেয়াল রাখব সয়েল সায়েন্স ডিপার্ট্মেন্টের কাছে কাশফুল হয়েছে কিনা। নাহ, তালেগোলে ভুলেই গিয়েছিলাম। আর আমার কাশফুল দেখা হয়নি।

জানি না আর কোনদিন গেন্সভিল যেতে পারব কিনা, গেলেও সেখানে কাশফুল দেখব কিনা। হয়ত কাশফুল থাকবে, আমার পর নতুন কোন সদ্য বাড়ি ছাড়া বাঙালি ছাত্রের আবার সেই কাশফুল দেখে বাড়ির কথা মনে পড়বে। 

Monday, August 29, 2016

তারাবাগ ডায়রিজঃ বাপিদা ও বুম্বাদা

আমার জন্ম বজবজে। এক বছর বয়সে তারাবাগে যে কোয়ার্টারে এসে উঠি সেটি ছিল বি- ওয়ান। বাবা বিয়ের পর থেকেই এখানে থাকতেন। ১৯৯১ সালে, মানে আমার যখন ৬ বছর বয়স তখন আমরা বি-ওয়ান ছেড়ে অন্য কোয়ার্টারে যাই। আমাদের ঠিক উপরের ফ্ল্যাটটাতে মানে বি-থ্রিতে থাকতেন শীল জেঠুরা। প্রফেসর বিজয় শীল আর বাবা দুজনেই রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন।
শীল জেঠুর দুই ছেলে, বাপি আর বুম্বা। বাপিদা আমার থেকে অনেকটাই বড়। বুম্বাদা বছর দশেকের। দুজনেই আমাকে ভীষণ ভালবাসত। বাপিদা রোজ বিকেলে পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলতে যেত। শুনেছি আমাকে নিয়ে মা ঘুরতে বেরোলে বাপিদা মাঠ থেকে ছুটে আসত আমাকে আদর করতে। জেঠিমা নাকি বারান্দা থেকে বাপিদাকে ধমক দিতেন যেন নোংরা হাতে আমাকে না ছোঁয়।
বুম্বাদা আবার সুযোগ পেলেই আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসত। মনে আছে আমার পাঁচ বছরের জন্মদিনে বুম্বাদা একটা বই উপহার দিয়েছিল -- "মা দূর্গার কলকাতা ভ্রমণ।"
শীল জেঠুর কড়া শাসনে মানুষ হত দুই ভাই। একবার মনে আছে আমাদের বাড়ির সামনে নেট টাঙিয়ে দুই ভাই ব্যাডমিন্টন খেলছিল। প্রথম সেটটা বাপিদা একদম খাটেনি। বুম্বাদা কিন্তু প্রচণ্ড খেটে জিতল। পরের সেট খেলতে গিয়েই বুম্বাদা হাঁফিয়ে পড়ল। ব্যাস, বাপিদার সহজ জয়।
একদিন বাপিদা শুনলাম খড়গপুরে পড়তে গেল। জানতামও না সেটা কি। কয়েক বছর বাদে বাপিদা গেল আমেরিকা। এক বছর বাদে যখন বাড়ি ফিরল, আমার জন্য নিয়ে এল নীল-হলুদ এক ফেরারি গাড়ি। এখনও আছে সেটা। তারাবাগের বাকি সবাই আমাকে পিকো বলে ডাকলেও বাপিদা আর বুম্বাদা কিন্তু আমাকে "বাবাই" বলে ডাকত। এখনও ডাকে।
২০০৭-এ যখন আমি ফ্লোরিডা যাচ্ছি, জানতে পারলাম বাপিদাও ফ্লোরিডাতেই থাকে, তবে অন্য শহরে। তার মধ্যেও বাপিদা আমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করতে লাগল। বাপিদা থাকে অরল্যান্ডোতে। ওখানকার Material Science -এর নামকরা প্রফেসর। গেন্সভিল থেকে বার দু-তিন বাপিদার বাড়ি গেছি। বলা বাহুল্য, যা আতিথিয়তা পেয়েছি তা অতুলনীয়। বাপিদার স্ত্রী শান্তাদি লন্ডনের মেয়ে। আমাকে উইম্বিল্ডন দেখার গল্প বলে মুগ্ধ করে রাখতেন। বাপিদার মেয়ে লিলির মত মিষ্টি মেয়ে খুব কমই দেখেছি। সন্ধ্যে হলে বাপিদা আমার কাছে তারাবাগের গল্প শুনতে চাইত। সমস্যাটা হল বাপিদা আমার চেয়ে অনেকটাই বড়। তাই বাপিদা যাদের নাম বলত, আমি তাদের চিনতাম না। তাও কিছু কিছু চেনা জানা থাকত। বুঝতে পারতাম বাপিদা যেন অরল্যান্ডোতে বসেই তারাবাগকে ফেরত পেতে চাইছে।
বুম্বাদা থাকত ম্যাসেচুসেটসে। কথা ছিল দেখা হবে। ২০১২ তে আমি দেশে ফেরার আগে হয়ে উঠল না। এর মাঝে আমি একবার ছুটি কাটাতে বাড়ি এসেছি। যতদূর মনে পড়ছে সালটা ২০১০। দুপুরবেলা বেল বাজতে দরজা খুলে দেখি বাপিদা, শান্তাদি, লিলি আর শীল জেঠু। মা বাবাকে দেখে ভীষণ খুশি বাপিদা। তারাবাগের পুরানো গল্প শুরু হল।
"তারাবাগ কত পাল্টে গেছে কাকিমা, আর কাউকেই চিনি না আপনাদের ছাড়া।"
-- বাপিদার হতাশ উক্তি মনে পড়ে।
আবার ছোটবেলার কথা বলতেই বাপিদা বলে
"মনে পড়ে কাকিমা, বাবা আমাকে কি মারত?"
জেঠু মাথা নিচু করে বলেন --
"সেই, তোদের তো শুধু মেরেইছি!"
২০১২-এ আমি আমেরিকা ছাড়ার আগে আমার মা বাবা এসেছিলেন ফ্লোরিডায় আমার কনভকেশনে। একদিন বাপিদার বাড়িতে নিয়ে গেলাম ওদের। শান্তাদি সে সময় লন্ডনে। বাবা মাকে দেখে বাপিদা যে কি খুশি বলে বোঝানো যাবে না। অত বড় একজন অধ্যাপক, যার বিশ্বজোড়া নাম, তার মধ্যে এরকম ছেলেমানুষি আনন্দ দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। সারা সন্ধ্যে ধরে চলল ১৯৮০ র দশকের তারাবাগের গল্প যার আশি শতাংশ আমার অজানা। ফোনে বুম্বাদাদের সঙ্গেও কথা হল।
দু সপ্তাহ আগে জানতে পারলাম বুম্বাদা মাত্র ৪১ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আজ বাপিদার কাছে শুনলাম জেঠুও খুব অসুস্থ। সকাল থেকেই তাই মনটা বেশ খারাপ। এই লেখাটা সেই মন খারাপেরই বহিঃপ্রকাশ। হয়ত খুব বোর করলাম সবাইকে এতটা লিখে, কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই লেখাটা না লিখলে রাত্রে হয়ত ভালো ঘুম হত না।
লোকে বলে জীবন এগিয়ে যায়। আমাদের সকলেরই জীবন এগিয়ে যাবে। হয়ত কাল আমি আবার পাগলু নিয়ে ঠাট্টা করব, বা আমার স্কুল জীবনের কোন মজার গল্পের কথা লিখব। কিন্তু দিনের শেষে হয়ত আবার ফিরে যাব তারাবাগে; সেই তারাবাগ যাকে বাপিদা বার বার খুঁজে বেড়ায়, যা আমরা জানি আর কোনদিন পাওয়া যাবে না -- না, এখনকার তারাবাগে গিয়েও না, যার থেকে হয়ত একদিন আমি সম্পুর্নভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব; কিন্তু যে তারাবাগে আমি, বাপিদা, আমরা সবাই বার বার ফিরে যেতে চাইব।

Wednesday, August 3, 2016

স্কুল জীবনের গল্প

Tapabrata-র ব্লগে লেখা পড়ে স্কুল জীবনের কিছু স্মৃতি ভেসে উঠল। সেন্ট জেভিয়ার্সের এগারো বছরের গল্প লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। বরং রামকৃষ্ণ স্কুলের কিছু গল্প বলি।
আমি ১১ ক্লাসে ভর্তি হই রামকৃষ্ণ স্কুলে। যারা পড়েননি, তাঁরা জানেন না মফঃস্বলের বাঙলা মিডিয়াম স্কুল মানে কি। এক এক করে সব গল্প বলব। তবে এটা স্বীকার করতে কোন বাধা নেই, ঐ দু'বছর চুটিয়ে ফুর্তি করেছি স্কুলে।
একবার বাঙলা স্যার বাড়ির কাজ দিয়েছেন এইরকম -- খবরের কাগজের সম্পাদককে চিঠি লেখ দূরদর্শনের অনুষ্ঠান নিয়ে তোমার ক্ষোভ জানিয়ে। আমরা সবাই লিখলাম আরও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দরকারি। শুভেন্দু বোধহয় লিখেছিল উচ্চমাধ্যমিকের অঙ্কের সাজেশান দেওয়া দরকার দূরদর্শনে (এর ফলে কানমলা জুটেছিল)। কেউ কেউ লিখল শচিন বা সৌরভের ইন্টারভিউ দেওয়া উচিত (আবারও কনমলা)। সবচেয়ে অবাক করল সুদীপ। ওর চিঠি পড়ে স্যার দেখলাম বেত নিয়ে ছুটে গেলেন মারতে। এর আগে স্যারকে দু-একবার কানমলা বা চড় মারতে দেখেছি বটে, তবে বেত দিয়ে মার আগে দেখিনি। বেশ খানিকক্ষণ পেটানোর পর উনি থামলেন। তারপর গর্জে উঠলেন "এটা কি লিখেছিস? 'দূরদর্শনের আধিকারিকদের বলবেন রাত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের সিনেমাগুলি আজকাল তেমন জুতসই হচ্ছে না।' কাল তোর বাবাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবি।"
আমরা সবাই অবাক সুদীপের কাণ্ড দেখে। ক্লাস শেষ হলে সুদীপ আরও একবার অবাক করল। আমাদের দিকে চোখ টিপে বলল "কেমন দিলাম?"
বেতের ব্যথা কখন উবে গেছে।

*****************************************************************************************************************
স্কুল জীবনের দ্বিতীয় গল্প। এবারও বেত আছে, তবে শেষে।
এই গল্পটি কুন্তলকে নিয়ে। কুন্তলের স্বপ্ন ছিল নামকরা ফুটবলার হবে। মারাদোনার মত। হতে পেরেছিল কিনা জানি না, কারণ বহুবছর কোন যোগাযোগ নেই। তবে মনে হয় হতে পারেনি, কারণ পারলে নাম শুনতাম। যাই হোক, এই গল্প যখন আমি আর কুন্তল একই স্কুলে ক্লাস ইলেভেনে পড়তাম।
কুন্তল সবসময় ফুটবল খেলতে চাইত। মাঝে মাঝে তো মনে হত ও স্কুলে আসতই ফুটবল খেলবে বলে। বলা বাহুল্য, রোজ নিজের একটা ফুটবল সঙ্গে করে আনত। সিটে পায়ের তলায় রেখে দিত। ক্লাসে স্যার আসতে দেরি করলে দেওয়ালে মেরে মেরে প্র্যাকটিস করত।
তো এরকমই একদিনের কথা। কুন্তল ক্লাসে বসে আছে, পায়ের কাছে ফুটবল। পাশে কুন্তলের প্রিয় বন্ধু অয়ন। ইংরেজির স্যার সবাইকে বই বার করতে বললেন। অয়ন বেচারি বই আনতে ভুলে গেছে সেদিন। সে কথা জানাতেই স্যার গম্ভীর গলায় বললেন
"Get out of the class"
অয়নকে বেরোতে দেখে কুন্তলের মাথার পোকা নড়ে উঠল। কুন্তলের সঙ্গে বই ছিল। স্যাট করে সেটা ব্যাগের ভেতর রেখে দিয়ে হাত তুলল --
"স্যার, আমিও বই আনিনি।"
"তাহলে তুমিও get out of the class."
কুন্তল আসতে আসতে হাঁটতে লাগল। দরজার একদম কাছে পৌঁছে এবার ঘুরে তাকাল স্যারের দিকে। হালকা গলায় বলল --
"বলটা নিয়ে যাব স্যার?"
তারপর ---
সেটাও বলে দিতে হবে? প্রথম লাইনটা আবার পড়ে নাও।
*****************************************************************************************************************
স্কুল জীবনের তৃতীয় গল্প। এবার আর বেত নেই।
আজকাল দেখি মানুষজন খুব বিচলিত হয়ে পড়েন বিভিন্ন কারণে। এই ভোটে কে জিতল, জন স্নো মারা গেলেন কিনা, বিরাট কোহলি আবার সেঞ্চুরি করলেন কিনা, ফেডেরার আর খেলবেন কিনা, টাইগার শ্রফ কেন সিনেমা করছেন, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে অনেকেই বিচলিত থাকেন। অথচ আমাদের স্কুলের রসায়নের স্যার একেবারেই বিচলিত হতেন না। আজ তাঁরই গল্প।
আমাদের স্কুলে ক্লাস টুয়েল্ভের ঘরটি ছিল তিন তলায়। পাশেই একটি মেয়েদের স্কুল। নাম ভারতী বালিকা বিদ্যালয়। মাঝে একটি ছোট পাঁচিল। কদাচিৎ পাঁচিলের এদিক থেকে ওদিকে মন দেওয়া নেওয়া যে হত না, তা নয়, তবে সেটা আমাদের গল্পের বিষয়বস্তু নয়।
আমাদের গল্প একদিন দুপুরের। টিফিনের পর ক্লাস শুরু হয়েছে। রসায়নের স্যার এসে বই খুলে মারত চুল্লী হইতে লৌহ নিষ্কাশন পড়াচ্ছেন। যারা ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র/ছাত্রী, তাদের জন্য -- এর মানে Iron Extraction from Blast Furnace. অত্যন্ত ঘুমপাড়ানি বিষয়, স্যার পড়াচ্ছিলেন সেই রকম ঘুমপাড়ানি ভঙ্গীতেই, তাই স্বাভাবিক ভাবেই কেউ খুব একটা মনোযোগ দিচ্ছিল না। আমি আর আমার বন্ধু পাপাই মিলে কাটাকুটি খেলছিলাম। কেউ কেউ পিছনে বসে নিষিদ্ধ বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছিল। কেউ কেউ প্রেমপত্র লেখার অভ্যাস করছিল। আর এক দল ছেলে দুপুরে খেয়ে দেয়ে স্রেফ ভাতঘুম দিচ্ছিল। মইদুল নাকও ডাকছিল।
স্যার কিন্তু বিচলিত হননি, এক মনে পড়িয়ে যাচ্ছিলেন।
এরই মধ্যে কে একটা বলে উঠল -- "এই ভারতী স্কুলের মেয়েরা পি টি করতে নেমেছে রে।"
বলা মাত্রই ম্যাজিক, পুরো ক্লাসের ভরকেন্দ্র ডানদিকের জানালায় চলে গেল। আমি আর পাপাই কাটাকুটির খেলাটা শেষ করতে গিয়ে দেরি করে ফেললাম। তাও খুব বেশি হলে মিনিট দু-এক। উঠে জানালার দিকে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম স্যার কিন্ত এসবের উর্ধে, এক মনে তখনও মারত চুল্লী পড়ে যাচ্ছেন। সেদিন থেকে স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। এ'রম পরিবেশে যদি কেউ বিচলিত না হয়ে থাকতে পারে, তাঁর অসীম ক্ষমতা।
*****************************************************************************************************************
স্কুল জীবনের একটা অনুগল্প।
বাংলা পরীক্ষা। সবাই খস খস করে পাতা ভরাচ্ছে। অনেকেরই ধারণা বেশি লিখলে নম্বর বেশি আসবে। সবচেয়ে চিন্তায় আছে আমাদের শীর্ষেন্দু। গত বার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে লাউসেনের বউ ফুল্লরা লেখায় স্যার কানমলা দিয়েছিলেন। এবার তাই আর কোন রকম সুযোগ নেয়নি। অনির্বাণের খাতা দেখে টুকছে। পরীক্ষা শেষ হতে আর আধ ঘন্টা বাকি। জোর কদমে টোকা চলছে শীর্ষেন্দুর। এর মধ্যে অনির্বাণ মাঝে মাঝেই খাতার উপর হাত দিয়ে ফেলছে। তাই বলতে হচ্ছে -- "হাত সরা"।
দু-একবার বলার পর স্যারের কানে গেল। স্যার কাছে এসে বললেন
-- "কি হচ্ছে নন্দী?"
শীর্ষেন্দু একটুও ঘাবড়াল না। ঠান্ডা মাথায় স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল --
"স্যার, এখন স্লগ ওভার চলছে, এগুলো দেখবেন না।"
*****************************************************************************************************************
স্কুল জীবনের আর এক গল্প। এটা ঠিক স্কুলের গল্প না, প্রাইভেট টিউশানের।
তার আগে বলা দরকার বর্ধমানের স্টার সিনেমা হলের কথা। জি টি রোডের উপর এই সিনেমা হলে মূলত বাংলা সিনেমা চলত। যারা ৮০-৯০ এর দশকের বাংলা সিনেমা নিয়ে খোঁজ-খবর রাখে, তারা জানে এই স্টার সিনেমা হলের সামনে "বেদের মেয়ে জ্যোতস্না" দেখার জন্য গরুর গাড়ির লাইন পড়েছিল।
আমাদের গল্প শুরু হচ্ছে বাংলার স্যার সুধীরবাবুর বাড়িতে। সুধীরবাবু সি এম এস স্কুলে বাংলা পড়াতেন। বাড়িতে ওনার টিউশানের ব্যাচ বসত। অত্যন্ত যত্ন সহকারে পড়াতেন সুধীরবাবু। ভাটনাগর পুরস্কার প্রাপ্ত বিখ্যাত রসায়নের শিক্ষক অধীর রঞ্জন চক্রবর্তী ওনার ভাই।
সুধীরবাবুর কাছে একদিন বাংলা পড়া চলছে। আমার পাশে বসে লাদেন। দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি লাদেনের আসল নাম আমার মনে নেই। সবাই লাদেন বলেই ডাকত (বোধহয় সুধীরবাবুও)। লাদেনকে খানিকটা বিখ্যাত বা কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী ওসামা বিন লাদেনের মত দেখতে ছিল, তাই এই নাম। যাই হোক, লাদেনের মাথায় সারাক্ষণ পোকা ঘুরত কি করে সুধীরবাবুকে রাগানো যায়। মাঝে মাঝে সেই পরিকল্পনা গুলোর বাস্তব রূপও দিয়ে থাকত, এবং অবশ্যই তিরস্কার জুটত।
তো সেদিন সুধীরবাবু আমাদের আরাকান রাজসভার কবিদের কথা বলছেন। "দুই কবির নাম দৌলত কাজী ও সৈয়দ আলাওল। এনাদের লেখা বইয়ের নাম লোর চন্দ্রাণী বা সতী ময়না।"
এই অবধি বলার পর লাদেন বলে উঠল -- "স্যার এই সিনেমাটা পুজোর সময় স্টারে এসেছিল মনে হয়। শতাব্দী ছিল না? পিঙ্কিকে নিয়ে দুপুরের শোতে দেখতে গিয়েছিলাম।"
বলা বাহুল্য, এ কথা শোনার পর সুধীরবাবু আর চুপ থাকেননি। তবে শুধুই তিরস্কার করেছিলেন, না হাতের কাজও ছিল, সেটা আজ আর মনে নেই।
*****************************************************************************************************************
 এই স্নাকুল জীবনের গল্পটার নাম দেওয়া যায় "একটি ফুটবল ম্যাচ"।
রামকৃষ্ণ স্কুলে জানতে পেরেছিলাম স্যারদের কাছে মার খাওয়া সব সময় অগৌরবের ব্যাপার না। মাঝে মাঝে মার খেয়ে সুদীপের ভাষায় "কেমন দিলাম?" বলা যায়। এটা সেরকমই এক গল্প।
সেটা ক্লাস টুয়েল্ভ। সেদিন ইংরেজীর স্যার আসেননি। প্রত্যেক স্কুলেই এই ক্লাস ৭-৮ নাগাদ একজন শিক্ষক থাকেন যিনি সব কিছু পড়াতে পারেন। মানে বাংলা, ইংরেজি, ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান, কখনও বা অঙ্ক। এরকম আমাদের স্কুলে ছিলেন শ্যামলবাবু।
তো আমরা ফাঁকা ক্লাসে বসে আড্ডা দিচ্ছি এই সময় শ্যামলবাবু এসে হাজির। আমি যেহেতু ১১ ক্লাসে স্কুলে ঢুকেছি, তাই ওনার ক্লাস করিনি আগে। শ্যামলবাবু বেশ গম্ভীর গলায় কথা বলতেন। আমাদের বসতে বলে জানতে চাইলেন কিসের ক্লাস। ইংরেজী বলায় স্যার খুব গম্বীর ভাবে একটা বই বার করলেন। সেটা নাকি "এসে" বই। সেখান থেকে স্যার এসে পড়ে শোনাবেন। আমরা চুপচাপ শুনতে লাগলাম। স্যার শুরু করলেন "A football match".
আগেই বলেছি ওনার গলা ছিল বেশ গম্ভীর। তার মধ্যে উনি অত্যন্ত নাটকীয় ভাবে এসেটা পড়ছিলেন। মানে অনেকটা এরকম -- "And with the referee's whistle, the game started. The center forward moved ahead with the ball.."। পুরো মনে হচ্ছিল আকাশবাণীতে ধারাবিবরণী শুনছি। এক্ষুনি যেন বলা হবে -- "টুলুঙ্গার থেকে বল পেলেন বাইচুং, গোলে শট, কিন্তু না, হেমন্ত ডোরা আটকে দিলেন।"
স্যার সেভাবেই পড়তে লাগলেন। ".. then Jatin passed the ball to Anil, who went past two defenders to take a shot." তখনও বুঝিনি ক্লাস শুদ্ধু ছেলে কি মতলব করছে। স্যার বললেন -- "and the ball went past the keeper and it was a G-O-A-L." গোলটা বেশ নাটকীয় ভাবে বললেন। হয়ত ভেবেছিলেন ছেলেরা আনন্দ পাবে। কিন্তু যেই গোল বলা, এক দল ছেলে পেছন থেকে লাফিয়ে উঠল -- "হে হে গোল।" তারপর পুরো ক্লাস একসাথে লাফাল গোল বলে। যেন মনে হচ্ছে বাইচুং-এর গোলের পর যুবভারতীর ইস্টবেঙ্গল গ্যালারী।
সবার দেখা দেখি আমিও সেদিন গোল বলে লাফিয়েছিলাম। রামকৃষ্ণ স্কুলে সেই আমার প্রথম বেত খাওয়া।

