Saturday, March 26, 2016

রত্নাবলীর দিনকাল

টিভিটা বন্ধ করে দিলেন রত্নাবলী। কতক্ষণ আর ভালো লাগে? বারান্দায় এসে বসলেন চেয়ারে। হাতে বই। কাজলের আলমারি থেকে সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্পের বইটি পড়বেন পরিকল্পনা ছিল। বাইরে বেশ মিঠে রোদ এসেছে। এখন নভেম্বর মাস। কলকাতায় হয়ত সবে শীত শুরু হবে হবে করছে। এই আটলান্টা শহরে কিন্তু এখনই বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। কাজল অবশ্য বলে এটা কিছুই না। ডিসেম্বরে নাকি আরও ঠাণ্ডা পড়বে। আসলে এই প্রথম মার্কিন দেশে শীত কাটাচ্ছেন রত্নাবলী। গতবছরও এই সময় তাঁদের কসবার বাড়িতে হয়ত বড়ি দিচ্ছিলেন। কাজল এবার থাকতে দিল না কলকাতায়।
   "কি করবে একা একা ওই ঠাণ্ডার মধ্যে? তার মধ্যে আমাদেরও এবার আর শীতে যাওয়া সম্ভব না। এখানে এস।"
রত্নাবলী অবশ্য জানেন কেন কাজল তাঁকে এখানে এনেছে। তাঁর বোনকে কাজল বলেছে -- শীতকালে নাকি ডিপ্রেশনে বাড়ে। আর এ বছর তো তিনি একা। "বাবা নেই, মা একা একা বাড়িতে কি করবে? আমাদের কাছে থাকুক।"
         পুজোর পর পরই রত্নাবলী চলে আসেন ছেলের কাছে। এর আগেও যে আসেননি তা নয়। তবে একা এই প্রথম। এয়ারপোর্টে কাজল আর লতা দুজনেই গিয়েছিল। মজার ব্যাপার, যেদিন তিনি এলেন, তার পরেরদিনই এখানে পুজো। আসলে এখানে নাকি উইকেন্ড দেখে দেখে পুজো হয়। সেই পুজোতেও গিয়েছিলেন রত্নাবলী। বিকেলের অনুষ্ঠানে তাঁকে গান গাইতে অনুরোধ করতে থাকল কাজলের বন্ধবান্ধবরা। কাজল ভয় পেয়েছিল, মায়ের মন খারাপ, হয়ত গাইবেন না। তাই বন্ধুদের বোঝানোর চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু রত্নাবলী নিজেই গাইতে রাজি হলেন। আসলে তিনি যে গান ছাড়া থাকতে পারেন না।
   "লতা, তোর নাম লতা হলে কি হবে, তোর শাশুড়ি তো পুরো লতাকণ্ঠী রে?"
শুনে এই বয়সেও লজ্জা পেয়েছিলেন রত্নাবলী।
  ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায় তাঁর। এই হয়। একটা কথা ভাবতে ভাবতে আর একটায় চলে যান। বোলপুরে বড় হওয়া। পড়াশুনো পুরোটাই শান্তিনিকেতনে। ওখানেই গান শেখা। প্রতিবছর তিনি গাইবেন এটা যেন বাঁধাধরা ছিল। হেমন্তর  সঙ্গে আলাপ ঐ পৌষমেলায়। বিয়ের পর গানের চর্চা কিন্তু থামেনই। পাড়ার ফাংশানে নিয়মিত গাইতেন তিনি। এখনকার টিভিতে গানের রিয়েলিটি শো দেখতে দেখতে ভাবেন, তাঁদের সময় যদি এর'ম থাকত, তাহলে হয়ত তিনি আরও নাম করে ফেলতেন। পরক্ষণেই ভাবেন, কি দরকার, এই বেশ ভালো। নির্ঝঞ্ঝাট জীবন।
  গান জীবন থেকে প্রায় বিদায় নিয়েছিল কাজল আসার পর। যে ছোট্ট কাজল তাঁর কোলে শুয়ে কাঁদত, সে কেমন চোখের সামনে বড় হয়ে উঠল, রত্নাবলী ভাল করে বোঝার সময় পেলেন না। কখন যেন কাজলের ভালো লাগাটা "খোকা ঘুমাল, পাড়া জুড়ালো" থেকে কার্টুন হয়ে, সৌরভ-সচিনের মধ্যে দিয়ে ইন্টারনেট আর মোবাইলে পৌঁছে গেল। একদিন কাজল যখন এসে বলল, "স্ট্যানফোর্ডে পি এইচ ডি র জন্য স্কলারশিপ পেয়েছি, পড়তে যাব", রত্নাবলীর মনে হল সত্যি তো, অনেকদিন কেটে গেছে।
   ছেলে বাইরে পড়তে গেলে সাধারণত ময়েরা ভীষণ বিষণ্ণতায় চলে যান। হেমন্ত সেটা আগে থেকেই অনুমান করে রত্নাবলীর জন্য একটা নতুন হারমোনিয়াম কিনে দিলেন। রত্নাবলী বারণ করেছিলেন "কী দরকার, এমনি ওকে আমেরিকা পাঠাতে এত খরচ?"
   আবার গানে ফিরে ফেলেন রত্নাবলী। আবার শুরু হল পাড়ার ফাংশান। গত বছর চলে যাওয়ার দুদিন আগেও হেমন্তর অনুরোধে তাঁকে তিনি "এই করেছ ভালো" শুনিয়েছিলেন।
      এখানে বড় একা লাগে রত্নাবলীর। কাজল-লতা মায়ের কষ্ট হবে বলে নিজেরাই সব রান্না বান্না করে, বাসনও নিজেরাই ধোয়। মাকে কিছুই করতে দেয় না। তাতেও যেন তাঁর আরাম নেই। কোন কাজ নেই, অখণ্ড অবসর, কিন্তু একটা কথা বলার লোক নেই। আগে যতবার এসেছেন, হেমন্ত ছিল সঙ্গে। কর্তা গিন্নি আর কিছু না হোক, স্রেফ ঝগড়া করেও সময় কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু এখন, কার সঙ্গে ঝগড়া করবেন? কাজলের টিভিতে সব বাঙলা চ্যানেল আসে, কিন্তু কতক্ষণ আর টিভি দেখা যায় বলুন?
