Saturday, March 5, 2016

এক বর্ষার বিকেল

ঘন্টাখানেক আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মগুলো এখনো ভালোমতন ভিজে। লোকজন ভিড়ের মধ্যেও সাবধানে যাতায়াত করছে, বেকাদায় পা পিছলে পড়লেই বিপদ। ঝালমুড়ি আর বাদামওয়ালারা জানে এই সময় বিক্রি বেশী হবে, তাই গলার ওপর কোনরকম দয়া না দেখিয়ে চিৎকার করে চলেছে। এই লোকাল ট্রেনের জানালার রডের ওপর জলের ফোঁটা, আর তার ওপর পড়া বিকেলের সূর্যের  আলো দেখে মুক্তো বলে ভুল হতে পারে। একটি ফোঁটা পড়ে গেলে খানিকক্ষণের মধ্যেই আর একটি তার জায়গা নেয়। অদ্ভুত এই দৃশ্য দেখে মজা পাচ্ছিল বছর আঠারোর ছেলেটি। ছিপছিপে চেহারা, হাল্কা গোঁফের রেখা, পরনে নীল হাফ শার্ট, কালো প্যান্ট আর চটি। পাশের বয়স্ক মানুষটির পরনে ধুতি-পাঞ্জাবী। বয়স্ক মানুষটি এবার এক চাওয়ালার কাছ থেকে দুটি চা কিনলেন।
"খা, এবার আস্তে আস্তে চা খাওয়া শুরু কর।"
চায়ের ভাঁড়গুলি সবে ট্রেনের জানালা দিয়ে নিচে ফেলা হয়েছে, এই সময় ট্রেনে উঠে এলেন একদল নিত্যযাত্রী। আশেপাশের খালি সিটগুলি দখল করার পর তাদের চোখ যায় এই দুই সহযাত্রীর উপর। 
"উঠুন দাদু, ওঠো ভাই, এখানে আমাদের জায়গা রাখা আছে।"
"না আমরা যখন এসেছি তখন এই সিট একদম খালি ছিল।"
"হতেই পারে না, ওঠো দেখাচ্ছি।"
ছেলেটি উঠতেই দেখা গেল সিটের উপর একটি তিন ইঞ্চি বাই তিন ইঞ্চি খবরের কাগজের টুকরো অটকানো আছে। 
"ওই দেখ, ওটাই আমাদের জায়গা। মিথ্যে কথা বললে ভাই? এইটুকু বয়সে এরকম মিথ্যে কথা বলা? স্কুলে কি শেখায়?" 
বলে সহনিত্যজাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বেশ জোরে হেসে উঠলেন ক্রিম রঙের ফুল শার্ট আর বাদামী প্যান্ট পরিহিত অশোকবাবু। 
"ঠিক আছে আমি উঠছি, কিন্তু প্লিজ আমার দাদুকে বসতে দিন।" লজ্জায় কান লাল, তবু বলল ছেলেটি। 
"না রে, তুই বোস, কত ধকল গেল তোর আজ। আমি উঠছি।" 
"আরে দাঁড়ান দাদু, আপনারা দাদু নাতি কেউই বসবেন না। এখন অফিস টাইম, এক এক সিটে চার জন করে বসে, তার মধ্যে আপনারা বসতে চাইলে হয়? নিন নিন, উঠুন।" 
অশোকবাবু যেন জোর করে উঠিয়ে দিলেন ওদের। পাশে দাঁড়ানো চশমা পড়া ভদ্রলোকের বোধহয় দয়া হল। ছেলেটিকে বললেন 
"বর্ধমান যাবে তো? চিন্তা করো না, মাঝের গ্রামে ট্রেন দাঁড়ালে অনেকে নামবে। তখন তোমার দাদু বসতে পারবেন।"


গা ঝাড়া দিয়ে রওয়ানা হল ডাউন বর্ধমান গ্যালোপিং লোকাল কর্ড লাইন সুপার। সূর্যাস্তের এখনও অনেক দেরি থাকলেও, হাওড়া কারশেডের গাড়িগুলোর মধ্যে যেন এক বিষণ্ণতা চলে এসেছে। সারাদিন অফিস পাড়ায় কর্মরত নিত্যযাত্রীদের মতই এই ট্রেনের কামড়াগুলো যেন বহুদিন পথ চলে ক্লান্ত। প্রতিদিন এই সময় ঘরফেরা নিত্যযাত্রীদের দেখে তারা সমব্যাথী হয়ে পড়ে। 

ট্রেন লিলুয়া পেরোতেই বেড়িয়ে পড়ল তাস। একটি খবরের কাগজ পেতে খেলা শুরু করলেন অশোকবাবু ও অন্যান্যরা। গ্যালোপিং লোকাল, তাই প্ল্যাটফর্ম বা পাশে দাঁড়ানো বাকি লোকাল ট্রেনগুলিকে পাত্তা না দিয়ে পেড়িয়ে গেল বেলুড়, বালি, বেলানগর। তাস দিতে দিতে এবার কথা বললেন সেই চশমা পড়া ভদ্রলোক।
"কি অশোকদা, কাল তো ছুটি। তোমার তো আবার এসব সেকেন্ড স্যাটারডে আছে। আমার মত না।"
"আর ছুটি, কাল একগাদা কাজ আছে রে সকাল থেকে।"
"আবার কি কাজ? বস কালকেও আসতে বলেছে নাকি?"
"না না, সেসব না রে। বাড়ির কাজ। মন্ট তো জানিস এবার মধ্যমিক পাশ করল। ওদের স্কুলের কোন এক ছেলে নাকি এবার জয়েন্টে স্ট্যান্ড করেছে। তো মনটুকে নিয়ে কাল সকালে তার বাড়ি যেতে হবে।"
"কেন? সেই ছেলে মনটুকে পড়াবে নাকি?"
"ধুর, তোর যেমন বুদ্ধি। তা নয়, আরে এই বড় দাদাদের বই খাতাগুলো পেলে মন্টুর সুবিধা হবে না? ভাব না, যে ছেলে স্ট্যান্ড করেছে, তার খাতায় কত নোটস আছে, সেগুলো যদি মন্টু পড়তে পারে, কে আটকাবে ডাক্তার হওয়া থেকে? হা হা হা, আরে জানিস না, এই খাতা নেওয়া নিয়েও কি লড়াই। মন্টু তো ভয় পাচ্ছিল অন্যান্য কেউ খাতা নিয়ে নিয়েছে কিনা। বলে 'দাদাকে বলে রেখেছি, কাল সকালেই যাবো'। এখন আমাকে এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে কাল সকালে যেতে হবে ছেলেটির বাড়ি। এগুলো শিখে রাখ। তোর মেয়ে তো এবার ক্লাস সেভেনে উঠল। কদিন বাদে তোকেও করতে হবে এসব।" 
"বাড়ী কোথায় ছেলেটির?"
"পার্কাস রোডে, এই তো মন্টুর সঙ্গে টাউন স্কুলেই পড়ত।"

এতক্ষণ চুপ করে ট্রেনের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি এবার এগিয়ে গেল অশোকবাবুর কাছে। কাঁধে আলতো করে হাতটা রেখে বলল 
"কাকু, এবার প্লিজ আমার দাদুকে একটু বসতে দিন। নইলে কাল সকালে আমাদের বাড়িতে এসে আপনার ছেলের সামনে লজ্জায় পড়ে যাবেন।" 



3 comments: