ট্রেন থেকে নেমে আস্তে আস্তে হেঁটে ওভারব্রিজের কাছে এলেন অভয়বাবু। বহুদিন পরে এলেন। আগে হলে তরতরিয়ে উঠে যেতেন। এখন আর পারবেন না। এক ধার ধরে ধীরে ধীরে ওঠাই শ্রেয়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। আজ আকাশ ফরসা। বর্ষা শেষ। ক'দিন বাদেই পুজো। কলকাতার রাস্তাঘাটে পুজোর বাজারের ভিড়। এই মফঃস্বলে কি অবস্থা কে জানে?
সুবিনয় ছাড়া আর কোন বন্ধু এখানে থাকে না। সুবিনয় নিজের পারিবারিক ব্যবসা সামলাচ্ছে। বলেই দিয়েছে -- "স্টেশনে নেমে রিক্সাকে বলিস ইন্ডিয়ান সিল্ক হাউজ। ঠিক নিয়ে এসবে। দোকানের পাশেই বাড়ি। আমি তোকে নিয়ে যাব। তবে তুই সকালে আয়। বয়স হয়েছে। রাতে অসুবিধা হবে না?"
"না না, চিন্তা করিসনা। ঠিক পৌঁছে যাব।"
আসলে সকালে যে আসতে পারতেন না তা নয়। সকালে তেমন কাজ ছিলনা। কিন্তু তিনি এই সন্ধ্যাবেলাই আসতে চেয়েছিলেন। তিনি তো সন্ধ্যাবেলাই আসতেন। কলেজে ক্লাস না থাকলে দুপুরের দিকে বাসে চড়ে সোজা হাওড়া স্টেশন। তারপর ট্রেনে নিজের বাড়ির স্টেশন আসতে আসতে সন্ধ্যা নামত। তখন মোবাইল ছিল না। রওয়ানা হওয়ার আগে শুক্রবার বিকেলে বাস স্ট্যান্ডের পাশের বুথ থেকে ফোন করে দিতেন।
ট্রেন থেকে নেমে যখন ওভারব্রিজে উঠতেন, তখন আকাশে আলো নেই। কিন্তু তাঁর জন্য মুখ আলো করে দাঁড়িয়ে থাকতেন আলোদেবী। আলো রায়। পাশের পাড়ায় বাড়ি। তখনো ক্লাস টুয়েলভে পড়েন। সারাদিন ক্লাস, বাস জার্নি, ট্রেন জার্নির ক্লান্তি এক নিমেষে মুছে যেত অভয়বাবুর।
আলোদেবী লেবু লজেন্স খুব ভালোবাসতেন। তাই ট্রেনে কিনে রাখতেন অভয়বাবু। ওভারব্রিজে উঠেই সেই প্যাকেটটি হস্তরান্ত হত। একসাথে হাঁটতেন দু'জনে স্টেশনের বাইরে রাখা সাইকেল স্ট্যান্ড অবধি। মনে আছে আজও হাত ধরতেন না। পাছে কেউ দেখে ফেলে। কিছু বলে। কেউ শোনে। যদি আর দেখা না হয়।
সাইকেল নিয়ে দুজনেই চলে আসতেন বিলুদার দোকানে। এই দোকানে জোড়ায় জোড়ায় কপোত কপোতী আসত। তাই তাঁদের আলাদা করে চিনতে পারা শক্ত। দুজনে দুটো এগ রোল নিয়ে বসতেন। মনে পড়ে সেই দিনটার কথা, যেদিন তিনি এক অন্য স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন --
"জানো, জয়েন্ট নিয়ে খুব চিন্তায় থাকি। যদি না পাই, তোমার মত ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবনা।"
"কেন পাবে না? তুমি তো সুধীনবাবুর কাছে অঙ্ক করছ। উনি যখন বলেছেন তুমি পাবে, তখন পাবেই। আরে তুমি গার্লস স্কুলের সেকেন্ড। তুমি পাবে না?"
"যদি না পাই?"
"পরের বছর চেষ্টা করবে। তোমার যখন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে, নিশ্চয় হবে।"
"কে জানে। দেখি।"
"দেখো তুমি ইঞ্জিনিয়ার হলে না আমরা দুজনে একই কোম্পানিতে চাকরি করব। তারপর অনসাইটে যাব।"
"সেটা কি?"
"আরে আমিও নতুন শিখলাম। অনসাইট মানে হচ্ছে বিদেশ যাওয়া। জান আমার ইচ্ছে আমরা প্যারিস যাব। আইফেল টাওয়ারের ছবি দেখেছ তো?"
"না বাবা, আমি অত দূরে যাব না। আমি বলে আজ পর্যন্ত কলকাতাই গেছি জীবনে একবার। ওখানে গিয়ে পড়তে হবে শুনলেই ভয় করে। আমি প্যারিস যাব না। তার চেয়ে বরং দেখো না, এখানেই যদি কোন চাকরি পাওয়া যায়, আমরা রোজ অফিসের পর বিকেলে বিলুদার দোকানে রোল খেয়ে ঐ অজয়ের ধারে গিয়ে বসব।"
"ধুর, কোথায় আইফেল আর কোথায় অজয়!!"
"আমার এই ভালো লাগে জানো, এই রিক্সা, সাইকেল, বিলুদার দোকান, অজয় নদী, তোমার পাশে থাকা।"
বিলুদা আজ বহুদিন মারা গেছেন। গতবছর স্ত্রীর মৃত্যুর পর অভয়বাবু বুঝতে পারলেন আস্তে আস্তে তার স্মৃতি হারিয়ে যাওয়া শুরু হয়েছে। অনেক ঘটনাই মনে পড়ে না। পাছে এই ওভারব্রিজের ঘটনাগুলি ভুলে যান, তাই তড়িঘড়ি করে এলেন এতদিন বাদে। যদি কিছু মনে পড়ে। এরম করে আস্তে আস্তে তো সারা জীবনটাই একদিন ভুলে যাবেন।
অনেকক্ষণ ওভারব্রিজের উপর ধীরে ধীরে হাঁটলেন অভয়বাবু। কেউ কেউ ধাক্কা মারল। "একটু সরুন দাদু" থেকে "এক্সকিউজ মি", সবই শুনলেন। তবু কিছুতেই মনে পড়লনা। অথচ খবরটা শুনে এই ওভারব্রিজেই এসেছিলেন অভয়বাবু, সেটা মনে আছে। আলোদেবী বিয়ের পর ঘাটশিলা না বালুরঘাট কোথায় গিয়েছিলেন, একদম মনে পড়ল না।