     সেই সকাল ৯টার সময় বেড়িয়ে যায় কাজল আর লতা। ফিরতে ফিরতে ৭টা বা ৮টা। এতক্ষণ সময় একা একা দিন কাটে তাঁর। শুয়ে শুয়ে বা বারান্দায় বসে অনেক সময় তিনি পুরনো কথা ভাবেন।  বারান্দায় বসে থাকলেও যে লোক দেখা যায় তা নয়। এ তো আর কলকাতা না, যে সামনে দিয়ে "আলু আছে, পটল আছে" বা "বাসন চাই গো বাসন" ডাক শুনতে পারবেন। মাঝে মাঝে শুধু গাড়ির আওয়াজ। বুঝে নিতে হয় তাঁর মধ্যেই মানুষ আছে। উল্টো দিকের বাড়িতে এক বয়স্ক ব্যক্তি থাকেন। শ্বেতাঙ্গ। মাঝে মাঝে তাঁকে দেখে হাত নাড়েন। রত্নাবলীও হালকা হেসে হাত নাড়েন। ব্যস ওইটুকুই। পাশের বাড়িতে একটি ভারতীয় ছেলে থাকে, কোন প্রদেশের অবশ্য তিনি জানেন না। আলাপ নেই কাজলের সঙ্গে সেভাবে। জিগ্যেসও করা হয়নি কাজলকে।
    "হ্যালো।"
ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন রত্নাবলী। এতক্ষণ মানিকবাবুর "সহযাত্রী" গল্পটি পড়ছিলেন। ডাক এসেছে পাশের ওই ভারতীয় ছেলেটির বাড়ি থেকে। যিনি ডাক দিয়েছেন তিনি রত্নাবলীর বয়সি, পরনে হালকা সবুজ রঙের শাড়ি, তবে চুল পুরো সাদা।
 "হ্যালো।"
"আপনি বাঙালী? হাতে বাংলা বই দেখছি?"
"হ্যাঁ, আপনিও?"
"হ্যাঁ। বাঁচা গেল, এখানে এসে যে আর একজন বাঙালীর সঙ্গে আলাপ হবে, ভাবতেই পারিনি। দুদণ্ড কথা বলার তো কাউকে পাওয়া যায় না।"
স্মিত হাসলেন রত্নাবলী।
"নমস্কার দিদি, আমার নাম ছন্দা সেনগুপ্ত। আপনি?"
"আমি রত্নাবলী ভট্টাচার্য।"
"কলকাতায় বাড়ি আপনার?"
"শ্বশুরবাড়ি কলকাতায়। বাপের বাড়ি বোলপুর। আপনার?"
"আমারও বাপের বাড়ি বোলপুরে। বোলপুরের কোথায়?"
"গুরুপল্লী।"
"আপনি কি শান্তিনিকেতনে পড়তেন? প্রতিবার রবীন্দ্রজয়ন্তীতে গান করতেন?"
"হ্যাঁ, আপনি জানেন?"
"আপনার বিয়ের আগের নাম রত্নাবলী বসু তো?"
"হ্যাঁ, আপনি চেনেন নাকি আমায়?"
"আরে মিঠিদি চিনতে পারছ না, আমি পুতুল গো। তোমাদের পাশের বাড়িতে থাকতাম।"
"পুতুল, আচ্ছা, তুমি তো বিজনকাকুর মেয়ে?"
"একদম। তাই ভাবি, গুরুপল্লী তে থাকত, আমার বয়সি, আর আমি চিনতে পারছি না; এটা হতে পারে। তবে তুমি তো আমাকে তুই করে বলতে, আবার তুমি কেন?"

মানিকবাবুর বইটা চেয়ারে ফেলতে ফেলতে রত্নাবলী বুঝলেন তাঁর দিনগুলো আর একাকিত্বে ভরা থাকবেনা।


Saturday, March 19, 2016

মা আসছেন

"আজ ক্লাস হবে না? শিওর?"
"হ্যাঁ রে ভাই, আজ আর ক্লাস নেই। আমরা বিকেলে নবীনায় ধুম দেখতে যাচ্ছি। যাবি? শুনলাম দারুণ হয়েছে।"
"না, ধুর।"
"বাড়ি যাবি?"
"ভাবছি।"
"১ টা বাজে তো? হবে তোর?"
"হয়ে যাবে।"
মিনিট ১৫ বাদে হস্টেল থেকে ব্যাগটা নিয়ে বেরোল সুদেব। মনে করে ব্যাগে ভরে নিল নতুন কেনা পেন্সিল ব্যাটারির টর্চটা। ওটি আজ একান্ত জরুরি। কলকাতা আসার পর থেকে কোনদিন সে এর'ম সময় বাড়ি যায়নি। সবসময় সকালেই যায়। আজ যাবে। একটা সুযোগ যখন এসে গেছে...।
৮ বি তে পৌঁছিয়ে প্রথমেই একটু পেট-পুজো করে নিল সুদেব। বাসস্ট্যান্ডের পিছনে একটা ছোট ভাত খাওয়ার দোকান। মূলত বাস ড্রাইভাররা সেখানে আহার সারেন। সুদেব আগে কয়েকবার খেয়েছে এখানে। ইউনিভার্সিটির সি ই টি ক্যান্টিনের চেয়ে এখানে খাওয়াটা অনেকটাই ভালো। আর দামের ফারাকও সামান্যই।
"কি দেব?"
"মাছ কি আছে?"
"রুই আর পাবদা।"
"না থাক, ডিম ভাত দাও।"
"একটা ডিম ভাত, ৫ নম্বরে।"
খেয়ে দেয়ে ম্যানেজারকে দাম মিটিয়ে একটু মৌরি মুখে পুরে অপেক্ষারত সবুজ রঙের ই ওয়ান বাসে উঠে জানালার ধারে বসল সুদেব। ফাঁকা বাস। পাশের সিটে কেউ নেই দেখে ব্যাগটা পাশেই রাখল। মিনিট দশেকের মধ্যেই বাস চালু হল। যাদবপুর থানা পেড়োতে না পেড়োতেই কন্ডাক্টার এসে দশ টাকার টিকিট কেটে নিলেন। এই ই ওয়ান বাসের ভাড়াটা বেশী বটে, তবে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি হাওড়া যাওয়া যায়। গোলপার্কের কাছটা বেশ জ্যাম পেল সুদেব। আসলে কাল ষষ্টি, লোকে এরমধ্যেই রাস্তায় নেমে পড়েছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রঙ্গিন জামাকাপড় পরে মা বাবার হাত ধরে প্রতিমা দর্শনে বেড়িয়ে পড়েছে। রাস্তায় বড় বড় বিলবোর্ড সেসব পুজোর প্রচারে। গতবছর কলকাতায় যখন প্রথম এলো, সুদেব শুনেছিল এখানে নাকি একটা প্রতিযোগিতা হয় কার পুজো সবচেয়ে ভালো তাই নিয়ে। আর কত পুজো। প্রতি গলিতেই যেন পুজো চলছে। সত্যি, কলকাতাটা কত আলাদা।
   প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় নিল ই ওয়ান হাওড়া পৌঁছাতে। এত দেরি হয়না। কিন্তু পুজোর ভিড়ে কলকাতার অবস্থা পুরো পাল্টে যায়। মান্থলি করাই আছে,  চারটে পাঁচের কর্ড লাইন বর্ধমান লোকাল ধরল সুদেব। ট্রেনএ যথেষ্ট ভিড়, সবাই আজ যেন সাত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চায়। কোনরকমে একটা সিট পেল সুদেব। যদিও এবার আর জানালার হাওয়া খেতে খেতে যেতে পারবে না। ব্যাগটা কোলের কাছে ধরে বসল। এতই ভিড় কামড়ায় যে হকাররাও উঠছে না। অবশেষে কামার কুণ্ডু থেকে ভিড় কমতে থাকল। চন্দনপুর এলে এক চা-ওয়ালার থেকে এক কাপ চা কিনল সুদেব। এই নেশাটা কলকাতা আসার পড় শুরু হয়েছে তার। বাড়িতে ফিরে অভ্যাস বদলাতে হবে।
   ট্রেন যখন বর্ধমানে এলো তখন সোয়া ছ'টা বাজে। এবার যেতে হবে তিনকোনিয়া বাসস্ট্যান্ড। অন্যদিন হলে হেঁটেই চলে যায় সুদেব। কিন্তু আজ তাড়া আছে। একটা রিক্সা করতে হবে। ওভারব্রিজ থেকে নামতেই ছেঁকে ধরল রিক্সাওয়ালারা।
"কোথায় যাবেন বাবু?"
"রিক্সা লাগবে।"
এখানে যে কেন কলকাতার মত অটো হয়না। অবশেষে দরাদরি করে একটা রিক্সা পেল সুদেব। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তিনকোনিয়া। বড়শুল যাওয়ার বাস ছাড়ল একটু বাদেই।
"কোথায় যাবেন?" কন্ডাক্টার জানতে চাইলেন।
"রতনের দোকান।"
"সামনে চলে আসবেন, বাস এমনি দাঁড়ায় না।"
সুদেবের হাতে টিকিট দিয়ে পরিষ্কার জানাল কন্ডাক্টার।
"জানি।"

সাড়ে সাতটার একটু পরেই রতনের দোকানের সামনে নামল সুদেব। রতনদা ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে দোকানের। সুদবদের গ্রামে বাস স্টপ নেই। এই রতনের দোকানের সামনে থেকে যেতে হয়। দিনের বেলা তবু ভ্যান রিক্সা পাওয়া যায়। এখন কিছুই নেই। এবার ব্যাগ থেকে নিজের পেন্সিল ব্যাটারির টর্চটা বার করল সুদেব। তারপর শুরু হল তার পথ চলা। দেড় মাইল মত রাস্তা। আধ ঘণ্টার বেশী লাগার কথা না। প্রথমে পাকা রাস্তা দিয়ে খানিকক্ষণ আর তারপর আল। আলের ওপর দিয়ে সাবধানে হাঁটতে হাঁটতে ভয় পেতে শুরু করল সুদেব। চারধারে কেউ নেই। দূরে কাগতাড়ুয়াটাকে দেখে কেমন যেন গা ছমছম করছে। মনটা অন্যদিকে নিয়ে যেতে চাইল সে। ভাবতে লাগল পুজোর কথা। কলকাতায় কত পুজো দেখে এলো। অথচ তাদের গ্রামে পুজোই হয়না। পাশের মধুপুর হাটে একটা পুজো হয়, গ্রামের সবাই সেখানেই যায়। সারাবছরের সঙ্গে এই সময়ের সন্ধ্যাগুলোর কোন ফারাক নেই তাদের গ্রামে। ঢাকের শব্দ শোনা যায়না, মাইকে গানও বাজে না, লোকের ভিড়ও থাকে না। গতবছরও ছুটিতে বাড়ি চলে এসেছিল সুদেব। এবছর ভেবেছিল কলকাতার পুজো দেখবে। কিন্তু যেই শোনা ছুটি পড়েছে, যাদবপুরের ওই চার দেওয়ালের ঘরে আর থাকতে ইচ্ছে করল না তার। আদৌ কি কোনদিন কলকাতার পুজো দেখা হবে সুদেবের!! চাকরি পেলে একবার মা বাবাকে নিয়ে কলকাতায় থাকবে সে। কলকাতার পুজো দেখবে সবাই মিলে।

এইসব ভাবনার মধ্যে সামনে তাকাতেই এবার নজরে পড়ল তাদের গ্রাম। আর ওইতো তাদের বাড়ি। এখনো গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি, তাই বাড়িতে মা লন্ঠন জ্বালিয়ে রাখেন। এত দূর থেকে সেই লন্ঠনের আলো চোখে পড়ে মনটা খুশিতে নেচে উঠল সুদেবের। এক মুহূর্তে ভুলে গেল গোলপার্কের ভিড়, পুজোর বিলবোর্ড, ঢাকের আওয়াজ।

আসলে পুজোর সময় শুধু যে মা সন্তানের কাছে আসেন তা নয়, মাঝে মাঝে সন্তানও মায়ের কাছে ফেরে। 

Thursday, March 10, 2016

বাড়ি থেকে পালিয়ে

তখন বোধহয় ক্লাস থ্রিতে পড়ি। জন্মদিনে উপহার পেলাম শিবরামের ছোটদের গল্প। প্রথম গল্প "বাড়ি থেকে পালিয়ে"। গোগ্রাসে গিলে ফেললাম। অদ্ভুত ভালো লাগল। আমার একটা স্বভাব হচ্ছে কোন গল্প ভালো লাগলে বার বার পড়ি। "বাড়ি থেকে পালিয়ে" যে কতবার পড়েছি তার হিসেব নেই। কয়েক বছর বাদে "ছুটি ছুটি" তে ঘটকবাবুর সিনেমাটা দেখলাম। শুনেছিলাম ঘটকবাবু নামকরা পরিচালক, তার উপর আমার প্রিয় গল্প, তাই প্রত্যাশা ছিল গগনচুম্বী। কিন্তু সিনেমা দেখে ভীষণ হতাশ হলাম। একেবারেই পছন্দ হল না; সত্যি কথা বলতে কি বেশ খারাপ লেগেছিল।
বহু বছর বাদে সিনেমাটা আবার দেখলাম। গল্পটা এর মাঝে কতবার যে পড়েছি তার হিসেব নেই। এবারো সিনেমাটা ভালো লাগল না। এর মধ্যে আমি ঘটকবাবুর বাকি সব সিনেমা দেখেছি। কেমন লেগেছে সে আর নতুন করে বলার কিছু নেই। কেন এই সিনেমাটা আমার ভালো লাগল না ভাবছিলাম। মনে হয় আমি নিজেই "বাড়ি থেকে পালিয়ে" নিয়ে একটা সিনেমা বানিয়ে ফেলেছি মনে মনে। ঘটকবাবু যদি গল্প না পাল্টাতেন তাহলেও হয়ত আমার সিনেমার সঙ্গে ওনার সিনেমার মিল হত না। কারণ আমার সিনেমায় আমি নিজেই কাঞ্চন। আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওষুধের দোকানে দাঁড়িয়ে আমি খবরের কাগজে মহাত্মা গান্ধীর "স্বরাজ" আনার কথা পড়ছি। চব্বিশ ঘণ্টা উপবাসের পর রাস্তার দোকানের ছাতু আমার অমৃত লাগে। দেশবন্ধুর ভলেন্টিয়ারদের সঙ্গে সারা কলকাতা শহরটা যেন আমি বহুবার হেঁটেছি। না ঋত্বিকবাবু, আপনি এই সিনেমার সঙ্গে টেক্কা দিতে পারবেন না।