Tuesday, July 26, 2016

স্বপ্ন



"ছোটকা, তুমি?”

"ওঠ, আর কতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকবি? নাটক তো শুরু হয়ে যাবে।”
"নাটক! কিসের নাটক?"
"আরে আজ আম্রকুঞ্জে নাটক আছে, কিছুই জানিস না দেখছি।" 
"কিন্তু তুমি? তুমি কোথা থেকে এলে? তুমি তো ...। "
"আমি তো কি?"
"তবে যে শুনেছিলাম এই বর্ষায় সাপের কামড়ে তুমি ...।"
"ঠিকই শুনেছিলি, পরে সেসব বোঝাব। এখন চল।"
"না মানে বাবা তো এসেছিল সেই সময়। ঠাম্মা ভীষণ কান্নাকাটি করছিল মনে আছে। বাবা বলছিল দিল্লিতে আমাদের সঙ্গে থাকলে এটা কখনওই হত না। তোমার বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো নিয়ে রাগারাগি করছিল।" 
"এসব বলেছে নাকি মেজদা? ছোটবেলা থেকে শুধু গুড বয় হয়েই জীবন কাটাল।"
"কিন্তু তুমি কি করে এলে এখানে?"
"আরে দেরি হয়ে যাচ্ছে। চ, রাস্তায় যেতে যেতে বলি।" 
"চল। দাঁড়াও, সোয়েটারটা পরে নি।"
"হুঁ, পরে নে, বাইরে ঠাণ্ডা আছে, আর ফিরতে রাতও হতে পারে।"
"আমি রেডি, বল, কিভাবে যাবে? রিকশা নেবে?"
"আরে ধুর, হেঁটেই চলে যাব। কাছেই তো।"
"কাছে কি গো? রিকশা করেই তো পনের কুড়ি মিনিট লেগে যায়।"
"হা হা, আয় আমি একটা শর্টকাট চিনি।"
"আরে, এটা তো বাড়ির পিছনদিকের রাস্তা, পুকুরপাড়ে চলেছে।"
"হ্যাঁ, ওখান দিয়েই যাব, চল।"
"তোমরা নাকি এই পুকুরে সাঁতার কাটতে?"
"শুধু তোর বাবা কাটত না।"
"তুমি এখন বাবার ওপর রেগে আছ?" 
"আরে না, সত্যিই কাটত না। তুই শিখেছিস?"
"হ্যাঁ, আমাদের পিতামপুরার সুইমিং পুলেই শিখি।"
"তাও ভাল, আমি তো ভেবেছিলাম মেজদা তোকে সাঁতার শেখাবেই না।"
"আরে পুকুরের পাশের এই রাস্তাটা কি? আগে দেখিনি তো।"
"হুঁ হুঁ বাবা, সব যদি জানবে তাহলে তো হয়েই গেল। তোর বাবাও এই রাস্তাটা চেনে না।"
"আমি কাল সকালে বাবাকে এটা চিনিয়ে দেব।"
"পারবি না। কাল সকালে এই রাস্তা আর থাকবে না।"
"কেন?"
"তুই বড্ড প্রশ্ন করিস। চল, ওই দেখ আমরা আম্রকুঞ্জ এসে গেছি।"
"নাটক কোথায়?"
"হবে, একটু বস।" 
"এখানে ঘাসেই বসব ?"
"বাকিরাও তো তাই আছে, তুইও বস।"
"আচ্ছা।" 
"ওই দেখ, উনি কে বলত?"
"কে? কার কথা বলছ?"
"ওই দেখ চেয়ারে বসে আছেন।"
"আরে কেউ একটা রবি ঠাকুর সেজে এসেছে দেখছি।"
"উফ, কি উজবুক তুই। কেউ সেজে আসেননি। উনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।"
"যাহ কি যে বল? রবি ঠাকুর তো সেই ১৯৪১ সালে মারা গেছেন।"
"আর আমি? আমি কি বেঁচে আছি?"
"মানে? ছোটকা, তুমি কি বলছ?"
"পরে বোঝাবো, আপাতত নাটক শুরু হচ্ছে, মন দিয়ে নাটক দেখ।"
"কি নাটক হবে?"
"কবিগুরুর লেখা গীতিনাট্য কালমৃগয়া।"
"এটার নাম শুনিনি তো? গল্পটা কি? জানো ছোটকা, গতবছর পুজোতে আমাদের চিত্তরঞ্জন পার্কে তাসের দেশ গীতিনাট্য হয়েছিল।"
"বাহ, তুই কিছু করেছিলি?"
"নাহ, বড়রা করেছিল, তাই আমাকে নেয়নি। বললে না কালমৃগয়ার গল্পটা কি?"
"গল্পটা তোর জানা, দেখতে থাক।"
"যারা করছে, তারা কারা?"
"পাঠভবনের ছাত্র ছাত্রীরা।"
"আরে এই গানটা তো চেনা। এটা তো পূরানো সেই দিনের কথা, তাই না? তাহলে এরা অন্যভাবে গাইছে কেন?"
"এটা আলাদা গান। রবি ঠাকুর অনেক সময়ই একিই গানের সুর দুবার ব্যাবহার করেছেন। এই 'কাল সকালে উঠব মোরা, যাব নদীর কূলে' আর 'পূরানো সেই দিনের কথা' গান দুটির সুর এক। জানিস কি এই সুরটি কবিগুরু এক স্কটিশ লোকসঙ্গীত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পেয়েছিলেন?"
"না তো, কি গান?"
"১৭৮৮ সালে স্কটিশ কবি রবার্ট বার্নসের লেখা 'Auld Lang Syne'। এই লোকসঙ্গীতটি অত্যন্ত জনপ্রিয়, ১৯৪০ সালে বিখ্যাত হলিউড সিনেমা ওয়াটারলু ব্রিজ সিনেমায় গানটি ব্যবহৃত হয়।"
"এই গানটা তো আমি জানি। 'ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে' -- এটি কি এই গীতিনাট্যের গান?"
"হ্যাঁ, কিন্তু আর বকবক না, এবার মন দিয়ে দেখ।"
"ঠিক আছে, শুধু একটা জিনিস, ওই সাহেবটি কে?"
"উনি ইনস্পেকটর জেমস, এই অঞ্চলের ইনস্পেকটর ছিলেন। মারাত্মক রবীন্দ্রভক্ত।"
"উনি বাংলা বোঝেন?" 
"হ্যাঁ, এত ভালবাসতেন কবিগুরুর লেখা, কষ্ট করে বাংলা শিখেছিলেন। এবার নাটক শেষ না হওয়া অবধি একদম চুপ।"
"ছোটকা, গল্পটা আমি জানি, এটা তো রামায়ণের গল্প। দশরথ শ্রবণ নামক এক ঋষিকুমার কে হত্যা করেন জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে। শ্রবণের অন্ধ পিতা অভিশাপ দেন দশরথকেও পুত্রশোক ভোগ করতে হবে। তার কারণেই নাকি ওনাকে রামচন্দ্রের থেকে আলাদা হতে হয়।" 
"একদম। এবার ভাব এই গল্পটিকে কি সুন্দর একটি গীতিনাট্যের রূপ দিয়েছেন কবিগুরু।"
"সত্যি, সবার জানা গল্প, অথচ কি সুন্দর ভাবে কবিগুরু সাজিয়েছেন এটা।"
"আর কত অল্প বয়েসে!!"
"ভাবাই যায় না।"
"নে বাড়ি এসে গেছে। তুই যা ওপরে গিয়ে শুয়ে পর।"
"তুমি আসবে না?"
"নাহ, আমি কি করতে যাব? তুই আবার যেদিন স্বপ্ন দেখবি, আমি চলে আসব।" 
"তার মানে আমি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম, তুমি স্বপ্নে এসেছ।" 
"ঠিক তাই। আসি রে বাবুল।"



ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। কি স্বপ্ন!! গত এক সপ্তাহ ধরে বার বার ছোটকার কথা মনে হচ্ছিল, তাই বোধহয় আজ... 
আচ্ছা, বিছানার ধারে কে যেন বসে আছে না? চোখটা রগড়ে নিলাম। তাকিয়ে দেখি ছোটকা। প্রচণ্ড অবাক হলাম --
"ছোটকাতুমি?”

"ওঠআর কতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকবিনাটক তো শুরু হয়ে যাবে।”



গল্পটি বর্ণদূত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
বর্ণদূত পত্রিকা- দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা।তারিখ - ১২ই আষাঢ় ১৪২৩।

Friday, July 15, 2016

লে জায়েঙ্গে

-- এই দাদা, লন্ডন যাবি?
-- চুপচাপ সিনেমা দেখ।
-- চল না, কি সুন্দর দেখ।
-- উফ, এত কথা বলিস কেন। তোকে না আনাই উচিত ছিল।
-- হেঁ, যেন আমাকে না আনলে মা তোকে ছাড়ত।
-- কেন ছাড়ত না, আমি বড় হয়েছি। সবে উচ্চমাধ্যমিক দিলাম। মা'র অনুমতির কি দরকার?
-- পয়সা পেতি কোথায়? বাবাকে যদি বলতিস হিন্দি সিনেমা দেখতে যাবি, পাতি অপসংস্কৃতি বলে বকে দিত।
-- সেটা ঠিক। যাকগে, বাজে না বকে সিনেমা দেখ।
-- বল না, লন্ডন যাবি?
-- আচ্ছা যাব।
-- আমাকে নিয়ে যাবি?
-- হুঁ।
-- লন্ডনের ট্রেনগুলো কি সুন্দর না রে, আমাদের কর্ড লাইন লোকালের মত না?
-- হুঁ।
-- ওদের স্টেশনেও বাবার মত মাস্টারমশাই থাকে?
-- হুঁ।
-- খালি হুঁ হুঁ করছিস কেন? আমরা গেলে ঐ রকম ট্রেনে চাপব?
-- হ্যাঁ চাপব।
-- ওগুলো লোকাল না এক্সপ্রেস রে?
-- এক্সপ্রেস।
-- ওদের লোকাল ট্রেন হয় না? মালগাড়ি?
-- হয়।
-- সেগুলো দেখাচ্ছে না কেন?
-- ভীষণ মার খাবি বুলি। চুপচাপ দেখ না।
-- তুই আমাকে মারবি?
-- আচ্ছা না মারব না। সিনেমা দেখ। এই না তোর শাহরুখকে এত ভালো লাগে।
-- দেখ দেখ কি সুন্দর গাড়ি চালাচ্ছে। কেমন গাড়িটার মাথা নেই।
-- হ্যাঁ একে হুড খোলা গাড়ি বলে।
-- আমাদের ডাক্তারবাবুর সাদা গাড়িটার চেয়ে ভালো তাই না?
-- ধুর, ওটা তো একটা এম্ব্যাসাডর।
-- যাহ, গাড়ি খারাপ হয়ে গেল যে।
-- হুঁ।
-- এর চেয়ে বাবার সাইকেলই ভালো তাই না? মাঝে মাঝে চেন পড়ে যায়, তবে সে তো তাড়াতাড়ি লাগিয়ে নেওয়া যায়।
-- হুঁ।
-- আবার হুঁ হুঁ করছিস? আচ্ছা যা, আমি তোর সঙ্গে আর কথাই বলব না।
-- সেনিওরিটা।
-- কি বললি?
-- সেনিওরিটা।
-- ওহ যেটা শাহরুখ কাজলকে বলল?
-- হুঁ, বেশ সুন্দর না ডাকটা?
-- হ্যাঁ, তুই বার বার বলছিস কেন? প্র্যাকটিস করছিস? কাল সঙ্গীতাদিকে বলবি?
-- বুলি? কি বললি?
-- হে হে, আমি সব জানি।
-- কি করে? কবে থেকে? মা বাবাকে বলেছিস?
-- চুপচাপ সিনেমা দেখ না দাদা, এত কথা বলছিস কেন? তোকে না আনাই উচিত ছিল।


