Thursday, December 17, 2020

মফঃস্বলের প্রেম -- ৩

 ট্রেন থেকে নেমে আস্তে আস্তে হেঁটে ওভারব্রিজের কাছে এলেন অভয়বাবু। বহুদিন পরে এলেন। আগে হলে তরতরিয়ে উঠে যেতেন। এখন আর পারবেন না। এক ধার ধরে ধীরে ধীরে ওঠাই শ্রেয়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। আজ আকাশ ফরসা। বর্ষা শেষ। ক'দিন বাদেই পুজো। কলকাতার রাস্তাঘাটে পুজোর বাজারের ভিড়। এই মফঃস্বলে কি অবস্থা কে জানে? 

সুবিনয় ছাড়া আর কোন বন্ধু এখানে থাকে না। সুবিনয় নিজের পারিবারিক ব্যবসা সামলাচ্ছে। বলেই দিয়েছে -- "স্টেশনে নেমে রিক্সাকে বলিস ইন্ডিয়ান সিল্ক হাউজ। ঠিক নিয়ে এসবে। দোকানের পাশেই বাড়ি। আমি তোকে নিয়ে যাব। তবে তুই সকালে আয়। বয়স হয়েছে। রাতে অসুবিধা হবে না?"

"না  না, চিন্তা করিসনা। ঠিক পৌঁছে যাব।"

আসলে সকালে যে আসতে পারতেন না তা নয়। সকালে তেমন কাজ ছিলনা। কিন্তু তিনি এই সন্ধ্যাবেলাই আসতে চেয়েছিলেন। তিনি তো সন্ধ্যাবেলাই আসতেন। কলেজে ক্লাস না থাকলে দুপুরের দিকে বাসে চড়ে সোজা হাওড়া স্টেশন। তারপর ট্রেনে নিজের বাড়ির স্টেশন আসতে আসতে সন্ধ্যা নামত। তখন মোবাইল ছিল না। রওয়ানা হওয়ার আগে শুক্রবার বিকেলে বাস স্ট্যান্ডের পাশের বুথ থেকে ফোন করে দিতেন। 

ট্রেন থেকে নেমে যখন ওভারব্রিজে উঠতেন, তখন আকাশে  আলো নেই। কিন্তু তাঁর জন্য মুখ আলো করে দাঁড়িয়ে থাকতেন আলোদেবী। আলো রায়। পাশের পাড়ায় বাড়ি। তখনো ক্লাস টুয়েলভে পড়েন। সারাদিন ক্লাস, বাস জার্নি, ট্রেন জার্নির ক্লান্তি এক নিমেষে মুছে যেত অভয়বাবুর। 

আলোদেবী লেবু লজেন্স খুব ভালোবাসতেন। তাই ট্রেনে কিনে রাখতেন অভয়বাবু। ওভারব্রিজে উঠেই সেই  প্যাকেটটি হস্তরান্ত হত। একসাথে হাঁটতেন দু'জনে স্টেশনের বাইরে রাখা সাইকেল স্ট্যান্ড অবধি। মনে আছে আজও হাত ধরতেন না। পাছে কেউ দেখে ফেলে। কিছু বলে। কেউ শোনে। যদি আর  দেখা না হয়। 

সাইকেল নিয়ে দুজনেই চলে আসতেন বিলুদার দোকানে। এই দোকানে জোড়ায় জোড়ায় কপোত কপোতী আসত। তাই তাঁদের আলাদা করে চিনতে পারা  শক্ত। দুজনে দুটো এগ রোল নিয়ে বসতেন। মনে পড়ে সেই দিনটার কথা, যেদিন তিনি এক অন্য স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন -- 

"জানো, জয়েন্ট নিয়ে খুব চিন্তায় থাকি। যদি না পাই, তোমার মত ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবনা।"

"কেন পাবে না? তুমি তো সুধীনবাবুর কাছে অঙ্ক করছ। উনি যখন বলেছেন তুমি পাবে,  তখন পাবেই। আরে তুমি গার্লস স্কুলের সেকেন্ড। তুমি পাবে না?"

"যদি না পাই?"

"পরের বছর চেষ্টা করবে। তোমার যখন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে, নিশ্চয় হবে।"

"কে জানে। দেখি।"

"দেখো তুমি ইঞ্জিনিয়ার হলে না আমরা দুজনে একই কোম্পানিতে চাকরি করব। তারপর অনসাইটে যাব।"

"সেটা কি?"

"আরে আমিও নতুন শিখলাম। অনসাইট মানে হচ্ছে বিদেশ যাওয়া। জান আমার ইচ্ছে আমরা প্যারিস যাব। আইফেল  টাওয়ারের ছবি দেখেছ তো?"

"না  বাবা,  আমি অত দূরে যাব  না। আমি বলে আজ পর্যন্ত কলকাতাই গেছি জীবনে একবার। ওখানে গিয়ে পড়তে হবে শুনলেই  ভয় করে। আমি প্যারিস যাব না। তার চেয়ে বরং দেখো না, এখানেই যদি কোন চাকরি পাওয়া যায়, আমরা রোজ অফিসের পর বিকেলে বিলুদার দোকানে রোল খেয়ে ঐ অজয়ের  ধারে গিয়ে  বসব।" 

"ধুর, কোথায় আইফেল আর কোথায় অজয়!!"

"আমার এই ভালো লাগে জানো, এই রিক্সা, সাইকেল, বিলুদার দোকান,  অজয় নদী, তোমার পাশে থাকা।" 


বিলুদা আজ বহুদিন মারা গেছেন। গতবছর স্ত্রীর মৃত্যুর পর অভয়বাবু বুঝতে পারলেন আস্তে আস্তে তার স্মৃতি হারিয়ে যাওয়া শুরু হয়েছে। অনেক ঘটনাই মনে পড়ে না। পাছে এই ওভারব্রিজের ঘটনাগুলি ভুলে যান, তাই তড়িঘড়ি করে এলেন এতদিন বাদে। যদি কিছু মনে পড়ে। এরম করে আস্তে আস্তে তো সারা জীবনটাই একদিন ভুলে যাবেন। 

অনেকক্ষণ  ওভারব্রিজের উপর ধীরে ধীরে হাঁটলেন অভয়বাবু। কেউ কেউ ধাক্কা মারল। "একটু সরুন দাদু" থেকে "এক্সকিউজ মি", সবই শুনলেন।  তবু কিছুতেই মনে পড়লনা। অথচ খবরটা শুনে এই ওভারব্রিজেই এসেছিলেন অভয়বাবু, সেটা মনে আছে। আলোদেবী বিয়ের পর ঘাটশিলা না বালুরঘাট কোথায় গিয়েছিলেন, একদম মনে পড়ল না। 


Monday, November 23, 2020

অপুর সংসার ও বিকেলবেলা

 অপুর সংসার দেখছিলাম। সৌমিত্রবাবু চলে গেছেন বলে আর একবার। অত্যন্ত প্রিয় সিনেমা এটি। যাই হোক, লক্ষ্য করলাম  সিনেমার বেশিরভাগ বড় ঘটনাই  বিকেলবেলা। কিছু কিছু আমি নিজের মনে কল্পনা করে নিয়েছি। সাদা কালো ছবি, তাই বিকেলবেলা ভাবতেই পারা যায়। 

প্রথম যখন অপুর সাথে পুলুর দেখা হয়। মনে করে  দেখুন। কলকাতায় নিজের ভাড়া বাড়িতে ছেঁড়া গেঞ্জি পরে বসে ছিল অপু। হয়ত তখন এক গরমের বিকেল। বিকেলে তেমন হাওয়া নেই, ভ্যাপসা গুমোট। ছাদেও হাওয়া ছিলনা নিশ্চয়। নাহলে অপু তো ছাদে থাকত। এই সময় পুলুর আগমন। 

আবার খুলনায় সেই বিকেলটার কথা। সেটি বিকেল না হয় অবশ্য দুপুরে হতে পারে। তবে কিনা বিয়েবাড়ির মধ্যে দুপুরে খেয়ে দেয়ে ঘুমোতে গেলে বিকেল হয়েই যায়। অপর্ণার বরও তো সেই সময় এসেছিল। অপু নদীর ধারে একটি বই মাথায় দিয়ে শুয়ে। হাতে বাঁশী। হয়ত খানিকক্ষণ আগেই বাজাচ্ছিল। এমনি খুলনায় কলকাতার মত অত লোকজন নেই। তায় নদীর ধার। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। গাছের স্নিগ্ধ ছায়ায় শুয়ে অপুর হয়ত নিশ্চিন্দপুরের কথা মনে পড়ছিল। নদীতে মাঝির গান শুনতে শুনতে হয়ত ভাবছিল নিজের পরিবারের কথা, ছোটবেলার বন্ধুদের কথা। এই সময় পুলু তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। 

অপর্ণার সঙ্গে অপুর শেষ দেখাও পড়তি বিকেলে। প্রায় সন্ধ্যাবেলা। তখন সবে সূর্য ডুবেছে। ট্রেন ছাড়ছে। স্টেশনের ভিড়, লোকের ঠেলা, চা-ওলার আওয়াজ, কয়লার গন্ধ, সব মিলিয়ে এক আলাদা বিকেল যেন। তার মধ্যে অপুর চোখে আটকে আছে অপর্ণার কাজল কালো চোখ। 

অপর্ণার মৃত্যুসংবাদটিও অপু পায় এক বিকেলবেলা। সারাদিন অফিস করে অপর্ণার চিঠি পড়তে  পড়তে  হাসি মুখে বাড়ি এসে দরজা খুলতে গিয়ে দেখে ছাদে মুরারি দাঁড়িয়ে। সেটা বোধহয় শীতকাল। মুরারি শাল গায়ে দিয়েছিল। শীতের বিকেল বড় হয়না, বড্ড কষ্ট দেয়। ফাটা ঠোঁট, শুকনো গা, তার উপর অপর্ণার বিয়োগ, যেন সব কিছুতেই এক অনুপস্থিতিকে  প্রকট করছিল। শীতকালে চড় খেলে লাগে বেশী। বেচারি মুরারি। 

এরপর আসা যাক নাগপুরের কয়লাখনিতে। পুলু যখন অপুকে নিজের ছেলের কথা বলতে আসে। সেটি শীতকাল। তার উপর নাগপুরের ঠাণ্ডা। কেন নিজের ছেলেকে দেখতে পারেনা বলতে গিয়ে সেই  অনুপস্থিতি বার বার যেন অপুকে বিঁধছিল। জানে ভুল  করছে, যা করছে তার কোন যুক্তি নেই। তাও করছে।  পুলু চলে যাওয়ার পর যখন ঐ শীতের মধ্যে ঐ উপত্যকায় একা একা পুলুকে ডাকছিল,  যেন মনে হচ্ছিল কারোর অনুপস্থিতি না, কোন দোষ না, শুধু যেন একাকীত্ব তাকে বার বার গ্রাস করছে। দিদি, বাবা, মা, স্ত্রী, এই একাকীত্ব তাকে যেন ছাড়ছেই না। 

খুলনায় আর এক বিকেল।  অপু এসেছে নিজের ছেলেকে দেখতে। ছেলে শুয়ে আছে। জ্বর। অপু বিছানার পাশে এক কেদারায় বসল। জানালা খোলা। ভাটিয়ালি গানের সুর ভেসে আসছে নদী থেকে। ছেলেটিকে দেখে অপুর কী মনে পড়ল কে জানে। হয়ত নিজের ঐ বয়সের কথা। নিশ্চিন্দপুরে দিদির সাথে খেলত। অথবা নিজের স্কুল জীবনের কথা। যখন ছুটি হলে অপু বাড়ি ফিরতে পারতনা। একা বোর্ডিং-এ বসে থাকত।  

বিয়োগব্যথা, অনুপস্থিতি, একাকীত্ব, অপুর সকল অভিমান যেন মিশে গেছে বিকেলবেলায়। 

Wednesday, October 28, 2020

একাকীত্ব আর মেঘলা আকাশ

 গত ক'দিন ধরে ডালাসের আকাশ মুখ গোমড়া করে আছে। তার মধ্যে বেশ ঠাণ্ডা আর সঙ্গে বৃষ্টি। গতকাল তো সকালে -১ সেলসিয়াস ছিল। দুপুরে মিটিঙের ফাঁকে কফি নিয়ে সোফায় বসে বাইরের দিকে চেয়ে থাকি। ঠাণ্ডায় বারান্দায় যেতে পারিনা। পর্দা সরানো থাকে। কাঁচের ফাঁক দিয়ে তাকাই। বৃষ্টি থেমে গেলে চারদিক কেমন যেন থম থম করে। বাড়ির সামনে লাল হয়ে যাওয়া পাতা যেন ভয়ে কাঁপছে। আশেপাশে লোকজন কম। শুধু কিছুই গাড়ি। তার মধ্যে আরোহীকে দেখা যায়না। তাই  মনে হয় যেন এক রোবট যুগে আছি, যেখানে শুধুই যন্ত্র। 

এই মেঘলা দিনে একাকীত্ব কিন্তু বেশী করে দানা বাঁধে। প্রিয়জনকে হারানোর যন্ত্রণা সেই কষ্টকে বাড়িয়ে দেয়। কোথাও যেন ভালোবাসা আর অধিকার এক হয়ে যায়। পুরোন স্মৃতি, কিছু অনুশোচনা, আর বার বার ভুল শুধরে নেওয়ার ব্যর্থ ইচ্ছে। মায়া। ভালোবাসা, অধিকার না মায়া। ছোটবেলায় এক টাকার মৌরি লজেন্সের সঙ্গে পাওয়া প্লাস্টিকের স্কুটারের চাকা ভেঙ্গে গেলে কেঁদে ভাসাতাম। আজ হেলায় এক বছরের পুরনো দামী মোবাইল ফোন পাল্টে ফেলি। 

মেঘলা দিনে একা হতে চাওয়ার আকাঙ্কা সবার হয়না। কেউ কেউ আবার এর থেকে বেরোতে চায়। মন  খারাপ লাগলে চেষ্টা করে কীভাবে ভিড়ে মিশে যাওয়া যায়। নিজের অস্তিত্বের বৈধতা রক্ষার দায় এসে যায় মনের গভীরে। তাও ভালো এখন সোশাল নেটোয়ার্ক আছে। নিজেকে ভেঙ্গে, নতুন করে সংগঠন করে, একা না হতে চাওয়া, সবাইকে বলা "এই দেখো, আমি আছি, আমাকে দেখো"  -- নিজের জীবনের প্রতিপাদন দরকার পরে। 

তবু আমাদের মত লোকেরা বাঁচে, ভাবে কবে ঐ মেঘলা আকাশ এসবে। কারুর কাছে না, নিজের কাছে নিজের কষ্ট মেলে ধরবে। একা থাকবে। একাকীত্বের সুখ সকলে বোঝেনা। 

Tuesday, October 6, 2020

পাতাঝরা বিকেলবেলা

 ডালাস শহরে এক বছর হয়ে গেল। যা বুঝেছি, এই মরুভূমির দেশে মে আর অক্টোবার হচ্ছে সবচেয়ে বাসযোগ্য। এখানে গরমটা একটু দেরী করে আসে, তাই মে মাসটা বেশ সুন্দর। এদিকে মে মাসে নীল রঙের একটি ফুল হয় -- নাম ব্লুবনেট। অক্টোবারে গরমটা চলে যায়, কিন্তু শীত আসেনা। হাল্কা একটা ঠাণ্ডা হাওয়া দেয়। রাতে একটা হাল্কা চাদর গায়ে দিয়ে শুতে হয়। বেশ লাগে। 

আমাদের কমপ্লেক্সে একটা বড় হাঁটার জায়গা আছে -- যাকে এদেশে বলে ওয়াকিং ট্রেল। আমি রোজ বিকেলে সেখানে হাঁটতে যাই, মাস্ক পরে। আজ সকালে একটু সময় ছিল বলে গেলাম। হাল্কা মিঠে একটা রোদ ছিল। বেশ লাগছিল গায়ে রোদের আমেজ। ওদিকে একটি ডগ পার্ক আছে। এক ভদ্রলোক তাঁর পোষা কুকুরটাকে নিয়ে এসেছিলেন। কুকুরটি আমাকে দেখেই পার্কের ভিতর থেকে চেঁচিয়ে উঠল, আমার সঙ্গে খেলতে চায়। আমি হাঁটছি দেখে পার্কের ভিতরে দৌড়াতে আরম্ভ করল। 

পার্কের হাঁটার রাস্তাটা সোজা নয়। সর্পিল। পাশের মাঠে কিছু ছোট ছোট ফুল হয়েছে। কী ফুল নাম জানিনা। একটু দূরে একটা কাঠবেড়ালি ছুটে গেল। ক'দিন আগে হলে খরগোশ-ও দেখতাম। আজকাল ওগুলি আর আসেনা। ঠাণ্ডা পড়ছে বলে বোধহয়। উত্তরের মত এখানে পাতায় এখনো তেমন রং আসেনি। তাও কিছু কিছু পাতায় হাল্কা লাল আভা। আমাদের এই পার্কের পিছনে একটা রেললাইন। তেমন কোন ট্রেন যায়না, দিনে ১-২ বার শুধু মালগাড়ি যায়। আজকে আমি যখন হাঁটছিলাম, একটা মালগাড়ি গেল। মনে পড়ে গেল, বর্ধমানে দূর্গামাসিদের বাড়ি যখন যেতাম, আমি ট্রেন দেখার জন্য পাগল ছিলাম। ওনাদের বাড়ির খুব কাছেই ট্রেন লাইন। ছাদ থেকে পরিষ্কার দেখা যেত। একবার আমি মালগাড়ি দেখছি, মেসো বললেন -- "এটা তো শুধুই মালগাড়ি।" আমার তাতেই আনন্দ। কত বড় মালগাড়ি, শেষ আর হয়না। 

বিকেলবেলা পড়ার ফাঁকে একটু চা নিয়ে বারান্দায় গেলাম। পাতাঝরার দিনে আমাদের কমপ্লেক্সের যাঁরা মেন্টেনেন্সের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের কাজ বেড়ে যায়। রোজ বিকেলবেলা পাতা পরিষ্কার করেন। এই সময়টা সূর্য ঘুরে যায়। গাছের একদিকে আলো আসে, অন্যদিকে ছায়া। বেশ লাগে দেখতে। মনে আছে, এইরকম হাল্কা শীতের দুপুরে বর্ধমানে মা আমাকে কমলালেবু খেতে দিত। শীত পড়লেই বাড়িতে কমলা হাজির। যখন খুব ছোট মা একটা জুসারে কমলার জুস বানিয়ে দিত। তখনকার দিনে একটা ছোট টিফিন বক্সের মত জুসার পাওয়া যেত। উপরটা ত্রিকোণের মত। মাঝে খাঁজ। টক লেবু হলেই বলা হত ওগুলো নাগপুরের। আজও বুঝি না নাগপুরে কি শুধুই টক লেবু পাওয়া যায়? 