Saturday, March 5, 2016

এক বর্ষার বিকেল

ঘন্টাখানেক আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মগুলো এখনো ভালোমতন ভিজে। লোকজন ভিড়ের মধ্যেও সাবধানে যাতায়াত করছে, বেকাদায় পা পিছলে পড়লেই বিপদ। ঝালমুড়ি আর বাদামওয়ালারা জানে এই সময় বিক্রি বেশী হবে, তাই গলার ওপর কোনরকম দয়া না দেখিয়ে চিৎকার করে চলেছে। এই লোকাল ট্রেনের জানালার রডের ওপর জলের ফোঁটা, আর তার ওপর পড়া বিকেলের সূর্যের  আলো দেখে মুক্তো বলে ভুল হতে পারে। একটি ফোঁটা পড়ে গেলে খানিকক্ষণের মধ্যেই আর একটি তার জায়গা নেয়। অদ্ভুত এই দৃশ্য দেখে মজা পাচ্ছিল বছর আঠারোর ছেলেটি। ছিপছিপে চেহারা, হাল্কা গোঁফের রেখা, পরনে নীল হাফ শার্ট, কালো প্যান্ট আর চটি। পাশের বয়স্ক মানুষটির পরনে ধুতি-পাঞ্জাবী। বয়স্ক মানুষটি এবার এক চাওয়ালার কাছ থেকে দুটি চা কিনলেন।
"খা, এবার আস্তে আস্তে চা খাওয়া শুরু কর।"
চায়ের ভাঁড়গুলি সবে ট্রেনের জানালা দিয়ে নিচে ফেলা হয়েছে, এই সময় ট্রেনে উঠে এলেন একদল নিত্যযাত্রী। আশেপাশের খালি সিটগুলি দখল করার পর তাদের চোখ যায় এই দুই সহযাত্রীর উপর। 
"উঠুন দাদু, ওঠো ভাই, এখানে আমাদের জায়গা রাখা আছে।"
"না আমরা যখন এসেছি তখন এই সিট একদম খালি ছিল।"
"হতেই পারে না, ওঠো দেখাচ্ছি।"
ছেলেটি উঠতেই দেখা গেল সিটের উপর একটি তিন ইঞ্চি বাই তিন ইঞ্চি খবরের কাগজের টুকরো অটকানো আছে। 
"ওই দেখ, ওটাই আমাদের জায়গা। মিথ্যে কথা বললে ভাই? এইটুকু বয়সে এরকম মিথ্যে কথা বলা? স্কুলে কি শেখায়?" 
বলে সহনিত্যজাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বেশ জোরে হেসে উঠলেন ক্রিম রঙের ফুল শার্ট আর বাদামী প্যান্ট পরিহিত অশোকবাবু। 
"ঠিক আছে আমি উঠছি, কিন্তু প্লিজ আমার দাদুকে বসতে দিন।" লজ্জায় কান লাল, তবু বলল ছেলেটি। 
"না রে, তুই বোস, কত ধকল গেল তোর আজ। আমি উঠছি।" 
"আরে দাঁড়ান দাদু, আপনারা দাদু নাতি কেউই বসবেন না। এখন অফিস টাইম, এক এক সিটে চার জন করে বসে, তার মধ্যে আপনারা বসতে চাইলে হয়? নিন নিন, উঠুন।" 
অশোকবাবু যেন জোর করে উঠিয়ে দিলেন ওদের। পাশে দাঁড়ানো চশমা পড়া ভদ্রলোকের বোধহয় দয়া হল। ছেলেটিকে বললেন 
"বর্ধমান যাবে তো? চিন্তা করো না, মাঝের গ্রামে ট্রেন দাঁড়ালে অনেকে নামবে। তখন তোমার দাদু বসতে পারবেন।"


গা ঝাড়া দিয়ে রওয়ানা হল ডাউন বর্ধমান গ্যালোপিং লোকাল কর্ড লাইন সুপার। সূর্যাস্তের এখনও অনেক দেরি থাকলেও, হাওড়া কারশেডের গাড়িগুলোর মধ্যে যেন এক বিষণ্ণতা চলে এসেছে। সারাদিন অফিস পাড়ায় কর্মরত নিত্যযাত্রীদের মতই এই ট্রেনের কামড়াগুলো যেন বহুদিন পথ চলে ক্লান্ত। প্রতিদিন এই সময় ঘরফেরা নিত্যযাত্রীদের দেখে তারা সমব্যাথী হয়ে পড়ে। 

ট্রেন লিলুয়া পেরোতেই বেড়িয়ে পড়ল তাস। একটি খবরের কাগজ পেতে খেলা শুরু করলেন অশোকবাবু ও অন্যান্যরা। গ্যালোপিং লোকাল, তাই প্ল্যাটফর্ম বা পাশে দাঁড়ানো বাকি লোকাল ট্রেনগুলিকে পাত্তা না দিয়ে পেড়িয়ে গেল বেলুড়, বালি, বেলানগর। তাস দিতে দিতে এবার কথা বললেন সেই চশমা পড়া ভদ্রলোক।
"কি অশোকদা, কাল তো ছুটি। তোমার তো আবার এসব সেকেন্ড স্যাটারডে আছে। আমার মত না।"
"আর ছুটি, কাল একগাদা কাজ আছে রে সকাল থেকে।"
"আবার কি কাজ? বস কালকেও আসতে বলেছে নাকি?"
"না না, সেসব না রে। বাড়ির কাজ। মন্ট তো জানিস এবার মধ্যমিক পাশ করল। ওদের স্কুলের কোন এক ছেলে নাকি এবার জয়েন্টে স্ট্যান্ড করেছে। তো মনটুকে নিয়ে কাল সকালে তার বাড়ি যেতে হবে।"
"কেন? সেই ছেলে মনটুকে পড়াবে নাকি?"
"ধুর, তোর যেমন বুদ্ধি। তা নয়, আরে এই বড় দাদাদের বই খাতাগুলো পেলে মন্টুর সুবিধা হবে না? ভাব না, যে ছেলে স্ট্যান্ড করেছে, তার খাতায় কত নোটস আছে, সেগুলো যদি মন্টু পড়তে পারে, কে আটকাবে ডাক্তার হওয়া থেকে? হা হা হা, আরে জানিস না, এই খাতা নেওয়া নিয়েও কি লড়াই। মন্টু তো ভয় পাচ্ছিল অন্যান্য কেউ খাতা নিয়ে নিয়েছে কিনা। বলে 'দাদাকে বলে রেখেছি, কাল সকালেই যাবো'। এখন আমাকে এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে কাল সকালে যেতে হবে ছেলেটির বাড়ি। এগুলো শিখে রাখ। তোর মেয়ে তো এবার ক্লাস সেভেনে উঠল। কদিন বাদে তোকেও করতে হবে এসব।" 
"বাড়ী কোথায় ছেলেটির?"
"পার্কাস রোডে, এই তো মন্টুর সঙ্গে টাউন স্কুলেই পড়ত।"

এতক্ষণ চুপ করে ট্রেনের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি এবার এগিয়ে গেল অশোকবাবুর কাছে। কাঁধে আলতো করে হাতটা রেখে বলল 
"কাকু, এবার প্লিজ আমার দাদুকে একটু বসতে দিন। নইলে কাল সকালে আমাদের বাড়িতে এসে আপনার ছেলের সামনে লজ্জায় পড়ে যাবেন।" 



Friday, March 4, 2016

চিমিচাঙ্গা এবং ...

- গুড মর্নিং পল্টু।
- গুড ইভনিং দাদাভাই। রাত্রে খাওয়া হয়ে গেছে?
- পেট ভরা ছিল রে, তাই বিশেষ কিছু খাইনি। তোকে আজ চিমিচাঙ্গার গল্প বলব।
- সেটা কি রে?
- একটা মেক্সিকান খাবার। আজ প্রথম খেলাম। উফ, কি খেতে রে। মাংস দিয়ে, ভাত দিয়ে, রুটি দিয়ে, চিজ দিয়ে, উফ ... সঙ্গে একটা সাদা সস, নাম নাকি সাউর ক্রিম আর সবজি। যা খেতে না!!
- হেব্বি বল? শুনেই তো লোভ হচ্ছে। একটা ছবি তুলে রাখতে পারতিস তো? মেল করে পাঠাতিস।
- সরি রে, ভীষণ ভুল হয়ে গেছে। পরেরবার খেলে নিশ্চয় তুলব।
- খুব দামি জিনিস?
- তেমন দাম না রে, ৭ টাকা লাগল।
- ৭ টাকা? আমাদের ভারতের টাকা ওখানে চলে?
- আরে না না, আমরা বাঙ্গালীরা এখানে ডলার কে টাকাই বলি। ৭ ডলার দাম।
- সে তো অনেক রে, প্রায় পাঁচশ টাকা।
- ওভাবে ভাবিস না। তাহলে এখানে সব কিছুই তোর দামী লাগবে। তুই এখানে এলে তোকে নিশ্চয় খাওয়াব।
- ধুর, আমি কবে যাই।
- তোকে বলেছিলাম এবার জি আর ই -র পড়াশোনা শুরু করতে, করলি? আমার ব্যারন্সটা তো বাড়িতেই আছে।
- পড়ব রে, আসলে ঐ অত ইংরেজি শব্দ মুখস্ত করতে ভয় করে।
- আরে আমার কার্ডগুলো ব্যবহার কর, সুবিধা হবে।
- ঠিক আছে।
- আর ওদিকের কি খবর? মা কি করছে? বাবা?
- মা তো সকালে উঠেই রান্নাঘরে, বাবা পেপার পড়ছে।
- তুই প্রিয়াঙ্কাকে প্রপোজ করতে পারলি? কাল তো বলেছিলি করবি?
- না রে, ভয় পেয়ে গেলাম।
- যা শালা, কাল যে বললি দেখা করবি, ওর কলেজ থেকে দুজনে মিলে কোথায় যাবি, তারপর ...
- হ্যাঁ রে, ওর কলেজের সামনে গিয়েছিলাম। তারপর প্ল্যান ছিল কৃষ্ণসায়র পার্কে গিয়ে ওকে বলব, কিন্তু পার্কে যাওয়ার কথা বলতেই ভয় হল, যাওয়াও হল না।
- ধুর, তুই একটা অপদার্থ। কিস্যু হবে না। এত ভয় পেলে চলে? তারপর কি করলি? উইমেনস কলেজের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ভ্যারেণ্ডা ভাজলি?
- নাহ, ঐ তেলেভাজার দোকানে গিয়ে আলুর চপ আর ফুলুরি খেলাম।
- কোন দোকান?
- ঐ তো সত্য ফার্মেসীর পাশে, উইমেনস কলেজের গেট থেকে বেড়িয়েই। তুই তো জানিস দোকানটা। সেই বাবা ছোটবেলায় আমাদের জন্য আলুর চপ নিয়ে আসত, মা রাগারাগি করত, আর তুই আর আমি মারামারি করতাম খাওয়ার জন্য। সেই দোকানটা।
- পল্টু প্লিজ।
- কি হল দাদাভাই?
- তুই প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে ঘুরতে যা, প্রপোজ কর, প্রেম কর, সব গল্প আমি শুনছি। কিন্তু ঐ তেলেভাজার গল্প বলিস না। দেড় বছর হয়ে গেল বাড়ি যাইনা, বড্ড মিস করছি রে। ঐ দোকানটা পৃথিবীর বেস্ট তেলেভাজা বানায়।
- জানি দাদা।
- আমাকে আর ঐ আলুর চপের গল্প বলিস না। পরের বার বাড়ি গেলে প্রথমেই দুজন মিলে ওখানে গিয়ে খাব কেমন?
- ঠিক আছে দাদা। তবে তুই আমায় চিমিচাঙ্গার গল্প বলতে পারিস। বেশ লাগে।