Sunday, June 26, 2016

ঘরে ফেরার গান

বাড়ি ফেরার গল্প কিন্তু কেউ খুব একটা করে না। রাবণবধের পর শ্রীরামচন্দ্র কিভাবে বাড়ি ফিরেছিলেন বা কংস হত্যার পর শ্রীকৃষ্ণের বাড়ি ফেরার কথা কেউ তেমন বলে না। অথচ এই বাড়ি ফেরার মধ্যে এক অদ্ভুত আনন্দ আছে। সারাদিনের পরিশ্রমের শেষে যেন আরামের জায়গায় ফেরা। লক্ষ্য করে দেখবেন, এই সময় কোন বিঘ্ন ঘটলে ভীষণ রাগ হয়। ধরুন আপনি অফিস যাচ্ছেন, রাস্তায় জ্যাম পেলেন, যতটা না মাথা গরম হবে, বাড়ি ফেরার সময় জ্যাম পেলে আরো বেশী হবে।
   মনে পরে ছোটবেলায় স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় বেশ হুল্লোড় হত স্কুল বাসে। আমার সবচেয়ে ভালো লাগত বাস স্টপ থেকে নেমে বাড়ি অবধি হেঁটে যাওয়াটা। তখন স্কুল ছুটি হত বিকেল ৪টে। তারপর বিকেলবেলা পশ্চিমের সূর্যের আলোয় বাড়ি ফেরার আনন্দই ছিল আলাদা। গ্রীষ্মকাল হলে বাড়ি ফিরে প্রচুর সময় থাকত হাতে। শীতকালে কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। খানিকক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নামবে, তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেই তৈরি হওয়া খেলতে যাওয়ার জন্য। আবার যেদিন পরীক্ষার নম্বর বেরত, মনে হত বাড়ি ফেরার পথটা কত বড়। মা যেন জানতেন আমি কখন আসব। বা হয়ত আমাদের স্কুল বাসের আওয়াজ শুনতে পেতেন। তখন এমনিতেও বর্ধমানে বাস বেশী চলত না। তাই রুক্ষ চুল, ঘামে ভেজা বা বোতাম খুলে যাওয়া জামা পরিহিত আমি নিচ থেকে সবসময় দেখতে পেতাম মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন।
   যাদবপুরে পড়াকালীন বাড়ি ফেরাটা বেশ কষ্টকর ছিল। আমাদের বেহালায় প্রায়শয় জ্যাম হত। তারপর তো থাকত চৌরাস্তা থেকে অটোর লাইন। কোনকোনদিন তার মধ্যেও জলদি অটো পেয়ে গেলে ভীষণ আনন্দ হত। তৃতীয় বর্ষ থেকে জি আর ই-র কোচিঙে যখন ভর্তি হলাম, বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হত। তবে কদিন বাদেই এক সঙ্গী পেলাম। সঙ্গিনী বললে বোধহয় ঠিক হবে। কোহিনুরদি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাশিবিজ্ঞানের ছাত্রী। দু'জনে একসাথে ফিরতাম যোধপুর পার্ক থেকে বেহালা। প্রচুর আড্ডা হত। কোহিনুরদি কয়েক বছর বাদে আমার বর্ধমানের পাড়াতুত দাদা বাবানদাকে বিয়ে করে। পৃথিবীটা বড়ই ছোট।
   গেন্সভিল থাকাকালীন ল্যাব থেকে ফিরতাম ১৬ বা ১৭ নম্বর বাসে। রাত হয়ে গেলে বাস কমে যেত। তাই অনলাইন দেখে নিতাম বাস কতদূর, সেই দেখে ল্যাব থেকে বেরোতাম। অনেক সময় এরকম রাত বিরেতে বাস স্ট্যান্ডে কোন বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে যেত। আড্ডা মারতে মারতে বাস ভ্রমণ চলত। শেষের দিকে অবশ্য গাড়ি থাকার দরুন ফেরার অভ্যাসটা পালটে গিয়েছিল। মনে আছে রাত ২-৩ টের সময় ল্যাব থেকে ফেরার সময় দেখতাম কেউ কেউ রাস্তার ধার দিয়ে দৌড়াচ্ছে, কানে আই পড। অধ্যাবসয় দেখে অবাক হতাম। রাতের গেন্সভিলে গাড়ি চালাতে এক আলাদা আনন্দ ছিল। চারিদিক চুপচাপ, সকাল বা বিকেলের ভিড় নেই রাস্তায়; তার মধ্যে গাড়ি চালান, নিজের ছন্দে, নিজের গতিতে, চেনা রাস্তাগুলোকে যেন অন্যরকম লাগত।
     মনে আছে একবার শিকাগো এয়ারপোর্টে বসে আছি দিল্লীর বিমানের প্রতীক্ষায়। দেখি এক প্রবাসী বাঙালী দম্পতিও নিজেদের ছেলে মেয়েকে নিয়ে অপেক্ষা করছেন। আলাপ হল। ভদ্রলোকের বাড়ি হুগলী। ভদ্রমহিলার কসবা। ছেলে মেয়ে দু'জনেরই জন্ম মার্কিন দেশে, তাই তাড়া সেই দেশেরই নাগরিক। মেরিল্যান্ডে এক স্কুলে পড়ে। ভদ্রলোক  খুব খুশি, বহুদিন বাদে বাড়ি ফিরছেন। এক মাসের ছুটি, এইসব বলছিলেন আমায়। আমি শুধু ভাবছিলাম ছেলে মেয়ে দুটির কথা। তারা কি ভাবছে? তাদের কাছে এটা নিশ্চয় বাড়ি ফেরা না? ভদ্রলোকের এখন যা মনের ভাব, হয়ত এক মাস বাদে তাদের সেটা হবে। আবার ভাবলাম, ভদ্রলোকেরও কি সেটা হবে না? মার্কিন দেশের বাসস্থানটাও তো ওনার বাড়ি? কে জানে কি ভাবছেন উনি? আগেও বলেছি, বাড়ি কাকে বলে সেটাই আমি বুঝি না। হয়ত কোনদিন বুঝবো না। কিন্তু এই বাড়ি ফেরার আনন্দটা সবসময়ই উপভোগ করব। 

Friday, June 24, 2016

ধনক

অপু-দূর্গাকে নিশ্চয় সবার মনে আছে? বা আলি- জাহরাকে? সেই পারস্য দেশের সিনেমা "বাচ্চা-এ-আসমান"-এর দুই খুদে ভাই বোন, যারা এক পাটি জুতো নিয়ে স্কুল যেত! আসলে চলচ্চিত্রের পর্দায় ভাই-বোনের গল্প বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে। বিখ্যাত পরিচালক নাগেশ কুকুনুর এবার এরকমই দুই ভাইবোনকে নিয়ে বানালেন তাঁর নতুন সিনেমা "ধনক"।
       দিদি পরি আর ভাই ছোটুর গল্প "ধনক"। অনাথ ভাইবোন থাকে নিঃসন্তান কাকা আর কাকিমার কাছে। কাকা তাদের নিজের ছেলে মেয়ের মত স্নেহ করলেও কাকিমা কিন্তু মেনে নিতে পারেন না। তার মধ্যে ছোটু আবার চোখে দেখতে পায়না। ছোটু কিন্তু জন্মান্ধ না। বছর চার আগে অপুষ্টিতে ছোটু দৃষ্টিশক্তি হারায়। পরির ইচ্ছা একদিন ছোটু নিজের দৃষ্টি ফিরে পেয়ে আকাশের সাতরঙা রামধনু দেখুক। এই রামধনুর নামেই সিনেমার নাম "ধনক"।
       রাজস্থানে থর মরুভূমির কাছে এক ছোট গ্রামে বাস পরি আর ছোটুর। পরি ছোটুকে চোখের বাইরে যেতে দেয়না। রোজ একসাথে স্কুলে যায় দু'জনে। নদী থেকে জল আনার সময় ছোটুর কোমরে নিজের ওড়না বেঁধে দেয় পরি, যাতে ভাই হারিয়ে না যায়। তাই বলে ভেবো না দু'জনের মধ্যে ঝগড়া হয় না। তোমরা তোমাদের দিদি বা ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করোনা? করো তো? তাহলে পরিরা কেন করবেনা? পরি শাহরুখ খানের ভক্ত আর ছোটু সালমান খানের। এই নিয়ে ঝগড়া লেগেই আছে দু'জনের। এমনকি পরি বেশিক্ষণ শাহরুখের প্রশংসা করলে ছোটু কানে হাত দিয়ে "মাফ করো সালমান ভাই" বলে। এহেন পরি একদিন জানতে পারে শাহরুখ খান রাজস্থানে এসেছেন নিজের নতুন সিনেমার শুটিং করতে। ভাইয়ের চোখের অপারেশনের জন্য যদি শাহরুখ পয়সা দেন, এই আশায়  ভাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালায় পরি। শুরু হয় দুই ভাইবোনের পদব্রজে রাজস্থান ভ্রমণ। পরি কি পারে শাহরুখ খানের সঙ্গে দেখা করতে? ছোটু কি রামধনু দেখতে পায়? এই প্রশ্নের উত্তর আর দিচ্ছি না। তোমরা সিনেমা হলে গেলেই এর উত্তর পেয়ে যাবে।
      আমাদের এই জটিল আর গতিময় জীবনে রূপকথার বড়ই অভাব। পরিচালক নাগেশ কুকুনুরকে ধন্যবাদ এত সুন্দর একটি গল্প উপহার দেয়াড় জন্য। বহুদিন বাদে এরকম একটি মিষ্টি, সহজ, সরল গল্প দেখলাম রূপোলী পর্দায়। পৃথিবীতে সবাই যে খারাপ মানুষ না, ভালো লোকেরা এখনও এই দুনিয়ায় আছেন; এই বক্তব্যটি যেন বার বার ফিরে আসে এই সিনেমায়। অভিনয়ের দিক থেকে পরির ভূমিকায় হেতল গাদা অসাধারণ। আশা করি হেতল বড় হয়ে একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী হবেন। ছোটু হিসেবে কৃষ ছাবরিয়াও খুব ভালো অভিনয় করেছেন। এই সিনেমার আসল প্রাপ্তি হচ্ছে ক্যামেরার কাজ। রাজস্থানকে ভীষণ সুন্দর ভাবে দেখিয়েছেন পরিচালক মশাই। এই রাজস্থান কিন্তু প্রাসাদ বা রাজাদের রাজ্য নয়; এই রাজস্থান পরি-ছোটুর মত সাধারণ মানুষদের বাসস্থান; যেখানে পরিষ্কার বালির উপর দুই ভাইবোন বিকেল বেলা খেলা করে, যেখানে রাস্তায় মহিলারা রংবেরঙের পোশাক পরে গান গাইতে গাইতে চলেন, যেখানে মাঝে মধ্যেই বালির ঝড় ওঠে। সিনেমার গনগুলিও অত্যন্ত শ্রুতিমধুর। তাহলে আর দেরি কিসের? তোমার বাড়ির কাছের সিনেমা হলে গিয়ে "ধনক" দেখে এসো; দেখ হয়ত তোমার মনের মধ্যেও রামধনু দেখতে পাবে!! 