পরশু সুপারমার্কেট থেকে কিছু কমলা কিনেছিলাম। বলা বাহুল্য একটাও নাগপুরের না। একটা খেলাম। পোস্টম্যান ভদ্রলোক চলে গেলেন দেখে মাস্ক পরে লেটারবক্স থেকে চিঠি আনতে গেলাম। দেখি একটা ছেলে বেরোচ্ছে। আমাদের কমপ্লেক্সে অনেক ছাত্র ছাত্রীরাও থাকে। এই ছেলেটির মুখ দেখে মনে হল আমাদের দেশের কেউ। বাচ্চা ছেলে, হাল্কা হাল্কা দাড়ি মুখে। হাতে দেখলাম একটা নীল খাম। একবার চোখ যেতেই দেখি খামের উপর লেখা, "ফ্রম মধুছন্দা রায়।" 

Wednesday, July 29, 2020

মফঃস্বলের প্রেমঃ ২

সকালবেলা হাওড়া যাওয়ার লোকাল ট্রেন যখন আওয়াজ করে রওয়ানা দেয়, কুসুম বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে শব্দ শোনে। তারপর ঘরে এসে পেপারে চোখ বোলাতে বোলাতে রত্না এসে যায়। রত্না তাদের বাড়ি কাজ করে। সকালটা রত্নার সঙ্গেই কেটে যায় কুসুমের। রত্নার বাসন মেজে, ঘর ঝাড় মোছ করে, কাপড় কেচে, ফার্নিচার মুছে যেতে যেতে প্রায় বেলা এগারোটা-বারোটা। কুসুম তার আগেই রান্না বসিয়ে দেয়।  রত্না আবার বিকেলে আসে। তার মাঝে তার গল্প চলতে থাকেই। আড়ালে রত্নাকে শেওড়াফুলি গেজেট বলে ডাকে পার্থ। রত্না গেলে স্নান খাওয়া করে পেপার নিয়ে বসে। কোন কোনদিন বাড়িতে মাকে চিঠি লেখে কুসুম। দুপুরে ঘুমোয় না। দুপুরে ঘুমোলে সকালে উঠতে দেরী হয়। পার্থর অফিস যাওয়ার আগে সকালের জলখাবার করে দেওয়া হয়না। লাঞ্চটা পার্থ অফিসেই খায়। বহুদিনের অভ্যাস। কুসুম যে সকালে উঠে রান্না করতে পারেনা তা নয়, কিন্তু পার্থর ঐ শক্তিদা, রঘুদাদের সঙ্গে অফিস ক্যান্টিনে বসে না খেলে নাকি হয়না।

সদ্য দু'মাস হল বিয়ে হয়েছে কুসুমের। তার বাড়ি অন্ডাল। বিয়ের পর পার্থর সঙ্গে সংসার করতে এই শেওড়াফুলিতে এসেছে কুসুম। স্টেশনের কাছে সরকারপাড়ায় বাড়ি। বাড়িটি তৈরি করেছিলেন পার্থর বাবা। ছোট একতলা বাড়ি। তিনটি ঘর। এ ছাড়া আছে একটি রান্নাঘর ও দুটি বাথরুম। হাল্কা গোলাপি রঙের বাড়ি। সামনে ছোট পাঁচিল (যার উপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পোস্টার পড়েছে)। হলুদ রঙের গেট। গেট থেকে একটা ছোট ইঁটের রাস্তা ঢুকে গেছে বাড়ির দিকে। রাস্তার দু'ধারে ফুলের বাগান ছিল একসময়। কুসুম সেগুলি ঠিক করবে ভেবেও করে ওঠা হয়নি। আসলে সত্যি কথা বলতে, কুসুমের সেরকম ফুলের শখ নেই। বাড়িতে ঢুকলেই এক ফালি বারান্দা। সেখানেই পার্থর সাইকেল থাকে। রোজ সকালে সাইকেল করে স্টেশন যায় পার্থ। স্টেশনে শঙ্করের দোকানে সাইকেল জমা রাখে। বারান্দায় দুটি বেতের মোড়া আছে। রোজ বিকেলবেলা বাড়ি ফিরে পার্থ মুড়ি খায়। মুড়ির সঙ্গে কোনদিন তেলেভাজা, কোনদিন ঘুগনি বানায় কুসুম। মুড়ি খেয়ে একটু বাইরে এসে ঐ মোড়ায় বসে পার্থ আর কুসুম। ততক্ষণে গোধূলি লগ্ন। আকাশে একটা হাল্কা আলোর রেখা কুসুমের মনে এক প্রসন্ন ভাব এনে দেয়। সামনেই একটা পুকুর আছে। ভালো হাওয়া দেয়। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেরা ক্রিকেট খেলে বাড়ি ফেরে। পার্থ মাঝে মাঝে গুন গুন করে গান ধরে। নিজের বাড়িতে পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে মানুষ কুসুম যেন এই সময়টুকুর জন্য সারাদিন অপেক্ষা করে। এই সময়টুকু যেন তার জীবন থেকে কোনদিন না চলে যায়।

পাঠক নিশ্চয় খেয়াল করেছেন কুসুমের দিনের একটা সময়ের কথা আমি এখনও বলিনি। হ্যাঁ দুপুরে পেপার পড়া আর বিকেলবেলা পার্থ ফেরার আগে পর্যন্ত। এই সময়টুকুর মধ্যে হাজির হন পাড়ার দুই "দিদি"। বয়সে তাঁরা কুসুমের মায়ের চেয়ে কিছু ছোট হলেও তাঁদেরকে দিদি বলেই ডাকতে বলেছেন।  এনারা নাকি কুসুমের শাশুড়ির খুব কাছের মানুষ ছিলেন। আজ ওনার অভাব পূর্ণ করতেই বোধহয় এনারা রোজ কুসুমের খোঁজ নিতে আসেন। অবশ্য রোজ খোঁজ নেয়ার কিছু থাকেনা, মানে থাকা সম্ভব হয়না। যেটা চলে সেটা হল রত্নার শেওরাফুলি গেজেটের সরকারপাড়া ভার্সান।
"জানো তো, কবিতার সঙ্গে ওর ছেলের বউয়ের আবার ঝগড়া হয়েছে কাল।"
"রমার মেয়েটাকে দেখেছো, কি কালো। কে ওকে বিয়ে করবে বাবা?"
"ঘোষবাবুর ছেলে এবারো মাধ্যমিকে ফেল করেছে।"

তবে যেটা ভালো দিক হচ্ছে এনারা রোজ যাওয়ার সময় কুসুম কত ভালো, পাড়ার অন্য বউদের কুসুমের মত হওয়া উচিত, তাই বলে যান। প্রথম প্রথম এনারা পার্থ আসার আগেই চলে যেতেন। কখনো কখনো পার্থর সাইকেলের আওয়াজ শুনেই বেরিয়ে পরতেন। আজকাল সেটাও করেন না। এরকম অনেকদিন হয়েছে পার্থ এসে একা ঘরে বসে মুড়ি খেয়েছে। এনারা যেতে যেতে গোধূলি পেড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে। আর বারান্দায় গিয়ে বসা হয়নি। কুসুম মুখে কিছুই বলতে পারেনি। পার্থকেও বলেনি। সত্যি করে বলতে কি এই দুমাসে মানুষটিকে সেভাবে চিনে উঠতে পারেনি কুসুম। তাই এই কথাটা বললে পার্থর কেমন লাগবে বোঝেনি।

আজও দিদিরা এসে হাজির হয়ে গল্প শুরু করলেন। সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ব্যানার্জিবাবুর মেয়ে কেন নিচু জাতে বিয়ে করল তাই নিয়ে আলোচনা শুরু হচ্ছিল, এই সময় বাইরে সাইকেলের শব্দ শুনে অবাক হয়ে বারান্দায় এল কুসুম। গেট দিয়ে সাইকেল ঢোকাচ্ছে পার্থ। চমকে গেল কুসুম। পার্থ যেন বুঝতে পেরেই বলল -- "আজ তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। তাই আগের ট্রেনেই চলে এলাম। শোন না, উদয়নে নবাব এসেছে। যাবে? তুমি তো সেদিন বলছিলে রঞ্জিত মল্লিককে তোমার ভালো লাগে। চলো না।"

ভিতরে যে দিদিরা বসে আছেন, সেটা কি খেয়াল করেনি পার্থ? লজ্জায় লাল হয়ে গেল কুসুম। দিদিরা শুনতে পেলেন পার্থর গলা। তাড়া আছে, পরে আসবেন ইত্যাদি বলে তখনি সেখান থেকে বিদায় নিলেন। "সত্যি যাবে?"
কুসুমের বিস্ময় কাটেই না। পার্থ স্রেফ মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।

সেই সময়, যখন পাড়ার ছেলেরা ব্যাট নিয়ে মাঠে যাচ্ছিল, যখন কলেজ ফেরতা মেয়েটি গাছের তলায় প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল, যখন ধর্মতলার অফিসে বসে কেউ কাজ শেষ করে হাওড়া স্টেশনে আসার পরিকল্পনা করছিল, যখন তার সাধের গোধূলি আসতে ঢের দেরী, তখন ঐ সাইকেল স্ট্যান্ড করানোর শব্দে, দেওয়ালের লাল সবুজ রাজনৈতিক দলের স্লোগানে, রাস্তায় একা ডাকতে থাকা আইসক্রিমওয়ালার ডাকের মধ্যে দিয়ে কুসুম বুঝতে পারল সে না চিনলেও পার্থ তাকে ঠিক চিনেছে।



Friday, July 17, 2020

বহরমপুরের সুতপা

অফিসে কাজের ফাঁকে প্রায়ই অর্কুটটা চেক করে নেয় নিখিল। আর এখন তো বেশী করে করতে হয়। সুতপা মেসেজ করে এই সময়। রোজ বিকেলে এক ঘণ্টার জন্য সুতপা সাইবার ক্যাফে যায় শুধুমাত্র নিখিলের সঙ্গে দেখা করতে। কলেজ পাশ করে বহরমপুরে একটা স্কুলে পড়ায় সুতপা। বাবা নেই। বাড়িতে শুধু মা। হাল্কা শ্যামলা গায়ের রং, তন্বী। প্রথমবার ছবি দেখেই পছন্দ হয়েছিল নিখিলের। অর্কুটেই আলাপ সুতপার সঙ্গে। অনলাইনের মধ্য দিয়ে কলকাতার রাস্তার ভিড় আর বহরমপুরের লোডশেডিং যে কখন মিলেমিশে এক প্রেমকাহিনীর সূচনা করেছিল দু'জনে কেউই বোঝেনি। অনলাইনে এভাবে প্রেমে পড়া শুনলে লোকজন এই ২০০৬-এ অবাক হয় বইকি। তবে দুজনেই দুজনের ছবি দেখেছে। গলা শুনেছে। কাজেই একেবারে অচেনা নয়। সুতপা নতুন একটা মোবাইল ফোন নিয়েছে। তবে ওর বেশী টকটাইম নেই। তাই নিখিল-ই ফোন করে। সারা রাত্রি ধরে সুতপা বলে চলে তার স্কুলের খাতা দেখার গল্প, আর নিখিল তার অফিসের। নিখিলের গলায় সুর আছে। সুতপা বার বার বায়না করলে নিখিল গান শোনায়। কোনদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত, কোনদিন আধুনিক। সুতপা বলে নিখিলের গলা নাকি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মত।

দু'মাস এভাবে অতিবহিত হওয়ার পর দুজনেরই মনে হল এবার সামনাসামনি দেখা হওয়া দরকার। সুতপা ঠিক করল কলকাতায় এসবে। কলকাতায় তার মাসীর বাড়ি। সেখানে উঠে নিখিলের সঙ্গে দেখা করবে। লালগোলা প্যসেঞ্জারে চেপে মাসীর বাড়ি এসে একদিন পর নিখিলের সঙ্গে দেখা করতে গেল সুতপা। ভিক্টোরিয়ার সামনে দেখা করার কথা। বাস থেকে নেমে সুতপা দেখল গেটের সামনে সাদার উপর লাল চেক জামা পরিহিত নিখিল। সুতপা নিজে পরেছে সবুজ রঙের সালোয়ার কামিজ। বেশী গয়না পছন্দ করেনা সুতপা। তাই সামান্য একটা গলায় হার আর কানে দুল। তাতেই নিখিল বলে উঠল -- "বিউটিফুল।"

সারাদিন ভিক্টোরিয়ায় ঘুরে, দুপুরে এক চাইনিজ দোকানে খেয়ে বিকেলবেলা নিখিলের নিউ আলিপুরের বাড়িতে এল সুতপা। ভিক্টোরিয়ার মাঠে সর্বসমক্ষে ঘনিষ্ট হতে আপত্তি ছিল সুতপার। নিখিল একাই থাকে। তাই ওর বাড়িতে আপত্তি নেই। নিখিলের বাড়িটা খুব একটা ছোট না। ওর বাবা বানিয়েছিলেন। বাবা মা দুজনেই এক এক্সিডেন্টে গত হন। তারপর থেকে একাই থাকে নিখিল। বাড়িতে ঢুকেই বাঁ দিকের বন্ধ ঘরটার দিকে এগোচ্ছিল সুতপা। নিখিল বারণ করে। ঐ ঘরটি নাকি নিখিলের বাবা মার। ঐ ঘরটি সে বন্ধই রাখে। নিখিলের লিভিং রুমের সোফায় বসতে যাচ্ছিল সে, এই সময় নিখিল তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। মনে হল সুতপার গায়ে যেন শিহরন খেলে গেল। চকিতে নিখিলের দিকে ঘুরে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। আস্তে আস্তে নিখিলের ওষ্ট সুতপার অধর স্পর্শ করল। সুতপার হাট উঠে গেল নিখিলের কাঁধে। নিখিলের চোখ বন্ধ হল। সুতপারও।  নিখিল তৈরি ছিল। চট করে পকেট থেকে ইনজেকশনটা বার করে সুতপার হাতে তাক করল। এক মিনিটের মধ্যেই সোফায় অজ্ঞান হয়ে পরে গেল সুতপা। এবার নিখিল ফোন করল -- "আমি রেডি তন্ময়দা, আপনার নার্স নিয়ে চলে আসুন।"


কসবা থেকে নিউ আলিপুর আসতে সময় লাগে বলেই চেতলাতে এক বন্ধুর বাড়ি ছিলেন ডাক্তার তন্ময় সেনগুপ্ত। ফোন পাওয়া মাত্রই নিজের নার্স রুমাকে নিয়ে চলে এলেন নিখিলের বাড়ি। নিখিল ততক্ষণে বন্ধ ঘরের দরজা খুলে রেখেছে। সেটি যেন এক পুরোদস্তুর অপারেশন থিয়েটার। সুতপার অবচেতন দেহটা সবাই মিলে ধরে নিয়ে এল। শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল নিখিল। বাইরের ঘরে বসে টিভিটা চালাল। সৌরভ বোধহয় আবার টিমে ফিরবে।

খানিকক্ষণ বাদেই বেরিয়ে এলেন ডাক্তার সেনগুপ্ত। "নিখিল, এই মেয়েটির তো কিডনি নেই!"
"কিডনি নেই মানে? এটা হয় নাকি?"
"আরে দেখে যাও।"
"খারাপ করছেন তন্ময়দা, আমাকে শেয়ার দেবেন না বলে কিডনি লুকিয়ে এখন এসব বলছেন।"
"আরে তুমি নিজেই দেখো না।"

ঘরের ভিতরে তখনো হাল্কা আলোটা জ্বলছে। বেডের পাশে বাকি সব আলো যেন সুতপার কাটা দেহটাকে ঝলসে দিচ্ছে। নার্সটিকে দেখা যাচ্ছেনা। নিখিল এসে কিছুই বুঝলো না। "কোথায় কিডনি নেই তন্ময়দা?"

ঘাড় ঘুরিয়ে নিখিল দেখল তন্ময়দা পাশে নেই। ঘরের দরজাটিও এবার বন্ধ হয়ে গেল। বাইরে থেকে কেউ যেন তালাটা ঘোরাচ্ছে। নিখিল ছুটে গেল দরজার দিকে। দু'বার ধাক্কা দিতেও দরজা খুলল না। আবার পাশ ফিরতেই নিখিলের চোখ গেল ঘরের অন্য কোণে। হাল্কা আলোতে এতক্ষণ খেয়াল করেনি। পাশাপাশি পরে আছে তন্ময়দা আর রুমা। দুজনের কারুর জ্ঞান নেই মনে হচ্ছে। নিখিল অবাক হয়ে এগিয়ে গেল তন্ময়দার দিকে।
"তন্ময়দা, তন্ময়দা।"
"ওরা কেউ বেঁচে নেই নিখিল।"
একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে বেডের দিকে ফিরে তাকাল নিখিল। এই সেই গলা, যা রাতের পর রাত নিখিলকে বহরমপুরের গল্প বলেছে, হাজারদুয়ারী বেড়াতে যাবার কথা বলেছে, বিধবা মায়ের কষ্টের কথা বলেছে, স্কুলের বাচ্চাদের বাঁদরামোর কথা বলেছে। নিখিল এতদিন এই গলা শুনে চমকাত না। আজ চমকাল। এখন চমকাল।

নিখিল এবার অবাক হয়ে দেখল সুতপার কাটা দেহটা বেড থেকে নেমে আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে আসছে। নিখিল ভয়ে নড়তেও পারল না। কাটা দেহে কিডনি আছে কিনা, সে বোঝার মত ক্ষমতাও তার নেই। এবার একদম কাছে এসে নিখিলের সামনে ফিসফিসিয়ে সুতপা বলল -- "আমাদের চুম্বন তো শেষ হয়নি নিখিল। আমাকে চুমু খাবে না?"

বলেই নিজের ঠাণ্ডা ওষ্ঠ এবার নিখিলের অধরের উপর চেপে ধরল সুতপা। নিখিল ঠাণ্ডায় ছটফট করতে গেল। কিন্তু ততক্ষণে সুতপার দুই হাত এসে গেছে নিখিলের মাথার পিছনে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিখিলের ধরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। শুধু সুতপার কাটা দেহের হাতে ধরা থাকল নিখিলের চুম্বনরত মস্তক। নিখিলের চোখ এবার সত্যি বন্ধ।


Thursday, July 16, 2020

প্রশ্ন করা হয়নি

অফিসে বসে লেখাটা শেষ করছিলাম। এই সময় অফিসের পিওন রামদেব এসে জানাল আমার ফোন এসেছে। আমার ডেস্কে একটা বড় কাঁচের পেপারওয়েট থাকে। গোল, ভিতরে ডিজাইন। সেটা দিয়ে লেখাটা চাপা দিয়ে ফোন ধরতে এলাম। আমাদের অফিসে এখনো সেই মান্ধাতার আমলের কালো ফোন। গোল করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাম্বার ডায়াল করতে হয়। আমাদের বাড়িতেই এর চেয়ে আধুনিক ফোন আছে। এখন কি প্যাড লাগানো নতুন যে ফোন হয়, সেগুলি একটা কিনলে পারে অফিস।

"হ্যালো, অতনু বলছি।"
"চিনতে পারছিস?"
"না তো, কে?"
"আমি অসীম।"
"অসীম কে? অসীম বসাক?"
"ইয়েস স্যার।"
"আরে, কতদিন বাদে। কোথায় আছিস, আমার অফিসের নম্বর পেলি কোথায়?"
"আজ বিকেল পাঁচটায় কফি হাউসে আসবি? সব জবাব দেব।"
"ঠিক আছে, তবে তোকে চিনব কি করে?"
"ভাবিস না, ঠিক চিনতে পারবি। খুব একটা বদলাই নি।"

বিকেলে চিকেন স্যান্ডইউচ আর কফি খেতে খেতে আমি প্রশ্ন করলাম
"এবার বল, আমার অফিসের নম্বর পেলি কোথা থেকে?"
"খবর পেলাম তুই আজকের সংবাদে চাকরি করিস। ডিরেক্টরি থেকে নম্বর পেলাম।"
"তুই আছিস কোথায়?"
"আমি ব্যাঙ্গালোরে। ইসরোতে চাকরি করছি।"
"আইব্বাস। চাঁদে যাবি কবে?"
"এই তো কাল। চল তোকে নিয়ে যাই।"
"উফ, কতদিন বাদে তোর সাথে দেখা হল।"
"হ্যাঁ, প্রায় ১৫ বছর বাদে।"
"সত্যি। তুই তো মাধ্যমিকের পরই সুন্দরপুর ছেড়েছিলিস?"
"হ্যাঁ। বাবা তার আগের বছর চলে গেল।"
"হ্যাঁ রে, কাকুর কথা খুব মনে পড়ে। ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। কি ভালো ফুটবল খেলতেন! কীভাবে যে এমন ভাবে হার্ট এটাক হলো।"
"হুম। শোন না, তোর একটা সাহায্য দরকার।"
"বল।"
"তুই তো জানিস বাবা কিছুদিনের জন্য ইস্টবেঙ্গলে ট্রায়ালে গিয়েছিল।"
"হ্যাঁ, জানি তো।"
"হ্যাঁ, সেই সময় ইস্টবেঙ্গলের কোচ ছিলেন রবি সেন। এখন যিনি আবার ইস্টবেঙ্গলের কোচ হয়েছেন।"
"হ্যাঁ।"
"বাবা আমাকে বলেছিল উনি নাকি বাবাকে কিছু একটা বলেছিলেন যেটা বাবার সারাজীবন মনে থাকবে। আমি বড় হলে আমাকে বলবেন বলেছিলেন। কিন্তু আমি প্রশ্ন করার আগেই বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তো আমি ভাবছিলেন রবিবাবুকে জিজ্ঞেস করলে হয়না?"
"ওনার কি মনে থাকবে? এত ফুটবলার সামলেছেন।"
"জানি। তবুও। বলে দেখা যাক না। তুই তো ওনার সাক্ষাতকার নিয়েছিস নিশ্চয়। একবার আলাপ করাতে পারবি না?"
"তা আমি চিনি ওনাকে। ঠিক আছে দেখছি। ক'টা দিন সময় দে। সামনে ডার্বি। তুই লিগের খবর রাখিস?"
"না রে, আমি শধুই ক্রিকেট। এখন তো কলকাতার ছেলে ক্যাপ্টেন।"
"হ্যাঁ, সামনে ওয়ার্ল্ড কাপ। দেখা যাক। শচীন এবার জিততে চাইবে।"
"যাই বল, ভালো বোলার নেই। এই জাহির ছেলেটা খারাপ না..."


ডার্বির পরেরদিন অসীমকে ফোন করলাম। অসীম এখন কলকাতায় আছে ওর জ্যাঠার বাড়ি। সেখানে ফোন করে ডেকে দিতে বললাম
"কি রে, ব্যবস্থা হল? "
"তুই কি একদমই কাগজ পড়িসনা?"
"না মানে কি হয়েছে?"
"ডার্বি জিতে রাত্রে গাড়ির এক্সিডেন্টে রবিবাবু পরলোকগত।"
"যাহ।"
"হ্যাঁ, গতকাল।"
"বুঝলি, আমার প্রশ্নটা করাই হয়না কাউকে।"
"একজন জানতে পারে।"
"কে বলত?"
"লক্ষণদাকে তোর মনে আছে?"
"লক্ষণদা মানে যে মোহনবাগানে খেলত?"
"খেলত মানে দু'বছর খেলেছে। তারপর গোয়া গেল খেলতে। চোট পেয়ে আর খেলা বন্ধ। এখন বড়বাজারের পাশে একটা রোলের দোকান চালায়।"
"আচ্ছা। হ্যাঁ, ওনার সঙ্গে বাবার খুব ভাব ছিল। চল যাওয়া যাক সুন্দরপুর। কবে যাবি?"
"কাল চল?"

সুন্দরপুরে লক্ষণদার রোলের দোকানে একটা করে এগ চিকেন রোল খেতে খেতে আড্ডা হচ্ছিল। পাশে রেডিওতে "সেই যে হলুদ পাখি" গানটা বাজছিল। অসীম শোনেনি। ওকে জানালাম এটা ক্যাকটাস বলে একটা বাংলা ব্যান্ডের।
"লক্ষণদা, তোমার ফুটবল ছেড়ে ভালো লাগে?"
"কে বলল ছেড়েছি!"
"না তো, আজ তো রবিবার। চল একটু বাদে।"
"কোথায়?"
"মসজিদের পাশের মাঠে। আমরা বন্ধুরা মিলে রবিবার বিকেলে ফুটবল খেলি।"
"বন্ধুরা মানে? তোমার বয়সী সবাই?"
"ছোট বড় অনেকেই আছে। কলকাতায় অফিস করে। দুজনেই চলো আজ।"
এবার অসীম প্রশ্ন করল
"লক্ষণদা, তোমার সঙ্গে তো বাবা অনেক গল্প করতেন।"
"তা করতেন। তোমার বাবা এই সুন্দরপুরের একমাত্র স্পোর্টসম্যান ছিলেন, বুঝলে?"
"আচ্ছা বাবা কোনদিন তোমাকে বলেছেন ওনাকে ইস্টবেঙ্গল ট্রেনিং-এ রবি সেন কি বলেছিলেন?"
"না গো। মনে পড়ছে না। আমাকে এরকম কিছু বলেননি।"

অসীম আবার হতাশ হল। এবার লক্ষণদা বললেন
"চলো চলো খেলতে চলো। তোমার বাবা খুশী হবেন তুমি ফুটবল খেলছ দেখলে।"
"এই ফুল প্যান্টে?"
"আরে ধুর, প্যান্ট গুটিয়ে নিও।"

ভালোই খেলা হল। আমি যদিও বা একটু আধটু খেলালাম, অসীম একেবারেই পারল না। মিনিট দশেকের মধ্যেই হাঁপিয়ে বলল -- "আমি গোলকিপার হব।" তবে খেলা শেষের পর ওর মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তির হাসি দেখলাম।

মাসখানেক বাদে আবার কাজে সুন্দরপুর গিয়েছিলাম। লক্ষণদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল স্টেশনে। শুনলাম ব্যান্ডেল যাচ্ছেন বোনের সঙ্গে দেখা করতে। আমাকে দেখে একটু গল্প করে বললেন -- "জানো তোমার বন্ধু অসীমের বাবা আমাকে বলেছিলেন রবি সেনের কথা।"
"মানে আপনি জানতেন রবি সেন ওনাকে কী বলেছে?"
"হ্যাঁ।"
"অসীমকে বললেন না কেন?"
"ওর খারাপ লাগত।"
"কেন?"
"রবি সেন বলেছিলেন -- দেখ, তোমার ইস্টবেঙ্গল বা ময়দানের কোন বড় ক্লাবে তেমন ভবিষ্যৎ নেই। বরং ব্যাঙ্কে দেখ। ওখানে ভালো খেললে তোমার পাকা চাকরি হবে। সংসারে অসুবিধা হবে না।"
"সেকি।"
"সেই কথা শুনেই উনি ব্যাঙ্কে জয়েন করেন। পরে আক্ষেপ করতেন রবিবাবুর কথা না শুনে টিকে থাকলে হত। আমাকে বলতেন বার বার হাল না ছাড়তে। হয়ত অসীমকে ..."

Sunday, June 28, 2020

একবারই এসেছিল নীরবে

এটিএম থেকে টাকা তুলে ট্রেন স্টেশনের দিকে হাঁটতে লাগল অর্ক। নিউ জার্সির জার্সি সিটিতে থাকে সে। ওদিককার বেশিরভাগ দোকানেই ক্যাশ ওনলি। তাই সপ্তাহান্তের বাজার করতে তাকে টাকা তুলতে হয়। টাকা মানে ডলার। তামাম মার্কিন দেশের বাঙালিরা ডলারকে টাকা বলে। তাই আমরাও তাই বলব। এভিনিউ এইচ ষ্টেশনে এসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল অর্ক। ওপরে ডিজিটাল বোর্ডে দেখাচ্ছে আর চার মিনিট বাদে ট্রেন। ফোনে ওয়াটস্যাপটা চেক করে নিল। নাহ, কোন নতুন মেসেজ নেই। ভেবেছিল শাল্মলী মেসেজ করবে। মেয়েটি লন্ডনে পড়াশুনো করছে। কালকেই ফেসবুকে একটা গ্রুপে আলাপ। দুজনেই উডি এলেন ফ্যান। অর্ক নিউ ইয়র্কে থাকে শুনে শাল্মলী বলে "হাউ লাকি ইউ আর।" যদিও অর্ক সত্যি সত্যি নিউ ইয়র্কে থাকেনা। থাকে নদী পেড়িয়ে নিউ জার্সিতে। কিন্তু বলতে তো ক্ষতি নেই। কে আর লন্ডন থেকে এতদূর আসবে দেখতে। অর্ক অম্লানবদনে বলে দেয় সে ব্রুকলিনের পার্ক স্লোপ অঞ্চলে থাকে। গতবছর একবার ওখানকার একটা পাবে এসেছিল। তাই কিছুটা হলেও বলতে পারবে। শাল্মলীর সঙ্গে ফেসবুকে অনেকক্ষণ চ্যাটের পর তার ফোন নম্বর পাওয়া যায়। ওয়াটস্যাপে যোগ করে অর্ক।

এবার ট্রেন এসে যায়। ট্রেন ফাঁকা। অর্ক জানালার ধারে বসতে পারে। ব্যাগ খুলে কমলকুমার মজুমদারের বই বার করে পড়ার জন্য। তার পাশে এক মহিলা এসে বসেন। ঘাড়  ঘুরিয়ে দেখা খারাপ, তাই পড়তে পড়তে আড়চোখে দেখে অর্ক। ভারতীয়। অথবা বাংলাদেশীও হতে পারে। নিউ ইয়র্কে এখন প্রচুর বাংলাদেশী। সত্যি কথা বলতে কি, পশ্চিমবংগের বাইরে ভারতবর্ষের অন্য কোন জায়গার চেয়ে নিউ ইয়র্কেই অর্ক বেশি বাঙালি পায়। এভিনিউ এইচ পেরোতেই হাল্কা গলার আওয়াজ পাওয়া গেল -- "আপনি কি বাঙালি?"
"হ্যাঁ, অর্ক সেনগুপ্ত। আপনি?"
"আমি চৈতালি রায়।"
একটু অদ্ভুত গলার স্বর মহিলার।
"আপনি কলকাতার কোথায় থাকেন? আমি পাটুলি।"
"আমি কলকাতার না। আমি মিলওয়াকিতে বড় হয়েছি। আমার বাবা মা এখানেই থাকেন।"
ওহ প্রবাসী বাঙালি! তাই এরকমভাবে বাংলা বলছে। শুনতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল।
"আপনি এখানে বড় হয়েছেন? ভাবাই যায়না। আপনার বাংলা ভীষণ পরিষ্কার।"
"থ্যাংকস। আমার পেরেন্টসরা ছোটবেলা থেকে আমার সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলতেন।"
"ওহ, তা আপনি বুঝলেন কি করে আমি বাঙালি?"
"আপনার হাতের বই দেখে।"
"আপনি বাংলা পড়তে পারেন?"
"হ্যাঁ, পারি তো। আমি ফেলুদা, টেনিদা, মিতিনমাসী পড়েছি।"
"আচ্ছা। কমলকুমার পড়েছেন?"
"না। আমার বাবা বলতেন উনি ছোটবেলায় স্বপনকুমার বলে একজনের বই পড়তেন। এটা কি তিনি?"
"না না, স্বপনকুমার খাজা, আই মিন, পাল্প লেখক। কমলকুমার আলাদা। মনে হবে ফরাসী সাহিত্য পড়ছেন।"
"ওহ, আমি ফরাসী সাহিত্য পড়িনা।"
"তা আপনি যাচ্ছেন কোথায়?"
"আমি, জার্সি সিটি। ওখানেই থাকি। আপনি?"
এক মুহুর্ত ভেবে নিল অর্ক। ব্রুকলিনের ঢপটা দেওয়া উচিত হবেনা। জার্সি সিটিতেই তাকে যখন, ট্রেনে দেখা হবেই।
"আমিও ওখানেই। তাহলে ভালোই হল, একসাথে যাওয়া যাবে। আপনি এখানে কি পড়ছেন না চাকরি করছেন?"
"আমি ব্রুকলিনে ব্যাঙ্ক অব আমেরিকায় চাকরি করি। আপনি?"
"আমি ব্রুকলিন কলেজে পড়াই। আর কিউনিতে পি এইচ ডি করছি।"
"ওয়াও। কোন বিষয় আপনার?"
"আমার ইকোনমিক্স।"
"নো ওয়ে, আমার আন্ডারগ্র্যাড ইকোনমিক্স ছিল।"
"তাই? কোন কলেজ?"
"মিলোয়াকি কমিউনিটি কলেজ।"
"আচ্ছা। আপনি কতদিন আছেন নিউ ইয়র্কে?"
"আমি তো জার্সি সিটিতে থাকি। আমি এই তিন মাস হল এসেছি। আপনি?"
"আমার তিন বছর হল। তা আপনি উইকেন্ডে নিউ ইয়র্কে আসেন নিশ্চয়?"
"নাহ সারা সপ্তাহ ট্র্যাভেল করে ক্লান্ত থাকি। তখন শুধু বাড়ি বসে নেটফ্লিক্স। আপনি?"
"আমি আসি মাঝে মধ্যে। আপনিও তার মানে সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন?"
"হ্যাঁ ভীষণ। আপনারও?"
"হ্যাঁ। আপনার প্রিয় নায়ক কে?"
"টম ক্রুজ। আপনার?"
"ম্যাক্স ভন সিডো।"
"সেটি কে? নাম শুনিনি। কোন সিনেমা বলুন?"
"সেভেন্থ সিল।"
"না দেখিনি। কার সিনেমা?"
"বার্গম্যান। দেখেননি?"
"আমি ক্যাসাব্লাঙ্কা দেখেছি। আচ্ছা, এটলান্টিক এভিনিউ এসে গেছে। চলুন নামা যাক।"
"না না, পরেরটায় নামব। ডি ক্যাব। ওখানে পাশের প্ল্যাটফর্মেই আর আসবে। সোজা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার।"
"আচ্ছা।"

সিনেমায় মিল পাওয়া না গেলেও মিল পাওয়া গেল গানে। চৈতালি গান শুনতে ভালোবাসে। অর্ক বিটেলসের বেশিরভাগ গান বাজাতে জানে শুনে খুব উৎসাহিত হল। বাকি রাস্তাটা অর্থাৎ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার থেকে পাথ ট্রেনে চেপে জার্নাল স্কোয়ার স্টেশন অবধি বিটলস, ডিলান, সিনাত্রা, রোলিং স্টোন্স সঙ্গ দিল। গানের মাঝে আপনি থেকে তুমিতে নামতে খুব একটা অসুবিধা হলনা।

জার্নাল স্কোয়ারে নেমে চৈতালি বলল ওর বাড়ি ডানদিকে। অর্ক বামদিকে থাকে। তাই এবার আলাদা হতেই হবে। অর্ক এবার সাহস করে বলল -- "চৈতালি, তোমার সঙ্গে গল্প করে খুব ভালো লাগল। যদি কিছু মনে না কর, তোমার নম্বরটা পেতে পারি?"
"নিশ্চয়। (২০৮)...। তোমারটা দাও।"

নম্বর নেয়ার পর দুজন চলে যাচ্ছিল। চৈতালি এগিয়ে এসে অর্ককে আলিঙ্গন করল। এদেশে এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। তাই অর্কর প্রথমে কিছু মনে হয়নি। তারপর বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনে হতে লাগল, "মেয়েটি নিজে থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরল। নিশ্চয় আমাকে ভালো লেগেছে। উফ, আর লন্ডন নিয়ে মাথা ঘামাবো না। এই মেয়েটি আমার জন্য পারফেক্ট।"

বাড়ির দরজা অবধি পৌঁছাতে পৌঁছাতে অর্ক স্বপ্ন দেখে ফেলল ভবিষ্যতে সে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হয়েছে। সকালে ক্লাস নেয়ার পর সে আর চৈতালি ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে যায়। সেখানে আজ অর্ককে বিশেষ অতিথি করে আনা হয়েছে মায়াকোভস্কির আত্মহত্যার উপর কবিতা পাঠ করার জন্য।

বাড়ি ফিরে জামাকাপড় ছেড়ে গিটারটা নিয়ে বসল অর্ক। একটু বাদেই দরজায় ধাক্কা। অর্কর রুমমেট সুমন। নাহ, সুমনকে এখন কিছু বলার দরকার নেই। সুমন বলল -- "বস, দুটাকা খুচরো দিবি, সিগারেট কিনতে যাব।"

গিটার ছেড়ে জিনসের পকেটে হাত দিয়ে অর্ক বুঝতে পারল তার মানিব্যাগটা নেই। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পেলনা। একটা সন্দেহ হতেই চৈতালির দেওয়া নম্বরটায় ফোন করল। ফোনের কলার আই দিতে দেখাল এটি আইডাহো রাজ্যের ফোন নম্বর। কিন্তু, মিলওয়াকি তো উইস্কন্সিনে, তাই না? এবার উল্টোদিকে একজনের গলা শোনা গেল

"হ্যালো, বয়সি পুলিশ স্টেশন।" 

Sunday, June 14, 2020

রুকু-সুকু

আজকে বাইরে একটা মিষ্টি হাওয়া দিচ্ছে। এই বাংলো বাড়িটার সামনে একটা ছোট বাগান। বাগানের মধ্যে দিয়ে লাল সুড়কির রাস্তা। দু'ধারে ছোট ছোট গাছ করেছেন রুকুর মা সাধনাদেবী। বাগান শেষ হয় একটি বেড়ায়। বেড়ার মাঝে লোহার গেট। রুকুর ঐ গেটের বাইরে যাওয়া মানা। সুকুর সাথে খেলতে গিয়ে বলটা বাইরে চলে গেলেও রুকু বাইরে যেতে পারেনা। বাড়িতে মাকে গিয়ে বললে মা এনে দেন। আসলে বাইরে বড় রাস্তা। মাঝে মাঝেই সেখান দিয়ে বড় লরি যায়।

সুকু হল রুকুর পোষা ল্যাব্রাডর। রোজ বিকেলে শুকুর সাথে এখানে খেলতে আসে রুকু। এ অঞ্চলে ওর আর কোন বন্ধু নেই। ওদের এই বাংলো বাড়িটা খুব সুন্দর। ওপরে আবার একটা চিমনি আছে। ওটা যদিও মিছিমিছি। মানে কাজ হয়না ওতে। বাংলো বাড়ি থেকে একটু দূরেই ট্রেন লাইন। এই অঞ্চলে খুব বেশী ট্রেন আসেনা। তবে রাত্রে মাঝে মাঝে ট্রেন এলে এই বাড়ি থেকেই আওয়াজ শোনা যায়। এই পাহাড়ি অঞ্চলে লোকজন বেশী নেই। তাই রাতের দিকে ট্রেনের আওয়াজ বড় স্পষ্ট। মনে পড়ে বছর দুয়েক আগে এই ট্রেনের আওয়াজে মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙ্গে যেত রুকুর।

বলা হয়নি, ঐ বেড়ার পাশেই একটা বড় গাছ আছে। কি গাছ সেটা অবশ্য রুকু জানেনা। গরমের দিনে মাঝে মাঝে এর ছায়াতে বসে পড়ে সুকু। তখন ওর গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে গান করে রুকু। রুকুর মা খুব ভালো গান জানেন। উনি রুকুকে গান শেখান। সে কত গান। "ছোট পাখি চন্দনা", "আতা গাছে তোতা পাখি", আরো কত গান। সুকু  খুব আদর খেতে ভালোবাসে। আদর করলেই নিজের লেজ নাড়াতে থাকে।

বাংলো বাড়ির জানালা দিয়ে রুকুর মা সাধনাদেবী ওদের দেখছিলেন। ওনার দৃষ্টি একটু অদ্ভুত। কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে পড়েছেন মনে হবে। এক দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখছেন। যেন মেয়ের উপর থেকে চোখ সরাতে পারছেন না। একটু বাদেই সূর্য ডুবল। তখন চাঁপা ফুলের গন্ধে, ট্রেনের আওয়াজে, ফড়িং-এর ভনভনানিতে, আকাশের লাল রঙে আর সদ্য ওঠা চাঁদের আলোয় বাংলো বাড়িটিকে এক রূপকথার পরিবেশে রুপান্তিরত করেছিল। এবার বাড়ি ফেরার পালা। রুকু সুকুকে নিয়ে বাড়ি এল।

বাড়ি ফিরতেই মা বকলেন জামা নোংরা করেছে বলে। "যাও, এক্ষুনি নোংরা জামাটা পাল্টে কাপড় কাচার জায়গায় রেখে এসো। কাল লক্ষ্মী কেচে দেবে।"

রুকু ঘরে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সাধনাদেবী। মেয়েটার কি হয়েছে কে জানে? কতবার স্বামীকে বলেছেন কলকাতা নিয়ে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু তাঁর স্বামী চিত্তবাবু কিছুতেই রাজি হন না। উনি যেন বিশ্বাসই করেন না রুকুর অসুখ আছে। অথচ সাধনাদেবী পরিষ্কার বুঝতে পারেন। আজ থেকে দু'বছর আগে সুকু মারা গেছে। খেলতে খেলতে বল বড় রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। সুকু বেড়া ডিঙ্গিয়ে বল আনতে যায়। একটি লরি এসে চাপা দিয়ে যায় সুকুকে। অথচ রুকু রোজ বলে ও নাকি সুকুর সাথে বিকেলে খেলতে যায়। আর পেরে উঠছেন না সাধনাদেবী। ওনার স্বামী বা শাশুড়ি কারুরই যেন এতে কিছু যায় আসেনা।

আজকেও বাইরের ঘরে গিয়ে দেখলেন মা-ছেলে বসে আছে। তাঁর শাশুড়ি এক মনে উল বুনছেন। আর চিত্তবাবু পেপার পড়ছেন। সাধনাদেবী বললেন -- "রুকু আজকেও জামা নোংরা করে এসেছে। বলছে নাকি সুকুর সাথে খেলতে গিয়ে এই হয়েছে। তুমি কিছু বলবে না?"
"বাচ্চা মেয়ে, আদরের বন্ধুকে ছাড়তে পারছে না। তুমি এতো চিন্তা করোনা। তোমাকে তো বলেছি, বড় হলেই ঠিক হয়ে যাবে।"
"দেখ এভাবে বেশীদিন ফেলে রাখা ভালো না। আর কয়েক মাসের মধ্যে না কমলে কিন্তু যেতেই হবে। তুমি না গেলে আমি একা নিয়ে যাব।"
"আচ্ছা, বেশ। কয়েক মাস দেখতে দাও।"

সাধনাদেবী রান্নাঘরে যেতেই নিজের মায়ের দিকে চাইলেন চিত্তবাবু। ক্লান্ত চোখে হতাশ দৃষ্টি ফেলে বললেন -- "কি করি বলো তো মা? দু' বছর আগে রুকুটাও কুকুরটার সাথেই চলে গেল। অথচ আজকেও ও মেয়েটার জামা পালটায়।" 

Tuesday, June 9, 2020

প্রবাসীর ডায়রি ৪ঃ প্রথম দিন

যদি কেউ আমাকে বলে একটা টাইম মেশিন দিয়ে আমার জীবনের কোন একদিন ফিরে যেতে, আমি ফিরব ১৪ই আগস্ট ২০০৭। জীবনে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু ঐ দিনটি বোধহয় আমার জীবনের শেষ স্টেবল পয়েন্ট। যেখানে ফিরে গেলে আমি জীবনটাকে নতুন করে লিখতে পারি।

যাই হোক, সেদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙল একটা অদ্ভুত ঝাঁকুনিতে। যে দাদার বাড়ি উঠেছিলাম গেন্সভিলে, সেই দাদার দু'বছরের ছেলে আমার বিছানায় উঠে পড়ে লাফাচ্ছে। উঠে পড়লাম। স্নান করতে যাওয়ার আগে দাদা দেখিয়ে দিল। এখানে বালতি নেই। শাওয়ারে স্নান করতে হবে। আবার পর্দা টানা আছে। পর্দা ভিতর দিকে টানা। জল যেন বাইরে না পড়ে। এ ছাড়া গায়ে মাখার সাবানের জায়গায় বডি ওয়াশ।

সকালে কর্ন ফ্লেক্স খেয়ে বেরোলাম। দাদা, বউদি, দাদার ছেলে আর আমি। দাদার ছেলেকে প্রথমে ডে কেয়ারে রাখা হবে। ডে কেয়ার জিনিসটা আমি আগে জানতাম না। দেখলাম প্রচুর বাচ্চারা রয়েছে। তাদের সকলের মা বাবারা বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করেন। তাই তারা এখানে রয়েছে। দাদার ছেলেকে রেখে আমি বিশ্ববিদ্যালয় এলাম। এই প্রথম আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয় দেখলাম। ইঁট বার করা বেশ কিছু বিল্ডিং। একটা বড় বাড়িতে দাদা গাড়ি রাখলেন। সেখানে দেখলাম শয়ে শয়ে গাড়ি। সেটি নাকি একটি পার্কিং স্ট্রাকচার। অর্থাৎ এখানে সবাই গাড়ি রাখে। অবশ্য সবাই না। ওখানে গাড়ি রাখতে একটা পারমিট লাগে। যেমন ছাত্র ছাত্রীরা ওখানে গাড়ি রাখতে পারেনা। বড় ক্যাম্পাসটা প্রথম দিন পুরো দেখতে পাইনি। চারদিকে বড় বড় গাছ যেগুলি থেকে একরকম অদ্ভুত তন্তর মত জিনিস ঝুলছে। পরে জেনেছিলাম ওগুলিকে স্প্যানিশ মস বলে। ওরকম গাছ নাকি ফ্লোরিডাতে পাওয়া যায়।

প্রথমেই আমার নিজের ডিপার্টমেন্টে গেলাম। সামনেই হলুদ রঙের বড় বড় আলুভাজার মত কিছু মূর্তি। পরে জানতে পেরেছি এই জেলাটির নাম এলাচুয়া, যেটির ইন্ডিয়ান ভাষায় মানে আলুভাজা। ডিপার্টমেন্টে আমাকে একটি চিঠি দিয়ে বলল ইন্টার্নেশনাল সেন্টারে যেতে। গেলাম। পাসপোর্ট, আই টুয়েন্টি, আর অন্যান্য সব কাগজপত্র দেখানোর পর ওরা আমাকে রেজিস্টার করল। তারপর কিছু বই আর একটা টি শার্ট দিয়েছিল। টি শার্টটি আমার খুব পছন্দের ছিল। ওর দু দিকে পৃথিবীর সকল দেশের পতাকা ছিল। এর পর গেলাম গেটর কার্ড বানাতে। এটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডেন্টিটি কার্ড। সব জায়গাতে এটি চলবে। মানে লাইব্রেরি থেকে বই ধার নিতে গেলে যাদবপুরের মত লাইব্রেরি কার্ড বানাতে হবেনা। এই আই ডি কার্ডেই সব কাজ হবে। ১৫ ডলার দিতে এক ভদ্রমহিলা ছবি তুলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে হাতে কার্ড দিয়ে দিলেন। তারপর বললেন -- "এই কার্ডটি তুমি এ টি এম কার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে পারো।" মানে বুঝলাম না। উনি হেসে বললেন -- "ব্যাঙ্কে যাও। বুঝিয়ে দেবে।"


এবার গেলাম ব্যাঙ্ক একাউন্ট খুলতে। এই প্রথম জীবনে ব্যাঙ্ক একাউন্ট খুলব। ব্যাঙ্কের নাম ওয়াকোভিয়া। পরে তা ওয়েলস ফারগো হয়ে গেছে। ব্যাঙ্কের লোক সব কাজ করে আমার আই ডি কার্ডটা নিয়ে কি একটা করে দিল। তারপর বলল "যতদিন না তোমার আসল কার্ড আসে, এটিকে এ টি এম কার্ড হিসেবে  ব্যবহার করতে পারো।" এবার খেয়াল করলাম আমার আই ডি কার্ডের পিছনে একটা ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ আছে।

দুপুরে আমার গাইডের সঙ্গে লাঞ্চে গেলাম। ওয়েন্ডিজ-এ বার্গার আর ফ্রাইস খেলাম। এই প্রথম জীবনে চৌকো প্যাটির বার্গার দেখলাম। দেশে মঞ্জিনিসে যেটা খেতাম সেটাও গোল হত। সেখানেই শুনলাম পরের সপ্তাহ থেকে নাকি কৃষ্ণ লাঞ্চ শুরু হবে। সেটা কি ভালো বুঝলাম না যদিও। দুপুরের দিকে প্রচণ্ড ঘুম পেল। তবু জেগে থাকলাম কষ্ট করে। এর মধ্যে গাইড একটা ল্যাপটপ দিয়েছেন। বিকেলবেলা দাদা বৌদি এলেন আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। দাদার ছেলেকে তুলে আমরা বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। বাড়ি গিয়ে একটু ঘুমলে বাঁচি। দাদারা কিন্তু বাড়ি গেলেন না। আমাকে নিয়ে গেলেন ওয়ালমার্ট বলে একটা দোকানে। কি বিশাল দোকান!! ঐ দেখেই আমার ঘুম গেল কেটে। কি না পাওয়া যায় সেখানে। জামা কাপড় থেকে শুরু করে বাড়ি সাজানোর জিনিস থেকে সাইকেল, ফুটবল, খাবার জিনিস, প্রায় সমস্ত কিছু। পরে জেনেছি দাদা ইচ্ছে করে আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। জানতেন ঐ দেখলে আমি জেগে থাকব। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হল। ফিরেই জলদি ডিনার করে শুয়ে পড়লাম।

সমস্যা হল তার পরের দিন। ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে চারটেয়। দাদারা তখন গভীর ঘুমে। আমেরিকাতে সূর্য ওঠে প্রায় সকাল ছ'টার পড়। অন্ধকারের মধ্যে কি করব বুঝে পেলাম না। ল্যাপটপ খুলে ইউটিউব চালিয়ে "শ্রীমান পৃথ্বিরাজ" দেখতে বসলাম।


Friday, June 5, 2020

'মিট' দ্য পেরেন্টস

-- মেট্রোতে ভিড় ছিল?
-- সবসময় থাকে। এতো আর করোনাভাইরাসের সময় না, যে ফাঁকা থাকবে।
-- তা বটে। এদিকে আয়।
-- আর কতদূর রে? ঘেমে গেলাম তো?
-- দেখুন ম্যাডাম, ঘামের দোষ আমাকে দেবেন না। তাহলে কলকাতায় না থেকে আমাদের দার্জিলিং-এ থাকা উচিত।
-- সবসময় মজা তোর। এই তোর মায়ের আপত্তি ছিল না, ঠিক বলছিস তো?
-- হ্যাঁ রে। মা তোর ছবি দেখে বেশ ইম্প্রেসড। তার উপর আমার কাছে তোর বাকি গুন শুনে তো কথাই নেই।
-- আর তোর বাবা কিছু বলবেন না বল?
-- দেখ বাবার কথা তো তোকে বলেছি। মাথার গণ্ডগোলটা আজকাল ভীষণ বেড়ে গেছে। এই লকডাউনের সময় বাড়ি থেকে থেকে আরো বেড়েছে। আমরা চিন্তায় থাকি রে। বাবা কিছু ভুল ভাল বললে প্লিজ মাইন্ড করিসনা।
-- আরে না না। তুই সঙ্গে থাকিস প্লিজ।
-- আমৃত্যু থাকব।

বাড়ির সবুজ দরজায় টোকা দেওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খুললেন সমরের মা। সমরের মোবাইলে ওনার ছবি আগেই দেখেছিল অনন্যা। কাজেই চিনতে অসুবিধা হলনা। পরনে সবুজ রঙের তাঁতের শাড়ি। চোখে চশমা।

-- এসো এসো, আসতে কষ্ট হয়নি তো? এত দূর থেকে এলে।
-- না না।
এই বলেই ওনাকে প্রণাম করল অনন্যা।
-- আহা থাক থাক, কি লক্ষ্মী মেয়ে।
অনন্যার দু গালে হাত বুলিয়ে চিবুক ছুঁয়ে আদর করলেন সমরের মা। এত সহজে আপন করে নেবেন ভাবেনি অনন্যা। যেন কতদিনের চেনা। এত নরম করে গালে হাত বুলোলেন যে দূরত্ব বোধহয় এক মূহুর্তে ঘুচে গেল।
-- এসো এসো বসো এখানে।
বাইরে ঘরে দু' সেট সোফা। বাদামী রঙের। সামনে কাঠের সেন্টার টেবিল। ওপরটা  কাঁচের। টেবিলের নিচে কিছু ম্যাগাজিন রাখা। একটা সানন্দা চোখে পড়ল অনন্যার। সামনে টি ভি। বন্ধ ছিল। ঘরের একদিকে একটা বড় বইয়ের র‍্যাক। এটির কথাই বোধহয় সমর বলেছিল। সমর ভীষণ বই পড়তে ভালোবাসে। অনন্যাও। সেভাবেই ওদের আলাপ অবশ্য।

সোফায় অনন্যার পাশে বসলেন সমরের মা। শুরু হল গল্পগুজব। বাড়িতে কে কে আছে, বাবা কোথায় চাকরি করেন, এসব। ভদ্রমহিলাকে ভীষণ ভালো লাগছিল অনন্যার। কথা বলতে বলতে বার বার ওর হাতে, পায়ে হাত রাখছিলেন। যেন আজকের আলাপ না।

এর মধ্যে হঠাত পাঞ্জাবী পাজামা পরা এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। ভিতরের কোন ঘরে ছিলেন হয়ত। এসেই সবার দিকে একবার ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থেকে

-- খাবার কই, খাবার। বাবু খাবার আনিসনি?

বলে চেঁচালেন। অনন্যা বুঝতে পারল ইনি সমরের বাবা। প্রণাম করবে বলে উঠছিল, কিন্তু সমর তার আগেই ওনাকে ভিতরের ঘরে নিয়ে গেল। ওর মা বলতে লাগলেন

-- কি বলি বলো, আগে তবু বেরোত, আজকাল বাড়িতে বন্ধ থেকে থেকে মাথাটা একেবারে গেছে।

এবার নিজে থেকেই ওনার হাত ধরল অনন্যা।

-- না না কাকিমা, কিচ্ছু ভাববেন না। আমি শিওর কাকু সুস্থ হয়ে উঠবেন শিগগিরি।

-- তোমার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক মা। দাঁড়াও আমি চা নিয়ে আসি। সমরের কাছে শুনেছি তুমি বই পড়তে খুব ভালোবাসো। সমরের বই দেখবে? ঐ দেখো র‍্যাকটা।

-- হ্যাঁ কাকিমা, আমি দেখছি।

এবার আস্তে আস্তে উঠে বইয়ের র‍্যাকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো অনন্যা। কত বই। তার পড়া বই যেমন আছে, না পড়াও আছে। ওটা কি, হেনরি ফ্রেড্রিকের সংস অব সলিটিউড। দেখি।

বইটা হাতে নিয়ে দেখছিল অনন্যা যখন ওর মাথায় আঘাত হানা হল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে। বইটি হাত থেকে ছিটকে পড়ল। আরো বার কয়েক আঘাত করে থেঁতলে দিয়ে থামল সমর। এর বেশী মারলে বোধহয় ঘিলু বেরিয়ে আসবে।

ভিতর থেকে সমরের বাবার গলা শোনা গেল
-- বাবু, খাবার এনেছিস? খাবার কই বাবু?

সমর এবার বিরক্ত গলায় বলল

-- দাঁড়াও মাকে রান্না করতে দাও। 

Sunday, May 31, 2020

প্রবাসীর ডায়রি ৩ঃ যাত্রাপথে

ইমিগ্রেশন করে যখন গেটের দিকে এগোলাম, পিছন থেকে একটা ডাক শুনলাম

-- তুই কণাদ না?

তাকিয়ে দেখি প্রাঞ্জলদা। প্রাঞ্জলদা আমার সঙ্গে ফ্লোরিডা যাচ্ছে অঙ্কে পিএইচডি করতে। অর্কুটে আলাপ ছিল। সামনে প্রথম দেখা। প্রাঞ্জলদা সঙ্গে যাচ্ছে জেনে মন ভালো ছিল বটে, কিন্তু একটু বাদেই জানতে পারলাম ও অন্য প্লেনে যাবে। মানে ফ্রাঙ্কফুর্ট অবধি একসাথে। তারপর আমি ওয়াশিংটন ডি সি। ও মায়ামি। তবু দুজনে কলকাতা এয়ারপোর্টে গেটের সামনে বসে আড্ডা দিলাম। তখন এয়ারপোর্টে একটি ফ্রি ফোন থাকত। শুধু লোকাল কল করা যেত ২ মিনিটের জন্য। একবার গিয়ে মা বাবার সাথে কথা বলে এলাম।

খানিকক্ষণ বাদেই হাজির হল ত্রিশিখিদি। বলেছিলাম আগেই, ত্রিশিখিদি আমাদের তারাবাগের কণিকাকাকিমার ভাইয়ের শ্যালিকা। তখন রাখি ছিল। দিদি তাই আমার জন্য এক বাক্স ক্যাডবারি সেলিব্রেশন নিয়ে এসেছিল। সেটা যদিও পরে আমাদের বেশ কাজে দিয়েছিল। যাই হোক, সে গল্প পরে। এ ছাড়াও এয়ারপোর্টে আলাপ হল আমার যাদবপুরের সিনিয়ার সোমদত্তাদি আর ওর মায়ের সঙ্গে। সোমদত্তাদি ওহায়োতে পড়ে। ২০১০-এ সোমদত্তাদির বাড়ি গিয়েছিলাম ম্যাসাচুসেটসে। ততদিনে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ওর বর ম্যাসাচুসেটসে আর্মহার্স্ট শহরে পিএইচডি করে।

এবার ঘোষণা হল প্লেনে ওঠার জন্য। বাবা যেমন বলেছিল, সেরকম এয়ারব্রিজের ভিতর দিয়ে আমি প্লেনে উঠলাম। এই প্রথম প্লেনে উঠলাম। বসার ব্যবস্থা ছিল ২-৫-২। আমি দু'জনের সিটে ধারে বসেছিলাম। পরে জেনেছি ওটাকে আইল সিট বলে। আমার পাশে এক অসমীয়া ভদ্রলোক বসেছিলেন। বললেন মেয়ের কাছে যাচ্ছেন। পোর্টল্যান্ড। তখন জানতামই না পোর্টল্যান্ড কোথায়। কে জানত আর চার বছর বাদে আমি ৩ মাসের উপর পোর্টল্যান্ডে থাকব।

প্লেনে ওঠার খানিকক্ষণের মধ্যেই খেতে দিল। বেশ খিদে পেয়েছিল বটে। সেই কখন ডিনার করেছি বাড়িতে। তবে খেতে গিয়ে মুস্কিল। জার্মান রুটি কি শক্ত। দাঁত ফোটানো যায়না। আর তার ক'দিন আগেই আমার দাঁতের অপারেশন হয়েছিল। কষ্ট করে খেলাম। ড্রিকন্স দিতে এসেছিল। কোকা কোলা নিলাম। প্লেনে তখন প্রতি সিটের সামনে টি ভি হতনা। কয়েকটা সিট ছেড়ে ছেড়ে মাঝে একটা করে বড় টিভি। সেই টি ভিতে শ্রেক দিয়েছিল। খানিকক্ষণ দেখলাম। তারপর ঘুমাতে গেলাম। যদিও ভালো ঘুম এলোনা। বার বার চিন্তা হতে লাগল আমার ব্যাগটা কেউ চুরি করে নেবে না তো?

সকালবেলা যখন ফ্রাঙ্কফুর্টে নামলাম তখন সকাল। উপর থেকে জার্মানিকে অসাধারণ লাগছিল। আমার সেই প্রথম বিদেশ দর্শন। ছোট ছোট বাড়ি। আর রাস্তা দিয়ে ছোট ছোট গাড়ি যাচ্ছে। পুরো মনে হচ্ছিল আমার ছোটবেলার হট উইলসের গাড়ি। ফ্রাঙ্কফুর্টে আমার ৬ ঘণ্টা স্টপ। ত্রিশিখিদির সাড়ে ৬ ঘণ্টা। কলকাতায় আলাপ হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা দেবশ্রীদির সঙ্গে। দেবশ্রীদির সাড়ে ৫ ঘণ্টা। তিনজন মিলে ফ্রাঙ্কফুর্টে একসঙ্গে বসে আড্ডা দিতে লাগলাম। তবে ত্রিশিখিদি খানিকক্ষণেই ঘুমিয়ে পড়ল। তখন আমি আর দেবশ্রীদি মিলে এয়ারপোর্ট ঘুরতে লাগলাম। একটা পে ফোন বুথ দেখে দেবশ্রীদি বলল -- "কণাদ, ফোন করবে বাড়িতে?"

দেবশ্রীদির কলিং কার্ড দিয়ে ফোন করলাম। মার সঙ্গে কয়েক সেকেন্ড কথা হল। তখন আমি বুঝতে অস্বীকার করেছিলাম যে ১২ সেকেন্ড কথা বলা আর ৫২ সেকেন্ড কথা বলার মধ্যে কোন তফাত নেই। একই দাম কাটবে। ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে আমি অনেক ইহুদি লোকজনকে দেখলাম তাদের নিজস্ব পোশাকে। ঘুরতে ঘুরতে আমরা ফিরে এলাম ত্রিশিখিদির কাছে। ত্রিশিখিদি তখন ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। সবার খিদে পেয়েছে হাল্কা। অতএব সেই ক্যাডবেরি সেলিব্রেশন খোলা হল। সবাই মনের আনন্দে তাই ভক্ষণ করলাম।

এবার বিদায় নেয়ার পালা। দেবশ্রীদি আগে বিদায় নিল। তারপর আমি।

এবার প্লেনে খুবই খারাপ সিট পেলাম। এবারে বসার ব্যবস্থা ছিল ৩-৪-৩। আমি একটি তিনের মাঝখানে বসেছিলাম। আমার এক ধারে একটি পোলিশ ছেলে। আমার অন্য পাশে একটি ভিয়েতনামি মেয়ে। বর্ধমানে ছোটবেলা থেকে ভিয়েতনাম নিয়ে এত কথা শুনেছি বলে উচ্ছ্বসিত ছিলাম, কিন্তু মেয়েটি  প্লেন চালু হতেই নাক ডাকিয়ে  ঘুমাল। পোলিশ ছেলেটি যদিও গপ্পে। জানতে পারলাম ছেলেটি নেভিতে কাজ করে। ভার্জিনিয়া যাচ্ছে। আমি জানতে চাইলাম এতদিন বাড়ির বাইরে থাকতে তার মন খারাপ করেনা। ছেলেটি বলল -- "বন্ধু, জাহাজই আমার বাড়ি।" একটি পোলিশ মুদ্রা দিয়েছিল। বহুদিন সেটি আমার সঙ্গে ছিল। এরপর কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল আর খুঁজে পাইনি।

ওয়াশিংটনে নেমে ইমিগ্রেশন করে লাগেজ আইডেন্টিফাই করতে হল। লাগেজ জমা দেওয়ার সময় এক ভদ্রলোক আমাকে "হাউ আর ইউ ডুইয়ং মাই ফ্রেন্ড?" বলায় আমি কি বলব বুঝিনি। এরকম অপরিচিত লোক কেমন আছি আগে কোনদিন জানতে চায়নি।

টার্মিনাল পাল্টে নতুন বোর্ডিং পাস নিয়ে আমি গেটের সামনে এলাম। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। একটা মেক্সিকান দোকান দেখে খেতে গেলাম। কিন্তু মুস্কিল হল কোন খাবারই তো আমি চিনিনা। তাই কিছুটা ন্যাচোস নিলাম। সমস্যা হল টাকা দিতে গিয়ে। আমি একটা দশ ডলারের নোট দিতে মেয়েটি কিছু খুচরো করে দিল। কিন্তু আমি তো মার্কিন মুদ্রা চিনিনা। এদিকে কেউ আমাকে ঠকাক সেটাও চাইব না। তাই মেয়েটিকে বললাম আমাকে বোঝাও কোনটি কি। ভাগ্যিস আসে পাশে আর কোন খদ্দের ছিলনা।

এই প্লেনে সবচেয়ে খারাপ জায়গায় বসলাম। মাঝের তিন জনের সিটের ঠিক মাঝে। ২ ঘণ্টার প্লেন যখন অরল্যান্ডো এয়ারপোর্টে পৌঁছাল, তখন রাত ১০টা। গেন্সভিলের এক সিনিয়ার দাদার বাড়িতে এক সপ্তাহ থাকব ঠিক ছিল। দাদা এয়ারপোর্টে এসেছিলেন আমাকে নিতে। দাদার বাড়ি যখন পৌঁছালাম তখন মধ্যরাত। কোনওরকমে রাতের ডিনার করে শুয়ে পড়লাম। মার্কিন মাটিতে প্রথম রাতে আমার চোখে, মাথায়, শরীরে, মানে অনুপামদার গানে যেখানে যেখানে "তুমি মেখে আছো" হয়, সেসব জায়গায় শুধুই ঘুম ছিল। 

Sunday, May 10, 2020

লবাব

এ অনেকদিনের পুরোন গল্প। আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। আমি তখন সবে বর্ধমান মেডিকাল কলেজের থার্ড ইয়ারে পড়ি। আমি তারাবাগে বাড়িতে থেকেই যাতায়াত করি। আমাদের বাড়ির পাশেই একটা গ্রাম, নাম গোদাগ্রাম। ঐ গ্রাম থেকে লোকজন এসে আমাদের পাড়ার সকলের বাড়িতে সাহায্য করতেন। আমাদের বাড়িতে যিনি আসতেন তাঁর নাম কমলাদি। কমলাদির মেয়ে ফুচি। বয়স বছর ৭-৮। স্কুলে টুলে যায় না। বাড়ির কাজকম্ম করে। কমলাদিকে বললে বলে -- "কি হবে বাবু পড়াশুনা করে? তার চেয়ে বাড়ির কাজটা শিখুক। বিয়ে দিতে পারব।"

আমরা কয়েকজন মেডিকাল কলেজের ছাত্র মিলে ঠিক করলাম ছুটির দিনে এরকম ফুচির মত ছেলে মেয়েদের পড়াব। কাউন্সিলার চয়নবাবুর সাহায্যে সে আয়োজনও হয়ে গেল সহজেই। সামান্য অঙ্ক, টাকা পয়সার হিসেব, বাংলা লেখা, ইংরেজি সংখ্যা চেনানো, এসব হত আর কি। ফুচির কিন্তু শেখার ভীষণ আগ্রহ ছিল। আমার মতে প্রচণ্ড শার্প মেয়ে। কমলাদির বড় ছেলে রতন বোধহয় বর্ধমানে রিক্সা চালাত। একদিন মাথায় ভুত চাপে, সব ছেড়ে কলকাতা চলে যায় সিনেমার হিরো হতে। কমলাদি দুঃখ করেন  -- "আমার কপাল, ছেলেটা জলে গেল।" ফুচির কিন্তু দাদাকে নিয়ে ভীষণ গর্ব। "দেখবেন কানুদা, আমার দাদা একদিন প্রসেঞ্জিতের মত হিরো হবে। আপনি আমাকে দাদার সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবেন তো?"

একদিন কমলাদি আমাদের বাড়ি এলেন একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে। তাতে গোটা চারেক ছানার কেক। মা জিজ্ঞেস করে -- "কি হল কমলা?"
"আর বৌদি, কি বলবো। আমার ছেলে সিনেমায় চান্স পেয়েছে। রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে। পরের বছর বেরোবে।"
"সেকি গো? দারুণ খবর তো।"

ফুচি আমাদের ছুটির ক্লাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে গেল। "জানেন, আমার দাদার সাথে দেবশ্রী রায় সিনেমা করতে চায়, কিন্তু দাদার শতাব্দীকেই পছন্দ।"
"সেকি? কেন? দেবশ্রী খারাপ কি?"
"নাহ, আমার শতাব্দীকে ভালো লাগে। আপনার কাকে ভালো লাগে কানুদা?"
"মাধুরী।"
"যাহ, আপনি তো আবার শুধু হিন্দি সিনেমা দেখেন।"

ক'দিন যেতে না যেতেই শুরু হল
"আর কয়েক বছর যাক, দাদা এবার বম্বেও যাবে। দেখুন না, দাদা, মিঠুন আর মাধুরী মিলে সিনেমা করবে। আপনি আমায় দেখাবেন কানুদা?"
"ফুচি, অনেক বকেছিস। এবার হাতের লেখা দেখা।"

এরকম করে একদিন ফুচির দাদার সিনেমা বেরোল। নাম "নবাব"। কমলাদি আমাদের বাড়ি এসে বললেন -- "বৌদি, জানো রতনের সিনেমা বেরোচ্ছে শুক্রবার। লবাব। এস্টার-এ আসছে। আমরা তো গ্রাম থেকে সবাই মিলে যাবো। আমাকে শুক্রবার দিন ছুটি দেবে?"
"হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়। ফুচিও যাবে?"
"না বৌদি, ওর ঐটুকু বয়স, যদি হলে ঢুকতে না দেয়। আমি ওকে এসে গল্প বলব। রঞ্জিত মল্লিক আছে, সন্ধ্যা রায় আছে।"

ফুচির পরের দু'দিন ক্লাসে ভীষণ মন খারাপ। আমি শেষকালে বললাম "দাঁড়া এবার পুজোয় যখন পাড়ায় পর্দা ফেলে সিনেমা দেখানো হবে, তখন আমি নবাব নিয়ে আসব।"
"সত্যি কানুদা? আপনি লবাব আনবেন তো?"
"আনব। তবে ওটা লবাব না ফুচি, ওটা নবাব।"

শনিবার দিন কমালাদি সিনেমা দেখে এলেন। মা প্রথমেই জানতে চাইল -- "কেমন ছিল সিনেমা?"
"ঐ একরকম। যা হয় বাংলা সিনেমায়। শুধু মারামারি। বাদ দাও বৌদি। বলছি আজকে আলুগুলো কি ডুম ডুম করে কাটব না সরু সরু করে?"
মা যা বোঝার বুঝে গেল। সমস্যা হচ্ছে, মা আমাকে বলেনি। বললে আমি আমিয়বাবুকে হাতে পায়ে ধরে পুজোর সময় নবাব আনতে বলতাম না।

পুজোর সময় আমাদের পাড়ায় মাঠে পর্দা ফেলে সিনেমা দেখানো হয়। একই দিনে দুটো সিনেমা। এবার প্রথমে ছিল সপ্তপদী। তারপর হবে নবাব। সিনেমা শুরুর আগেই ফুচি এসে হাজির। একটা ফাঁকা চেয়ার দেখে ওকে বসতে বললাম। ফেবেছিলাম ওর পাশে বসেই সিনেমা দেখব। কিন্তু তার আগেই আমার অন্য বন্ধুরা টেনে নিয়ে গেল। সিনেমা শুরু হল। রতনকে আমি চিনি। আগে দেখেছি। তাই মুখ জানি। একটু বাদেই রতনকে দেখতে পেলাম পর্দায়। সৌমিত্র ব্যানার্জি একটা চায়ের দোকানে বসে কিছু ছেলের সঙ্গে মাস্তানি করছি। একটি মেয়ের শাড়িতে চা ফেলে ইভ টিজিং করে। এই ইভ টিজারদের দলে ছিল রতন। লাল সাদা ডোরাকাটা একটা টার্টলনেক গেঞ্জি পরিহিত রতন কিছুক্ষণ বাদেই লবাবরুপি রঞ্জিত মল্লিকের হাতে বেধড়ক মার খেল। সে দৃশ্য দেখেই ফুচির জন্য মন কেমন করল। ওর চেয়ারের দিকে তাকাতেই দেখি ফুচি কাঁদতে কাঁদতে চেয়ার ছেড়ে ছুটে পালাল।

বেশ কিছুদিন ক্লাসে আর আসেনি ফুচি। তারপর একদিন এলো। আমার সঙ্গে চোখে চোখ রাখতে লজ্জা পাচ্ছিল। আমি কিছুই হয়নি এরকম ভাব করে, "ফুচি, ৫ এর নামতা বল" বলে শুরু করলাম।

ক্লাসের শেষে ফুচি আমাকে ডাকল - "কানুদা, দাদা হয়ত বম্বে যেতে পারবে না, কিন্তু শতাব্দীর সঙ্গে সিনেমা করবে বলুন?" 

Thursday, May 7, 2020

প্রবাসীর ডায়রি ২ঃ যাত্রা শুরু

টি ভি এফ-এর "ইয়ে মেরি ফ্যামিলি" সিরিজে একটি দামী কথা বলেছিলেন মোনা সিং। ছেলে কখন বাড়ি ছেড়ে চলে যায় বোঝাই যায় না। মনে হয় পড়তে গেছে, ক'দিন বাদেই ফিরবে। সেই ফেরাটা কোনদিনই আগের মত বাড়ি থাকা হয়না।

কলকাতা পৌঁছে আমি এরকম বাড়ি ছাড়ার জন্য তৈরি হতে লাগলাম। আমার জয় বাংলাটা এক-দু দিনের মধ্যেই সেরে গেল। তারপর একদিন আমরা গেলাম ব্যাগ কিনতে। এখন আমাদের পরিবারে আগে কেউ কোনদিন বিদেশ যায়নি। তাই চেক-ইন লাগেজ কি হতে পারে আমরা ভাবতে লাগলাম। কেউ কেউ বলল হার্ড লাগেজ নিতে, কেউ কেউ বলল সফট লাগেজ। একদিন আমার বড়মামার গাড়ি করে আমরা সকলে, মানে আমি, মা, বাবা, বড় মামা আর মামি মিলে প্যান্টালুন্সে গেলাম ব্যাগ কিনতে। সবাই বলেছিল ভালো ব্যাগ কিনতে -- এত বড় জার্নি, ব্যাগ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অবশেষে আমেরিকান টুরিস্টারের একটা লাল সফট আর একটা নীল হার্ড লাগেজ কেনা হল। দুর্ভাগ্যের কথা, ঐ নীল ব্যাগটি আমেরিকা পৌঁছাতে পৌঁছাতেই ভেঙ্গে যায়। তাই ওটি আর কোনদিন ব্যবহার করতে পারিনি।

সেদিন ব্যাগ কিনে বাড়ি ফিরে বুঝতে পারলাম দাঁতে একটা অস্বস্তি হচ্ছে। পরেরদিন বেহালা চৌরাস্তায় ডাক্তারবাবুকে দেখালাম। উনি দেখে বললেন -- "সর্বনাশ করেছ। তোমার একটা আক্কেল দাঁত দুটো সুস্থ দাঁতের মধ্যে দিয়ে বেরোতে চাইছে; পারছে না। তাই এখানে ইনফেকশন  করেছে। দাঁত তুলতে হবে।"
"কিন্তু আমার যে আর ক'দিন বাদেই আমেরিকা যাওয়া।"
"অসম্ভব। তোমার সুস্থ হতে মিনিমাম এক সপ্তাহ লাগবে। টিকিট পাল্টাও।"

পাল্টানো হল। পার্ক স্ট্রিটের আল্পস ট্র্যাভেলসের মালকিন তাড়াহুড়ো করে একটা সস্তার টিকিট করে দিলেন বটে। কিন্তু আমার সব বন্ধুরা আলাদা চলে যাবে। আমি একা এত বড় যাত্রা করব। পাক্কা দু ঘণ্টা ধরে আমার দাঁতের উপর কসরত চালালেন ডাক্তার বর্মন। যার ফলে আমার নর্মাল খাওয়া দাওয়া পুরো বন্ধ হয়ে গেল ৪-৫ দিনের জন্য। আমি শুধু খেতে পেতাম আইসক্রিম আর রসগোল্লা। প্রথম প্রথম কথা বলাও বারণ ছিল। আসতে আসতে সেসব মিটল।

আমার বাবা কয়েক বছর আগে ইউ জি সির কাজে একবার প্লেনে দিল্লী গিয়েছিলেন। বাবা ফিরে এসে গল্প করেছিলেন। সিকিউরিটি চেকের পর একটা বড় ঘরে সবাইকে বসতে দেয়। তারপর একটা করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন প্লেনের ভেতরে ঢুকে পরা হয়।

১১ই আগস্ট ২০০৭ রাত্রে আমি মনে হয় এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমোতে গিয়েছিলাম। পরেরদিন বেলা করে উঠলাম। মা আমার জন্য দুপুরে আলুপোস্ত করে রেখেছিলেন। মাংস খাওয়ার মত দাঁতের অবস্থা নেই। রাত ১টায় প্লেন। আমাকে সবাই বলে দিয়েছিল -- বড় জার্নি, রেস্ট নে বাড়িতে, দুপুরে ঘুমিয়ে নিস। শুলাম। কিন্তু ঘুম এলো না। বাবা দেখি বাইরের ঘরে একা একা বসে আছে। বাবার কোলে মাথা দিয়ে শুলাম। টি ভি-তে "এই ঘর, এই সংসার" চলছিল। তাই দেখলাম দুজন মিলে। বিকেলবেলা তারাবাগ থেকে কণিকাকাকিমা ফোন করলেন। ওনার ভাইয়ের শালী, ত্রিশিখীদিও আমার সঙ্গে একই প্লেনে ফ্র্যাঙ্কফুর্ট যাচ্ছে। তারপর উনি টরোন্টো যাবেন। ভালোই হল, চেনা জানা কেউ তো থাকল।

সন্ধ্যেবেলা গোপু মামা আর জয়া মাইমা এলেন আমাদের বাড়ি। ওনারা জানতেন না সেদিন আমাদের যাত্রা। গোপুমামা ঠিক করল রাত্রে এয়ারপোর্ট যাবেন আমাদের সাথে। রাত নটা নাগাদ আমরা বেরোলাম। বৃষ্টি পরছিল। প্রথমে গেলাম মামাবাড়ি। দিদাকে প্রণাম করলাম। দিদা জানতে চাইল পুজোতে আসব কিনা।

অবশেষে দুই গাড়ি ভর্তি বেহালাবাসী আমাকে সি অফ করতে দমদম ছুটল। এক গাড়িতে বাবা, গোপুমামা, আমার বড় মামা আর আমার সেজ মামা। অন্য গাড়িতে বড় মামি, ফুল মামির সঙ্গে মা আর আমি। মা পুরো সময়টা আমার হাত ধরে ছিলেন। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি তো বড় হয়ে গেছি। বাড়ির বাইরে, দেশের বাইরে পড়তে যাচ্ছি। দমদমে নেমে সব ব্যাগ গুছিয়ে আবার এক রাউন্ড প্রণাম সেরে আমি গেটম্যানকে টিকিট দেখিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। সবাই বাইরে থেকে হাত নাড়ছিল। কথা দিয়েছিলাম আমার লাগেজ চেক ইন হয়ে গেলে আর একবার কাঁচের ভেতর থেকে হাত নেড়ে যাব। লাগেজের লাইনে আলাপ হল যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপিকা দেবশ্রী দত্তরায়ের সঙ্গে। লাগেজ চেক ইন করে যখন হাত নাড়লাম, সবাইকে দেখতে পেলাম। মায়ের চোখে জলটাও দেখতে ভুল করলাম না। আমার মোবাইল ফোনটা না আনার জন্য আক্ষেপ করলাম। অবশেষে আমি ইমিগ্রেশনের লাইনে অগ্রসর হলাম। 

Wednesday, April 29, 2020

প্রবাসীর ডায়রিঃ ১ঃ পরীক্ষা শেষ

এ এক অন্য সময়ের গল্প। সেই সময়, যখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরু হয়নি, যখন লিওনেল মেসি একটিও ব্যালন ডি-ওর জেতেননি, যখন সৃজিত মুখার্জি বা দীপিকা পাড়ুকোনকে কেউ সিনেমায় দেখেনি, যখন ইরফান খানের "রোগ"-এর গান লোকের মুখে মুখে ঘুরত। এটা সেই সময়ের গল্প যখন সারা পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল হয়ে উঠেছিল সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নিয়ে, যখন  ভারতবর্ষ থমকে গিয়েছিল ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপের প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়ে, যখন লোকে মোবাইলে রিং টোন বানিয়ে বন্ধুদের পাঠাত।

এরকম সময় আমার বাইশ বছর জন্মদিনের দিন আমি সকালে উঠলাম খুশী মনে। গতকাল আমার যাদবপুরের শেষ পরীক্ষা হয়ে গেছে। এখন প্রায় আড়াই মাস ছুটি। তারপর আমার ফ্লোরিডা ভ্রমণ। সকাল থেকেই আত্মীয় স্বজনদের ফোন আসতে শুরু করল। আমাদের পরিবারে একটি কুসংস্কারের জন্য জন্মদিন পালন হয়না। আমি সকালে অন্যান্য দিনের মতই স্নান খাওয়া করে বেরিয়ে পড়লাম। কলেজে যাব। তবে অন্য কারণে। আমাদের বন্ধু আশিস গেটে ভালো র‍্যঙ্ক করেছে। তাই আজ খাওয়াবে। রোজকার মত অটো করে বেহালা চৌরাস্তা, তারপর বাসে করে যাদবপুর। বাওয়ারচিতে ভরপেট খেয়ে গাছতলায় বসে আড্ডা দিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন সন্ধ্যা হবে। ঠিক হল দু'দিন পর আমরা বর্ধমান যাব।

বাবা বর্ধমানে একাই থাকত। আমরা সকালের ট্রেন নিয়ে দুপুর নাগাদ বাড়ি পৌঁছালাম। ২০০৬ এ আমরা ফ্ল্যাট পালটেছিলাম। কিন্তু আমি তখন দিল্লীতে ইন্টার্নশিপ করছি। তারপর আর কাজের চাপে বর্ধমান যাওয়া হয়নি তেমন। নতুন ফ্ল্যাটের সবার সাথে সেভাবে আলাপ ছিল না। কয়েকজনকে চিনতাম, যেমন আমাদের প্রতিবেশী ছোটু। ছোটু আমার ছোটবেলার বন্ধু। একসাথে ক্রিকেট খেলেছি। আমাদের তারাবাগের এক একটা ব্লকে চারটি করে ফ্ল্যাট থাকত। আমরা আর ছোটুরা দোতলায় থাকতাম। একতলায় তুয়া-টুটু দুই ভাই বোন আর নন্দ জেঠুরা। তিনতলায় সায়নীরা আর শ্রাবণীদিরা। বাকিদের সবার সঙ্গে চেনা জানা থাকলেও একদম চিনতাম না শ্রাবনীদি দেবাঙ্গনদাকে। শ্রাবণীদি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে সদ্য জয়েন করেছে, অধ্যাপক হিসেবে।

কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের একটা দারুণ দল হয়ে গেল। রোজ বিকেলে চা খেতে খেতে ছাদে আড্ডা। দেবাঙ্গনদা রসিয়ে গল্প করতে পারে। আমি কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে যাচ্ছি শুনে বলল -- "জানিস আমি সফটওয়ার শুনে খুব ঘাবড়ে যাই। ছোট থেকে হার্ডওয়ার বলতে বড় বড় দোকান দেখেছি। সফটওয়ার শুনে ভাবলাম এটা কি? হোসিয়ারি?" একদিন  তো ছাদে সবাই মিলে পিকনিক করলাম সন্ধ্যাবেলা। যারা সঞ্জীববাবুর শিউলি পড়েছেন, তারা জানবেন, আমরা প্রায় ওরকম জীবন কাটাতাম।

একদিনের কথা মনে পড়ে, সেদিন ছাদে তখনও কেউ আসেনি। আমি একা। চুপচাপ ছাদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মনে মনে ভাবতাম আচ্ছা এরকম ভাবে তারাবাগে আমাদের ছাদে আবার কবে আমি এভাবে বসে থাকতে পারব। হয়ত কালকেই পারব। হয়ত এই পুরো সপ্তাহটা পারব। কিন্তু তারপর? একদিন এই বাড়িটা ছেড়ে আমি অনেক দূরে চলে যাব। তখন কি এটার কথা মনে পড়বে? মনে পড়েছিল। বার বার মনে পড়ত। তাই ২০১৭-এ যেদিন আমরা শেষবারের মত তারাবাগ ছাড়ি, যেদিন মিডলসবরোকে হারিয়ে লিভারপুল চ্যাম্পিয়ান্স লিগে থাকা নিশ্চিত করছে, সেদিনও আমি উঠে গেছিলাম ছাদে।

এর মধ্যে ফ্লোরিডা থেকে আমার  আই টুয়েন্টি চলে এল। যারা জানেন না তাদের জন্য বলি -- স্টুডেন্ট ভিসায় মার্কিন দেশে আসতে গেলে এই নথিটি লাগে। অনলাইনে ভিসার দিন ঠিক করলাম। আমার  স্কলারশিপ ছিল। তাও কেউ কেউ বলল বাড়ির দলিল, নথি দেখানো উচিত। যদি ঝামেলা করে। আমি আর বাবা বর্ধমানে এক উকিলের বাড়ি গেলাম। তিনি সমস্ত নথি বানিয়ে দিলেন। এরপর জুনের শেষ দিকে আমরা আবার কলকাতা ফিরলাম। ভিসার আগে সবাই দুশ্চিন্তায় ফেলে দিল। তখন স্টুডেন্ট ভিসা, বিশেষত যারা পি এইচ ডি করতে যাচ্ছে, তাদের একটি পিঙ্ক স্লিপ দিত মাঝে মাঝে। কিছুই না, ভিসা হয়ে যেত। কিন্তু দেরী হত কয়েক সপ্তাহ। যাই হোক, আমার ক্ষেত্রে সেসব হলনা। ভিসা অফিসার মহিলা বললেন "ভিসা ইজ এপ্রুভড।" কাউন্টারের বাঙালি মহিলা বললেন -- "আজ শুক্রবার তো? আজকেই পেয়ে যাবেন। বিকেলে আসুন।"

ইন্টার্ভিউ দিয়ে বাইরে বেরোতেই এক দল লোক ছেঁকে ধরল -- "লোন লাগবে?" না জানিয়ে বাবাকে বললাম যে আজকেই ভিসা পাবো। কি করবে? পার্ক স্ট্রিট থেকে আমাদের শকুন্তলা পার্কের বাড়িতে ফিরে আবার চারটের মধ্যে আসা সময়সাপেক্ষ। তাই আমরা ঐ অঞ্চলেই ঘুরে বেড়ালাম। দুপুরে ডমিনোজে পিতজা খেলাম। বাবা সেই প্রথম জীবনে পিতজা খেলেন। আমি এর আগে একবারই খেয়েছি দিল্লীতে। আজকাল হয়ত কলকাতায় কলেজে পড়া ছেলেদের কাছে পিতজাটা কোন বিলাসিতা না। কিন্তু সেই সময় আমাদের মত মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেদের কাছে তা ছিল বইকি।

ভিসা নিয়ে আবার বর্ধমান ফিরলাম। এবার আমি আমার স্কুল জীবনের শিক্ষক শিশিরবাবুর কাছে ভর্তি হলাম জাভা শিখব বলে। আমার পুরনো এটলাস গোল্ডলাইন সুপারটা আবার ঝেড়ে বার করা হল। কতদিন বাদে সেই স্কুল জীবনের মত সাইকেল করে পড়তে যাচ্ছিলাম। একদিন আমরা তারাবাগের ব্লকের সবাই মিলে গাড়ি ভাড়া করে ঘুরতে বেরোলাম। দামোদারের পার ঘুরে, শের আফগানের সমাধি ঘুরে, কঙ্কালিতলা হয়ে দারুণ এক সন্ধ্যা কাটালাম। এর মধ্যে আমার প্লেনের টিকিট কাটা হয়ে গেল। ঠিক হল ৬ আগস্ট ভোর একটার প্লেনে আমরা অনেকে মিলে একসাথে যাব। তখন কলকাতা থেকে লুফথান্সা চলত। সেই প্লেনে আমরা যাদবপুরের বন্ধুরা মিলে যাব ফ্র্যাঙ্কফুর্ট। সঙ্গে থাকবে আমার রুমমেট সায়ক। সেখান থেকে আমি আর সায়ক ওয়াশিংটন ডি সি হয়ে যাব ফ্লোরিডার ওরল্যান্ডো।

বলতে ভুলে গেছি এই ছুটিতেই আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম ফ্লোরিডায় কে কে একসাথে থাকব। তখন ফেসবুকের এত রমরমা ছিল না। ফ্লোরিডার বাঙালি ছাত্র ছাত্রীদের একটা ইয়াহু মেলিং গ্রুপ ছিল। আমি এডমিশন পাওয়ার পর পর সেখানে ঢুকে পরেছিলাম। সায়কের সঙ্গে আলাপ আর এক পরিচিতর মাধ্যমে। একদিন সেই মেলিং গ্রুপে দেখলাম এক বাঙালি ছাত্র, নাম অনিরুদ্ধ, মেল করেছে তার দুটি রুমমেট লাগবে। মেল পড়েই আমরা উত্তর দিলাম আমরা রাজি। অনিরুদ্ধদা এর মধ্যে একদিন কলকাতা এলো। ওর বাড়ি বালিগঞ্জে। একদিন ওর বাড়িতে আমি আর সায়ক দুপুরে লাঞ্চের নেমন্তন্নে গেলাম। প্রচুর আড্ডা হল। অনিদা বলল ও ২০ আগস্ট নাগাদ ফ্লোরিডা ফিরবে। আমরা তার মধ্যে যেন লিজ সই করে বাড়িতে ঢুকে যাই। কিন্তু আমরা যেন বেশী আসবাব বা বাসনপত্র না কিনি। কারণ ওর সব আছে, ও সেগুলো নিয়ে আসবে।

এভাবে একদিন বর্ধমানের পাট শেষ হল ২২শে জুলাই। আর দু সপ্তাহ বাদে আমার যাত্রা। এবার কলকাতা ফিরতে হবে। ব্যাগ কিনতে হবে, ব্যাগ গোছাতে হবে। যেদিন তারাবাগ ছেড়ে এলাম সেদিন আমাদের রিক্সার পাশে ব্লকের ছটা ফ্ল্যাটের সবাই নেমে এসেছিল। কৃষ্ণাদি আমাদের বাড়িতে মাকে সাহায্য করত। আমি চলে যাচ্ছি বলে কেঁদে ফেলেছিল। সবাই বলল সাবধানে থাকিস, দেবাঙ্গনদা বলল চিঠি লিখিস। কথা দিলাম লিখব। কৃষ্ণাদির স্বামী শম্ভুদা আমাদের স্টেশনে নিয়ে এল রিক্সায়।  ট্রেনটা যখন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, যখন হলুদ সাইনবোর্ডে বর্ধমান লেখাটা শেষবারের মত দেখলাম, আমার কান্না পাচ্ছিল।

বার বার চোখ মুছেও দেখলাম চোখের লাল ভাবটা যাচ্ছেনা। বাবা বলল কলকাতা গিয়ে তোর ডাক্তারমামাকে দেখাস। হয়ত জয় বাংলা। তখনো জানতাম না জয় বাংলায় শেষ না, কলকাতায় কি ভয়ানক ব্যাধি অপেক্ষা করছে আমার জন্য।


Monday, March 30, 2020

তৃষ্ণা

মা বাবার সঙ্গে ক'দিন হল এই নতুন শহরে এসেছে রিঙ্কা। নামেই শহর। প্রায় গ্রাম বললেই চলে। পাহাড়ি জায়গা। বাবা এক টিম্বার কোম্পানিতে চাকরি করেন। তাই রিঙ্কারা এখানে এসেছে। কয়েকটা মাত্র কোয়ার্টার। রিঙ্কাদের পিছনে থাকেন  দে বাবুরা। এ ছাড়া হাসানবাবু, কোলেবাবু, শর্মাবাবু এনারা বাকি কয়েকটা বাড়িতে থাকেন। রিঙ্কাদের কলোনি থেকে বেরোলেই একটা ছোট গ্রাম। সেই গ্রামে একটাই স্কুল। রিঙ্কা অনেক ছোট, তাই ঐ স্কুলে যায়না। এখানে এক বছর থেকেই ট্রান্সফার হয়ে যাওয়ার কথা রিঙ্কার বাবার। তাই রিঙ্কাকে স্কুলে ভর্তি করেননি।

এই জায়গাটা ভীষণ নিরিবিলি। সন্ধ্যা হলেই রাস্তায় তেমন লোকজন দেখা যায়না। রিঙ্কার বাবার যদিও সেটা ভালোই লাগে। মাঝে মাঝেই রাত্রিবেলা বারান্দায় বসে থাকেন একা একা। রিঙ্কাকেও ডাকেন। রিঙ্কা এলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।  রিঙ্কার ভালো লাগেনা। রিঙ্কার বাবার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বাবা কিছুতেই কথা বলতে চাননা। একটা দুটো হ্যাঁ হুঁ উত্তর দিয়ে থেমে যান। রিঙ্কার রাত্রে ভালো লাগেনা। কী সুন্দর কলকাতায় ছিল। রাত অবধি বাড়ির সামনে  রোলের দোকানটা খোলা থাকত। একটু দূরেই মদনকাকুর ওষুধের দোকান ছিল। সেখানেও আলো জ্বলত। আর রাস্তাতেও কত আলো। এখানে রাস্তায় আলো থাকেনা। সারা পাড়া নিঝুম ঘুমে থাকে। মাঝে মাঝে পাতার আওয়াজ শুনেই রিঙ্কার ভয় করে। মনে হয় কে যেন দেখছে থাকে। ছুটে চলে যায় মায়ের কাছে।

রিঙ্কার সবচেয়ে বড় কষ্ট এখানে তার বয়সী কোন বন্ধুবান্ধব নেই। এখানকার স্কুলটা বেশ বাজে বলে প্রায় সবার ছেলে মেয়েই বাইরে হস্টেলে থেকে পড়ে। বিকেলবেলা রিঙ্কা একা একাই পুতুল নিয়ে বা রান্নাবাটি খেলে। মা মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে ঘুরতে বেরোন। কিন্তু মায়ের সঙ্গে হাঁটতে কি ভালো লাগে।  একদিন বলটা নিয়ে বেরিয়েছিল। খানিকক্ষণ খেলার পর বলটা খাদের ধার দিয়ে পড়ে যায়। রিঙ্কাদের কলোনিটা পেরোলেই গভীর খাদ। তারপর থেকে রিঙ্কার মা আর বল নিয়ে বেরোতে দেন না। রিঙ্কা একা একা বারান্দায় বসে থাকে। 

একদিন বিকেলবেলা এরকম বারান্দায় বসে আছে রিঙ্কা। দেখে নিচ দিয়ে এক দিদা হেঁটে যাচ্ছেন। রিঙ্কাকে দেখেই তিনি এক গাল হেসে বললেন
-- কি নাম তোমার?
-- প্রিয়াঙ্কা সেন।
-- ডাক নাম কি?
-- রিঙ্কা।
-- তুমি এরকম একা একা বারান্দায় বসে আছো কেন?
--  আমার কোন বন্ধু নেই।
-- সেকি? কেউ নেই?
-- নাহ, কেউ নেই।
-- তাহলে তো আমাকেই তোমার সাথে খেলতে হয়।

এরকম সময় মা পাশ থেকে এসে গেলেন।

-- কার সাথে কথা বলছিস রিঙ্কা?
-- নমস্কার, আমার নাম পারমিতা রায়। আমি এখানকার স্কুলে আগে পড়াতাম। এখন অবসর নিয়েছি।
-- বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? আসুন না।

সেদিনকেই পারমিতা দিদার সঙ্গে আলাপ জমে গেল রিঙ্কার। ওনাকে মিতাদিদা বলে ডাকতে বললেন। কত গল্প জানেন মিতাদিদা। ব্যাঙ রাজপুত্রের গল্প, রাক্ষসের গল্প, ডাইনি বাবা-ইয়াগার গল্প, শুনতে শুনতে মন ভালো লাগছিল রিঙ্কার। মা এত গল্প জানেননা। মিতা দিদা যাওয়ার সময় ওনার বাড়ি যেতে বললেন। একাই থাকেন। রিঙ্কারা গেলে ওনার ভালোই লাগবে।

পরের রবিবার তিনজনে মিলে মিতাদিদার বাড়ি যাওয়া হল। ওদের কলোনি পেড়িয়ে, পাশের গ্রামের মধ্যে মিতাদিদার বাড়ি। বাবার স্কুটারে যেতে পাঁচ মিনিটও লাগল না। কিন্তু গিয়ে রিঙ্কার প্রথমে মন খারাপ হয়ে গেল। বড়রা তিনজন গল্প করতে লাগলেন। রিঙ্কাকে কেউ পাত্তাই দিলনা। সেটা বুঝতে পেরে মিতাদিদা বললেন

-- রিঙ্কা মুখ গোমড়া কেন? খেলার সাথি পাচ্ছনা? চল ভেতরে অনেক পুতুল আছে। তোমাকে দেখাচ্ছি।

মিতাদিদা রিঙ্কাকে ভিতরের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরে একটা পুরোন দিনের খাট, একটা আলমারি, আর একটা দেওয়াল আলমারি। সেই দেওয়াল আলমারিতে এক গাদা পুতুল দেখা গেল।

-- তুমি এগুলো নিয়ে খেল, আমরা গল্প করছি।

মিতাদিদা চলে গেলে রিঙ্কা খেলতে শুরু করল। পুতুলগুলো কি সুন্দর। কোনটা হাতি, কোনটা বাঁদর। তবে সবচেয়ে সুন্দর পুতুল হচ্ছে একটা বড় মেয়ে পুতুল। কোঁকড়া সোনালি চুল, পরনে হালকা নীল রঙের ফ্রক। হাতে বালা। পুতুলটার সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে এক মিনিট অন্তর অন্তর চোখ পিট পিট করে। রিঙ্কা তাকে মেয়ে বানিয়ে খেলতে শুরু করল।

খেলতে খেলতে রিঙ্কার মনে হল কেউ যেন তাকে দেখছে। একটু ভয় পেল রিঙ্কা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। না, কেউ তো নেই। জানালার পরদা উড়ছে। বাইরে সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। ঐ তো দূরে ধূলিয়া  নদী দেখা যাচ্ছে। নদী দেখেই রিঙ্কার মাথায় এল, আরে তার মেয়ের তো জল খাওয়া দরকার। তার মা তাকে প্রতি ঘণ্টায় জল খাওয়ায়। মেয়েকে সে খাওয়াবে। পাশেই বাথরুম ছিল। পুতুলগুলোর সঙ্গে যে রান্নাবাটির সরঞ্জাম ছিল, তার থেকে গ্লাস এনে তাতে জল ভরে মেয়েকে খাওয়াতে গেল রিঙ্কা। জল পুতুলের মুখ থেকে জামায় গিয়ে পড়ল।

-- এভাবে তো ও জল খাবে না রিঙ্কা।

মিতাদিদা কখন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন রিঙ্কা খেয়াল করেনি। চমকে উঠল সে।

-- আজ চল, তোমার মা বাবা অপেক্ষা করছেন। তোমাকে আর একদিন দেখাব ও কীভাবে গ্লাস থেকে খায়।

এরপর অনেকবারই রিঙ্কার মিতাদিদার বাড়ি যাতায়াত চলতে লাগল।  একদিন মা কোলে আন্টিদের বাড়ি পার্টিতে যাবে। রিঙ্কা একা বাড়ি থাকতে পারবেনা। তাই মা ঠিক করলেন ওকে মিতাদিদার বাড়ি রেখে আসবেন।

-- আপনার অসুবিধা হবে না তো?
-- একদম না। রিঙ্কা থাকলে আমার খুব ভালো লাগে। আপনার হয়ে গেলে এসে ওকে নিয়ে যাবেন।
-- রিঙ্কা বিস্কুট খাবে?

বিস্কুট খেয়ে মিতাদিদার কাছে দৈত্যের গল্প শুনে রিঙ্কা পুতুলঘরে খেলতে গেল। আজ মিতাদিদাও খেলতে এলেন। বেশ খানিকক্ষণ খেলার পর মিতাদিদার কাছে রিঙ্কা বায়না ধরল তার মেয়েকে জল খাওয়ানোর।

-- তোমার মেয়ের যেন কি নাম দিয়েছ?
-- আমার নাম রিঙ্কা, তাই ওর নাম পিঙ্কা।
-- বাহ ভালো নাম। কিন্তু ঐ নামে ডাকলে তো ও খাবে না। ওকে ডাকতে হবে সোনাই বলে।
-- আচ্ছা, সোনাই জল খা।
-- দাঁড়াও দাঁড়াও ঐ ভাবে বললে ও খাবেনা।
-- তাহলে?
-- ও তো জল খায়না।
-- তাহলে কি খায়?
-- ও একটা লাল শরবত খায়।
-- লাল শরবত?
-- হ্যাঁ।
-- কই দাও। আমি খাওয়াবো।
-- দিতে পারি। কিন্তু তোমার ভীষণ লাগবে।
-- লাগুক। আমি মেয়েকে শরবত খাওয়াবো।
-- তোমার যতই লাগুক তুমি চেঁচাবে না তো? তুমি চেঁচালে কিন্তু ও খাবে না।
-- না চেঁচাব না।
-- আর কাউকে বলতে পারবেনা ওকে তুমি খাইয়েছ? তোমার মা বাবাকেও না।
-- না বলব না।
-- বললে কিন্তু ও সারাজীবনের জন্য চলে যাবে, আর কোনদিন আসবেনা।
-- না দিদা, আমি বলব না।
-- দাঁড়াও, আমি আসছি।

এই বলে দিদা ভিতরে গেলেন । রিঙ্কা একা একা মেয়েকে ডাকল

-- এই সোনাই।

বলা মাত্র দেখল সোনাইয়ের চোখের পাতা পড়ল আবার। এবার দিদা ঘরে ঢুকলেন। হাতে একটা লম্বা গ্লাস, সঙ্গে একটা স্ট্র। আর সঙ্গে একটা ছোট বাক্স। বাক্স খুলে যে জিনিসটা বার করলেন দিদা সেটা রিঙ্কা চেনে; ওর নাম ইনজেকশন। কলকাতায় ডাক্তারকাকু প্রায় দিতেন এটা। খুব লাগে রিঙ্কার।

-- না...
রিঙ্কা কেঁদে উঠল।
-- ঠিক আছে তাহলে  সোনাই আজ খাবে না।
দিদা আবার বাক্স বন্ধ করলেন।
-- না না, সোনাই খাক। কিন্তু আমার ওতে ভয় করে।
-- ভয় করলে তো সোনাইকে খেতে দেখতে পারবেনা।

এবার রাজী হল রিঙ্কা। আস্তে আস্তে রিঙ্কার হাতে ইনজেকশন দিয়ে রক্ত নিলেন দিদা। ইনজেকশনের ভিতরটা লালচে কালো হয়ে গেল। সেটা এবার ঐ বড় গ্লাসে ঢেলে দিলেন। স্ট্রটা দিয়ে এবার গ্লাসটা রিঙ্কার হাতে দিলেন

-- তোমার মেয়েকে খাওয়াবে না রিঙ্কা?

সোনাইয়ের মুখের সামনে স্ট্রটা ধরতেই গেলাস খালি হতে লাগল। রিঙ্কা হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। প্রায় দু মিনিট সময় নিল সোনাই গ্লাসটা খালি করতে। এই দু মিনিটে একবারো কিন্তু সোনাই-এর চোখের পাতা পড়ল না। 

Wednesday, March 25, 2020

পিতৃ দায়িত্ব

"নতুন এলেন পাড়ায়?"
"হ্যাঁ এই তো কালকে।"
"নমস্কার, আমি সুবিমল সান্যাল।"
"আমি মলয় সেনগুপ্ত। এটি আমার মেয়ে রত্না।"
"নমস্কার কাকু।" -- মিষ্টি গলায় বলল রত্না।
"নমস্কার। কোথায় উঠেছেন?"
"আমরা লাহাবাবুর বাড়িটা ভাড়া নিয়েছি।"
"ওহ, কোথা থেকে আসছেন?"
"কলকাতা।"
"তা ভালো, এখানে কোন কাজে?"
"নাহ সেরকম কিছু না। আসলে আমি বছর দুয়েক হল রিটায়ার করেছি। এখন আমি আর মেয়ে মিলে এই গাড়িটা করে ঘুরে বেড়াই। এই দেশের বিভিন্ন শহরে শহরে কয়েক মাস করে থাকি।"
"অবাক ব্যাপার মশাই। আপনি কোথায় চাকরি করতেন?"
"আমি রেলের ডাক্তার ছিলাম।"
"আরিব্বাস। ভালোই হল আমাদের বাড়ির কাছে একটা ডাক্তার পাওয়া গেল। গাড়িটা খাসা। কবেকার?"
"এটা যুদ্ধের পর পরই কেনা। অস্টিন।"
"বাহ বাহ বেশ। তো আপনার মেয়ে কি করে?"
"ও আমার সঙ্গেই থাকে, আমার দেখাশোনা করে।"
"সেকি? আপনার মেয়ের তো বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে মশাই। বিয়ে দিচ্ছেন না কেন?"
সুবিমলবাবু কথাটা বলেই লক্ষ্য করলেন রত্নার মুখটা গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। মলয়বাবু খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন
"ঐ আর কি?"

সুবিমলবাবু ধুরন্ধর লোক। বুঝে গেছেন এই নিয়ে কথা বলা পিতা পুত্রী কেউই পছন্দ করবেন না। তাই আর প্রশ্ন না করে বললেন

"চলি আজ। একদিন আসবেন দু'জনে আমাদের বাড়ি। আমার স্ত্রী খুশী হবে।"
"নিশ্চয়।"

সুবিমলবাবু লক্ষ্য করলেন যে মলয়বাবু কিন্তু তাঁকে নেমতন্ন করলেন না।

মলয়বাবুরা থাকতে শুরু করলেন পাড়ায়। খুব একটা কারুর সঙ্গে মিশতেন না। সুবিমলবাবুর বাড়ি আর যাননি তাঁরা। তাঁদের বাড়িও কেউ আসত না। কাজের লোক বীণা সকালে কাজ করে চলে যেত। মলয়বাবুর সঙ্গে সবার দেখা হত সকালবেলা বাজার করার সময়। নিজের গাড়ি নিজেই পরিষ্কার করতেন মলয়বাবু। কিন্তু যেটা সবচেয়ে অদ্ভুত হল রোজ সন্ধ্যেবেলা খানিকক্ষণের জন্য ওনাদের বাড়ি থেকে কান্না শোনা যেত। রত্না কোনদিন ফুঁপিয়ে কাঁদত, কোনদিন চেঁচিয়ে। লাহাবাবু একবার পরেরদিন জানতে চেয়েছিলেন

"কাল রত্না কাঁদছিল, ওর কি কিছু হয়েছে?"

মলয়বাবু হেসে উত্তর দিয়েছিলেন --
"না না, ওর আসলে মাঝে মাঝে পেটে ব্যাথা হয়। এটা একটা অদ্ভুত রোগ জানেন। এর কোন প্রতিকার নেই। হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে যায়। তখন ও কাঁদে।"

আসল ঘটনা কিন্তু অন্য। ঐ সময় কেউ সেনগুপ্ত বাড়ি গেলে দেখতে পারত রত্নার কান্নার কারণ কোন শারীরিক যন্ত্রণা না। রত্না  কাঁদতে কাঁদতে বলত --

"বাবা ওরা আমাকে এখানে মেরেছে, এখানে ব্যাথা দিয়েছে দেখো।" -- এই বলে নিজের শাড়ি টেনে তুলত।

আজকাল আর চোখ বন্ধ করেননা মলয়বাবু। বরং সে জায়গায় হাত বুলিয়ে বলেন

"না মা, কাঁদিস না। আমরা ওদের শাস্তি দেব।"
"কবে বাবা, পুলিশ তো ওদের ছেড়ে দিল।"
"দেব মা, ওদের দেব। তুই ওদের মারবি তো?"
"হ্যাঁ বাবা," -- এবার হাসি ফুটত রত্নার মুখে।
"কীভাবে মারবি বল?"
"ঐ বড় লাঠিটা দিয়ে মারব। মাথায় মারব। চোখে মারব। রক্ত বেরোবে বাবা?"
"অনেক অনেক রক্ত বেরোবে। তুই খুশী হবি তো?"
"হ্যাঁ বাবা। হব। কবে মারব বাবা?"
"হ্যাঁ এবার মারব আমরা একদিন।"

একদিন রত্না বারান্দা থেকে একটা ছেলেকে দেখাল। মলয়বাবু দেখে নিশ্বাস ফেললেন। একে তিনি চেনেন। পাশের পাড়ায় একটা ওষুধের দোকান আছে। নাম তমাল। দু'দিন বাদে ছেলেটিকে বাড়িতে নেমতন্ন করলেন তিনি। তার আগেরদিন বীণাকে মাইনে দিয়ে ছাড়িয়ে দিয়েছেন।

তমালের কিছুদিন ধরেই রত্নাকে ভালো লাগে। কোনদিন কথা বলেনি, তবে বলতে কতক্ষণ। আজ রত্নার বাবা তাকে নেমতন্ন করতে বেশ অবাক লেগেছিল তার।

বাড়ি ঢুকে তমাল দেখল বাড়ির বেশিরভাগ জানালা বন্ধ। বাড়িতে আসবাব পত্র বিশেষ নেই। সে বোধহয় এই পাড়ায় প্রথম যে এ বাড়িতে এল।

"বস তমাল, আছো কেমন?"

আড্ডা চলতে লাগল। তমালের অবাক লাগল সে রত্নাকে দেখতে পেল না। একটু বাদেই রত্না এল চা নিয়ে। চা খাওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই গভীর ঘুমে ঢলে পরল তমাল। এবার মলয়বাবু ব্যাগ থেকে একটা ইনজেকশন বার করে তমালের হাতে দিলেন। মিনিট দুয়েক পর তমালের নাকের তলায় হাত রেখে বুঝলেন তমাল আর ইহলোকে নেই। তখন রত্নাকে ডাকলেন।

"মারবি? কীভাবে মারবি বল?"
"ঐ বড় লাঠিটা দিয়ে মারব। মাথায় মারব। চোখে মারব। রক্ত বেরোবে বাবা?"
"অনেক অনেক রক্ত বেরোবে। তুই খুশী হবি তো?"

রত্না প্রায় আধঘণ্টা ধরে তমালের মৃতদেহটাকে মারল। জায়গা জায়গা থেকে রক্ত বেরোল। পুরো মেঝে ভিজে গেল।

"রক্ত, বাবা রক্ত"
"হ্যাঁ মা, আস্তে কথা বল। কেউ শুনতে পারলে?"
"হে হে, আরো মারব বাবা?"
"মার মার"

এবার উল্টোদিকের চেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরালেন মলয়বাবু। যেভাবে ছোটবেলায় মেয়ের পুতুলখেলা দেখতেন, আজ সেইভাবেই মেয়ের রক্তখেলা দেখছেন।

"বাবা একটু জল দেবে? হাঁফিয়ে উঠেছি।"
"ছেড়ে দে নাকি?"
"না বাবা, আর একটু ... "
"আচ্ছা"

আরো ঘণ্টা দুয়েক বাদে বাপ মেয়ে মিলে সব ব্যাগপত্র নিয়ে গাড়ির পেছনে তুললেন। এই শহরে রাত দশটা বাজলেই সব আলো নিভে যায়। শুধু জ্বলতে লাগল সেই যুদ্ধের পরের কেনা অস্টিনের আলো। মলয়বাবু মনে মনে ভাবছেন --
"দিনাজপুরের একটা শহরের দিকে গেলে হয়। এবার আমার নাম দেব ভাস্কর। আর ওর গৌরী।"

Friday, March 20, 2020

সব জ্যোতিষী ভণ্ড হয়না

ক্লাস সেভেন-এ পড়ে সুজয়। সুজয় তালুকদার। বাড়ি বেগমপুরে । বাবা সরকারি ব্যঙ্কে কর্মরত। মা গৃহবধূ। সুজয় স্কুলে ফার্স্ট হয়না বটে, তবে তেমন খারাপ কিছুও করেনা। মোটামুটি ক্লাসে প্রথম দশেই থাকে। খেলাধুলোতে মোটামুটি। মানে ১০০ মিটার দৌড়ে হিটে ওঠে, তবে মেডেল পায়না। ক্লাসের ফুটবল টিমে বেঞ্চে থাকে। অন্য সব বাড়ির বাবা-মায়ের মত সুজয়ের বাবা মা কিন্তু তেমন চাপ দেন না ছেলের উপর। শুধু অঙ্কে কম পেলে বাবা একটু রাগারাগি করেন। মোটকথা সুজয়ের জীবন ঝঞ্ঝাট শূন্য।

তবে সুজয়ের একটাই সমস্যা। বড্ড পেটের রোগে ভোগে। এই নিয়ে তার মা খুব চিন্তায় থাকেন। এই কয়েকদিন আগে পাড়ার রানিদির বিয়েতে খেয়ে সুজয় পরেরদিন স্কুল যেতে পারেনি। অথচ এমন কিছু বাড়াবাড়ি খায়নি সুজয়। কত ডাক্তার দেখিয়েছেন, কিছুই হয়নি। এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, এমনকি কয়েকদিন আগে এক কবিরাজের ওষুধও খাওয়ালেন, কোন লাভ হলনা।

গত মাসে পাড়ায় এক  নতুন ভদ্রলোক এসেছেন। নাম বলরাম মহাপাত্র। দুটো বাড়ি পরে অরূপদাদের বাড়িতে ভাড়া এসেছেন। একাই থাকেন। খুব একটা কারুর সঙ্গে মেশেন না। শুধু মৃণাল জেঠুর সঙ্গে যা আলাপ। মৃণাল জেঠু কলকাতার কোন এক কলেজে ফিজিক্স পড়াতেন। দু'বছর হল অবসর নিয়েছেন। বিপত্নীক। ওনার এক মেয়ে, দিল্লীতে থাকে। সুজয় শুনেছে বলরামবাবু নাকি প্রায়ই সন্ধ্যাবেলা মৃণাল জেঠুর বাড়ি আড্ডা মারতে যান।

ঘটনাটা ঘটল গত শনিবার। সেদিন সন্ধ্যাবেলা ওয়ার্ল্ড কাপে আর্জেন্টিনা হল্যান্ডের খেলা ছিল। স্কোর ১-১, এই সময় সুজয়দের পাড়ায় লোডশেডিং। এরকম অবস্থা আগেও হয়েছে। হলেই সুজয়, রন্টু, সোমনাথ, এরা ছোটে মৃণাল জেঠুর বাড়ি। ওনার জেনেরেটার কানেকশন আছে। এবার গিয়ে দেখলেন ঘরে বলরামবাবু বসে আছেন। এক গাল চাপ দাড়ির মধ্যে দিয়ে ওদের দেখে উনি হাসলেন। মাথার পাকা চুল দেখে ওনার বয়স আন্দাজ করা শক্ত। টি ভি  চালিয়ে দিলেন জেঠু।  সোমনাথ আর রন্টু ঝগড়া শুরু করল 

-- বাতিস্তুতা আছে, আজ আর্জেন্টিনা জিতবে।
-- ক্লুইভার্ট আর একটা দেবে।

-- বার্গক্যাম্পকে দেখছি না?
এবার বলরামবাবুর গলা শুনল সুজয়রা।
-- ঐ তো দেখুন, ৮ নম্বর জার্সি।
-- হ্যাঁ, দেখতে পেয়েছি। ওর দিকে নজর রেখ।

খেলার অন্তিম লগ্নে এক অসামান্য গোলে হল্যান্ডকে জেতাল ডেনিস বার্গক্যাম্প। গোলটা হতেই সবাই চমকে তাকাল বলরামবাবুর দিকে।
-- আপনি কি করে জানলেন?
-- না না, আন্দাজ আর কি।

কথা চাউর হতে  বেশিদিন  লাগলনা। পাড়ায় অনেকেই বলরামবাবুকে জ্যোতিষী ভাবতে লাগলেন। সবার আগে সুজয়কে নিয়ে এলেন ওর মা।

-- আপনি একবার ওর হাতটা দেখে দিন, দেখুন না করবেন না। কবে ওর এই পেটের সমস্যা মিটবে?
-- না না, আমি জ্যোতিষী নই। এরকম করবেন না।

সুজয়ের মা তবু নাছোড়বান্দা, বার বার ছেলেকে নিয়ে আসতে লাগলেন। একদিন হাল ছেড়ে দিলেন  বলরামবাবু।

-- দাঁড়ান দেখি, তবে হাত লাগবে না।

এই বলে সুজয়ের চোখের দিকে দেখলেন। দেখে কিছুক্ষণ খাতায় কিসব লিখে বললেন

-- দেখুন আপনার ছেলের তেমন কোন সমস্যা নেই। শুধু ওর ভাত হজম হয়না। আপনি ভাবেন ভাত খেলে ওর পেট ঠিক থাকবে, তা নয়। ওকে রুটি দিন দু'বেলা।
-- কিন্তু রুটি হজম করা তো আরো শক্ত।
-- সবার জন্য না। যেটা বললাম করুন, দেখুন কি হয়।

এক সপ্তাহ বাদে আবার এলেন সুজয়ের মা। এবার সুজয় না। সঙ্গে ওর বাবা।  এসেই প্রণাম করলেন বলরামবাবুকে।

-- আপনি সাক্ষাত ভগবান। আমার ছেলেটা একদম সুস্থ এখন। আপনার ফিজ কত বলুন।
-- না না, একদম না। একই, প্রণাম করছেন কেন? ছি ছি!! আমি এসব শখে করি। কোন ফিজ না।
-- আমার আর একটা প্রশ্ন আছে। আমার ছেলেটা খুবই সাধারণ। ও বড় হয়ে চাকরি পাবে তো?
-- কেন পাবে না!! আপনার ছেলে খুবই ভালো। চিন্তা করবেন না, ও খুব ভালো করবে পড়াশুনায়। শুধু ওকে জোর করে কিছু করাবেন না। ও যা করতে চায়, তাই করতে দিন।
-- আমাদের শখ ও ইঞ্জিনিয়ার হোক। এখন শুনছি ঐ লাইনে পড়লেই চাকরি।
-- ও ভুলটা করবেন না। ওর যেটা ইচ্ছে সেটা পড়তে দেবেন।
-- আচ্ছা। আপনি যা বলবেন সেরকমই হবে।
-- একটা কথা, প্লিজ কাউকে বলবেন না আমি আপনাকে সাহায্য করেছিলাম।
-- না না, আপনি ভাববেন না। আমি কথা দিলাম।

কথা দেওয়ার ফল হল পরের এক সপ্তাহের মধ্যে রোজ  সন্ধ্যেবেলা বলরামবাবুর বাড়ির সামনে লোকের ভিড়। টুকটুকিদির বিয়ে কবে হবে, তপনদা চাকরি কবে পাবে, এমনকি সামনের ইলেকসানে দত্তবাবু জিতবেন কিনা, সব জানতে ভিড় চলল। কিছু কিছু ভুল হলেও বলরামবাবু যা বলতেন বেশিরভাগই ফলত।

এইভাবে এক বছর প্রায় চলার পর একদিন বিকেলে যখন সুজয় স্কুল থেকে ফিরছে, বলরামবাবু বারান্দা থেকে ডাকলেন

-- সুজয় শোন।

সুজয় ব্যাগ নিয়ে ওনার বাড়ি ঢুকল।
-- কেমন আছেন কাকু?
-- ভালো। তুমি ভালো?
-- হ্যাঁ।
-- শোন তোমাকে যে কারণে ডাকলাম। আমি কাল এই পাড়া ছেড়ে চলে যাব।
-- সেকি? কেন?
-- সেটা বলার জন্যই তোমাকে ডাকলাম। বস। তুমি মাল্টিভার্স কাকে বলে জানো?
-- না।
-- আমাদের পৃথিবীতে অগুনতি সমান্তরাল জগত আছে। সেই সব জগতেই  তুমি আছো, তোমার মা আছেন, তোমার বাবা আছেন, শুধু জগতগুলো আলাদা। কিছু জগতে  তুমি হয়ত নামকরা ফুটবলার। কিছু জগতে তুমি হয়ত জেলের কয়েদী। এই জগতগুলি বিভিন্ন সময়ে চলে। এখানে এখন ১৯৯৯, অথচ কিছু জগতে এখন ২০০১, কোথাও এখন ২০২০।
-- এ তো প্রোফেসর শঙ্কুর গল্প লাগছে!!
-- হ্যাঁ, শুধু এটা সত্যি। আমি সেরকম এক জগত থেকে এসেছি। আমি এসেছি ২০২০ থেকে। ২০২০ তে পৃথিবীতে করোনাভাইরাস নামক এক ভাইরাস এসে মারাত্মক কোলাহল সৃষ্টি করে। আমি তখন সুইটজারল্যান্ডে সার্নে পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণা করি। আমি এই দরজাটা বানাতে সক্ষম হই যা দিয়ে এক জগত থেকে আর এক জগতে যাতায়াত করা যাবে। সুইটজারল্যান্ডের অবস্থা ভয়ানক খারাপ হওয়ায় আমি পালিয়ে আসি। তবে মাঝে মাঝে গিয়ে দেখতাম কি হয়েছে। এখন পুরোপুরি সুস্থ ওখানে সবাই। তাই কাল ফিরে যাব।
-- সেকি!! তাহলে আপনি আমাদের সকলের ব্যাপারে ঠিক বলতেন কি করে? ভবিষ্যৎ দেখে?
-- হ্যাঁ, কারণ আমি তোমাদের সবাইকেই চিনতাম। কাজেই তোমাদের ১৯৯৮-এ কি হবে সেটা আমি আগে জেনে গেছি। টুকটুকিদির বিয়ে, দুত্তবাবুর ভোট সবই আমি জানতাম। আমি তো সেই সময়টা তোমাদের মধ্যে কাটিয়েছি। যেমন মৃণাল জেঠু পরের বছর চলে যাবেন সবাইকে ছেড়ে। সেই কারণেই আমি গত এক বছর ওনার সঙ্গে সময় কাটিয়েছি। উনি একমাত্র জানতেন আমার পরিচয়। আমাকে মারাত্মক স্নেহ করেন বলে কাউকে বলেননি আমার কথা।
-- মানে, জেঠু মারা যাবেন?
-- হ্যাঁ সুজয়, জানি কষ্ট হচ্ছে শুনতে, আমারো হয়েছিল ওনার মৃত্যুসংবাদ শুনে। কিন্তু এটা সত্যি।
-- এক মিনিট, আপনি যখন আমাদের সম্বন্ধে সব জানেন, তখন আপনি নিশ্চয় আমাদের মধ্যে কেউ। কে আপনি?

এবার নিজের পরচুলা আর দাড়ি খুলে ফেলল বলরামবাবু। সুজয়ের ওনার মুখটা মারাত্মক চেনা চেনা লাগল। কোথায় যেন দেখেছে। ও হ্যাঁ, তাই তো। সেকি!! বলরামবাবু এক গাল হেসে বললেন

-- আমার নাম সুজয় তালুকদার।

Sunday, March 1, 2020

অনন্ত স্যার

অনন্ত স্যারকে আমি প্রথম দেখি এক বুধবার। সেদিন দুপুরে টিফিন টাইমে আমরা বলটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে পাসিং করছিলাম। দেখতে পেলাম সাদা গোলাপি স্ট্রাইপ জামা পরে এক ভদ্রলোক স্কুলের গেট খুলে ঢুকলেন। ঘণ্টা কয়েক বাদে আমাদের যখন ইতিহাসের ক্লাস চলছিল, হেডস্যার মলয়বাবু ওনাকে নিয়ে ক্লাসে এলেন।

-- তোমাদের অঙ্কের স্যার রতনবাবু এক মাস থাকবেন না। তার বদলে ইনি তোমাদের অঙ্ক করাবেন। এনার নাম অনন্ত সরকার।

অনন্ত স্যার আমাদের স্কুলের বাকি স্যারদের মত অত বয়স্ক নন। বেশ কম বয়সী। প্রথমদিন ক্লাসে এসে অঙ্কের ফাঁকে গল্প করতে শুরু করলেন। একটু বাদেই চলে এল ফুটবল। অতঃপর শুরু হল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান নিয়ে বাদানুবাদ। স্যার তাড়াতাড়ি সেটা থামালেন।
-- স্যার আপনি কার সাপোর্টার?
সেই উত্তর না দিয়ে স্যার চোখ টিপলেন।

বিকেলবেলা স্কুলের শেষে আমরা মসজিদের পাশের মাঠে বল নিয়ে নেমে পড়লাম। খেলে অনেকেই, কিন্তু আমরা চারজন, অর্থাৎ আমি, কুন্তল, রবি আর সরোজ রোজ খেলি। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের চারজনের বন্ধুত্ব অনেকদিনের। কীভাবে এটা শুরু হয়েছিল, সে গল্প পরে বলব। কিন্তু আমাদের এই বিকেলের খেলাটা বহুদিন ধরে চলছে। বাকি লোকজন যাতায়াত করে, কিন্তু আমরা প্রায় রোজ খেলি। প্রায় রোজ।

সেদিন অনন্ত স্যারও আমাদের সাথে যোগ দিলেন। ভদ্রলোক বেশ ভালোই খেলেন। এমনি ব্যাকে খেলেন, আর দৌড়াতেও পারেন প্রচণ্ড। খেলার পর আমরা চারজন মাঠে বসে আড্ডা দি। অনন্ত স্যারও যোগ দিলেন। এমনি আড্ডা হল। স্যারের বাড়ি পলাশগ্রামে। এখানে একটা মেসবাড়িতে থাকেন। স্যারের বাবা নেই, মা আছেন। স্যারের দাদা কলকাতায় চাকরি করেন। স্যার কলকাতা গেছেন শুনে আমাদের হিংসা হল। কবে যে যেতে পারব?

এরকম ভাবে কয়েকদিন চলার পর স্যার একদিন আড্ডায় বসে বললেন
-- শোন, তোদের একটা কথা বলি; কিন্তু সেটা যেন শুধু আমাদের মধ্যে থাকে।
-- নিশ্চয়।
-- আমি আসলে শিক্ষক নই, আমি পুলিশে কাজ করি।
-- পুলিশ?
-- হ্যাঁ, এই শহরে গত কয়েক মাসে একটা করে খুন হচ্ছে জানিস কি তোরা?
-- না তো।
-- না জানার কথা। কারণ ঘটনাটা এত ভয়াবহ যে আমরা কাউকে বলিনি।
-- কি হয়েছে স্যার?
-- হয়েছে কি, গত কয়েক মাস কিছু লোক অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কোন একটা নির্দিস্ট বয়সের না কিন্তু। এই যেমন ধর প্রাইমারী স্কুলের ছেলেও গায়েব হয়েছে, আবার অবসর নেওয়া বৃদ্ধও হয়েছে। থানায় এরকম নিরুদ্দেশদের নিয়ে ডায়রি থাকেই। কিন্তু দু সপ্তাহ আগে শহরের বাইরে যে জঙ্গলটা আছে, সেখানে আমরা কিছু কঙ্কাল পাই। টেস্ট করে দেখা গেছে ঐ কঙ্কালগুলি যারা নিরুদ্দেশ হয়েছে তাদের কঙ্কাল।
--  সেকি?
-- হ্যাঁ। আমি এই কেসটা দেখছি। তাই এই স্কুলে আসা।
-- কিন্তু তার সঙ্গে আপনার স্কুলে পড়ানোর কি সম্পর্ক?
-- বলছি। আমরা ঐ কঙ্কালগুলোর কাছে একটা এই স্কুলের ব্যাজ পেয়েছি। আমরা স্কুলের কোন শিক্ষককে সন্দেহ করছি। তাঁর পকেট থেকে এটা পড়েছে। এখন আমাদের দেখতে হবে কে?
রবি আমার দিকে আতঙ্কের চোখে তাকাল।
-- আমাদের স্কুলে?
-- হ্যাঁ।
-- আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?
-- হ্যাঁ, গত কয়েকদিনে আমি লক্ষ্য করছি কোন কোন শিক্ষক ব্যাজ ব্যবহার করেন। এনাদের মধ্যে কার কার ব্যাজ হারিয়েছে। যা বুঝছি সমীরবাবু আর অরবিন্দবাবু, এদের দুজনের অতি সম্প্রতি ব্যাজ হারিয়েছে।
-- কিন্তু স্যার, একটা কথা বলুন। এনারা ঐ নিরুদ্দেশ হওয়া ব্যাক্তিদের জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে মারবে কেন?
-- তার চেয়েও বড় প্রশ্ন কি জানিস? ঐ ব্যাক্তিদের গায়ে এক ফোটা মাংস নেই।
-- সেকি? শেয়ালে খেয়েছে?
-- হতে পারে। আমরা বুঝছি না। যাই হোক, তোদের যে এসব বললাম, কাউকে বলিস না। এই কেসে তোদের সাহায্য লাগতে পারে।
-- নিশ্চয় স্যার। আপনি ফেলুদা,  আর আমরা সবাই তোপসে।


কয়েকদিন বাদে স্যার আবার বসলেন আমাদের সাথে।
-- কাল আবার একটা খুন হয়েছে।
-- কে?
-- রেলধারের বস্তির ছোটন।
-- কঙ্কাল পাওয়া গেছে?
-- হ্যাঁ, এবার চন্ডীতলার ছোট জঙ্গলে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কি জানিস? এক দিনের মধ্যেই পাওয়া গেছে কঙ্কাল। কিন্তু এবারো কোন মাংস নেই।
-- সেকি?
-- হ্যাঁ, শেয়াল এরকম পরিপাটি করে খাবে না। আমার বস বললেন কেউ হয়ত মানুষের মাংস চুরি করছে। কিন্তু আমার তা মনে হয়না। আমার এক আলাদা সন্দেহ হয়।
-- কি স্যার?
-- বিশ্বাস করবি কিনা জানি না। গতকাল পূর্নিমা ছিল।
-- জানি তো স্যার।
-- গল্পে পড়েছি বিলেতে এক ধরণের জন্তু হয়। যারা পুর্নিমার রাতে মানুষ থেকে নেকড়ে হয়ে যায়। আমি খোঁজ নিয়ে দেখলাম প্রতিটা খুন হয়েছে কোন এক পুর্নিমার রাতে। কেউ মাংস চুরি করলে  কেন শুধু পুর্নিমার রাতে করবে বল?
-- মানে আপনি কি বলতে চাইছেন?
-- আমি বলছি যে এই শহরে একটা নেকড়ে-মানব আছে। এবং আমার ধারণা সেটা সমীরবাবু।
-- কেন স্যার?
-- সমীরবাবুকে ক'দিন ধরে স্টাফ রুমে দেখছি। ওনার দাঁত দেখবি, শ্বদন্ত আছে। এছাড়া উনি নাকি রোজ রাত্রে খেয়ে দেয়ে পাড়ায় হাঁটতে বেরোন। মর্নিং ওয়াক শুনেছিস, কোনদিন নাইট ওয়াক শুনেছিস?
-- তবে কি সমীরবাবু নেকড়ে মানব?
-- আমাদের পরের পুর্নিমা অবধি অপেক্ষা করতে হবে।


পরের মাসে  পূর্ণিমার আগের রাতে অনন্ত স্যার আমাদের ধরলেন।
-- শোন, কাল আমি সমীরবাবুর বাড়ির উপর নজর রাখব। তোরা  আসবি?
সরোজ ভয় পেল।

-- স্যার, উনি যদি সত্যি নেকড়ে মানব হন, আমরা কি করব?
-- চিন্তা করিস না, আমার সার্ভিস রিভল্বারটা থাকবে সঙ্গে।
আমরা তবুও কিন্তু কিন্তু করছিলাম। কিন্তু স্যারের তেজ দেখে আমরাও রাজি হলাম। এই প্রথম এরকম একটা কর্মকান্ডের অংশ হব আমরা।


পরেরদিন রাতে আমরা আস্তানা নিলাম সমীরবাবুর বাড়ির ঠিক পাশের গলিতে। আমাদের জেলা শহরে এই রাত্রে কাক পক্ষীটিও দেখা যায় না। চারদিক যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। সবাই মাথায় শাল জড়িয়ে আছি, তাই লোকে আমাদের পাড়ার রিক্সাওয়ালা ভাববে। স্যার আগে। আমরা পিছনে। একটু বাদে সমীরবাবু বাড়ি থেকে বেরোলেন। হেঁটে হেঁটে  সামনের গলি ঘুরে আবার এদিকে ফিরলেন। আমরা অপেক্ষা করছি। আকাশে পুর্নিমার চাঁদ। সমীরবাবু একটু বাদেই বাড়ি ঢুকে পড়লেন। আর বেরচ্ছেন না। আমাদের অপেক্ষা চলছে।

রাত তখন প্রায় বারোটা। পাশের গির্জার ঘড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। আমরা সকলেই খুব ভয়ে ভয়ে আছি। রবি দেখলাম চিন্তায় একবার কেশেও ফেলল। কিন্তু আর আটকাতে পারল না।

অনন্ত স্যার এবার বললেন -- "আমার কি তবে ভুল হল?"
এই বলে স্যার পিছন ফিরে আমাদের দেখে -- "একি তোরা..."

স্যার বন্দুকটা বার করার সময় পেলেন না।


স্যারের কঙ্কালটা  আমরা জংগলে ফেলে এসে কুন্তলদের আউট হাউসটায় উঠলাম। এভাবে মাসের পর মাস আমরা রাত্রে পড়াশুনো করব বলে এই আউট হাউসটায় রাত কাটাই পুর্নিমার রাতে। কতদিন এভাবে চলবে জানি না। কিন্তু  এ আমাদের হাতে নেই।

Tuesday, February 4, 2020

তারাবাগ ডায়রিজঃ বিজয়বাবু

সালটা ২০০১। টেস্ট পরীক্ষা চলছে। অঙ্ক পরীক্ষার আগে বাবা বলে দিলেন -- "৮০ পেতেই হবে। নইলে বিজয়বাবু নেবেন না।" তখন বিজয়বাবুর নাম প্রথম শোনা। শ্রী বিজয় রায়। বর্ধমানের রামকৃষ্ণ স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক। ওনার কাছে পড়লে নাকি জয়েন্ট নিশ্চিত। আমাদের পাড়ার অন্তুদা, বাপিদারা নাকি ওনার কাছেই পড়েছিল। তা অঙ্কে ৮০-র উপরই পেয়েছিলাম।

২০০১ এর মার্চ মাসে যেদিন হরভজন সিংহের বলে ম্যাকগ্রাথ এল বি হলেন আর সারা কলকাতা আনন্দে মেতে উঠল, সেদিন আমার আই সি এস ই পরীক্ষা শেষ হয়। পরেরদিন সকালে জলখাবার খেয়ে আমি আর বাবা গেলাম বিজয়বাবুর বাড়ি। আমাদের পাড়ার কাছেই থাকেন। তাই হেঁটে হেঁটেই গেলাম। কোন বাড়িটা জানতাম না, তাই একজনকে জিজ্ঞেস করে নিলাম। বাড়ির দরজা খোলাই ছিল। উনি নিচে আর একজন ছাত্র আর তার বাবার সঙ্গে কথা বলছিলেন। পরে জেনেছি সেটি শঙ্খজিৎ। প্রথম দেখলাম ভদ্রলোককে। সাধারণ চেহারা। সাদা পাঞ্জাবী-পাজামা পরিহিত। হাতে চশমা ধরে আছেন। আমাকে বললেন -- "এতদিন কার কাছে পড়তে?" কথা হল এপ্রিল থেকে ব্যাচ বসবে।

সেই শুরু। পরের দু'বছর চলল এক অসাধারণ সম্পর্ক। অঙ্ক করাতে করাতে বার বার মজা করতেন। কোন অঙ্ক বাজে লজিক দিয়ে মিলিয়ে দিলে -- "গ্যাটিস দিচ্ছ?" কোন অঙ্ক নিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকলে -- "পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা?" কোন অঙ্ক পারলে আনন্দ করলে বলতেন -- "জে ই তে উড়িয়ে দেবে তো?" মাঝে মাঝে পড়াশুনোর বাইরেও কথা বলতেন। মারাত্মক মারাদোনা ভক্ত ছিলেন। বলতেন -- "আজকাল তোমরা সব জিদান জিদান করো, কিন্তু মারাদোনার পাশে কেউ না।"

ট্রিগোনোমেট্রি থেকে ইন্টিগ্রেশন, এত মন দিয়ে এত ভালোভাবে আর কেউ পড়াতে পারতেন কিনে জানি না। জয়েন্টের আগে বলেছিলান -- "মাঠা ঠাণ্ডা রেখো, ঠিক পারবে।"  মনে আছে জয়েন্টের রেজাল্ট বেরোনোর পর গেছি। দেখি উল্টোদিকে আর একজন বসে আছে। আমাকে আলাপ করালেন -- "এই হল শ্রেয়স, গত বছর যাদবপুর জয়েন করেছে। শ্রেয়স, ভাইকে সাহায্য কর।"

শেষ দেখা হয়েছিল বিয়ের নেমতন্ন করতে যাওয়ার দিন, সাড়ে তিন বছর আগে। শুনলাম স্কুল থেকে অবসর নিয়েছেন। আর টিউশান পড়াননা। গলার অবস্থা ভালো না। আজ ধীমান জানালো বিজয়বাবু আর নেই। গত পরশু ওনার হার্ট এট্যাক হয়। শুধু আমি কেন, বর্ধমানের অগুনতি ছেলে মেয়ের ভবিষ্যত তৈরি করে দিয়েছেলেন বিজয়বাবু। এক যুগের অবসান।