Wednesday, May 4, 2016

ছেলে গেছে পড়তে

ছেলে গেছে পড়তে, সেই দূর শহরে,
গ্রামের আলের পথ ধরে,
নদীর পার দিয়ে পাঁচ ক্রোশ পথ হেঁটে গেলে
পঞ্চায়তের তৈরি পিচ ঢালা রাস্তা।
দিনে দু'বার বাস যায় স্টেশনের দিকে -
ট্রেনে করে কলকাতা, সেও কম করে আড়াই ঘন্টা।
তারপর বাসে চড়ে ঘন্টাখানেকের পথ,
একটা সরুগলিতে দোতলা বাড়ির একতলায়
চার বন্ধু মেস করে থাকে।
ঘুপচি ঘরে না ঢোকে সূর্যের আলো,
না আসে একটু বাতাস।
তবু তার মধ্যে হাত পুড়িয়ে সকালে ভাত আর
আলুসিদ্ধ; বিকেলে একটু ডাল বড়জোর।
কেই বা বাসনমাজা, রান্নার ঝক্কি পোহায়?
খরচাও তো অনেক।

আসলে গ্রামের সকলে বলল,
এত ভালো রেজাল্ট, এত বড় সুযোগ -
চার বছর কষ্ট করলেই বিরাট চাকরি।
চাকরি এখানেও ছিল না তা নয়!!
পঞ্চায়েতকে বললেই প্রাইমারী ইস্কুলে --
মায়ে ছেলে দিব্যি চলে যেত।
তবু, ঐ যে "গ্রামের সকলে বলল" -
এই পাসটা দিতেই হয়।


রোজ সন্ধ্যাবেলা তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে
মা আকাশপানে প্রার্থনা করেন।
সারাদিন এধার ওধার করে কেটে যায়,
কাটে না সন্ধ্যার পর, একটানা ঝিঁঝিপোকার শব্দ।
তারপর অনেকরাত্রে ঘুম আসেনা যখন,
জানালার ধারে চাঁদমাখা মাঠটার দিকে
তাকিয়ে ভাবেন --
"মোচার ঘন্ট আর পোস্তর বড়া
কি ভালোই না বাসত।"
তখন তিন বন্ধুকে ঘুমন্ত দেখে
ছাতে পায়চারি করে যায় একটি উনিশবছর
আর গুনগুন করে মুখস্ত বলে সন্ধ্যার পড়া।

পশ্চিমের আকাশে হেলে পরা চাঁদ
মুচকি হেসে মজা করে।
একবার দেখে মাকে,
আর একবার ছেলেকে, প্রতীক্ষায় আছে লড়াইয়ের।
আসলে চাঁদই মিলিয়ে দেয় দু'জনের প্রতীক্ষার,
মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধনের সুতো।



~~~ সুকল্যাণ বসু (মে ২০০৮)

Thursday, April 21, 2016

সাধারণ জ্ঞান

- তোমার জন্য ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে।
- এটা আমার মাও আমার বাবাকে বলত, নতুন কিছু বল।
- ইয়ার্কি রাখো। ছেলেটার দিকে তো একবারও চেয়েও দেখোনা। কি করে না করে খবর রাখো?
- উফ, কি করেছে বল তো? সেই হাওড়া থেকে ৩ জনের সিটে ৫ জন বসে এলাম, ব্রিজে দুবার এল এস খেলাম, আর তুমি...
- সেই তো, তাস। ঐ তাস তোমার আপন হল? আর ছেলেটা কেউ না? কি অবস্থা হয়েছে জানো তুমি? ঈশ, ভাবলেই লজ্জা করে আমার।
- আবার কি করল? এই তো গত সপ্তাহে শুনলাম ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ঘোষবাবুদের জানালার কাঁচ ভেঙেছে। তাঁর দু'দিন আগে নাকি পাশের পাড়ার টুকটুকিকে দেখে "দেখা হে পেহেলি বার" গেয়েছে, দু'বারই আমি ভালো রকম পিটিয়েছিলাম। আজ আবার কি করল? বল, আবার পেটাই।
- পিটিয়ে যদি লাভ হত!! ছি ছি, ওর পরীক্ষার খাতাটা দেখ একবার।
- ফেল করল নাকি? এতদিন তো ফেল করত না, হ্যাঁ ক্লাসে স্ট্যান্ড করে না ঠিক-ই, কিন্তু ফেল করতে তো দেখিনি। আজ হচ্ছে।
- না ফেল করেনি বটে, তবে "সাধারণ জ্ঞান"-এর খাতায় কি লিখেছে জান? টিচার খাতার সামনে বড় করে লিখে দিয়েছেন "হোপলেস"। - কি লিখেছে?
- প্রশ্ন এসেছিল "আগ্রার সবচেয়ে বিখ্যাত বস্তুটি কি?"
- কি লিখেছে? পেঠা তো?
- ওহ, আমার আর কিছু বলার নেই। এই বাবা হলে, তার ছেলে আর কি হবে?
- রাগ করছ কেন? কি লিখেছে?
- হাত মুখ ধুয়ে খেতে এস, আমি "নগরপারের রূপনগর" দেখতে গেলাম। যেমন বাপ, তেমনি ...
- (একান্তে) যাক, ছেলেটা ঠিক ঠাক মানুষ হচ্ছে।


Tuesday, April 12, 2016

আগুন

-- এক প্লেট মাটন বিরিয়ানি।
-- হবে না।
-- হবে না মানে? আপনাদের মাটন বিরিয়ানি নেই?
-- না, জানেনি তো আজ আগুন লেগেছিল, আমরা মাটন করছি না।
-- ধুর বাবা, মাটন ছাড়া বিরিয়ানি হয় নাকি? নিন, চিকেন বিরিয়ানি আনুন নাহয়। দুধের স্বাদ ইত্যাদি...
-- হবে না।
-- মানে? চিকেনও হবে না?
-- না। চিকেন, মাটন, ডিম কিচ্ছু হবে না। আজ আমাদের কোন আমিষ বিরিয়ানি হবে না।
-- তবে কি হবে?
-- ভেজ বিরিয়ানি, পনীর বিরিয়ানি, আলু বিরিয়ানি, সয়াবিন বিরিয়ানি, আপেল বিরিয়ানি, মোচার বিরিয়ানি।
-- আপেল? মোচা? এসব কি? এটা আরসালান তো?
-- একদম স্যার, এ ছাড়াও পাবেন বিরিয়ানি পাও।
-- বিরিয়ানি পাও আবার কি?
-- ঐ যে স্যার, আপনি যেমন বম্বেতে খান, বড়া পাও বা মিসেল পাও, সের'ম। মানে পাও এর মাঝে থাকবে ভেজ বিরিয়ানি।
-- কি? কি বললেন, আমাকে কলকাতায় বসে পাও খাওয়াবেন? আমার পিস্তলটা কই?

*****

-- অভিদা ওঠো, আর কত ঘুমাবে? জেমস টেলরকে নিয়ে লেখাটা শেষ হল?
-- পার্থ? তুই? আমি আরসালানে নেই?
-- আরসালান? ধুর, তুমি তো বম্বেতে আমাদের অফিসে।
-- আরসালানে আগুন লেগেছে জানিস? ওরা আর মাটন বিরিয়ানি করছে না।
-- যত আজে বাজে স্বপ্ন দেখা তোমার। লেখাটা জলদি দাও।
-- দাঁড়া আগে একবার আরসালান কে ফোন করে নিই। হ্যালো আরসালান?